গোপা মিত্র
[যাদের স্নেহচ্ছায়ায়, শিক্ষায়, আদর্শে আমি বেড়ে উঠেছি বা যাদের সাহচর্যে আমার জীবনের সেরা মুহূর্তগুলি কাটিয়েছি, তাদের কেউই আজ আমাকে সঙ্গ দেওয়ার জন্য এই পৃথিবীতে বেঁচে নেই। আমার এই স্মরণিকা তাদের উদ্দেশ্যে শ্রদ্ধা নিবেদনের এক ছোট্ট প্রচেষ্টা মাত্র।]
পর্ব-৭
দাদি ও আত্মজনেরা
আমাদের পরিবারের সবচেয়ে বয়োজ্যেষ্ঠ ছিল “দাদি” – আমাদের তিনবোনের ঠাকুমা, পটলডাঙার বসুমল্লিক পরিবারের মেয়ে। দাদু মারা গিয়েছিলেন আমাদের জন্মের অনেক আগে। কম বয়সেই বিধবা আমাদের দাদি, সেসময় ভেঙে না পড়ে ঘুরে দাঁড়িয়ে শুধুমাত্র সংসারের হালই ধরেননি; ছেলেদের মানুষ করে প্রতিষ্ঠিতও করেছিলেন। আমাদের কর্মনিষ্ঠ দাদির বুদ্ধি, ক্ষমতা, মনের জোরের কোনো তুলনাই হয় না। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত সেই মনের জোরই দাদিকে সক্ষম করে রেখেছিল।
মাথায় ছোট করে ছাঁটা পাকা চুল, মুখে একটাও দাঁত নেই, খালি পা, পরণে সাদা থান, হাতে জপের মালা- ছোটখাটো চেহারার দাদিকে বরাবর আমরা এমনই দেখে এসেছি। কোথাও যেতে হলে বা খুব প্রয়োজনে কখনোসখনো সেমিজ পরত বা গায়ে চাদর দিয়ে নিত। খালি পায়েই দাদি সব জায়গাতে ঘুরে বেড়াত। বাড়ীতে নিয়মিত নাপিত আসত দাদির চুল কেটে দেবার জন্য।
রোজ ভোরবেলা ঘুম থেকে উঠে, হাতে একটা জার্মান সিলভারের কমন্ডুলু আর কাঁধে একটা কাপড়ের ঝোলা ব্যাগ নিয়ে দাদি চলে যেত গঙ্গাস্নানে। আমাদের বাড়ি থেকে বাগবাজারের গঙ্গার ঘাট খুব কিছু কাছে ছিল না, খালি পায়ে রোজ অতদূর যাতায়াত আমরা তো ভাবতেও পারি না! দাদির অবশ্য কোনো বিকার ছিল না, গঙ্গাস্নানে দাদি যাবেই। সাতটা, সাড়ে সাতটার মধ্যে ফিরে এসে দাদি ঠাকুর ঘরে নিত্যপূজা সেরে তবেই চা জলখাবার খেত। মাঝেমধ্যেই দাদি ফেরার পথে আমাদের জন্য বেনে পুতু্ল, কোনো খেলনা, বা কোনো ফল কিনে নিয়ে আসত।
এবার দাদি নিচে নামত নিজের রান্নার ব্যবস্থা করতে। বাজার থেকে আনা সব্জী তরকারী থেকে নিজের পছন্দমত সব্জী বেছে নিয়ে বা তাইমা বেছে দিলে কেটেকুটে রান্নাঘরের ছোট নিরামিষ উনানে রান্না চাপাত। ঠাকুর বা বামুনদিদি দাদিকে সাহায্য করত। তবে নিজের রান্না দাদি নিজে করতেই বেশী পছন্দ করত। মাঝে মাঝে দাদি বাড়ীর সবার জন্যই নিরামিষ তরকারি রান্না করে দিত। যেভাবে মাটিতে বসে অবলীলায় নিখুঁত ভাবে দাদি বঁটি দিয়ে থোড়, মোচা, এঁচোড় কাটত দাদির চেয়ে কম বয়সেও আমি মাটিতে বসে তেমনভাবে কাটতে পারতাম না। কালো পাথরের থালা বাটি গেলাসে দাদি ডাল আর তরকারী মাত্র দিয়ে ভাত খেত সঙ্গে অবশ্য থাকত ঠাকুরের রান্না করা কোনো টক বা কোনদিন ঘরে পাতা দই। সকালে রান্নার সময়েই নিজের রাতের খাবারের জন্য চার ছ’টা লুচি আর একটা তরকারী বানিয়ে রাখত।
হিন্দু বিধবার সব নিয়মই দাদি পালন করত – সে একাদশী থেকে অম্বুবাচী পর্যন্ত। কাকু ফল মিষ্টি আনিয়ে দিলেও ছোট পিসীমা একাদশীতে প্রায়ই দাদির খাবার জন্য ফল মিষ্টি পাঠাত। অম্বুবাচীতে অবশ্য তার সঙ্গে নিজের হাতে তৈরী নানারকম খাবারও করে পাঠাত। দাদি সেসব নিজেও যেমন খেত, আমাদেরও তেমনি ভাগ দিত। শীতকালে দাদি বড়ি দিত, মা তাইমাকে সঙ্গে নিয়ে ( আমি লিখেছি ‘স্মৃতির স্মরণী বেয়ে’-তে)। সেই বড়ি সারাবছরই খাওয়া হত। গ্রীষ্মকালে পাকা আমের রস বার করে পাথরের থালায় আমসত্ত্ব বসাত, আমাদের জন্য।
দাদির তিন মেয়ে, আমার তিন পিসী, সকলেই থাকতেন বাড়ীর বেশ কাছে- হাঁটাপথে বা রিক্সাপথে। তিনজনের মধ্যে বড় পিসীমা ছিলেন ঘোর সংসারী – মাঝেমাঝেই এগারোটা সাড়ে এগারোটায় মাথায় একটা ভিজে গামছা চাপিয়ে আমাদের বাড়ী আসতেন দেখা করতে। তার ছোট দুই নাতি – সুবু, সানু, আমাদের চেয়ে বয়সে কিছু বড়, আমাদের বাড়ীতে প্রায়ই আসার সুবাদে, আমাদের বেশ ভালো বন্ধু হয়ে উঠেছিল।
বড়পিসীমার মিহিজামের বাগান বাড়ী ‘ঘোষ লজ’এর স্মৃতি এখনও আমার মনে অমলিন রয়ে গেছে। খুব ছোটবেলায় একবার মা বাবা দাদির সঙ্গে শীতকালে থেকেছিলাম সেখানে। সেই লন্ঠনের আলো, খাটা পায়খানা, কুয়োর জল, দুপুরে বাগানের গাছে উঠে আতা পেয়ারা ফল পাড়া, আজও মনে রয়ে গেছে। সেখানেই দেখেছিলাম প্রথম গ্রামীন হাট (আমার লেখা ‘ভালো লাগা দারুণ না নিদারুণ’-এ এই হাটের কথা আমি লিখেছি)। সেখান থেকে কেনা সৌখীন ঢাকা দেওয়া মাটির কলসী আমাদের বাড়ীতে ছিল অনেক দিন। মিহিজাম থেকে রেললাইন পেরিয়ে চিত্তরঞ্জনে গিয়ে আমরা একদিন রেলইঞ্জিন তৈরীর কারখানাও দেখে এসেছিলাম।
মেজপিসীমা ছিলেন খুবই পরোপকারী। প্রয়োজনে পাড়া প্রতিবেশী বা আত্মীয়স্বজনকে খুবই সাহায্য করতেন। মেজপিসীমার গাড়ি ছিল একখানা। মেজপিসীমা সেই গাড়ি নিয়ে কখনো দক্ষিণেশ্বর আবার কখনও কালীঘাট চলে যেতেন। কালীঘাটে একদিন মেজপিসীমা দেখেছিলেন, একজন মেমসাহেবকে – পথশিশুদের কোলে তুলে সেবা করতে। আমাদের এসে সেই কথা বলেছিলেন। মাদার টেরেসা তখনও মাদার টেরেসা বলে পরিচিত হননি। পরে অবশ্য কোনো এক সূত্রে আমার মাদার টেরেসার সঙ্গে পরিচয় লাভের সুযোগ হয়েছিল। তাঁর সই করা আর্শীবানী এখনও আমার কাছে যত্ন করে রাখা আছে।
ছেলেদের ব্যবসার প্রয়োজনে শিমূলতলায় থাকা মেজপিসীমার বাড়ী – ‘গোপালধাম’-এ মা বাবার সঙ্গে আমরা তিন বোনে একবার গিয়েছিলাম বেড়াতে। অবশ্য শুধুমাত্র আমরাই নয়, সেবার মেজপিসীমার পরিবারের অনেকজনই শিমূলতলায় গিয়েছিলেন। একুশজন ছিলাম আমরা একসঙ্গে, সঙ্গে একজন হিন্দুস্তানী কাজের লোক, বুলিয়া। সেখানেও হ্যাজাকের আলো, কুয়োর জল, আর খাটা পায়খানা। শিমূলতলায় আমার পিসতুতো দাদাদের একটা জীপগাড়ী ছিল। গাড়ীতে করে এখানে সেখানে বেড়াতে যাওয়া, রোজ ষ্টেশনে হাঁটতে যাওয়া, সবাই মিলে সেবার আমরা খুব মজা করেছিলাম।
এখানেই প্রথম দেখেছিলাম মোহনানন্দ মহারাজকে। তিনি তখন শিমূলতলায় তাঁর এক শিষ্যার বাড়িতে অবস্থান করছেন। মেজপিসীমা বলে কয়ে তাঁকে গোপালধামেও এনেছিলেন। আজানুলম্বিত বাহু, টক্টকে ফর্সা রঙ, সিল্কের পীত বস্ত্র, আঙুলে ঝক্ঝকে মূল্যবান পাথরের আংটি, এমনই দেখেছিলাম তাঁকে।
পিসীমাদের মধ্যে সবচেয়ে গুণী, মজার আর আমুদে মানুষ আমাদের ছোট পিসীমা – সে সময়ের ক্লাস টেনের পরীক্ষায় ফার্ষ্ট ডিভিসনে পাশ করেছিলেন। সে সময় ছোট পিসীমার বাড়ীতে প্রথম দেখেছিলাম পাইপ লাইনের গ্যাস, যা চাবি দিয়ে খোলা বন্ধ করা যেত। হেন মিষ্টি নেই যা তিনি করতে পারতেন না – সে লেডিকেনী, গজা, বালুসাহী, চম্চম, পটোলের দোলমা, সন্দেশ, মালোপোয়া – সব বাড়িতেই তৈরী করতেন পিসীমা। এই সব মিষ্টি তিনি শুধু নিজের জন্য নয়, সকলকেই খাওয়াতেন। রান্নাতেও ছিলেন সিদ্ধহস্ত। আজ ভাবি, ইউটিউব ছাড়া কোথা থেকে যে এতসব শিখেছিলেন পিসীমা! অসম্ভব ভালো ছুঁচের কাজ বা এমব্রয়ডারী করতেন। বলতেন যে, খুব ভোরে উঠে প্রতিদিন আমি আগে ঘণ্টাদুয়েক সেলাই করে নিই, তা না হলে আমার ভাত হজম হবে না, তারপর সংসারের কাজে লাগি। নিজের হাতের কাজ করা শাড়ী তিনি প্রায় সব নিকটজনদেরই দিয়েছিলেন – আমরাও তার থেকে বাদ পড়িনি। বাড়িতে এলে কত যে মজার মজার গল্প করতেন। পিসীমা তখন বাড়ি করেছেন এখনের অরবিন্দ সরণীতে, তখন যাকে বলা হত গ্রে ষ্ট্রীট এক্সটেন্শন, আমাদের বাড়ী আসতে সার্কুলার রোড পেরোতে হবে – একবার এসে বললেন, “জানো তো, আমি আজ একজন ট্রাফিক পুলিশকে বললাম যে বাবা আমাকে একটু রাস্তাটা পার করে দেবে? সে বলল যে, দেখছেন তো ডিউটি করছি, আপনি নিজেই পেরিয়ে যান। আমি বললাম যে, যদি আমি রাস্তা পেরোতে গিয়ে তোমার সামনে চাপা পড়ি, তখন কিন্তু তোমাকেই ওপরওয়ালার কাছে জবাবদিহি করতে হবে। একথা বলাতে সে আমাকে রাস্তা পার করে দিলো”। আবার একদিন এসে বললেন “আজ একজন রিক্সাওয়ালাকে বললাম যে বাবা আমাকে একটু রাস্তাটা পার করে দেবে? সে বলল যে, মাইজি আমি কি আপনার খেয়া পারাপারের নৌকো নাকি”? দোকানে কিছু কিনতে গিয়ে এমন দাম করলেন যে দোকানী বলতে বাধ্য হল ‘আপনি কি শের শাহের আমল থেকে এসেছেন নাকি’! আমাদের এসে এসব বলতেন আর নিজেই হেসে গড়িয়ে পড়তেন। ছোট পিসীমার বাড়ী গেলে সব সময়ই নিজের হাতে তৈরি নানারকম মিষ্টির সঙ্গে মুখরোচক খাবার – কচুরী, আলুর দম, রাধাবল্লভী, ঘুগনী, নিমকি এইসব ভরপেট খাইয়ে তবেই আমাদের ছাড়তেন। মুখে বলতেন “তিনটে মাত্র ভাইঝি আমার তাদের কি না খাইয়ে ছাড়ব”?
বড় পরিবারের মেয়ে দাদি, আত্মীয়স্বজনও অনেক। সবার কথা অবশ্য মনে নেই, তবে দুজনের কথা কোনোদিনও ভুলব না। দাদির চেয়ে বয়সে বেশ কিছু বড় দাদির এক দিদি, সেজদিদা, ওপরে উঠতে উঠতে ডাকতেন “নীলু (দাদির নাম ছিল লীলাবতী। “ল” উচ্চারণের দোষে, হয়ে গিয়েছিল “ন”। দাদিরও ছিল এক অবস্থা। লুচি হয়েছিল নুচি, লেবু হয়েছিল নেবু) আমি এসেছি”। সঙ্গে সঙ্গে বাড়ীতে সাড়া পড়ে যেত – কাজের লোকজন দৌড়োত সেজদিদার জন্য রাবড়ী, মিষ্টি, আম, এসব আনতে। আগে থেকে জানা থাকলে অবশ্য ক্ষীর লুচি মিষ্টি এসব ব্যবস্থা করে রাখাই হত। টক্টকে ফর্সা রঙ, ছোট করে ছাঁটা সাদা চু্ল, খালি পা, পরণে সাদা থান তার ওপরে চাদর জড়ানো – সেজদিদা নিজের গাড়িতে এলেও সবসময় সঙ্গে থাকতেন চলনদার লক্ষীমণিদি। তিনি বিধবা হলেও বয়সে সেজদিদার চেয়ে অনেক ছোট ছিলেন। প্রতি বছর শ্রীমাণি মার্কেটের পিছনে কাঁসারী পাড়ায় সেজদিদার বাড়ীতে জগদ্ধাত্রী পূজোয় আমাদের সকলের নিমন্ত্রণ থাকত। একতলার ঠাকুর দালানে প্রতিমার সামনে বসে সেজদিদা নিজে ফলমূল কেটে দেওয়া থেকে শুরু করে সবকিছু তদারকী করতেন। চক্মিলানো বাড়ীর ছাদে ম্যারাপ বেঁধে খাওয়া দাওয়ার আয়োজন। নিরামিষ খাওয়া হলেও ধোঁকার ডালনা, ছানার তরকারী (পনীরের প্রচলন তখন ছিল না) থেকে শেষ পাতে দই, সন্দেশ বোঁদে লেডিকেনী কোনো কিছুই বাদ থাকত না। পূজো শেষ হলে সেজদিদা নিজে দাঁড়িয়ে থেকে সকলের খাওয়ার তদারকী করতেন, নচেৎ বাড়ির কোনো বর্ষিয়ান সদস্যা। কাউকে অনুপস্থিত দেখলে খবর নিতেন কেন সে আসতে পারেনি! বুফে সিষ্টেমের খাওয়াদাওয়ায় এমন আন্তরিকতা এখন আর চোখে পড়ে কোথায়! জানি, সময়ের সঙ্গেসঙ্গে সিষ্টেমের সঙ্গে আমাদের মানিয়ে নিতে হয়। এই তাড়াহুড়োর যুগে, সময়ের মূল্য অনেক। তাই, যে যার সময় মত আসবে , নিজের পছন্দমত খেয়েদেয়ে ফিরে যাবে – তাতে নাই বা হল গৃহস্বামীর সঙ্গে সাক্ষাৎ, তিনি আমন্ত্রণ করছেন – এটাই কি যথেষ্ট নয়?
আর একজন আসতেন, দাদির এক ভাই, আমরা বলতাম রাঙাদাদু, প্রায়ই আসতেন সকালবেলা। দোতলায় সিঁড়ি দিয়ে উঠতে উঠতে তিনি ডাকতেন “কই কোথায় গেলে সব? গোপেন বাহাদুর, গীতন সাহেব( তখন বোনটির নাম ছিল গীতা, পরে বদলে হয়েছিল নীলা) আর আনু বাবু”! আমরা ডাক শুনে দাদিকে চীৎকার করে ডাকতাম, “দাদি শিগ্গির ওপরে এস, রাঙাদাদু এসেছেন। পরনে ধুতি আর আদ্দির পাঞ্জাবী, ছোট্টোখাট্টো চেহারার রাঙাদাদু তখন দাদির ঘরে জমিয়ে বসে আমাদের সঙ্গে গল্প করছেন।
রাঙাদাদুর এই আদরের ডাক, দাদিও কখন যেন তুলে নিয়েছিল। মাঝেমাঝেই নিচে থেকে হাঁক পাড়ত “ কই কোথায় গেলে, গোপেন বাহাদুর, গীতন সাহেব, আনু বাবু”? শিগ্গির নিচে এসে দেখ, তোমাদের জন্য কি করেছি”। দুদ্দাড় করে আমরা তিন বোন তিনতলা থেকে একতলায় নেমে আসতাম, জানতাম, দাদি আমাদের জন্য নিশ্চয় গরম গরম আলুভাজা করেছে। সেরকম চমৎকার আলুভাজা আমি আজ পর্যন্ত আর কোনদিনও খাই নি। মোটা মোটা গোল গোল করে কাটা খোসাশুদ্ধু ছাঁকা তেলে ভাজা পোড়া দাগহীন তেল চক্চকে্ গরম গরম সে আলুভাজার স্বাদ এখনও যেন মুখে লেগে আছে! দাদির হাতের অন্যরকম এক শশার স্যালাডও ছিল অপূর্ব। জিরে জিরে করে শশা কেটে তাতে নুন চিনি আর পাতিলেবুর রস দিয়ে মাখা সেই শশার স্যালাড এখনো ভুলতে পারিনি। গরমের দুপুরে অপূর্ব বেলের পানা করে খাওয়াত আমাদের দাদি। বড়ো ছাঁকনির অভাবে, একটা টুকরো কাপড়ের একদিক ঢাকা বারান্দার রেলিংএ বেঁধে অন্যদিক ধরে, ঘষে ঘষে বেল ছেঁকে নিয়ে তাতে চিনি আর জল মিশিয়ে সেই পানা নিজে না খেয়ে আমাদের খাওয়াত। মাঝেমধ্যে আমাদের বলত “কই, যাও তো কাঁকইটা নিয়ে এস তোমাদের চুল আঁচড়ে দিই, তেল মাখিয়ে দিই…”। তখন দুদিকে সরু দাড়ার একরকম চিরুণি পাওয়া যেত, দাদি বলত কাঁকই। আমরা নিশ্চিন্ত হয়ে বসতাম দাদির সামনে, আহা! কি যে আরাম হত! বাড়ীর কাছেই থাকতেন দাদির এক ননদ, প্রাক্তন মেয়র কমল বসুর মা, বৈশাখ মাসে দু তিন দিন বিকেলে, থালা ভর্তি বৈকালি (বৈশাখ মাসে বিকেলে ঠাকুরকে ফল মিষ্টি দিয়ে নিবেদন করা ভোগ ) পাঠাতেন আমাদের বাড়ী । গ্রীষ্মকালীন সব রকম ফল থাকত সেখানে – আম জাম লিচু ফুটি তরমুজ খরমুজ গোলাপজাম, কি নয়! সঙ্গে নানারকম মিষ্টি। দাদি এসে বসত তিনটে থালা নিয়ে, তারপর আমাদের সেসব ভাগ করে দিত। পেট ভর্তি হয়ে গেলে সেদিন আর রাতে আমদের খাওয়ার দরকারই হত না।
রোজ ভোরে দাদি যেমন নিয়মিত যেত গঙ্গাস্নানে, রোজ সন্ধ্যায় তেমনই যেত বাড়ির কাছের ভবতারিণী মন্দিরে পাঠ শুনতে। ফেরার সময় হাত ভর্তি হরির লুঠের বাতাসা নিয়ে আসত তার নাতনীদের জন্য। দাদিরই এক সম্পর্কিত আত্মীয়া, বিধবা কিন্তু দাদির চেয়ে বয়সে অনেক ছোট প্রায়ই বিকেলে আসতেন আমাদের বাড়ী। তারপর দাদির সঙ্গেই চা বিস্কুট খেয়ে রওনা দিতেন মন্দিরে। তাঁর নাম আমরা কোনোদিনও জানবার চেষ্টা করি নি, কারণ তিনি আমাদের কাছে চিরকালীন ‘গল্পদিদি’ হয়েই রয়ে গেছেন। স্কুল থেকে ফিরে তাকে দেখেই আমরা তাকে ঘিরে বসে পড়তাম, আর তিনি আমাদের গল্প বলতেন এমনভাবে, যেন বলা নয় গল্পের ছবি দেখাচ্ছেন। পরে সেসব গল্প আমরা পেয়েছি, ঠাকুরমার ঝুলি, বেতাল পঞ্চবিংশোতি বা আরব্যোপন্যাসে।
দাদির নিয়মিত রুটিনের মধ্যে আরো একটা ছিল – খবরের কাগজ পড়া। মাঝে মাঝে এর জন্য আমাদের সঙ্গে মারামারিও লেগে যেত, কে আগে কাগজ পড়বে, আমরা, না দাদি, তাই নিয়ে। এছাড়াও দাদির নিজের রামায়ণ, মহাভারতও ছিল। প্রতি বছর দাদির জন্য মোটা একটা পাঁজি আসত – দাদি তার থেকেই পূজা পাঠের দিন, একাদশী, পূর্ণিমা, অম্বুবাচী এসব দেখে নিত। দাদির চোখে ছানি পড়েইনি। ঐ বয়সে দাদি চশমা ছাড়াই বই কাগজ পড়ত, দাঁতহীন মুখেও সব কিছু খেতে পারত, আবার খালি পায়ে একতলা, দোতলাও করে বেড়াত! সত্যি দাদি ছিল আমাদের কাছে – বয়স হলেও যে কত সুস্থ থাকা যায় তার এক উদাহরণ।
চিরকাল দাদি শুধু আমাদের ভালোই বেসে গেছে, নাতি নেই বলে কোনোদিনও কোনো আফশোস করেনি, বরং কেউ কিছু বললে আমাদের পাশে দাঁড়িয়েছে, আমাদের জন্য সবসময় কিছু করতে চেয়ে ব্যস্ত হয়েছে। আজকের দিনে দাদু ঠাকুমার সঙ্গ যারা পায় না, তারা কি করে বুঝবে নাতি নাতনীর জীবনে তাদের মূল্য কি?
সপ্তম পর্ব সমাপ্ত
গোপা মিত্র
ফিজিক্স অনার্স। একসময়ে কিছুদিন শিক্ষকতা করলেও, প্রকৃতপক্ষে গৃহবধূ – কিন্তু পায়ের তলায় সর্ষে। ভ্রমণের নেশা প্রবল। ভারতের বাইরে কোথাও না গেলেও দেশের মধ্যেই প্রচুর ঘুরেছেন। পাহাড়, সমুদ্র, জঙ্গল, ঐতিহাসিক স্থান – কোনোওকিছুই বাদ নেই। এখনও সুযোগ সুবিধে হলেই বেরিয়ে পড়েন। দু-কলমের জন্যে জীবনে প্রথমবার কলম ধরা।
Very nicely described. Loved reading.
ধন্যবাদ