Home প্রবন্ধ, সাহিত্য ও সংস্কৃতি জাদুর ট্রাংক ও বিবর্ণ বিষাদেরাঃ জাদুবাস্তব গল্পপর্ব
প্রবন্ধসাহিত্য ও সংস্কৃতি

জাদুর ট্রাংক ও বিবর্ণ বিষাদেরাঃ জাদুবাস্তব গল্পপর্ব

এমরান হাসান

বর্তমান বাংলাসাহিত্যের সবচেয়ে জনপ্রিয় মাধ্যম ছোটগল্প। ছোটগল্পের আদল এবং নান্দনিক প্রেক্ষাপট বিচারে বাংলাদেশের ছোটগল্পের আলাদা অবস্থান রয়েছে এটি নির্দ্বধায় বলা যায়। বাংলাদেশের ছোটগল্পের রচনাশৈলীতে ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে গত শতাব্দীর পঞ্চাশে দশকের থেকেই। ১৯৪৭ সালের দেশভাগ এবং ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন ৬৯ এর গণঅভ্যুত্থান ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধ বাংলাদেশের সমগ্র সাহিত্যকে চরমভাবে নাড়িয়ে দিয়ে গিয়েছিল।বাদ পড়েনি ছোটগল্পও। এসময়ের অনেকেই তাদের আত্মজীবনীমূলক রচনা,যাপিত জীবনকে গল্পের আদলে তুলে ধরেছেন পাঠকের সামনে, আবার অনেকেই সমাজের বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের জীবনাচারকে তাদের গল্পের ভেতর সুনিপুণভাবে তুলে ধরতে পেরেছেন। গত শতকের শেষের দিকে অর্থাৎ নব্বই দশকের শুরুতে বাংলা কথাসাহিত্য আরো একবার বাক বদল করে চরম উৎকর্ষতার পথে। এই সময়ের ছোটগল্পে রাষ্ট্রচিন্তা রাজনৈতিক ভিন্ন দর্শন ফুটে ওঠে চমৎকার ভঙ্গিমায়‌। 

পরবর্তীতে সময়ের পরিবর্তনে বদলায় সমাজ, বদলায় সমাজের মানুষের চিন্তা,সেই সাথে বদলায় গল্পকারদের গল্প লেখার ভঙ্গিমা, উপকরণ এবং অনুষঙ্গ। এই বিবর্তিত অনুষঙ্গের ভেতর যারা বর্তমান কথাসাহিত্যে অগ্রগণ্য

নাহিদা আশরাফী তাদের একজন। তার গল্পগ্রন্থ ‘জাদুর ট্রাংক ও বিবর্ণ বিষাদেরা’তে সূচিবদ্ধ চৌদ্দটি গল্প বাংলাদেশের ছোটগল্পের পাঠক এবং লেখক সমাজের মাঝখানে তৈরি করে দিয়েছে একটি অসম্ভব সুন্দর মেলবন্ধন। বস্তুত এই গ্রন্থের গল্পগুলোকে নাহিদ আশরাফী একেবারেই ভিন্ন আঙ্গিকে সাজাতে চেয়েছেন। তার নিজস্ব চিন্তা এবং সময়ের দাবি মাথায় রেখে তিনি তৈরি করেছেন স্বতন্ত্র এক গল্পভাষাশৈলী যা পাঠকের মনে তীক্ষ্ণভাবে দাগ কাটতে সক্ষম।

একজন লেখক এর দায় তার সমাজের প্রতি শতভাগ বললেও ভুল হবে বরঞ্চ তার চেয়ে অনেকগুণ বেশি। সেই দায় থেকেই নাহিদা আশরাফী তৈরি করেছেন তাঁর এই গ্রন্থের চৌদ্দটি গল্প। গল্পগুলোতে স্বাভাবিকভাবে দেখতে গেলে নারীবাদী চিন্তার স্বতন্ত্র ছায়া চোখে পড়ে কিন্তু আরো গভীর পাঠকের মগজ দিয়ে প্রতিটি গল্পের প্রতিটি চরিত্র বিশ্লেষণ করলে খুব সাবধানী চিন্তায় ভেসে ওঠে পুরুষশাসিত সমাজের ভালোচিন্তার মুখোশের আড়ালে শত সহজ নোংরা মুখচ্ছবি। এই প্রেক্ষাপটকে গল্পকার তার নিজস্ব ঘরানায় সাজিয়েছেন। তিনি দেখিয়েছেন সমাজের নানা অসঙ্গতি ভেতরে কয়েকজন প্রতিবাদী মানুষের বেঁচে থাকার সাহসী চিত্র। সে চিত্রগুলো আমাদের সবার পরিচিত। আমাদের সমাজে প্রতিদিন তাদের দেখা মেলে বিভিন্নভাবে। আমরা আপ্লুত হই তাদের কথায়, কখনোবা প্রতিবাদী হয়ে ওঠি সমাজের ওইসব নোংরামির বিরুদ্ধে। কিন্তু কন্ঠ ছেড়ে বা সরাসরি কোন প্রতিবাদে সামিল হতে পারি না। একজন সচেতন নাগরিক হিসেবে এই জায়গাটিতে আমরা চরম ব্যর্থতার পরিচয় দিচ্ছি প্রতিনিয়ত। নাহিদা আশরাফী বিষয়গুলোকেই চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছেন তার পাঠকদের। তিনি খুব সূক্ষ্মভাবে আঘাত করেছেন সমাজের বিভিন্ন অসঙ্গতির গায়ে।

‘জাদুর ট্রাংক ও বিবর্ণ বিষাদেরা’ গ্রন্থের প্রতিটি গল্প সাবলীল ভাষায় রচিত হলেও এর গভীরতা এবং ভাবগাম্ভীর্য একেবারেই অন্য মাত্রায় আঘাত করেছে সমাজের বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার অনৈতিকতার বিরুদ্ধে। গল্পের ছলে- কৌশলে নাহিদা আশরাফী খুব স্বাভাবিক ভাবেই এঁকেছেন জীবনের চলচ্চিত্র। ‘হাওলাদার সাহেবের বিশ টাকা’ গল্পে খুব সাবধানে তিনি দেখিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছেন মধ্যবিত্ত পরিবারের একজন মধ্যবয়সী মানুষের মনস্তাত্ত্বিক দ্বন্দ্বকে। বাংলা সাহিত্যে জাদুবাস্তবতা ব্যবহারের এক চরম উদাহরণ এসব গল্প। আমাদের চারপাশের সমাজে এই ধরনের ঘটনা অহরহ ঘটে চলছে, কিন্তু বাংলাদেশের কথাসাহিত্যে এই সমস্ত ঘটনাগুলোকে গল্পের আদলে তুলে আনার প্রচেষ্টা করেছেন খুব কম সংখ্যক গল্পকার। এ মন্তব্য অত্যুক্তি হবে না বোধ করি। নাতিদীর্ঘ এই গল্পের প্রতিটি অংশ পাঠককে তীব্র বাস্তবতার সামনে দাঁড় করাবে দৃঢ় বিশ্বাসের সাথে বলা যায়। সারাদিনের যাবতীয় খরচ শেষ হয়ে যাবার পর এক মধ্যবিত্ত পরিবারের কর্তা যখন হিসেবের গোলমালে নিজের সমস্ত চিন্তা এবং ভাবনাকে নিয়োজিত করেন তখন পাঠকের মগজের হয়তো অন্যরকম ভাবনা দ্যূতি স্পষ্টভাবে ফুটে উঠবে।

একথা সর্বৈব সত্য যে,একজন গল্পকার যখন কাগজ-কলমের নিবিড় প্রেমে লিখতে বসেন তার নিজস্ব অনুভূতিগুলো তখন রাত জাগা কোন এক ভাবনা থেকেই প্রস্ফুটিত হতে থাকে,উজ্জ্বল হতে থাকে কাগজ কলমের সান্নিধ্যে। এই পরিস্থিতির ব্যতিক্রম ঘটেনি নাহিদা আশরাফীর এই গ্রন্থের গল্পগুলোতে। তিনি জীবনকে যেভাবে দেখেছেন এবং যেভাবে যাপিত জীবনের নানা ঘাত-প্রতিঘাত কে উপলব্ধি করেছেন হয়তো হুবহু সেগুলোই তিনি তুলে এনেছেন তাঁর প্রতিটি গল্পে। পাঠকের চিন্তা ঠিক অন্য জায়গায় আঘাত করবে এই গ্রন্থের প্রতিটি গল্প পাঠের পরে। অজানা এক রহস্যের দিকে পাঠক সমাজকে টেনে নিয়ে যেতে সক্ষম ‘জাদুর ট্রাঙ্ক ও বিভিন্ন বিষাদেরা’ গ্রন্থটি।

এই গ্রন্থের প্রথম গল্পের চরিত্র সবিতা। ‘সাদা বাস কালো গাড়ি’ শিরোনামের এই গল্পের সবিতার মতো হাজারো সবিতা আমাদের সমাজের টিকে রয়েছেন যারা সাংসারিক টানাপড়েন আর জীবনের অসহ্য নোংরা অভিজ্ঞতাগুলোকে কোনদিন প্রকাশ করতে পারেনা কেবলমাত্র পরিবারের সম্মান এবং ভরণপোষণের দিকে তাকিয়ে। সময়ের প্রয়োজনে জীবনের বাস্তবতার কাছে হার মেনে তারা সবকিছু মুখ বুজে সহ্য করে। আশ্চর্য রকমের সত্য তুলে ধরেছেন নাহিদা আশরাফী এই গল্পের প্রতিটি বাঁকে। তার প্রতিটি গল্প যেন জাদুর ট্রাংক থেকে উঠে আসা একেকটি বিবর্ণ বিষাদ! 

এই গ্রন্থের অন্য গল্পগুলোকে পাঠক তার নিজস্ব চিন্তার সাথে সহমত পোষণ করে পাঠ করতে পারবেন, কেননা বাস্তবতার নিরিখে রচিত এই গল্পগুলো অনেক অপ্রিয় সত্য এবং সমাজের মুখোশধারী মানুষের সত্যিকার চরিত্রকে উন্মোচন করেছে। এ মন্তব্য নির্দ্বিধায় করা যায় ‘জাদুর ট্রাংক ও বিবর্ণ বিষাদেরা’ গ্রন্থ সম্পর্কে। এ গ্রন্থের সবগুলো গল্পের ভেতর লুকিয়ে আছে খুব সাধারন মানুষের গোপন দীর্ঘশ্বাস এবং তাদের আত্মজৈবনিক টানাপোড়নের ইতিকথা বাংলা সাহিত্যের এক অনন্য দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে। গল্পের ভেতরে নাহিদা আশরাফী নাগরিক জীবনকে এঁকেছেন ঠিকই তবে মধ্যবিত্ত জীবনের নানামুখী টানাপোড়েনের মাধ্যমে যে জটিলতা তৈরি হয় তাকে উপজীব্য করে। তার সাথে তিনি নান্দনিক জাদুবাস্তবতাকে মিশিয়েছেন চমকপ্রদ পরিস্থিতির ভেতর দিয়ে।

এই গ্রন্থের একটি ব্যতিক্রমী গল্প ‘দ্বিতীয় ও শেষ চিঠি’। এই গল্পের প্রেক্ষাপট সাধারণ পরিস্থিতিতে মানুষের মনস্তাত্ত্বিক দ্বন্দ্বের সাথে সামাজিক অবস্থানের বিরোধ। আপাতদৃষ্টিতে গল্পটি পড়ার পর মনে হতে পারে, কোনো রোমান্টিক সিকুয়েন্স নিয়ে গল্পটি বয়ে চলেছে এক সুন্দর সমাপ্তির দিকে। আবার পরমুহুর্তেই পাঠকের মনে হতে পারে গল্পটির শেষ এইভাবে না হলেও হয়তো ভালো হতো। একজন পাঠক হিসেবে যে কেউ গল্পের মানদণ্ড বিচার করতে পারেন খুব সহজেই সে অধিকার অবশ্যই পাঠকসমাজের রয়েছে। জীবনের নানামুখী সুর নাহিদ আশরাফী ফ্রেমবন্দি করতে পেরেছেন তার ‘জাদুর ট্রাংক ও বিবর্ণ বিষাদেরা’ গ্রন্থে। একজন সত্যিকারের সমালোচক মাত্রই এই গ্রন্থটি পাঠের পর প্রকাশ করতেই পারেন তার নিজস্ব ভাবনা। স্বাভাবিক দৃষ্টিকোণ থেকে এই গ্রন্থের প্রতিটি গল্প পাঠের পর পাঠক তার মনোজাগতিক ভাবনার অনেক গভীরে গিয়ে হোঁচট খেয়ে যাবেন অকস্মাৎ। হয়তো ভাবতে পারেন যেভাবে তিনি পড়তে শুরু করেছিলেন প্রতিটি গল্প, শেষ করার পর তার ভাবনা ভিন্ন এক জগতের পথে হাঁটতে শুরু করেছে। সে জগত বাস্তবিক চিন্তা থেকে আরো গভীরে জাদুবাস্তবতার পথে, অস্তিত্ববাদী কন্ঠের আর্তচিৎকারের পথে। 

বস্তুত প্রতিটি মানুষই অস্তিত্ববাদী চিন্তার ভেতরেই বসবাস করে এ কথা আমরা সবাই জানি কিন্তু গল্প তৈরীর ক্ষেত্রে একজন গল্পকার কিভাবে তার চিন্তাকে সুনিপুন হাতে সার্বজনীন করে তুলতে পারেন সেটি এই গ্রন্থ থেকে খুব সহজেই প্রতিয়মাণ হয়। গল্পকার তার লেখার মাধ্যমে সমাজ জীবন,রাষ্ট্রীয় জীবন,পারিপার্শ্বিক জীবনকেই কথার ফ্রেমে বন্দী করতে চাইবেন– এটি খুব স্বাভাবিক, তবে নাহিদা আশরাফী এই পথে হেঁটে যাননি মোটেও। তিনি তার নিজস্ব অভিব্যক্তি প্রকাশ এর স্বার্থেই কাগজ কলম নিয়ে বসেছিলেন হয়তো খুব স্বাভাবিক কোন প্লট কিংবা কাগজ-কলমের ভ্রমণের সাথে নিজের হৃদয়কে সঙ্গী করতে। অথচ তার এই গ্রন্থের প্রতিটি গল্প একজন সচেতন পাঠক কে খুব সহজে টেনে নিয়ে যাবে অনন্ত এক অস্তিত্ব বিজড়িত বোধ এবং জীবনকল্পের দিকে। এই গ্রন্থের অন্যান্য গল্পগুলোর সাথে ‘বৃষ্টি ও শাড়ীর গল্প’, ‘তালেব বুড়োর বিজয় দর্শন’, ‘পার্সেল’, ‘মেয়েটি ও একটি অসম্পাদিত গল্প’,’ধারা বহমান’, ‘অমল ধবল শিউলি খালা, ‘আলো কথা’, ‘ডায়রি’ শীর্ষক গল্পগুলো বাংলা ছোটগল্পের বাগানে একেকটি প্রস্ফুটিত পুষ্প যা প্রতিনিয়ত সৌরভ ছড়াবে পাঠক-মনোভূমির নিজস্ব উদ্যানে।

Author

Du-কলম

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!