গোপা মিত্র
‘ভালো লাগা’, আমার কাছে সবসময়ই ভালো বা আনন্দের বলে মনে হয়েছে, একবার মাত্র ছাড়া। ভালো শব্দটার মধ্যেই তো একটা ‘Positive Thinking’ লুকিয়ে রয়েছে। তাই কখনোই এর মধ্যে আমি ‘Negative’ বা নিদারুণ কিছু খুঁজে পাই না – এটা অবশ্য আমার নিজস্ব চিন্তাধারা। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে অবশ্য সেই ভালো লাগা গুলোর পরিবর্তন হলেও, আমি আমার ভালো লাগার মূল উৎস থেকে কখনোই বিচ্যূত হই নি। আর এভাবে খুঁজতে খুঁজতেই অবশেষে একদিন আমি আমার দারুণ ভালো লাগার সন্ধান পেয়ে গেলাম।
খুব ছোট বেলায় আমি একবার মিহিজামের এক গ্রাম্য হাটে গিয়েছিলাম। সেই গ্রামীন হাট, তাদের বিকিকিনি, ঘুরে ঘুরে তাদের থেকে কিছু মাটির পছন্দের জিনিষ কেনা, যা আমাদের সংগ্রহে ছিল বহুদিন- জীবনের সেই প্রথম ভালো লাগার ছাপ এখনো আমার মনে রয়েই গেছে।
এরপর, আমি তখন ক্লাস টেন, গিয়েছিলাম স্কুলের সঙ্গে এক্সকার্সানে। মা বাবার সঙ্গছাড়া, বন্ধুদের সঙ্গে বাঁধনহারা উল্লাসের সেই ভালো লাগা আমার মনে এক ভুল ধারণার জন্ম দিয়েছিলো। মনে হয়েছিলো, বন্ধুদের সঙ্গে বেড়ানোতেই বোধহয় এত আনন্দ হয়। কয়েক বছর পরেই অবশ্য আমার এই ভুল ভেঙে যায়, যখন একসঙ্গে মা বাবা বোনেদের সঙ্গে বেশ কিছুদিনের জন্য বেড়াতে বেরিয়ে অনেক মজা করেছিলাম। তখনই নিশ্চিত হয়েছিলাম সঙ্গী নয়, বেড়ানোতেই আমার মূল আনন্দ।
এরপর অবশ্য আমি আর পিছন ফিরে চাইনি। যখনই সংসারের একঘেঁয়েমিতে ক্লান্ত হয়েছি তখনই ছুটে গেছি আমার সেই ভালো লাগার খোঁজে, কাছে বা দূরে।
কি অপূর্ব, কি অপরূপ! আজ থেকে কত শত বছর পূর্বে, কোন্ সে একজন শিল্পী,বা একাধিক শিল্পী অসমান পাথরের উপর এমন অনবদ্য গুহা চিত্রগুলি চিত্রায়িত করেছিলেন কে জানে? বুদ্ধদেব ও জাতকের কাহিনীর উপর ভিত্তি করা এই শিল্পকর্মগুলি যেন জীবন্ত। তাদের মুখের অভিব্যক্তিতে ফুটে ওঠা- আনন্দ, দুঃখ, হতাশা, বিষাদ, বেদনা এখনও যেন আমরা অনুভব করতে পারি। আবার মন্দিরগাত্রে খোদাই করা নিঁখুত মিথুনমূর্তিগুলি কখনো তো অশ্লীল বলে মনে হয় না, বরং বিস্মিত হয়ে ভাবতে হয়, এমন অতুলনীয় ভাস্কর্য কেমন করে সম্ভব হলো! সমাজ ব্যবস্থা সে যুগে কতটা প্রগতিশীল ছিলো!
বিশাল বিশাল হাভেলীগুলো দেখে মনে হলো আলো হাওয়া প্রবেশের কি আশ্চর্য ব্যবস্থা! আর তাদের অন্দর সজ্জা? সেও তো মুগ্ধ করার মত—ছোট ছোট রঙীন কাচের টুকরো, আয়না , ম্যূরাল বা ভাস্কর্য দিয়ে সজ্জিত ঘরগুলি চোখ ফেরাতেই দেয় না। এক বাদশাহর নির্মিত তার বেগমের সমাধিসৌধ তো আজও পৃথিবী বিখ্যাত। শ্বেতশুভ্র মার্বেলপাথরে নির্মিত কারুকার্যময় এই স্মৃতিসৌধ দর্শনের জন্য আজও দেশবিদেশের কতশত পর্যটক এই ভারতে আসে।
এভাবেই আমার ভালোলাগার ঝুলি একটু একটু করে পূর্ণ হতে থাকে। কিন্তু আমার ঈপ্সিত ভাল লাগা তখনো অধরা। তাই আমি তখনো তাকে খুঁজেই চলি।
পরিবারের সঙ্গে প্রথম যেবার নীল সমুদ্রের অসীম অপার জলরাশির সামনে এসে দাঁড়িয়েছিলাম, আমার পায়ের কাছে ছোট বড় ঢেউগুলো এসে ফেনায় ফেনায় ভেঙ্গে গুঁড়িয়ে যাচ্ছিল, আর আমি তাদের সংখ্যা গুনতে না পেরে হতাশ না হয়ে আবার চেষ্টা চালাচ্ছিলাম, হাসছিলাম –মনে হয়েছিলো, জগতে বোধহয় এটাই আমার একমাত্র পছন্দের ভালো লাগা কাজ। আবার যেদিন সবুজ অরণ্যের মাঝে ঝল্সে ওঠা হলুদ বিদ্যুৎ আমাদের সামনে এসে হঠাৎ থমকে গিয়েছিলো, সেদিন মনে হয়েছিলো ‘আহা, ঈশ্বরের কি অনুপম সৃষ্টি’! চিরচেনা শান্ত নদীর ভয়ঙ্কর গর্জনরত পাথর ভাঙ্গা উচ্ছ্বসিত রূপের সামনে এসে মনে হয়েছিলো ‘এর সঙ্গেই কি আমার রোজকার পরিচয়? একে কি আমি সত্যি চিনি’? এগুলোই তো সব আমার ভালো লাগার মূহুর্ত!
তারা ঝিলমিল কালচে আকাশের নিচে আলো আঁধারের জলছবি সঙ্গে নিয়ে একান্ত প্রিয়জনের সাথে অনবদ্য প্রকৃতির মাঝে লেকের জলে ছোট এক নৌকায় (শিকারায়) অনির্দেশের পথে ভাসতে ভাসতে মন বিনিময়ের মধ্যে যে আনন্দ, হোটেল রেস্টুরেন্টের মাঝে তা পাওয়া কি সম্ভব?
নিরিবিলি নির্জন প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের পরিবেশে আমি রূপের মাঝে অরূপের সন্ধানে ফিরি। তাই ভীড় আমার একেবারেই নাপসন্দ। কিন্তু সেই জনতার সঙ্গেই তো পা মিলিয়ে একদিন আমি পৌঁছে ছিলাম বাবা বিশ্বনাথের চরণে। তখন কিন্তু একবারও আমার সেই ভীড়ে সামিল হতে অসুবিধা হয় নি বা তাদের সঙ্গ আমাকে অস্বস্তিতে ফেলে নি। মনে হয়েছিলো, এরা সঙ্গী না হলে আমি হয়ত বাবার কাছে পৌঁছতেই পারতাম না। প্রকৃত অর্থে এরাই ছিলো সেদিন আমার সহযাত্রী, পথ প্রর্দশক। একসঙ্গে হাতে হাত ধরে চলার মাঝেও যে ভালো লাগা লুকিয়ে থাকে সেদিন আমি প্রথম বুঝেছিলাম। পদব্রজে এক মন্দিরের চড়াই পথে ওঠার সময়ও তো আমি এমন জনতার সামিল হয়েছিলাম। কেউ উঠছে, কেউ বা আবার নামছে। ধনী দরিদ্র জাতি ধর্ম উচ্চ নীচ নির্বিশেষে সকলের মুখেই এক ধ্বনি,’জয় কেদার’’জয় কেদার’। সেদিন আমি অখন্ড ভারতের যে চিত্র দেখেছি, সেটাই আমাদের প্রকৃত ভারতীয় সংস্কৃতি – যেখানে কোনো ভেদাভেদ নেই। সেই চিত্র, সেই ভালো লাগা এখনও আমি বয়ে বেড়াচ্ছি। সেদিন আমি উপলব্ধি করেছি এক সঙ্গে পথচলার মাহাত্ম্য। আর সেই মন্দির? মনে হয়েছিলো, এমন অনন্যসাধারণ পরিবেশই তো দেবতার অধিষ্ঠানের উপযুক্ত।
খুঁজতে খুঁজতে এবার আমি এসে পৌঁছলাম এক শৈল শহরে। এপ্রিল মাসের প্রথমে, দূরের বরফাবৃত পাহাড়সারি দেখতে দেখতে যখন আমি হেঁটে বেড়াতাম সেই শহরের পথে, তখন মনে হতো, ‘আহা!একবার যদি ঐ বরফের রাজ্যে যেতে পারতাম’! সেই চেষ্টা একবার তো অন্ততঃ আমাকে করতেই হবে। সেইমত এক গাড়ীর ব্যবস্থা করা হলো। কিন্তু সে বলেই দিলো যে, যতদূর পারবে নিয়ে যাবে, তারপর আমাদের পায়ে হেঁটেই সেই Pass বা উপত্যকায় উঠতে হবে। গাড়ী থেকে নেমে এবার আমাদের উপরে ওঠা শুরু হলো। যত অসম্ভবই হোক্, চারিপাশের মনোমুগ্ধকর দৃশ্যাবলী আমাদের ওঠার কষ্ট লাঘব করে দিচ্ছিলো।
অবশেষে পৌঁছে গেলাম সেই Pass-এ। আমি মুগ্ধ, আমি বাক্রহিত। এ কোথায় এলাম আমি? আমি কি এখন এই পৃথিবীতেই রয়েছি, নাকি স্বর্গরাজ্যে এসে পৌঁছেছি? আমার চারিপাশে বরফ, আমার পায়ের নিচে বরফ। এ যেন এক বরফের সাম্রাজ্য, চারিদিকে বিরাজ করছে এক অপার শান্তি। আমি উপলব্ধি করলাম – এখানেই আমার শান্তি, আমার মুক্তি, আমার আনন্দ।
অবশেষে আমি আমার কাঙ্খিত দারুণ আনন্দের সন্ধান পেয়েই গেলাম। এরপর আমি আর পিছনে তাকাই নি। প্রাত্যহিকতায় ক্লান্ত হলে, বারে বারে ছুটে গেছি কোনো এক পাহাড়ের কাছে, মুক্তির সন্ধানে। গিয়েছি একাধিক Pass-এ। আর যখন সেটা সম্ভব হয় নি, তখন পৌঁছে গেছি কোনো ধ্যানগম্ভীর মহামহিম গগনচুম্বী উন্নতশির শান্তসমাহিত শ্বেতশুভ্র পাহাড়ের পদতলে, আর অঞ্জলিপুটে তার কাছ থেকে ভিক্ষা করে নিয়ে এসেছি, আমার মুক্তির আনন্দ।
প্রথমেই যে ‘একবার মাত্র ছাড়া’-র কথা লিখেছি, এবার আসি তার কথায়। সেবার চলেছি আমাদের চিরচেনা এক নদীর উৎস সন্ধানে। যাত্রা শুরুর পরে বুঝেছিলাম কি ভঙ্ককর বিপদ সঙ্কুল পথ। অজানা ভয়ে মনে হয়েছিলো, না এলেই বোধহয় ভালো হতো। এতদিন ধরে বেরোচ্ছি, এমন ভয় নিয়ে, নিরানন্দ মনে কখনো তো কোথাও যাই নি। মনের জোরে আর ইচ্ছাশক্তির আগ্রহে অবশেষে পৌঁছে ছিলাম আমাদের গন্তব্যে। আর মনের সব আশঙ্কা দূর হয়ে মনে হয়েছিলো ‘ভাগ্যিস মাঝপথে ফিরে যাইনি, তাহলে তো এমন অকল্পনীয় অতুলনীয় অভাবনীয় সৌন্দর্য দেখা থেকে বঞ্চিতই থেকে যেতে হতো’। এই ভালো লাগাটাই আমার জীবনে ছিল এক দারুণ নয়, পরম আনন্দের।
গোপা মিত্র
ফিজিক্স অনার্স। একসময়ে কিছুদিন শিক্ষকতা করলেও, প্রকৃতপক্ষে গৃহবধূ – কিন্তু পায়ের তলায় সর্ষে। ভ্রমণের নেশা প্রবল। ভারতের বাইরে কোথাও না গেলেও দেশের মধ্যেই প্রচুর ঘুরেছেন। পাহাড়, সমুদ্র, জঙ্গল, ঐতিহাসিক স্থান – কোনোও কিছুই বাদ নেই। এখনও সুযোগ সুবিধে হলেই বেরিয়ে পড়েন। দু-কলমের জন্যে জীবনে প্রথমবার কলম ধরা।
Wonderfuly expressed. Khoob bhaalo likhecho.
Thank you .
পড়লাম। খুব ভালো লাগল। চরৈবেতি ।।
💐💐💐
ধন্যবাদ
গোপা,এবার তো তুমি দারুণ লিখেছো।অন্য angle থেকে লেখা।তোমার reminiscences গুলো এতো সুন্দর ভাবে মনে রেখে গুছিয়ে লিখেছো যে তোমায় সেলাম ।তোমার dementia হবে না ☺️ 💐💐
দারুণ কিনা জানিনা, আমি শুধু আমার ভালো লাগার আনন্দ টাই express করতে চেষ্টা করেছি ।