গোপা মিত্র
[যাদের স্নেহচ্ছায়ায়, শিক্ষায়, আদর্শে আমি বেড়ে উঠেছি বা যাদের সাহচর্যে আমার জীবনের সেরা মুহূর্তগুলি কাটিয়েছি, তাদের কেউই আজ আমাকে সঙ্গ দেওয়ার জন্য এই পৃথিবীতে বেঁচে নেই। আমার এই স্মরণিকা তাদের উদ্দেশ্যে শ্রদ্ধা নিবেদনের এক ছোট্ট প্রচেষ্টা মাত্র।]
পর্ব-৬
তাইমা
সময়ের সঙ্গে সঙ্গে স্মৃতিগুলোও হয়ে চলে ঝাপসা থেকে ঝাপসাতর। তারপর সময় পেরিয়ে গেলে অতি সহজেই ‘আজ’ হয়ে যায় ‘কাল’। তারপর হঠাৎই হয়তঃ কোনো একদিন অতীতের ‘আজ’ থেকে উঠে আসা কোনো এক চরিত্র স্পষ্টরূপে প্রতীয়মান হয় চোখের সামনে, তখনই মনে পড়ে যায় তার সঙ্গে কাটানো মধুর মুহূর্তগুলো।
তাইমা ছিল কাকুর উপযুক্ত সহধর্মিনী, বরং বলা ভালো কাকু আর তাইমা ছিল একে অপরের পরিপূরক। কাকু বাজার দোকান করে আনলে তাইমা সেগুলো যেমন গুছিয়ে তুলে রাখত, তেমনই কোন্টা সেদিন বা কোন্টা পরদিন রান্না হবে সেসবও রান্নার লোককে বলে প্রয়োজনীয় তেল মশলা ভাঁড়ার থেকে বার করে দিত। দাদির জন্য কি রান্না হবে, দাদিকে জিজ্ঞেস করে, সেই ব্যবস্থাও তাইমাই করত। শেষে সব্জী তরকারী কেটে, রান্নার লোককে সবকিছু বুঝিয়ে দিয়ে উপরে নিজের ঘরে এসে নিশ্চিন্ত হয়ে সেদিনের খবরের কাগজ নিয়ে বসত। তার আগে অবশ্য মুড়ি, পাঁউরুটি বা কিছু ফল দিয়ে নিজের জলযোগ সেরে নিত। ভাতপাতে নিয়মিত দই খাওয়ার অভ্যাস ছিল তাইমার। তবে যে সে দোকানের দই নয়- হাতিবাগান বাজারের রামলালের দোকানের মিষ্টি কম, সাদা দই। বিকেলে অন্য কিছু নয়, নিয়মিত খেত বাড়ীতে কাটানো দুধের ছানা।
মধ্যবিত্ত পরিবার ছিলাম আমরা, কোনো কিছু নষ্ট করা বা বিলাসিতা ছিল আমাদের জন্য একেবারেই নিষিদ্ধ। তবুও বাটীর তলায় একটু ডাল বা থালায় একটু তরকারী বা ভাত ফেলে রেখে, খাওয়া শেষ করে উঠে যাওয়া আমার বদ্ অভ্যাস ছিল। মা হয়তঃ কিছু বলল না, কিন্তু তাইমার নজরে এলেই তাইমা ঠিক ধরে ফেলত ‘এ থালায় নিশ্চয় মহারাণী ভিক্টোরিয়া খেয়েছেন’। আর যদি আমি সামনে থাকতাম, অবশ্যই আমাকে সেই ফেলা খাবারগুলো আবার খেয়ে নিতে হত।
তাইমার ছেলেমেয়ে ছিল না। তবে সেজন্য আমাদের বাড়ীর কারো কোনো অভিযোগ ছিল না। তাইমার চারপাশে তো আমরা তিন বোনই ছিলাম। আমাদের তিন বোনকেই তাইমা জড়িয়ে ধরেছিল। নিজের যা কিছু জানা বা শেখা ছিল, সবটুকু উজাড় করে দিয়ে আমাদের শিক্ষিত করে তুলতে চেয়েছিল। আমরাও অবশ্য মা আর তাইমাকে কখনো আলাদা ভাবি নি। দুজনকেই সমান চোখে দেখেছি। এর পিছনে অবশ্য মায়েরও অনেকটা অবদান ছিল। কারণ মা’ই নিজে সরে গিয়ে আমাদের তাইমার দিকে এগিয়ে দিত।
সে যুগে তাইমার মত বিদূষী, ব্যক্তিত্বময়ী রমণী খুব কমই দেখা যেত। তাইমার শিক্ষাগত যোগ্যতা কতটা ছিল, আমি জানি না। তবে শিক্ষা দিয়েই কি শুধুমাত্র বিদ্বান বা বিদূষী বিচার করা যায়? মানুষের অন্য কোন গুণই কি ধর্তব্যের মধ্যে আসে না? তাইমা এম এ, পি এইচ ডি ছিল না ঠিকই, কিন্তু আর যেসব গুণ ছিল, সেগুলোই বা কম কিসে! বাংলা ইংরাজী পড়া বা লেখা আর অঙ্ক বেশ ভালোই জানত তাইমা। পরে কথ্য ইংরাজী শেখাতে কাকু যখন তাইমার জন্য দিদিমণির ব্যবস্থা করেছিল তাইমা সেটাও বেশ ধৈর্য ধরে শিখে নিয়েছিল।
সে যুগে যখন বাড়ীর মহিলারা কাজকর্ম শেষে পান চিবোতে চিবোতে পরনিন্দা পরচর্চা করত বা কূট কচালিতে ব্যস্ত থাকত সেই সময় তাইমা আপন মনে সেলাইএর ফোঁড় তুলত বা কোনো বই পড়ত। এমন সেলাই ছিল না যা তাইমা জানত না। উল বোনা, কুরুশের কাজ, এমব্রয়ডারী, মেসিনে সেলাই, পিক্টোগ্রাফ, চট সেলাই – সব সব তাইমা নিঁখুত ভাবে করত। শুধু নিজে করত বললে ভুল হবে, এই সব কিছুই তাইমা হাতে ধরে আমাদের শিখিয়েছিল, বলা যায় তাইমাই ছিল আমাদের সেলাইএর শিক্ষাগুরু।
আমি তখন ক্লাস টু, স্কুলে শুনলাম আমাদের এবার উলের টুপি বুনতে হবে। দিদিমণি দেখিয়ে দিলেন, কিন্তু অত জনের সঙ্গে শিখে বাড়ীতে এসে দেখলাম সব ভুলে গেছি। তাইমাকে বললাম, তাইমা ঘর তোলা থেকে আরম্ভ করে সব বুঝিয়ে দিল। এবার সামান্য কিছু ঘর তুলে, সারা দুপুর ধরে আমার সেলাই চলল। বিকেলে তাইমাকে দেখাতে তাইমা বলল, ‘ একি করেছিস? কাঁটা ভর্তি ঘর হল কি করে? একটাও ঘর ফেলিসনি’?-বলে তাইমা আবার দেখিয়ে দিল।
তাইমার সেলাই দেখাতে বা শেখাতে কোনো আপত্তি ছিল না, কিন্তু ওই পর্যন্তই। তারপর সেটা এগিয়ে নিয়ে যাওয়া বা শেষ করার দায়িত্ব ছিল আমাদের ওপর। ‘তোমাদের স্কুলের সেলাই , তোমাদেরই করতে হবে। বাকী সব মেয়েরা কি করে করছে? তবে’?
আমি তখন ক্লাস এইট- স্কুলের অর্ডার, নিজেদের মাপের ব্লাউজ মেসিনে সেলাই করে হাতে গলায় এমব্রয়ডারি করতে হবে। তাইমার মেসিনে, ব্লাউজ তো তৈরী হল, এবার এমব্রয়ডারি। তাইমাকে বললাম, ‘সবচেয়ে সোজা ডিজাইন, আর সবচেয়ে ফাঁকিবাজী সেলাই দেখিয়ে দিতে’। কিন্তু পড়ার চাপে সেটুকুও করে উঠতে পারলাম না – এক হাত আর একদিকের গলা বাকী রয়ে গেল। এবার কি করি? সেলাই শেষ না হলে, পাশ না করলে, ক্লাসেই তো উঠতে দেবে না। এবার এক চালাকী করলাম। ভিতরে মোটা ড্রইং পেপার দেওয়া বেশ বড় বাঁধানো এক খাতার পাতায় সেলাইগুলো ভাল করে সেলাই করে আটকে দিয়ে জমা দিতে হত। আমি কি করলাম? যেদিকের হাত আর গলায় সম্পূর্ণ এমব্রয়ডারি হয়ে গেছে সেইদিকটা উপরে দিয়ে ব্লাউজটা অর্ধেক মুড়ে এমন শক্ত করে সেলাই করে দিলাম যে কোনমতেই খুলে ভিতর দেখা সম্ভব নয়। পাশও করে গেলাম, ক্লাসেও উঠে গেলাম।
ক্লাস নাইনেও একই অবস্থা। এবারেই সেলাইএর শেষ পরীক্ষা- কিন্তু পাশ করতেই হবে। এবার নিজের মাপের ফুলহাতা কার্ডিগান বুনতে হবে। তাইমাকে এসে ধরলাম। ‘Please তাইমা, একটা হাত অর্ধেক হয়েছে, আর একটা হাত বাকী রয়ে গেছে, এটুকু যদি শেষ করে দাও’। ‘অন্য মেয়েরা কি করে করছে? তারা যদি করতে পারে, তুমিও পারবে’। পড়াশোনার সঙ্গে আমি কোনোদিনই Compromise করি নি। সেটাই ছিল আমার First Priority. আমার সেলাই করার সময় কোথায়? কিন্তু বোঝাব কাকে?
বন্ধুদের গিয়ে ধরলাম, ‘এই তোরা সবাই সেলাই শেষ করতে পারবি’? আমি তো জানি, তাদের পক্ষেও সেলাই শেষ করা সম্ভব নয়। কারণ কদিন ধরে তো আমি তাদের সঙ্গেই সেলাই দিদিমণি, মায়াদির বকুনি খাওয়ার ভয়ে, ক্লাস কেটে লুকিয়ে পড়ছিলাম। তাদের মধ্যে দু একজন বলল ‘ আমরা তো নিজেরা সেলাই করছি না – একজনকে করতে দিয়েছি। পয়সা নিয়ে সে স্কুলের সেলাইএর সবটাই করে দিচ্ছে’। বাঃ বেশ ভালো ব্যবস্থা তো! কজন বন্ধু আবার বলল যে তাদের মা বা পিসীই তাদের সেলাই করে দিচ্ছে। এর কোনোটাই তো আমার পক্ষে সম্ভব নয়। তাইমা না বলায় মা’ও আমার সেলাই ধরতে রাজী নয়। কিন্তু আমাকে তো সেলাইএ পাশ করতেই হবে। তাই এবারও আমি সেই ক্লাস এইটের রাস্তাটাই বেছে নিলাম। কাউকে কিছু না বলে, আমি ওই এক হাতা কার্ডিগানটা এমন ভাবে বড়ো খাতায় সেলাই করে আটকে দিলাম যাতে দিদিমণি কোনোমতেই সেটা খুলতে না পারে।
আজকের এই Use and Throw এর যুগে যে কোনো মলে গেলেই মেসিনে বোনা বা সেলাই করা রেডিমেড সব কিছুই হাতের নাগালে চলে আসে। কিন্তু আমাদের ছোটোবেলায় তো তেমন ছিল না। হাতে বোনা সোয়েটার টুপি, এমব্রয়ডারী করা ড্রেস মেটিরিয়াল বা কুরুসে বোনা গৃহসজ্জার দ্রব্যাদি, বেডশীট সবই তাইমা নিজের হাতে নিঁখুত ভাবে করত – ঠিক এখন যেমন মলএ গেলেই কিনতে পাওয়া যায়। এগুলো তাইমা সবই করত নিজের কাছে থাকা বেশ কতকগুলো ইংরাজি বইএর সাহায্যে। কোথা থেকে যে তাইমা এই বইগুলো পেয়েছিল, জানি না। তবে অদ্ভুত দক্ষতায় তাইমা সেই সব বই পড়ে, বুঝে, সেই সব ডিজাইন হাতের সেলাইএ ফুটিয়ে তুলত। শুধুমাত্র নিজের জন্যই যে তাইমা এসব করত এমন নয়, কতজনকে যে কতকিছু করে দিয়েছিল নিজের হাতে! সেই সব ইংরাজি সেলাইএর বই পড়তে, বুঝতে এবং সেলাই তুলতে নিজের হাতে তাইমা আমাদের শিখিয়ে দিয়ে গেছে, বলা যায় নিজের উত্তরাধিকারীর ব্যাটনটা আমাদের হাতে তুলে দিয়ে গেছে। সেই কারণেই আমরা তিন বোনেই সেলাইএ যথেষ্ট পারদর্শী হয়ে উঠেছি।
রান্নাবান্নাতেও তাইমার দক্ষতা কম ছিল না। দেশী, বিদেশী, প্রাদেশিক সব রান্নাই তাইমা জানত – তবে নিয়মিত করত না। যেদিন তাইমা রান্না করত, আমরা নিশ্চয় জানতাম আজ আমরা বিশেষ কিছু পদ খাব। তাইমার রান্নার বৈশিষ্ট্যই ছিল কম তেল মশলায় সুস্বাদু রান্না। পুজোর পরে বিজয়াতে তাইমা সবার জন্য, অবশ্যই অতিথি অভ্যাগত শুদ্ধ, নানারকম মিষ্টি আর নোনতা খাবার তৈরী করত –আমরা অপেক্ষা করতাম কবে বিজয়া আসবে! তাছাড়া নানারকম আচার – কুলের, তেঁতুলের, লঙ্কার, সব্জীর এসব তো ছিলই। আমরা অবশ্য এসব তখন কিছুই শিখিনি, কারণ রান্নাঘরে যাওয়া আমাদের বারণ ছিল। তাইমার কাছ থেকে জেনে অনেক পরে কুলের মিষ্টি বা তেঁতুল ছড়ার আচারের স্বাদ আমরা নিজেরা চেষ্টা করেও আনতে পারি নি। দোকানের মতই তাইমার হাতের অপূর্ব পদ্ম খাজা বা সন্দেশ আমরা চেষ্টা করেও করতে পারি না।
কাকুর মত তাইমাও ছিল খুবই শৌখিন । বাড়ীতে চওড়া পাড় সাদা তাঁতের শাড়ী ছাড়া না পরলেও, কোনো অনুষ্ঠানে বা কাকুর সঙ্গে বেরোলে, নানা ধরণের শাড়ী পরত, মাইসোর সিল্ক, বাদলার কাজ করা শিফন জর্জেট বা লক্ষৌ চিকণের কাজ করা – এমনি সব। তখনের দিনের সেরা- মেটিয়াবুরুজ থেকে দর্জি আসত, তাহের বক্স। তার হাতে বানানো ব্লাউজ ছাড়া তাইমা পরত না। মাসে দুমাসে কাঁধে বিরাট এক বস্তা নিয়ে তাহের বক্স আসত আমাদের বাড়িতে। সেই বস্তায় যেমন নানা ডিজাইনের তৈরী ব্লাউজ থাকত, তেমনই থাকত নানারকম ডিজাইনার ব্লাউজ পিস। তার থেকে তাইমা নিজের পছন্দ মত অর্ডার দিলে তাহের বক্স সেই ব্লাউজ তৈরী করে নিজে এসে ডেলিভারী দিয়ে যেত। কাকুর সঙ্গে যখন তাইমা বেরোত কোনও পার্টী বা অনুষ্ঠানে – পিঠে আঁচল ফেলে কুঁচি দিয়ে শাড়ী পরা, চোখে রিমলেশ চশমা, মাথায় অল্প ঘোমটা, কাঁধে শান্তিনিকেতনী স্লীং ব্যাগ বা হাতে বাহারী বটুয়া নিয়ে, তখন বাড়ীর আটপৌরে বউ যেন স্বতন্ত্র হয়ে উঠত। প্রতি বছর নিজেদের বিবাহবার্ষিকীতে তাইমা কাকু সেজেগুজে বের হত কাছেরই কোনো সিনেমা হলে সান্ধ্যকালীন শোয়ে সীনেমা দেখতে। ব্যাস ঐটুকুতেই হয়ে যেত নিজেদের বিবাহবার্ষিকী পালন। আমরা অবশ্য কোনোদিনও জানতে পারিনি সেদিন তারা কোন্ সীনেমা দেখে এলো! তবে এটা ঠিক যেকোনো আচার অনুষ্ঠানে তাইমার পরিশীলিত সজ্জা, মার্জি.ত আচার ব্যবহার তাইমার রমণীয় ব্যক্তিক্ত যেন ফুটিয়ে তুলত।
আর আসতেন স্যাকরা হীরালালবাবু – নিয়ে আসতেন ছোট্ট এক পিতলের দাঁড়িপাল্লা আর গয়নার কিছু ডিজাইন। সেইসব ডিজাইন দেখে তাইমা নিজের পছন্দমত কখনো নতুন আবার কখনো পুরনো গয়না ভেঙে নতুন গয়না করতে দিত।
তাইমাকে কখনো আমরা ট্রামে বা বাসে চড়তে দেখিনি। বাড়ির কাছে হলে হেঁটে বা হাতে টানা রিক্সায় যেত আর দূরে হলে ট্যাক্সি বা গাড়ীতে যেত। সেক্ষেত্রে অবশ্য কাকু সঙ্গে থাকত। সেসময় তাইমার মা থাকতেন, রাসবিহারীর কাছে ধর্মদাস রো-তে। প্রতিবছর সেখানে রথের মেলা বসত। একবার কাকু তাইমার সঙ্গে আমরাও সেই মেলা দেখতে গিয়েছিলাম। মামা (তাইমার ছোট ভাই) কি সুন্দর ছোট ছোট কাচের শোপিস্ আমাদের কিনে দিয়েছিলেন!
শুনেছিলাম, একটা সময়ে তাইমা আর কাকু সারা ভারত ঘুরে বেড়িয়েছে- আমার অবশ্য সেসময়ের স্মৃতি নেই। তবে তার একটা স্মৃতিচিহ্ন কিন্তু অনেকদিন আমাদের কাছে ছিল। কাশ্মীর বেড়াতে গিয়ে তাইমা, আমার আর বোনটির জন্য দুটো শাল আর ছোট বোনের জন্য একটা সবুজ জ্যাকেট এনে দিয়েছিল। সেই ছোটবেলায়, অনেকদিন আমি আর বোনটি সেই শাল দুটো গায়ে দিয়েছি। তখন শীতের অনেক পোষাক আমাদের ছিল না। প্রতিবছর শীত এলে, মা আমাকে আর বোনটিকে একটা হাতকাটা সোয়েটার পরিয়ে, তার ওপর তাইমার আনা শাল জড়িয়ে দিত। যাতে খুলে পড়ে না যায় তাই শালগুলো পিছনে গেরো বেঁধে আটকে দিত।
রেডিও, তখন বলত আকাশবাণী, শোনার ঝোঁক অবশ্য তাইমার খুব ছিল না। তবে প্রতি শুক্রবার রাত আটটা থেকে নটা পর্যন্ত রেডিওতে নাটক সম্প্রচারিত হত, সেটা অবশ্য তাইমা কোনো দিনও মিস্ করত না –সঙ্গে মা’ও থাকত আর আমরাও। নামকরা লেখক, লেখিকাদের কাহিনী অবলম্বনে সেই সব নাটকে, তখনের নামকরা অভিনেতা অভিনেত্রীরা অভিনয় করত। যে কোনো বই পড়ার মত সেইসব নাটক শোনাতেও আমাদের কোনো বাধানিষেধ ছিল না।
সেসময় আকাশবানী থেকে প্রচারিত হবে, এমন আগাম অনুষ্ঠানসূচী দিয়ে একটা পত্রিকা বার হত। সেই পত্রিকা তাইমা নিয়মিত নিত। সেখান থেকে খুঁজে দেখে নিত কবে আছে ছবি বন্দ্যোপাধ্যায়ের অনুষ্ঠান- ব্যস সেই অনুষ্ঠান কিন্তু তাইমা কিছুতেই মিস্ করত না। কারণ ছবি বন্দ্যোপাধ্যায়ের কীর্তন বা গান ছিল তাইমার সবচেয়ে প্রিয়। তখনের বিখ্যাত পত্রিকা, ‘মাসিক বসুমতী’র গ্রাহক ছিল তাইমা। এছাড়াও কাছের লাইব্রেরী থেকে কাকু বা বাড়ির কোনো কাজের লোক নিয়মিত বইএর জোগান দিত তাইমাকে। তাইমার নিজেরও ছিল বেশ কিছু বই – সাধু সন্তের জীবন কথা, রামকৃষ্ণ কথামৃত ইত্যাদি।
অত্যধিক ঠাকুর দেবতায় ভক্তি কোনোদিনই ছিল না তাইমার। ঠাকুর ঘরে নিত্যদিনের পূজোয় একবার বসত ঠিকই- কিন্তু ঐ পর্যন্তই। একমাত্র ভক্তিভরে শিবরাত্রির ব্রত পালন করত।
কাকু যেমন নিজের শখসাধের এক জগৎ তৈরী করে নিয়েছিল, তাইমাও তেমনি নিজের সেলাই বোনা, বইপড়া নিয়ে নিজের এক জগৎ তৈরী করে নিয়েছিল – যে যার নিজের জগৎ নিয়ে ব্যস্ত থাকলেও কোথাও যেন তারা একাত্মই ছিল, কোথাও যেন তারা একে অপরের ওপর চূড়ান্তভাবে নির্ভরশীল ছিল। চীৎকৃত ঝগড়া তো দূর, কোনোদিন তাদের মতবিরোধ হতে দেখি নি। এমনই ছিল তাদের একে অপরের প্রতি বিশ্বাস, সম্মান, শ্রদ্ধা, ভালোবাসা।
ষষ্ঠ পর্ব সমাপ্ত
গোপা মিত্র
ফিজিক্স অনার্স। একসময়ে কিছুদিন শিক্ষকতা করলেও, প্রকৃতপক্ষে গৃহবধূ – কিন্তু পায়ের তলায় সর্ষে। ভ্রমণের নেশা প্রবল। ভারতের বাইরে কোথাও না গেলেও দেশের মধ্যেই প্রচুর ঘুরেছেন। পাহাড়, সমুদ্র, জঙ্গল, ঐতিহাসিক স্থান – কোনোওকিছুই বাদ নেই। এখনও সুযোগ সুবিধে হলেই বেরিয়ে পড়েন। দু-কলমের জন্যে জীবনে প্রথমবার কলম ধরা।
আপনার লেখনীর সঙ্গে সঙ্গে আমিও ফিরে গেলাম ছোটবেলার দিনগুলোতে। ভীষণ সুন্দর।
ধন্যবাদ। তোমার মন্তব্য আমাকে উৎসাহিত করলো।