গোপা মিত্র
[যাদের স্নেহচ্ছায়ায়, শিক্ষায়, আদর্শে আমি বেড়ে উঠেছি বা যাদের সাহচর্যে আমার জীবনের সেরা মুহূর্তগুলি কাটিয়েছি, তাদের কেউই আজ আমাকে সঙ্গ দেওয়ার জন্য এই পৃথিবীতে বেঁচে নেই। আমার এই স্মরণিকা তাদের উদ্দেশ্যে শ্রদ্ধা নিবেদনের এক ছোট্ট প্রচেষ্টা মাত্র।]
পর্ব-৮
বাবা
ইকনমিক্সে ডক্টরেট গোল্ড মেডেলিষ্ট, আমার বাবা, একসময় পড়াত অ্যাকাউনটেন্সি, খাতা দেখত কমার্শিয়াল জিওগ্রাফি – এটুকু বললে অবশ্য বাবার সম্বন্ধে কিছুই বলা হয় না। দাদির কাছে শুনেছি, প্রথম জীবনে I.Sc পাশ করার পর ল পাশ করে বাবা, দু’একদিন কোর্টেও গিয়েছিল। কিন্তু তারপরই কালো কোট খুলে রেখে দাদিকে বলেছিল যে, এমন মিথ্যের বেসাতির মধ্যে নিজেকে জড়িয়ে রাখতে পারবে না। বুদ্ধিমতী দাদি আমার, ছেলেকে বোঝাবার চেষ্টাও করেনি, বরং পেশা পরিবর্তনের পরামর্শ দিয়েছিল। তারপরই বাবার শিক্ষাজগতে প্রবেশ। অবশ্য তার আগে নিজেকে তৈরী করে নিয়েছিল বাবা।
অগাধ পান্ডিত্য ছিল বাবার। শুধুমাত্র নিজের পড়া বা পড়ানোর বিষয়ের মধ্যেই নিজের জ্ঞানকে সীমাবদ্ধ রাখতে চায় নি বাবা। রবীন্দ্রনাথ তো ছিলই, এছাড়াও বাট্রান্ড রাসেল, বিবেকানন্দ, সেক্সপীয়ার থেকে আরম্ভ করে শার্লক হোমস্ পর্যন্ত – কোনো লেখাই বাদ দিত না বাবা। মাঝে মাঝে কোনো পত্রিকায় নিজের লেখা ছাপতেও দিত –তবে দার্শনিক সেসব লেখা বোঝার ক্ষমতা তখন তো নয়-ই এখনও বোধহয় আমার তৈরী হয় নি।
এত জ্ঞানী গুণী বাবা আমার, নিজের পড়াশোনা, আর কলেজের চাপে, আমাদের কোনদিনও নিয়মিত ভাবে পড়াশোনা দেখাতে পারে নি। তবে আমরা নিশ্চিত জনতাম,বাবার কাছে কোনো প্রশ্ন বা সমস্যা নিয়ে গেলে বাবা তার সমাধান ঠিকই করে দেবে। কি সুন্দর করে বুঝিয়ে দিত বাবা , সে যে কোনো বিষয়ই হোক্ না কেন! আমি তখন ক্লাস এইট, প্রাকৃতিক ভূগোলের একটা সমস্যা নিয়ে আমি একবার বাবার কাছে গিয়েছিলাম। বাবা শুধু বইটা খুলে একবার বুঝে নিল আমার সমস্যাটা কোথায় হচ্ছে – তারপর বইটা বন্ধ করে এমন সুন্দর করে বুঝিয়ে দিল যে, আমার মনে হল, আরে এত সহজ জিনিষটাও আমি বুঝতে পারি নি! আরো একবার ক্লাস নাইন বা টেন, আমাদের স্কুলে তখন সেক্সপীয়ারের অরিজিন্যাল ইংরাজীতে লেখা কিছু গল্প পড়ানো হত। হেডমিস্ট্রেস সেই ক্লাসটা নিতেন এবং আমাদের তাঁর করা ইংরাজীতে প্রশ্নের উত্তর ইংরাজীতেই দিতে হত। কারণ ইংরাজী ক্লাসে বাংলা বলা ছিল নিষিদ্ধ । ওল্ড ইংলিশ – বাড়ীর নিয়মমত আগে ডিক্সনারীতে মানে খুঁজলাম, পেলাম না। কিন্তু আমাকে তো পরদিন পড়া তৈরী করে যেতেই হবে, নইলে কপালে শাস্তি লেখা আছে। বাবাকে ধরলাম, বাবা যে কি সুন্দর করে বুঝিয়ে দিয়েছিল! তবে সেক্সপীয়ার তো আমাদের সিলেবাসে ছিল না, আমাদের পড়ানো হত ইংরাজী শেখার জন্য। সিলেবাসের ইংরাজী প্রেসি, সাবস্টেন্স, প্রশ্নোত্তরও বাবা বুঝিয়ে দিত। বাংলা ব্যাখ্যা, ভাবসম্প্রসারণও দেখিয়ে দিত এক অন্যরকম দৃষ্টিভঙ্গীতে।
বাস্তবে বাবা অত্যন্ত সহজ, সরল, সাদাসিদে, নিরহঙ্কারী, নির্বিরোধী হলেও ছিল দৃ্ঢ় চরিত্রের, আত্মমর্যাদা সচেতন ও ব্যক্তিত্বময়। একবার যদি কোনো সিদ্ধান্ত নিত, সেখান থেকে বাবাকে সরানো কারো সাধ্য ছিল না। আমরা তখন একটু বড় হয়েছি – ক্লাস টেন কি ইলেভেন, সেসময় থেকেই বাবার কাছে আত্মীয় স্বজনের চাপ আসতে লাগল আমাদের বিয়ের জন্য সম্বন্ধ দেখতে। তাদের বক্তব্য, “পরপর তিন মেয়ে তোমার, এখন থেকে চেষ্টা না করলে, পরে অনেক দেরী হয়ে যাবে, তখন তুমিই বিপদে পড়বে”। বাবা কিন্তু খুব দক্ষ হাতে তাদের সামলেছিল, বলেছিল “গ্র্যাজুয়েসানের আগে আমি ওদের বিয়ের কথা ভাববোই না, আগে ওরা সাবলম্বী হবে, তারপর আমি ওসব চিন্তা করব”। আমাদের ওপর ভরসা রেখেছিল বাবা এবং আমরাও বাবাকে হতাশ করিনি। যাহোক্ একই কথা বলতে বলতে হিতৈষী আত্মীয় স্বজন একদিন অবশেষে হাল ছেড়েই দিয়েছিল। তবে একটা সুবিধা ছিল বাবার, বাড়ীতে আমাদের পরিবারের সকলেই বাবার সঙ্গে সহমত ছিল বলে, বাবাকে বাড়ীতে কোনো চাপের মুখে পড়তে হয় নি এমনকি দাদিও বাবার ওপরে সবটা ছেড়ে দিয়েছিল।
পোশাক পরিচ্ছদের দিক থেকে, কাকুর একেবারেই বিপরীত ছিল বাবা। বাবার চিরকালীন পোশাক ছিল ধুতির ওপর লংক্লথের পাঞ্জাবী। এর ব্যতয় কোনোদিনও হয় নি –সে যেকোনো সভা সমিতি বা অনুষ্ঠান বাড়ি যেখানেই হোক্ না কেন! লম্বা চেহারায় ধুতির বহর ছোটো হত বলে, সবসময় পাঞ্জাবীর নিচে বেল্ট দিয়ে ধুতি পরত বাবা। এই নিয়ে মা’র খুব অভিযোগ ছিল “ তুমি একটা আর্দির পাঞ্জাবী আর কোঁচানো ধুতি পরে তো বিয়েবাড়ী যেতে পার। আমি তোমার জন্য এমন ধুতি পাঞ্জাবী কিনে দেব”। কিন্তু আমার বাবা এসব কথায় পাত্তাই দিত না, বলত “জানো না, প্রবাদে আছে , চেনা বামুনের পৈতে লাগে না। আমাকে আমার পাড়া প্রতিবেশি আত্মীয় স্বজন সকলে এই পোশাকেই চেনে, আমার পোশাক বদলের দরকার কি, পোশাক বদলালেই কি আমি মানুষটা বদলে যাব”? অবশেষে মা বলা ছেড়েই দিয়েছিল।
বাবা সব সময়েই আমাদের বলত – দেখো, ভগবান আমাদের মাথাটা দিয়েছেন দেহের একবারে ওপরে। তোমাদের মাথা যেন সবসময়ই সেইমত সোজা থাকে। এমন কিছু কোরো না, যাতে তোমাদের সেই মাথা নিচের দিকে ঝুঁকে যায়”। ঋজু চরিত্রের বাবা, আমাদের বলেছিল, “দেখো, তোমরা অন্যায় যেমন করবে না, তেমন অন্যায়কে প্রশ্রয়ও কখনো দেবেনা। তারপর রবীন্দ্রনাথ খুলে দেখিয়ে দিত, দেখো রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কি বলেছেন, ‘অন্যায় যে করে আর অন্যায় যে সহে তব ঘৃণা যেন তারে তৃণসম দহে’”।
অনেক ব্যস্ততার মধ্যেও বাবা আমাদের নিয়ে বেশ কয়েকবার বেড়াতেও গেছে, -মিহিজাম, শিমূলতলা, মাইথন। মাইথনে বাবার সঙ্গে ব্যারেজের ওপরে বেড়ানো খুব মনে পড়ে।
বাবা তখন সান্ধ্য কলেজের অধ্যক্ষ, একদিন সকালে বসে পাঁউরুটি কলা, দিয়ে ব্রেকফাষ্ট করছে, এমন সময় কলেজের একজন কর্মচারী হাঁপাতে হাঁপাতে এসে বাবাকে বলল “ আপনি শিগ্গির একবার কলেজে চলুন। দেখুন গিয়ে মেয়েরা সেখানে কি হুজ্জুতি করছে। প্রিন্সিপাল ম্যাডাম আপনাকে ডাকতে পাঠালেন’’। মর্ণিং কলেজে বাবার যাওয়ার কথাই নয়, তবুও বাবা খাওয়া ফেলে ছুটল কলেজে।
হাসিদি (হাসি চক্রবর্তী) তখন মর্ণিং কলেজের অধ্যক্ষা। বাবা গিয়ে দেখল, পরে বাবাই আমাদের বলেছিল যে, কলেজ মেরামতির জন্য যে ভারা বাঁধা রয়েছে, মেয়েরা তার ওপরে উঠে পোষ্টার মারতে চেষ্টা করছে, নানারকম স্লোগান দিচ্ছে। হাসিদির বারণ সত্ত্বেও তারা নিচে নামতে রাজী নয়। বিপদের গুরুত্ব বাবা বেশ ভালোই বুঝতে পারল, যে কোনও মুহূর্তে কেউ নিচে পড়ে গেলে একটা দুর্ঘটনা ঘটে যেতে পারে, আর তখন কলেজের ঘাড়েই সব দোষ এসে পড়বে। বাবা সেখানে গিয়ে দাঁড়িয়েই, তাদের বলল যে কোনো কথা শুনতে চাই না, আগে তোমরা নিচে নামবে , তারপর তোমাদের সঙ্গে কথা হবে। বাবার কথায় শুড়শুড় করে মেয়েরা নিচে নেমে এল। বাবার ছিল এমনই ব্যক্তিত্ব। বাবা যেন জানত বাবা গিয়ে দাঁড়ালেই সব কিছু ঠিক হয়ে যাবে! এখন হলে হয়তঃ পুলিশ ডাকা হত, আর তাতে গন্ডগোল আরো বেড়ে যেত! বাবার উপস্থিতিই সহজে সব সমস্যার সমধান করে দিল।
বাবা তখন ইউনির্ভারসিটির হেড এক্জামিনার। দিস্তে দিস্তে পরীক্ষার উত্তরপত্র এসে পৌঁছলো আমাদের বাড়ী। দোতলার সবুজ ঘরে চারিপাশে বেঞ্চি রেখে তার ওপর খাতা রাখার ব্যবস্থা হল। হ্যাঁ, মা’র নির্দেশে আমরা ‘আমাদের ঘর’ বলতাম না। মা বলত “একসঙ্গে থাকি আমরা, আমাদের ঘর তোমাদের ঘর আবার কি”? মেঝের রং অনুযায়ী মা’ই ঘরের নামকরণ করেছিল – সবুজ ঘর, লাল ঘর, নীল ঘর। সবুজ ঘর সংলগ্ন লাল ঘরকে আমরা আবার খেলার ঘরও বলতাম। ওই ঘরটা দিয়েই ছাদ মাড়িয়ে তাইমার ঘরে যাতায়াত চলত।ওই ঘরেই রাখা একটা ইলেক্ট্রীক হীটারে মা, চা দুধ বা প্রয়োজনে সামান্য জলখাবারও করত। ঐ ঘরেই সকালে, আমরা বাবা মার সঙ্গে ব্রেকফাষ্ট করতাম, সন্ধ্যায় হঠাৎ কোনো অতিথি বা মামারা এলে, সবুজ ঘর আটকা থাকলে, ওই ঘরেই তারা চেয়ার পেতে বসত, চা খেত।
যাক্ যে কথা বলছিলাম, চারিপাশে খাতার মাঝখানে গদি পেতে তার ওপর scrutinizer দের বসার ব্যবস্থা হল। বাবাও বসত তাদের সঙ্গে। দুপুর দেড়টা দুটোর মধ্যে তিন চার জন স্ক্রুটিনাইজার এসে যেতেন, তারপর প্রায় রাত নটা পর্যন্ত চলত তাদের খাতা চেক্ করা। বাবাও সমানে তাদের সঙ্গে থাকত। বাবাকে ধরে করে একদিন আমরাও বসলাম খাতা Check করতে। কিন্তু কি করলাম? বাবা শুধু আমাদের দিয়ে কয়েকটা খাতার নম্বরের যোগফল Check করালো।
রোজ সকালে সময় পেলে বাবা একবার শ্যামবাজার পাঁচমাথার মোড়ে জয়কালীর মন্দিরে যেত ঠাকুর প্রণাম করতে। ফেরার পথে আমাদের জন্য কিনে আনত লিচু, কালোজাম, জামরুল, আঙুর বা ট্যাঁপারি। এছাড়া মোড়ের দোকান ‘দত্ত বেকারী’ থেকে নিয়ে আসত লজেন্স। তখন একরকম লজেন্স পাওয়া যেত, নরম নরম চিনি মাখানো –সেই লজেন্স বাবাও যেমন খেতে ভালোবাসত তেমন আমরাও। নামী ব্র্যান্ডের চকোলেটের কাছে এসব লজেন্স আজ যেন কোথায় হারিয়ে গেছে।
সকালে ব্রেকফাষ্টের পরে বাবা মাঝে মাঝে ভিটামিন ট্যাবলেট নিজেও যেমন খেত, তেমন প্রয়োজনে আমাদেরও খেতে দিত –তবে অবশ্যই কেষ্টবাবুর সঙ্গে পরামর্শ করে। তবে একই ভিটামিন ট্যাবলেট প্রতিবার খেত না, বদলে বদলে খেত। বাবার এক অদ্ভুত থিয়োরী ছিল, একই রকম ট্যাবলেট খেয়ে গেলে আমাদের শারিরীক সুস্থতা তো একমুখীন হয়ে যাবে –তাই বদলে বদলে খাওয়া। টুথপেষ্ট, সাবান, তেল, বিস্কুট –সবক্ষেত্রেই বাবা এই নিয়ম মেনে চলত, ব্যতিক্রম ছিল শুধু লজেন্স। এই কারণেই আমাদের বাড়ীতে টুথপেষ্ট, সাবান, তেল, বিস্কুট এসব কিছুই প্রতিবার ব্র্যান্ড বদলে আসত। আমাদের মধ্যে একমাত্র, বোনটির ছিল ভীষণ সর্দির ধাত – সবসময়ই নাক দিয়ে জল পড়ছে, হাঁচি কাশি লেগেই আছে। কেষ্টবাবুর পরামর্শে বাবা বোনটির জন্য অ্যাঞ্জিয়ার্স ইমালসান (এখন পাওয়া যায় কিনা জানি না) নিয়ে এল। বেশ কয়েক শিশি সেই ওষুধ খাওয়ার পর বোনটির সর্দি বরাবরের মত গায়েব হয়ে গেল। আমাদের সবার সুস্বাস্থ্যের জন্য বাবা মঝে মাঝে ওয়াটারবেরীজ কম্পাউন্ডও নিয়ে আসত।
বাবা যতই নিজের কলেজ, পড়াশোনা নিয়ে ব্যস্ত থাকুক না কেন আমাদের পড়াশোনা বা শরীর স্বাস্থ্যের দিকে সবসময় তীক্ষ্ণ নজর থাকত। নিজে নিয়মিত দেখতে পারত না বলে বরাবরই আমাদের জন্য মাষ্টারমশাই বা পরের দিকে দিদিমণি ছিলেন। খাওয়াদাওয়া বা অন্য সবকিছু দেখার দায়িত্বটা অবশ্য মায়ের ওপরই ছিল। মায়ের কাছে টাকা থাকত, মা সেখান থেকে আমাদের প্রয়োজনমত জিনিষপত্র আনিয়ে দিত। অনেক রাতে ফিরে খাওয়াদাওয়া সেরে বাবা বসত মায়ের কাছ থেকে সারাদিনের খরচখরচার হিসেব নিতে। সেই হিসেব বাবা নিজের হিসেবের খাতায় লিখে রাখত। মাঝে মধ্যেই দেখতাম প্রায় ঘুমন্ত মা সামান্য কিছু পয়সার হিসেব মেলাতে পারছে না। বাবা অবশ্য কিছু বলত না, শুধু খাতায় লিখে রাখত, -হিসেবের গরমিল, আট আনা। মজা করে, আমরা বাবাকে জিজ্ঞেস করতাম, “ আজ কত গরমিল হল গো বাবা চার আনা না আট আনা”!
বাবার কলেজ থেকে ফিরতে রাত সাড়ে দশটা পৌনে এগারোটা বেজেই যেত। দোতলার দালানে হরেকেষ্ট বাবার খাবার ঢাকা দিয়ে রেখে শুয়ে পড়ত। খানকয়েক রুটি , একটু তরকারী আর এক বাটী ঘন দুধ – এই ছিল বাবার রাতের খাওয়া। বাবা ফিরলে পঞ্চাননও সদর দরজায় তালা দিয়ে শুয়ে পড়ত। অনেক ভোরে উঠে ওদের কাজে লাগতে হত, তাই ওদের প্রতি এমন নির্দেশ ছিল। আমি হয়ত তখন তিনতলায় বসে আমার রাত জেগে পড়া শুরু করে দিয়েছি। বোনেরাও হয়ত কোনো কিছুতে ব্যস্ত বা ঘুমিয়ে পড়েছে – সারাদিনের পরিশ্রমে ক্লান্ত পরিশ্রান্ত আধ ঘুমন্ত মা কিন্তু প্রতিদিন বাবার খাওয়া শেষের অপেক্ষায় সিঁড়ির ধাপে বসে থাকত । তারপর থালা নামিয়ে শুতে যেত।
এমনই এক রাতের পরে, সকালে বাবা বসে ব্রেকফাস্ট করছে, মা সামনে বসে এগিয়ে দিচ্ছে, হরেকেষ্ট এল চা দিতে, বাবা বলল “ হ্যাঁরে হরেকেষ্ট কাল বুঝি রাতে রুটি হয়নি”? “ কেন বড়বাবু, রুটি তো হয়েছিল”। “কাল তো রাতে রুটি রাখা ছিল না। আমি তো শুধু তরকারী আর দুধ খেয়েই শুয়ে পড়লাম। ভাবলাম আজ বোধহয় কোনো কারণে রুটি হয় নি”। মা শুনে বলল “আচ্ছা আমি তো সামনেই বসেছিলাম, আমাকে তো একবার জিজ্ঞেস করবে”। “দেখলাম, তুমি প্রায় ঘুমোচ্ছ, কোন্ ভোরে উঠতে হয় তোমাকে, তাই আর তোমাকে কিছু জিজ্ঞেস করিনি”। এমনই ছিল আমার বাবা –ভায়ে ভায়ে প্রায় একই রকম, যেমন বাবা, তেমন কাকু। পরে এই হরেকেষ্টকে বাবা পাকা চাকরী করে দিয়েছিল।
প্রাইমারী স্কুল ছেড়ে এবার আমি উচ্চমাধ্যমিক স্কুলে। এর জন্য অবশ্য বাবা বা অন্য কারোকেই কোনো চেষ্টা করতে হয় নি। আমি আমার নম্বরের জোরে নিজের যোগ্যতায় এই স্কুলে সেভেনে এসে ভর্তি হয়েছি। তখন আমি ক্লাস এইট। এবার আমায় স্থির করতে হবে, আমি Science না Arts কি নিয়ে পড়ব! ক্লাসের সবচেয়ে নম্বরে দুর্বল মেয়েদের জন্য অবশ্য Commerce ও ছিল। বাবাকে এসে বললাম যে বাবা আমি Science নিয়ে পড়তে চাই। কারণ বিজ্ঞানের যুক্তি, প্রমাণ, পরীক্ষা, আমায় ভীষণভাবে আকর্ষণ করে, তছাড়া Algebra আমার প্রিয় বিষয় –x,y,z সমাধান করে আমি ভীষণ আনন্দ পাই।
বাবা আমার কথা শুনে বলল “বেশ তো , তোমার যেটা পছন্দ সেই বিষয় নিয়েই তুমি পড়বে, এর জন্য কিন্তু তোমাকে অঙ্ক আর বিজ্ঞানে ভালো নম্বর পেতেই হবে। নিজের যোগ্যতায় তুমি যদি Science পাও আমার আপত্তি নেই। তবে মনে রেখ আমি কিন্তু তোমার জন্য কারো কাছে সুপারিশ করব না”।
হিতৈষী আত্মীয়স্বজন এসে ঝাঁপিয়ে পড়ল –“ সেকী, কেন? আপনি ইকনমিক্সে ডক্টরেট, আপনার মেয়ে ইকনমিক্স না পড়ে বিজ্ঞান পড়বে, – কেন?” “আমার সাবজেক্ট পড়তে হবে এমন তো কোনো কথা নেই। ওর যেটা পছন্দ সেই বিষয় নিয়েই ও পড়বে”। ব্যস বাবার কথা শেষ।
আমার অনেক সৌভাগ্য আমি এমন একজন বাবা তথা পরিবার পেয়েছিলাম যারা সংস্কারমুক্ত চিন্তাধারায় যুগের থেকে অন্ততঃ কুড়ি পঁচিশ বছর এগিয়ে ছিল, মেয়েদের মেয়েমানুষ বলে না ভেবে, মানুষ বলে ভেবেছিল, এমনকি তাদের স্বাধীন চিন্তাধারার মূল্য দিয়ে তাদের স্বাধীনভাবে বেড়ে ওঠার জন্য সর্বোতভাবে সাহায্য করেছিল।
লেখা শেষের আগে সেসময়ের একটা ঘটনার কথা বলতেই হচ্ছে। বাবা যখন হেড এক্জামিনার তখন বিভিন্ন কলেজের অধ্যাপক/অধ্যাপিকারা নিয়মিত আসতেন বাবার কাছ থেকে নির্দিষ্ট সংখ্যক খাতা নিয়ে যেতে, আবার দেখা হয়ে গেলে ফেরৎ দিয়ে নতুন কিছু না দেখা খাতা দেখে দেবার জন্য নিয়ে যেতে। একাধিকবার যাতায়াতের কারণে আমরা সকলেই প্রায় তাদের সঙ্গে পরিচিত হয়ে উঠেছিলাম। হঠাৎই একদিন শুনলাম, তাদের মধ্যে একজন অধ্যাপিকা আর খাতা নিতে আসবেন না। কেন? – তিনি স্যুইসাইড করেছেন। একজন শিক্ষিতা আত্মনির্ভর অধ্যাপিকা এমনটা করতে পারেন? কারণ জেনে চমকে উঠেছিলাম – তার কপালে ছোট্ট একটা শ্বেতীর দাগ ছিল। সেই দাগ অধ্যাপিকার মেয়ের বিয়ের অন্তরায় হয়ে দাঁড়াচ্ছিল। তাই শিক্ষিতা মা সন্তানের ভবিষ্যত মসৃণ করতে আত্ম বলিদান দিয়েছিলেন। এ ছিল অনেক দিন আগেকার সেই ষাটের দশকের ঘটনা। আজ স্বাধীনতার পঁচাত্তর বছর পরেও কি এমন ঘটনা বন্ধ হয়েছে? এখনও কি সন্তান না হলে মেয়েদেরই দায়ী করা হয় না? ছেলে না হয়ে পরপর দুই মেয়ে হলেও তো মেয়েদেরই দোষ দেওয়া হয়! আবার কত মা’ই তো অত্যাচারিত হলেও নিজের কথা না ভেবে, সন্তানের মুখ চেয়ে সংসারধর্ম পালন করে চলে!
আমি জানি না, কবে আমরা স্বাধীনতার প্রকৃত অর্থ হৃদয়ঙ্গম করব, কবে আমরা লিঙ্গ বৈষম্য দূর করে নারী পুরুষের সমানাধিকার স্বীকার করে নেব, কবে আমরা মানুষকে ছেলে বা মেয়ে না ভেবে শুধুমাত্র মানুষ বলেই ভাবতে শিখব!
অষ্টম পর্ব সমাপ্ত
গোপা মিত্র
ফিজিক্স অনার্স। একসময়ে কিছুদিন শিক্ষকতা করলেও, প্রকৃতপক্ষে গৃহবধূ – কিন্তু পায়ের তলায় সর্ষে। ভ্রমণের নেশা প্রবল। ভারতের বাইরে কোথাও না গেলেও দেশের মধ্যেই প্রচুর ঘুরেছেন। পাহাড়, সমুদ্র, জঙ্গল, ঐতিহাসিক স্থান – কোনোওকিছুই বাদ নেই। এখনও সুযোগ সুবিধে হলেই বেরিয়ে পড়েন। দু-কলমের জন্যে জীবনে প্রথমবার কলম ধরা।
Khoob bhaalo laaglo. Dadu ke pronaam.
Thank you .