Home বিবিধ, প্রবন্ধ ফিরে দেখা (পর্ব-৫)
বিবিধপ্রবন্ধ

ফিরে দেখা (পর্ব-৫)

গোপা মিত্র

[যাদের স্নেহচ্ছায়ায়, শিক্ষায়, আদর্শে আমি বেড়ে উঠেছি বা যাদের সাহচর্যে আমার জীবনের সেরা মুহূর্তগুলি কাটিয়েছি, তাদের কেউই আজ আমাকে সঙ্গ দেওয়ার জন্য এই পৃথিবীতে বেঁচে নেই। আমার এই স্মরণিকা তাদের উদ্দেশ্যে শ্রদ্ধা নিবেদনের এক ছোট্ট প্রচেষ্টা মাত্র।]

 

পর্ব-৫

কাকু

(দ্বিতীয় পর্ব)

 

কাকুর ফুল, পাখী বা গাছের শখ যেমন আমাদের প্রকৃতি-পরিবেশ চিনতে বা ভালোবাসতে শিখিয়েছিল, কাকুর ক্যালেন্ডারের ছবিগুলো যেমন আমাদের বিশ্বকে চিনিয়েছিল, কাকুর সঙ্গ তেমনই আমাদের কলকাতা চিনিয়েছিল। আমি তখন ক্লাস সিক্স। বয়স – খুব বেশী হলে, এগারো কি বারো। পুজো এসে গেছে। সেসময়ই একদিন কাকু এসে বলল, ‘কাল তোমরা তিন বোন সকাল সকাল রেডী হয়ে নিও। তোমাদের নিয়ে আমি বেরোব’। ‘আমাদের কোথায় নিয়ে যাবে গো কাকু’? ‘গেলেই তো দেখতে পাবে’। ব্যাস! হয়ে গেল। কথা শেষ।

পরদিন সম্ভবতঃ শনিবার – কাকুর অফিস, আমাদের স্কুল, দুই-ই ছুটি। সে সময় আমাদের বাড়ীর কাছেই কর্ণওয়ালিশ ষ্ট্রীট, এখনকার বিধান সরণী, দিয়ে বেশ কয়েকটি রুটের ট্রাম চলত – ডালহৌসি, এসপ্লানেড, গ্রে ষ্ট্রীট। কাকুর সঙ্গে আমরা এসপ্লানেডের ট্রামে চড়ে বসলাম। তারপর দুদিকের জানলা দিয়ে কলকাতা দেখতে দেখতে এগিয়ে চললাম। 

এসপ্লানেডে কাকুর সঙ্গে আমরা নেমে পড়লাম। কাকু আমাদের চেনাতে লাগল, বাংলায় এই জায়গাকেই বলে ধর্মতলা, কলকাতার প্রাণকেন্দ্র। এই যে দেখছ, এটা হল ‘মেট্রো’ সিনেমা হল, একটু এগিয়েই দেখ, রয়েছে আরো দুটো সিনেমা হল – ‘লাইট হাউস’ ‘নিউ এম্পায়ার’ – ইংরিজী ভালো ভালো সিনেমাগুলো সব এই হলগুলোতেই আসে, ঐ যে দূরের সাদা বিশাল বড় বাড়ীটা, ওটা হল কলকাতার সবচেয়ে বড় হোটেল ‘ওবেরয় গ্র্যান্ড’। এবার এসো, আমরা আমাদের যাবার যায়গায় পৌঁছে গেছি। ‘কাকু এটা কি’? ‘এটা হল কলকাতার সবচেয়ে বড় বাজার, ‘হগ মার্কেট’ এখনের নিউ মার্কেট – যা চাইবে, সব জিনিষই এখানে এক ছাদের তলায় পেয়ে যাবে। 

ভিতরে কাকু আমাদের এক চাইনীজ জুতোর দোকানে নিয়ে গেল। ‘এবার বেছে নাও তোমরা, যে যার পছন্দমত জুতো’। বাটার জুতো ছাড়া যে আর জুতো হতে পারে তা তো আমাদের ধারণাতেই ছিল না। আমরা নিজেদের পছন্দমত জুতো বেছে নিলাম। সেই প্রথম আমি হিল দেওয়া এক চমৎকার চটি কিনলাম। এরপর থেকে আমি বরাবরই হিল পরে এসেছি, যতদিন না বয়সোচিত পায়ের ব্যথায় কাবু হয়ে পড়ি। জুতোর পরে সেখান থেকেই শ্যোকেসে সাজানো চমৎকার এক ফ্রক দেখে, কাকু আমাদের সেই দোকান থেকে একইরকম তিনটে ফ্রক তিনজনকে কিনে দিল। এরপর থেকে কাকু প্রতিবছরই আমাদের নিয়ে নিউ মার্কেট থেকে পছন্দসই পুজোর জুতো আর জামা কিনে দিত। পঞ্চাশ ষাটের দশকে স্কুলপড়ুয়া আমরা নিউ মার্কেট থেকে নিজেদের পছন্দমত জামা জুতো কিনছি, ভাবা যায়!

স্কুলের একেবারে শেষদিকে, যদিও তখনও আমরা স্কার্ট আর ফ্রক পরছি, তখনও কাকু আমাদের লিন্ডসে ষ্ট্রীটের হ্যান্ডলুম হাউস থেকে জীবনে প্রথমবার আমাদের শাড়ী কিনে দিয়েছিল। সেজন্য অবশ্য কাকুকে আমাদেরই এক আত্মীয়া হিতৈষিনীর কাছ থেকে অনেক কথাও শুনতে হয়েছিল, আমাদের তিন বোনকে এত প্রশ্রয় দেওয়া হচ্ছে কেন, কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা খরচা করে সেই তো বিয়ে দিতেই হবে, তখন এত স্বাধীন মতামত নিয়ে করবেটা কি! কাকু অবশ্য সে সবে পাত্তা না দিয়ে, পরে কলকাতার, তখনকার অনেক বিখ্যাত নামীদামী ব্র্যান্ডের শাড়ীর দোকানে আমাদের নিয়ে গিয়েছিল।

পূজোর সময় প্রতি বছরই কাকু একটা ট্যাক্সি করে তাইমা আর আমাদের তিন বোনকে নিয়ে ঠাকুর দেখতে বার হত। সেসময় পুজোর কটা দিন আমরা মায়ের সঙ্গে মামারবাড়ীতে মামাতো ভাই বোনেদের সঙ্গে কাটাতাম। মামার বাড়ির সামনেই পুজো প্যান্ডেল, জানলা থেকে আমরা সারাদিনই ঠাকুর দেখতাম, ভীড় দেখতাম। কানে বাজত সেসময়ের বিখ্যাত সব শিল্পীদের বাংলা গান (“আমার পুজো”-য় আমি সেই পুজোর কথা লিখেছি) । কাকু কিন্তু ঠিক নবমীর দিন সকালে তাইমাকে নিয়ে চলে আসত মামারবাড়ীতে। তারপর ঠাকুর দেখা শেষ হলে আমাদের আবার মামারবাড়ীতেই ফিরিয়ে আনত। 

প্রতি বছরই কাকু আর তাইমা হাওয়া বদলাতে শীতকালের কয়েকটা মাস রাজগীরে থাকত, সঙ্গে নিয়ে যেত একজন কাজের লোক, যে রান্নাবান্না থেকে ঘরদোর পরিষ্কার সবই করত। আমাদের কয়েকটা দিন সেখানে কাটিয়ে আসার জন্যে অনেকবার বলা সত্ত্বেও চলনদারের অভাবে আমাদের আর যাওয়া হয়ে উঠছিল না। অবশেষে সুযোগ এল। আমাদের মেজ পিসেমশাই আমাদের নিয়ে যেতে রাজী হলেন। 

দিন কয়েকের স্কুল ছুটি নিয়ে সারা রাত ট্রেণ জার্ণি করে বক্তিয়ারপুরে নামলাম আমরা। সেখান থেকে ভাড়ার গাড়ী করে আমরা এসে পৌঁছলাম রাজগীর, কাকু তাইমার কাছে ‘M.O. REST HOUSE’এ। দোতলা বাড়ীর একতলায় কাকুতাইমার ইউনিট – সামনেই খোলামেলা বাগানে শীতকালীন ফুলের সমারোহ। REST HOUSE-এ বিছানাপত্র থেকে বাসনকোসন সবই মজুত। কাকু শুধু সঙ্গে করে একটা প্রেশার কুকার নিয়ে গিয়েছিল। সেই আমলে প্রেশার কুকার সম্বন্ধে মানুষের যখন কোনো ধারণাই ছিল না, কাকু যে কোথা থেকে প্রেশার কুকার কিনে এনেছিল, কে জানে? এরপর শুধু খাওয়া আর খাওয়া, আনন্দ আর আনন্দ। রাজগীরের বিখ্যাত মিষ্টি, খাজা, কাকুর কাছে সবসময়ই মজুত – যত পার খাও, আর তারপর? টাঙ্গা করে রাজগীর চষে বেড়াও। বেণুবন, বানগঙ্গা, মনিয়ার মঠ, বিম্বিসারের জেল, সোন ভান্ডার, গৃদ্ধকূট পাহাড় – সব দেখা হয়ে গেল আমাদের। ইতিমধ্যে কাকুর এক ধানবাদ প্রবাসী ব্যবসায়ী, ছোটবেলার বন্ধু, পুলিনবাবু, তার স্ত্রী আর ছোট মেয়েকে নিয়ে সামনেই সার্কিট হাউসে এসে উঠেছেন। তার গাড়ী আমাদের রাজগীরের আশেপাশেও নিয়ে যেতে লাগল। শ্বেত পাথরের জৈন মন্দির পাওয়াপুরী আমাদের খুব ভাল লাগল।

‘REST HOUSE’-এর পিছনে ছিল ছোট্ট এক জলাশয় বা পুকুর। দুপুরের বাড়তি সময়ে আমরা তিন বোন সেখানে বসে ছিপ ফেলে মাছ ধরতাম। কাকুই সব ব্যবস্থা করে দিয়েছিল। বড় মাছ আর কোথায়? ছোট ছোট মাছ উঠত – নিজেদের ধরা সেই মাছ খেতে কি যে আনন্দ হত! তাছাড়া সামনের বাগান তো ছিলই আমাদের ছুটোছুটির জন্য। অনেক পরে আবার যখন আমার আরো একবার রাজগীর যাওয়ার সুযোগ হয়েছিল, তখন দেখেছিলাম, ‘M.O. REST HOUSE’ আর আগের মত নেই, যে উষ্ণকুন্ডে রোজ আমরা যেতাম তাইমার সঙ্গে স্নান করতে, তার জলও যেমন কমে গেছে, নোংরাও তেমন হয়ে গেছে।

কাকুর যেমন ছোটবেলার স্কুল কলেজের অনেকদিনের পুরোনো বেশ কিছু বন্ধু ছিল, তেমনই আবার বেশ কজন কাছেপিঠের বন্ধুও ছিল। কিন্তু সব বন্ধুরাই ছিলেন নিজ নিজ ক্ষেত্রে সুপ্রতিষ্ঠিত। সামনের বাড়ীতে থাকতেন বিনয়বাবু – প্রতি বছরই তিনি গ্রীষ্মকালে আমাদের জন্য বম্বে (এখনের মুম্বই) থাকে আনা বিখ্যাত আলফানসো আম পাঠাতেন। কাকুর ছোটবেলার বন্ধু ডাঃ কৃষ্ণ চন্দ্র চন্দ্র, আমরা বলতাম কেষ্টবাবু, ছিলেন আমাদের পারিবারিক চিকিৎসক – আপদে বিপদে সবসময়ই আমরা তাকে পাশে পেয়েছি। এই প্রসঙ্গে আমার একটা কথা মনে পড়ে গেল – প্রতি বছরই কাকুর নির্দেশে আমাদের বাড়ীর সবাইকে, এমনকি কাজের লোকজনকেও T.A.B.C ইঞ্জেকশন নিতে হত, টাইফয়েড কলেরা থেকে বাঁচবার জন্য। বর্ষার প্রাক্কালে কেষ্টবাবু আসতেন ইঞ্জেকশন দিতে। বাড়ীর সবার নেওয়া হয়ে গেছে, আমার আনুরও হয়ে গেছে, কিন্তু “বোনটি”-কে(মেজ বোন) খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না, সে তখন ইঞ্জেকশনের ভয়ে বাড়ীর কোন্‌ কোণে গিয়ে লুকিয়েছে। খুঁজেপেতে তাকে ধরে এনে তবে তাকে ইঞ্জেকশন দিতে হত। ডাক্তারবাবুর পরিবারের সঙ্গেও আমাদের একটা সুন্দর সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। তাঁর বাড়ীতে আমাদের যাওয়া আসাও চলত। কাকুর কাছের বন্ধুরাও কেউ কম ছিলেন না। সময় পেলে কাকু তাদের সঙ্গে দেশবন্ধু পার্কে যেমন হাঁটতে যেত, তেমন অবসর সময়ে তাসও খেলত।

কাকু যে শুধু নিজেকে বাড়ীতেই গন্ডীবদ্ধ করে রেখেছিল, তা কিন্তু নয়।  সেসময় উত্তর কলকাতার অন্যতম নামী ‘শ্যামবাজার ক্লাব’-এর সদস্য প্রেসিডেন্ট ছিল কাকু। নানারকম ইনডোর ও আউটডোর গেমস খেলা হত সেখানে, প্রতিযোগিতাও হত। এমনই কোনো প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়ে কাকু কাপ ও শিল্ড পেয়েছিল – যেগুলো আমাদের বাড়িতে রাখা ছিল। এই ক্লাবের মাধ্যমে পাওয়া সি এ বি’র ক্রিকেট খেলার টিকিট কাকু নিজে না গেলে খেলায় আগ্রহী কাউকে দিয়ে দিত। এছাড়াও মোহনবাগান ক্লাবের আজীবন সদস্য ছিল কাকু। কাকুর সেই কার্ড নিয়ে অনেক সময় বড় পিসীমার নাতি খেলা দেখতে যেত। ঘটি বাড়ীর মেয়ে আমি- তখন থেকেই রক্তে ঢুকে গেছে মোহনবাগান। ঠিকানা বদলে আমি আবারও এলাম এক ঘটি বাড়ীতেই – তাদেরও ধ্যানজ্ঞান মোহনবাগান। আমার এই পরিবারও আজীবন মোহনবাগান ক্লাবের সদস্য। আমার স্বামী আগে নিয়মিত খেলা দেখতে যেত, এখন অবশ্য আর যাওয়া হয়ে ওঠে না – বরং বাড়ীতেই একসঙ্গে বসে আমরা খেলা দেখি। মোহনবাগান জিতলে আনন্দ করি, হারলে দুঃখ পাই।          

আমি তখন ক্লাস টেন – শুনলাম, পুজোর কদিন আগে, দিন পনেরোর জন্য স্কুল থেকে এক্সকার্সানে অনেক জায়গা – ঝাঁসী, সাঁচী, অজন্তা, ইলোরা, বম্বে, হায়দ্রাবাদ, নিয়ে যাবে মাত্র তিনশ টাকার বিনিময়ে । বাবাকে এসে বললাম, ‘বাবা আমার বন্ধুরা সব যাচ্ছে, আমিও ওদের সঙ্গে যেতে চাই’। বাবা বলল যে ঠিক আছে , কাকু যদি রাজী হয়, তবে আমার আপত্তি নেই। বাবাকে বললাম যে বাবা, তুমি একটু কাকুকে বুঝিয়ে বলো না। “তুমি যাবে ,কাজেই তোমাকেই কাকুর সঙ্গে কথা বলতে হবে”। মা’কে এসে ধরলাম, “মা তুমি একটু কাকুর সঙ্গে কথা বলনা”। “কেন তুমি কি কাকুর সঙ্গে কথা বল না”? কাকুর কাছ থেকে মত নিতে হবে – আমি ধরেই নিলাম, আমার আর যাওয়া হল না, বোনেরাও মুচ্‌কি হাসতে লাগল, “দিদির আর যাওয়া হল না। কাকু কিছুতেই রাজী হবে না”।

আমি আগেই বলেছি যে আমাদের বাড়ীতে সব গুরুজনরাই ছিল আমাদের অভিভাবক। যে কোনো কিছু করতে গেলে শুধুমাত্র মা বাবার মত নিলেই হত না, কাকু তাইমার মত নেওয়াটাও জরুরী ছিল। চারজনে সহমত না হলে আমাদের কোনো কিছুতেই অনুমতি মিলত না। কাকুর মত মানেই অবশ্য তাইমারও মত। তাই আমার কাকুর কাছে আসা। দাদি অবশ্য এসবের মধ্যে থাকত না। 

বিছানায় কাকু শোয়া, তাইমা চেয়ারে বসা, কাকুকে গিয়ে বললাম ‘কাকু, তোমার সঙ্গে আমার একটা দরকারী কথা ছিল’। ‘হ্যাঁ, বল’ কাকু উঠে বসল। সাহস করে কাকুকে সব বললাম। কাকু সব জেনে নিল, ক’জন যাচ্ছে, কবে যাওয়া, কবে ফেরা। তারপর বলল যে, যাবে যে বলছ, তোমার জামা কাপড় নিয়ে যাবে কিসে, শোবে কোথায়? আমি বললাম যে, সে আমি বাবাকে বলবখন আমার জন্য একটা ছোট ট্রাঙ্ক আর হোল্ডল কিনে দেবে, তুমি শুধু বল, তোমার কোন আপত্তি নেই তো। ‘না, আমি আপত্তি করব কেন? শুধু একটা কথা, একলা যাবে, দিদিমণিদের কথা শুনবে, সাবধানে থাকবে’। মনে আছে, পরদিন কাকু আমার জন্যে একটা ছোট ট্রাঙ্ক, আর হোল্ডল কিনে নিয়ে এসেছিল।  

শুধুমাত্র একবারই কাকু আমাদের বাধা দিয়েছিল, যখন আমরা সাঁতার শিখতে চেয়েছিলাম। কাকুর যুক্তি ছিল, হেদুয়ায় ভোরবেলা সাঁতার শিখে, বাড়ি ফিরেই আবার সেই হেদুয়ার কাছেই স্কুলে যাবে, তাতে যাতায়াতের ক্লান্তি, সাঁতারের ক্লান্তি সব মিলে পড়াশোনাটা আর ঠিকমত করা হবে না। কাকুর কথা তখন আমাদের খারাপ লেগেছিল ঠিকই, তবে পরে বুঝেছিলাম, সাঁতার না শেখাতে আমাদের কোন ক্ষতি হয়নি, কিন্তু পড়াশোনাটা ঠিকমত না করলে সত্যিই আমাদের ক্ষতি হয়ে যেত। 

আমাদের বাড়ী পুরোনো হয়ে যেতে মাঝে মাঝেই সারানোর দরকার পড়ছিল। সেদিকেও কাকুর ছিল তীক্ষ্ণ নজর। কাকু এক অভিনব উপায় বার করেছিল। একজন কন্ট্রাক্টর ঠিক করেছিল। প্রতি দুবছর অন্তর সেই কন্ট্রাক্টর, তখন বলত ‘হেডমিস্ত্রী’ মাথায় ফেজ টুপি মুখে চাপ সাদা দাড়ি, বুখারি, একজন রাজ মিস্ত্রী সঙ্গে নিয়ে আসত – তারপর সারা বাড়ী ঘুরে ঘুরে দেখত। তার নির্দেশে কোনো জায়গা কমজোরী মনে হলে সঙ্গের সেই মিস্ত্রী দেওয়াল ঠুকে দেখত। তার কিছুদিন পর বুখারি, তার দলবল নিয়ে চলে আসত আমাদের বাড়ী সারাতে বা রঙ করতে। বালিকা বয়সের কৌতূহলী দৃষ্টিতে আমরা তাদের কাজ দেখতাম, বুঝতে চেষ্টা করতাম, কোথায়, কিজন্য, কিভাবে, কাজটা করা হচ্ছে! 

সেই পঞ্চাশের দশকেই আমাদের বাড়ীতে ল্যান্ডফোন এনেছিল কাকু। সেই ফোন শুধু আমরা, বাড়ির লোকেরাই নয়, আমাদের কাজের লোকেরাও প্রয়োজনে ব্যবহার করত।    

কাকুর আরো একটা গুণ ছিল, সবাইকে সাধ্যমত সাহায্যের চেষ্টা করা, সে প্রয়োজনে টাকা পয়সা দিয়েই হোক্‌ ওঠবা চাকরীর ব্যবস্থা করে দিয়েই হোক্‌। এই সাহায্যের কথা অবশ্য আমরা কেন, তাইমাও জানতে পারত না, যতদিন না উপকৃতরা মুখ খুলত! 

কাকুর শখ, যেমন আমাদের প্রকৃতি পরিবেশের সঙ্গে এই বিশাল পৃথিবী চিনিয়েছিল, কাকুর হাত তেমনই আমাদের ভবিষ্যতের দিশা দেখিয়েছিল। সেই ছোটবেলা থেকেই কাকু আমাদের স্বাধীন সত্ত্বার বিকাশের চেষ্টা করেছিল। কাকু যেন বলতে চেয়েছিল “আজ আমি তোমাদের পথ চেনাচ্ছি ঠিকই, কিন্তু একদিন তোমাদের নিজেদের বিচারবুদ্ধি মত সঠিক পথ তোমাদের নিজেদেরই খুঁজে নিতে হবে”। 

আমাদের পরম সৌভাগ্য যে আমরা এমন একজন কাকুর সান্নিধ্যে বড় হয়ে উঠেছিলাম। শখ, শৌখিনতা, আপনজনদের ভালোবাসা, পরোপকার, দায়িত্ববোধ, প্রকৃতি পরিমন্ডল, সব কিছু নিয়ে, ছেলেমেয়ে না থাকলেও,যে কত আনন্দে থাকা যায় কাকু ছিল তার জ্বলন্ত উদাহরণ। শর্ত শুধু একটাই – নিজের ভালোলাগা, ভালোবাসা আর আনন্দ নিজেই খুঁজে নেওয়া।  

লেখার এই স্বল্প পরিসরে এমন বর্ণময় চরিত্রের বিরাট মাপের কাকুকে ধরা প্রায় অসম্ভব বলেই আমার মনে হয়, তবুও আমি চেষ্টা করলাম। সফল হলাম কিনা, যারা কাকুকে, জানত, চিনত বা কাকুর দ্বারা একদিন উপকৃত হয়েছিল তারাই বলতে পারবে! 

পরিশেষে আর দুটো কথা না বললে এই লেখা অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। অসুস্থতার কারণে কাকু একদিন ঘরেই এক টেবিলে বসে ভাত খাচ্ছে, আমাদের রান্নার লোক হরেকেষ্ট, অপেক্ষা করছে – কা কুর খাওয়া হয়ে গেলে থালা নামিয়ে নিয়ে যাবে বলে! তাইমা চেয়ারে বসে কাকুর খাওয়া দেখছে, আমরা মাটিতে মাদুরে বসে। কাকুর খাওয়া হয়ে গেল, হরেকেষ্ট চলে যাচ্ছে, পিছন থেকে কাকু ডাকল ‘হরেকেষ্ট আজ তুই মাছের ঝালে নুন দিতে ভুলে গেছিস। আমি খেয়ে নিলাম ঠিকই, কিন্তু বাড়ীর সকলের খাওয়া তো এখনও বাকী আছে। মাছটা একটু নুন দিয়ে, ঠিক করে দিস্‌’। হরেকেষ্ট লজ্জা পেয়ে বলল ‘মেজবাবু আপনি আমাকে আগে বলবেন তো, তাহলে আমি আগেই ঠিক করে দিতাম’। (কাজের লোকেদের কাছে কাকু ছিল “মেজবাবু” আর বাবা “বড়বাবু”) তাইমা হাঁ হাঁ করে উঠল। কাকু তাইমাকে থামিয়ে দিয়ে বলল, ‘আরে, ভুল তো হতেই পারে। ওরাও তো মানুষ, তাতে এত চেঁচামেচির কি আছে? আমি তো খেয়ে নিয়েছি’। 

কাকুর ঘরের টেবিলে, শিশিতে সবসময়েই যেমন থাকত পিপারমিন্টের প্যাকেট তেমনই কাকুর পকেটেও থাকত। কাকু নিজেও সেই পিপারমিণ্ট যেমন খেত তেমনই আমাদেরও দিত। সেই পিপারমিন্ট মুখের ভিতর গেলেই মুখের সঙ্গে মনও যেন ঠান্ডা হয়ে যেত। চাতক পাখীর মত আমরা অপেক্ষা করতাম কখন কাকু আমাদের একটা পিপারমিন্ট দেবে! কাকুর সেই ভালোবাসার আস্বাদ ভরা স্বল্পদামী পিপারমিন্টের ঠান্ডা স্বাদ আজও যেন শুধু মুখ নয়, মন জুড়ে রয়ে গেছে – যা এখনের অনেক নামীদামী ব্র্যান্ডের ঠান্ডা মূল্যবান আইসক্রীমেও আজ আর খুঁজে পাই না।

পঞ্চম পর্ব সমাপ্ত

 

 

গোপা মিত্র

ফিজিক্স অনার্স। একসময়ে কিছুদিন শিক্ষকতা করলেও, প্রকৃতপক্ষে গৃহবধূ – কিন্তু পায়ের তলায় সর্ষে। ভ্রমণের নেশা প্রবল। ভারতের বাইরে কোথাও না গেলেও দেশের মধ্যেই প্রচুর ঘুরেছেন। পাহাড়, সমুদ্র, জঙ্গল, ঐতিহাসিক স্থান – কোনোওকিছুই বাদ নেই। এখনও সুযোগ সুবিধে হলেই বেরিয়ে পড়েন। দু-কলমের জন্যে জীবনে প্রথমবার কলম ধরা।

Author

Du-কলম

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!