কলমে : অনিন্দিতা
জীবনের সবই কি সূত্র মেনে দুয়ে দুয়ে চার হয়? কিছু থাকে বেহিসাবি অংশ যার সূত্র খুঁজে পাওয়া সম্ভব হয়না। আর কিছু এমন ঘটনাও ঘটে, যার কার্যকারণ খোঁজার পরিবর্তে তা অমীমাংসিত হয়ে থাকাই বেশি রোমাঞ্চকর। আজ এরকম তিনটে ঘটনার কথা বলবো। প্রথমটা আমার মায়ের কাছ থেকে শোনা। দ্বিতীয়টা মা ও বাবার জীবনের যৌথ অভিজ্ঞতা। এবং তৃতীয় ঘটনার সাক্ষী আমি নিজেই।
মুক্তি
আমার মামাবাড়ি বেলঘরিয়া। দাদু ,মানে আমার মায়ের বাবা স্বর্গীয় শ্রী রমনী মোহন মজুমদার ছিলেন ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেট ক্লাস ওয়ান অফিসার। মা, মাসির কাছে এই ভাবেই শুনেছি। স্বাধীনতার আগে অবিভক্ত ভারতের বাঙলাদেশে ব্রিটিশ গর্ভমেন্টের অধীনে কর্মজীবন শুরু করলেও স্বাধীনতার পরবর্তীতে দাদুকে যখন দুই দেশের মধ্যে বেছে নেওয়ার সুযোগ দেওয়া হয়েছিল, স্বাভাবিক ভাবেই দাদু পশ্চিম বাংলাকে বেছে নেয়। প্রথমে জলপাইগুড়ি হয়ে, তারপর বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে শেষে আলিপুর জাজ’স কোর্ট ও বসিরহাট হয়ে রিটায়ার করেছিল।
স্থানগুলির ক্রম একটু এদিক ওদিক হতে পারে। দিদা, সাদা দিদা, ন’দাদু , ন’দিদা যারা দাদুর সমসাময়িক, কেউই আজ আর বেঁচে নেই। ছোটো দাদু ও দিদাও গত বছর চলে গেছে। আমার বড় মাসি যে এখন প্রায় ৮২, সেজো মাসি ও আমার মায়ের কাছ থেকেই টুকরো টুকরো সব তথ্য নিয়ে জুড়েছি। যাই হোক, কর্মজীবনের শেষের দিকে বেলঘরিয়ায় দাদুর জমি কেনা ও স্থায়ী বসবাসের ব্যবস্থা। দিদা ছয় সন্তান সহ ও সাদা দিদা মানে দাদুর বাংলাদেশের পরিচিতি সূত্রে বাল্য বিধবা বোনকে নিয়ে বেলঘরিয়া থাকত। দাদু সপ্তাহান্তরে আসা যাওয়া করত।
এই ঘটনা আমার মায়ের মুখ থেকে শোনা। প্রায় আটচল্লিশ কি উনপঞ্চাশ বছর আগের কথা। ১৯৭৫ সালে মা-বাবার বিয়ে হয়েছিল এবং ঘটনাটি ঘটে ঐ বছর অথবা পরের বছর।
বড় মামা ও তিন মাসির পরে আমার মা হল দাদুর পঞ্চম সন্তান ও তৃতীয় মেয়ে। বড় মামা মাত্র চৌদ্দ বছর বয়সেই মারা যায়। আমার তাকে দেখার প্রশ্নই আসে না। মায়ের পরে ছিল চার বছরের ছোটো আমাদের একমাত্র প্রিয় অতনু মামা। মামাও নেই আজ বেশ কয়েক বছর। মেজো মাসিও মারা গেছে আমার জন্মের আগে। আমার দুই মাসতুতো দিদি তখন বেশ ছোটো।
দাদু অবসর নেওয়ার কয়েক বছর পরের ঘটনা। বড় মামা তো অনেক আগেই মারা গেছে। তিন মাসিরও বিয়ে হয়ে গেছে। দিদা, সাদা দিদা ও অতনু মামা ছাড়াও ছোট দাদু আর মা দের জেঠতুতো দাদা বিমল মামা ওই বাড়িতে থাকে তখন।আমার মা ও বাবাও ঐ দিন বেলঘরিয়ায় উপস্থিত ছিল।
কর্মজীবন থেকে অবসর নিলেও একদা ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেট এবং উন্নয়নে ব্রতি একজন সন্মানীয় ব্যাক্তি হিসেবে এলাকায় দাদু বেশ পরিচিত ছিল। সেই জন্য দাদুকে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ জানানো হত। অনুষ্ঠান,উৎসব তো লেগেই থাকত। এরকমই এক উৎসবের দিন দোল পূর্ণিমা। সেই উপলক্ষে ওখানে হরিসভার মাঠে নাম-সংকীর্তন হত। দোল পূর্ণিমার দিনই উদ্ধোধন হত। চলত প্রায় দিন পনের। দাদুকে যথারীতি উক্ত সভায় প্রেসিডেন্ট হতে অনুরোধ করা হয়েছিল।
মায়ের বয়ানেই বলি ……” আমি আর তোর বাবা এসেছি বেলঘরিয়ায়। অনেক রাত হলেও সবাই অপেক্ষা করছি ফ্যান ঘরে। বাবা আসলে এক সঙ্গে খেতে বসব। তখন একটা ঘরেই ফ্যান ছিল তো ,তাই ঐ নামেই ডাকা হত। ছোটো কাকাই জোর করে ঐ ফ্যান টা লাগিয়ে ছিল। না হলে বাবার কাছে প্রাকৃতিক বাতাসের তুলনায় এই সব ভীষন একটা অহেতুক বিষয় ছিল। সামনের বড় বারান্দা দিয়ে ঢুকেই ফ্যান ঘর। বাবা সেদিন অনেক রাতে এসে প্রথমেই পিসিমা কে বলল যে …..আশা, আজ আর খাবো না। তুমি লোহা পোড়া জল দাও। আমরা কেউ আর কিছু জিজ্ঞেস করিনি তখন। বাবা লোহা পোড়া জল খেয়ে হাত মুখ ধুয়ে শুয়ে পড়ল। (প্রসঙ্গত বলি,অনেক বয়স্ক মানুষেরা হয়তো জানবেন তাও যারা জানে না তাদের জ্ঞ্যতার্থে জানাই, এটা একটা বহুদিনের প্রচলিত বিশ্বাস যে প্রচন্ড ভয় পেলে লোহার যে কোনো কিছু গরম করে খাবার জলে চুবিয়ে দিয়ে সেই জল টা পান করতে হয়। তাহলে যে কারণে ভয় সেটা ক্ষতি করে না। এটা যার যার নিজস্ব বিশ্বাস। কি? কেন? এবং কি ভাবে? এই সব নিয়ে কোনো তর্কে যাবো না। আমি মনে করি , সাধারণ একটা বিশ্বাসে কারো যদি কোনো ক্ষতি না হয় তাহলে তার যৌক্তিকতা নিয়ে অযথা বাক্যব্যয় না করাই উচিৎ।) পরের দিন বাবা ঘুম থেকে উঠে একটা সময় আমাদের ঘটনাটা বর্ণনা করে। “
দাদুর কাছ থেকে মা যা শুনেছিল সেটা এবার আমি নিজের ভাষায় প্রকাশ করছি। উদ্ধোধনী অনুষ্ঠান শেষ হতে হতে প্রায় রাত এগারোটা। এরপর সারা রাত চলবে সংকীর্তন। দাদু তো আর সারা রাত থাকবে না। নিজের কর্তব্য পর্ব শেষ হয়ে গেলে দাদু তাই বাড়ি ফিরে আসছিল। একাই। সবাই তো নামসংকীর্তন শোনায় ব্যস্ত। হরিসভার মাঠ থেকে মামাবাড়ি হাঁটা পথ। ঐ পথ এসে মিশেছে একটা চার মাথার মোড়ে। ওটা বাজার মোড় নামে পরিচিত। এখান থেকে ডান হাতের রাস্তা গেছে বল খেলার মাঠের দিকে এবং বাম হাতের রাস্তা গিয়ে মিশেছে আদর্শ নগরের দিকে যেটা এখন দিল্লি রোড নামে পরিচিত। সামনের নাক বরাবর রাস্তাটা মামাবাড়ি যাওয়ার পথ। শুনশান। পূর্ণিমার চাঁদের আলোয় চারিদিক আলোকিত। পরিষ্কার দেখা যায়। আমার ছোটো বেলায়ও জায়গাটা ফাঁকা ফাঁকাই দেখেছি। বলা বাহুল্য যে অত বছর আগে আরও ফাঁকা ছিল।
পাড়ায় দাদুর একটা মর্যাদা ছিল আগেই বলেছি। রাস্তায় বেরোলেই কেউ না কেউ দাদুকে হাতজোড় করে অথবা মুখে নমস্কার জানিয়ে সন্মান জানাতো। দাদুও প্রতি নমস্কার জানাতে ভুলত না। কখনো বা দু হাত জোড় করে কিংবা একটা হাত কপালে ঠেকিয়ে। সব সময় হয়তো দাঁড়াবার সময় থাকতো না তাই চলার গতি না থামিয়েই সৌজন্য বজায় রাখত। যখন ছোটোবেলায় দাদুর সঙ্গে বাজারে যেতাম আমিও এটা দেখেছি।
দাদু হরিসভার মাঠ থেকে হেঁটে বাজারের মোড় পেরিয়ে সামনের বাড়ির রাস্তায় ঢুকেছে। এমন সময় পথের ডান পাশে কেউ একজন দাঁড়িয়ে দাদুকে বলে উঠল, “বাবু, নমস্কার”। দাদুও হাঁটা না থামিয়েই অভ্যেসবশত কপালে এক হাত ঠেকিয়ে নমস্কার বলে আরো একটু এগিয়েই থমকে গেছে। যে মানুষটি এই মাত্র দাদুকে প্রণাম জানালো সে তো প্রাণকৃষ্ণ সরকারের ভাই। এবং,,,,, যে কিনা ঐ দিনই সকালে মারা গেছে দাদু খবর পেয়েছিল। দাদু একবার পিছনে তাকিয়ে দেখলো। ফুটফুটে জোৎস্নায় চতুর্দিক ভেসে যাচ্ছে। কিন্তু দাদু ছাড়া ঐ নিশুতি রাতে রাস্তায় আর কেউ নেই। দাদু আগের মতই চুপচাপ সোজা হেঁটে বাড়িতে পৌঁছেছিল।
পরে লোকমুখে শুনেছিল যে, মৃত্যু শয্যায় ঐ ভদ্রলোক আমার দাদুর সঙ্গে দেখা করার জন্য খুবই কাতর হয়ে উঠেছিল। নিজের কোনো একটা কৃতকর্মের জন্য ক্ষমা চাইবে বলে। সকলেই যে দাদুর বন্ধু ভাবাপন্ন ছিল তা তো নয়। কেউ কেউ ক্ষতিও করেছিল। প্রাণকৃষ্ণ সরকারের ভাই তাদের মধ্যেই একজন।
তাহলে এর ব্যাখ্যা কি!? দাদুর অবচেতন মনে প্রাণকৃষ্ণ সরকারের ছোটো ভাই এর মৃত্যু সংবাদ ঘোরাফেরা করছিল এবং তারই ফসল ঐ মুহুর্তের দৃষ্টিভ্রম ! নাকি,,,সত্যিই অনুতাপের বোঝা মাথায় নিয়ে মৃত্যুর পরেও স্বস্তি পাচ্ছিলো না বলেই, তার এই ভাবে দাদুর কাছে আসা। ভার শূণ্য মনে মুক্তির কামনায়??
কাকতালীয়
এই ঘটনাটা ব্যাখ্যাতীত না হলেও স্বপ্ন যে এরকমও হয় তার প্রত্যক্ষদর্শী আমার মা-বাবা। মায়ের বয়ানেই পুরোটা বলি….
“রাতের স্বপ্ন। দেখছি একটা বড় মাঠের মাঝ বরাবর একটা লম্বা সেতু। আমি সেতুর একটা মুখের কাছে দাঁড়িয়ে রয়েছি। সেতুর বাঁ দিকে মাঠের উপরে অনেক খাটিয়া পাতা। লোকে ঘুমাচ্ছে। আমিও একটা খাটিয়াতে ঘুমাতে গেলাম। হঠাৎ দেখি সেতুর ডান দিক থেকে একটা লম্বা লোমোশ হাত সেতুর উপর দিয়ে এসে আমার ডান হাতটা খপ করে ধরল। তারপর টানতে থাকল নিজের দিকে। হাতটা আস্তে আস্তে গুটিয়ে ছোটো হতে হতে আমাকে সেতু পেরিয়ে ডান দিকে নিয়ে গেল। আমি ভয়ে হাতের মধ্যে ছটফট করছি। দেখলাম ঐ পাশে একটা বাক্স আর সেই বাক্সটার মধ্যে থেকেই হাতটা বেরিয়েছে। ক্রমশ হাতটা ছোটো হতে হতে আমাকে ঐ বাক্সটার মধ্যে পুরে ফেলবে। আমি স্বপ্নের মধ্যেই আতঙ্কে চিৎকার করে উঠলাম আর ঘুমটা ভেঙে গেল। আতঙ্কের রেশ তখনও কাটেনি। টের পেলাম সত্যিই আমার ডান হাতটা ধরে কেউ টানছে। তাকিয়ে দেখি তোর বাবা ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে বাঁ হাত দিয়ে আমার ডান হাতটা ধরে টানছে। মুখ থেকে গোঁ গোঁ করে শব্দ করছে। আমি ঘাবড়ে গিয়ে ধাক্কা মেরে জাগালাম। কি হয়েছে? ওরকম করছ কেন? তোর বাবা একটু ধাতস্থ হয়ে বললো যে, দেখছে বাড়িতে চোর এসেছে। আমি চোরটার হাত ধরে আটকাবার চেষ্টা করছি আর চ্যাঁচাচ্ছি ‘চোর চোর’ বলে। ”
এটা শুনে আমরা মজা পেয়েছিলাম। মা বলে এখনও স্বপ্নের হাত টার কথা ভাবলেই গা শিউরে ওঠে। স্বপ্নটার এমন রেশ। একে কাকতালীয় ছাড়া আর কি বলা যায়। একই সাথে দুজন সম্পূর্ণ দুটো আলাদা স্বপ্ন দেখছে কিন্তু অদ্ভুত ভাবে দুটো স্বপ্ন “corelated”।
বিশ্বাসে মিলায় বস্তু, তর্কে বহুদূর…
কম করে নয় বছর আগের ঘটনা। মেয়ের বয়েস পাঁচের আশেপাশে।। সেই সময় থাকি পাটুলির ব্রিজী রোডের গাজীপুকুর। পাটুলির ফ্ল্যাট টা ছিল জি+থ্রী। প্রত্যেক টা ফ্লোরে একটা করে ফ্ল্যাট। আমাদের ফার্স্ট ফ্লোর। আমি চিরদিনই গোছানো। দৈনন্দিন জীবনের ছোটোখাটো জিনিষপত্র মোটামুটি তার নিজস্ব জায়গায় গুছিয়ে রাখার ফলে ঘরে ছোটো বাচ্চা থাকলেও ঘর এলোমেলো থাকতো না। ঘরের মেঝে তকতকে না থাকলে আমার ভালো লাগেনা। মেয়ে ছোটো বলে আরো নজর এই সব দিকে। কারণ মেয়ের বসা, খেলা, খাওয়া, ঘুমানো সারাক্ষণ মাটিতেই। এমনকি বক্স খাটের তলাও লম্বা স্ট্যান্ড দিয়ে পরিষ্কার করা হত রোজ। খাটের নীচে এপাশ থেকে ওপাশ পুরোটাই তকতকে মেঝের মতই। নীচে খাবারের টুকরো বা কাগজের টুকরো পড়ে গেলে সঙ্গে সঙ্গে তুলে মুছে নেওয়ার অভ্যেস। এতটা বলতে হল কারণ না হলে ঘটনাটা কেউ ধরতে পারবেন না।
এই রকমই কোনো একটা সময় ত্রিদিবকে বেশ কিছুদিনের জন্য বাইরে যেতে হয়েছিল। প্রথম প্রথম একটু ভয় পেলেও তখন ছোটো মেয়েকে নিয়ে আমায় একাই থাকতে হয়েছে। কিছু তো উপায় নেই। মেয়ের স্কুল বন্ধ করে তো মায়ের কাছে চলে যাওয়া সম্ভব নয়। অতএব আমিও মেয়ের স্কুল আর বাড়ি নিয়ে ব্যস্ত। মা, বাবা হয়তো সপ্তাহান্তরে এসে ঘুরে যায়।
তখন রীণা বলে একটি মেয়ে আমার বাড়ি কাজ করে। হঠাৎ করেই একদিন টের পেলাম, রীণা বেডরুমের বক্স খাটের তলা মুছে বেরোবার সঙ্গে সঙ্গে বেডরুমটা আঁশটে গন্ধে ভরে গেল। ভাবলাম কিছু একটা পড়ে ছিল হয়তো। সেটা আরো ঘষা লেগে গন্ধ বেরোচ্ছে। ওকে বললাম। নিজে টর্চ মেরেও দেখলাম। কিছুই চোখে পড়লো না। সারাদিনে আস্তে আস্তে গন্ধটা আর পেলাম না
পরের দিন ঘটনার পুনরাবৃত্তি। সেই দিন রীণাকে মোছার স্ট্যান্ডটাকে সাবান, ফিনাইল দিয়ে ভালো করে ধুয়ে রোদে শুকোতে দিতে বললাম। ভাবলাম, হয়তো রোজ রোজ ভালো করে ধোয় না তাই স্ট্যান্ডটাই নোংরা হয়ে গেছে। পরের দিন আবার। এবার রীণাও বিরক্ত হয়ে গেল। বলল, বৌদি তুমি নতুন স্ট্যান্ড কেনো তো। পুরোনো হয়ে গিয়ে মোছার কাপড়টাই নষ্ট হয়ে গেছে। কিনে আনলাম। না, গন্ধটা তাও মোছার পর থেকেই বেরোচ্ছে। খুবই অদ্ভুত লাগলো। আরও অদ্ভুত যেটা, ঐ একই স্ট্যান্ড দিয়ে রান্নাঘরের তাকের নীচের মেঝের অংশের কোণা যেখানে হাত পৌঁছায় না মোছা হয়। তখন তো গন্ধ বেরোচ্ছে না।
মা’কে জানালাম। কি হচ্ছে বলতো মা? মা জানে আমি কিরকম পরিচ্ছন্ন রাখি ঘর। তাও বলল দেখ কোনো টিকটিকি মরে কোণায় পড়ে আছে। রীণা ওই শুদ্ধই মুছে বেরিয়ে আসছে আর গন্ধ বেরোচ্ছে তখন। যুক্তিটা মনে ধরলো। পরের দিন রীণাকে বললাম টর্চ ধর। আমি আনাচ কানাচ ভালো করে মুছলাম। তাও গন্ধটা বেরোয় আর তারপর ধীরে ধীরে মিলিয়ে যায়। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, পাটুলির ফ্ল্যাটও বেশ খোলামেলা ছিল। বেডরুমের পুবে ও উত্তরে বড় জানালা। পশ্চিমে ঢোকার দরজা। উত্তরে কিছুটা খোলা। আর একটা বড় আম গাছ। গন্ধটা কিন্তু বাইরে থেকে আসে না সেটা আগেই বোঝা গেছে।
এর মধ্যে একদিন রাতে আমি ভীষণ ভয় পেলাম। ঘুমিয়ে রয়েছি। হঠাৎ চোখ খুলে দেখি ত্রিদিব মশারির বাইরে থেকে মুখটা মশারির গায়ে ঠেকিয়ে আমার দিকে ঝুঁকে তাকিয়ে আছে। সঙ্গে সঙ্গে উঠে বসলাম। কোথায় ত্রিদিব? ও তো কলকাতার বাইরে। কিন্তু এতটাই স্পষ্ট। তারপর সারারাত মেয়েকে জড়িয়ে ধরে লাইট জ্বালিয়ে শুয়েছিলাম।
মা পরের দিন শুনে বলল তুই একা একা থাকিস। এরকম আগে কখনো তো থাকিস নি। এক কাজ কর লোকনাথ বাবার ছবি টা আলমারি থেকে বার করে বেডরুমে রাখ। কিছুই নয় আবার কিছু তো অসুবিধে মনের মধ্যে হচ্ছে। মন শান্ত হবে। আমাদের বাড়িতে পূজো নিয়ে কোনোদিনই কোনো বাড়াবাড়ি কিছু দেখিনি তাই আমারও অভ্যেসে নেই। শুধু সকালে ও সন্ধ্যায় নিয়ম করে ধূপ কাঠি জ্বালাই। ধূপের সৌরভে মন ভীষন ভালো হয়ে যায়। মা আমাকে লোকনাথ বাবার এই ছবিটা দিয়েছিল বিয়ের পরে। ত্রিদিব আপত্তি জানানোয় ছবিটা আলমারির মধ্যেই রাখা থাকতো।
মায়ের কথায় পরের দিনই ছবি বার করে বেডরুমের একটা কোণায় রাখলাম। তারপর থেকে ছবির সামনেই ধূপ কাঠি জ্বালি।
ত্রিদিব ফিরে আসার পর ছবি নিয়ে একটু গাঁই গুঁই যদিও করেছিল কিন্তু এবার আর ওর আপত্তি ধোপে টেকেনি। তবে এই ঘটনা ওকে বলিনি। কে সেধে ঠাট্টার পাত্রী হয়।
কিন্তু আমি আজও যেটার ব্যাখ্যা পাইনা তা হল, এরপর থেকে ঘর মোছার পর আঁশটে গন্ধটা আর পাইনি। কোন যুক্তি দিয়ে এই ঘটনা টার সঠিক বিশ্লেষণ করা যাবে? এতো আমার নিজের অভিজ্ঞতা। ঐ বক্স খাটটা নিয়ে পাটুলির ফ্ল্যাট থেকে অন্য আর একটা ফ্ল্যাট হয়ে এখন তিন নম্বর ফ্ল্যাটের বাসিন্দা। এখনো পর্যন্ত সেই গন্ধটা তো কই পাইনি!