কল্যানী মিত্র ঘোষ
প্রায় সতেরো বছর দেশ ছাড়া, এখন তো এই আমেরিকাই আমার দেশ, আর কি “বাংলার মাটি, বাংলার জল” বলে কান্নাকাটি করলে মানায়? কিন্তু পোড়া মন যে মানেনা। শ্বশুর বাড়ি এলে কি বাপের বাড়িতে ফেলে আসা মধুর স্মৃতি ম্লান হয়ে যায়? আমি ছোট থেকেই শ্যাওলার মতো ভেসে বেড়িয়েছি, বাবার ছিলো বদলীর চাকরী, আজ এই জেলায় তো দু বছর পর আর এক জেলায়। নতুন স্কুল, নতুন বন্ধু, নতুন ভালোলাগা, কিন্তু যেহেতু একই রাজ্যের মধ্যে তাই উৎসবের খুব একটা কোনো তারতম্য হয়নি। আর অর্ধেক জীবনটাই যে প্রতিদিন কোনো না কোনো উৎসবের মধ্যে কেটে গেছিলো সেটা আজ এই মধ্যবয়সে সুদূর বিদেশে বসে অনুভব করছি।
ক্লাস সিক্সের পর কলকাতায় ঠাকুর্দার বাড়িতে এসে মোটামুটি স্থিতু হয়েছিলাম, সেটা ছিল যৌথ পরিবার, আর সেই পরিবারে যেকোনো উৎসবই মহোৎসব। সব থেকে যেটা আমাদের বাড়ি ঘটা করে পালন করা হতো তা হলো কালী পুজোর দিন লক্ষ্মীপুজো। সংসারের অলক্ষ্মী কে মোটামুটি পিটিয়ে বার করা হতো,আর সেই সঙ্গে লক্ষ্মীর উপাসনা করা হতো। মা,কাকিমা, জেঠিমারা সারাদিন নির্জলা উপোস, মাঝে মাঝে লিকার চা চলতো, আমরা নিরামিষ খেতাম।
আমি আঁকতে ভালবাসতাম বলে গোটা তিনতলা বাড়ি সারা দুপুর ধরে আলপনা দিতাম, তার আগে মা চাল বেটে দিতেন , তুলো দিয়ে তুলির কাজ সারতাম। মা কতগুলো বিশেষ আলপনা শিখিয়ে দিয়েছিলেন, লক্ষ্মীর পা, ধানের শীষ ইত্যাদি এর সঙ্গে নিজের মস্তিষ্ক প্রসূত কিছু কারিকুরি। সন্ধ্যেবেলা সবাই এসে যাতে প্রশংসা করেন তার জন্য প্রচুর পরিশ্রম করতে হতো, আমার খুড়তুতো বোনকেও মাঝে মাঝে সঙ্গী পেতাম। বাড়ির সামনের মাঠ থেকে দূর্বা ঘাস তুলে আনা, পূজোর সময় ঘণ্টা বাজানো, ধূপ নিভলেই আর একটা জ্বালানো, ফল কাটা, আরতির পর পঞ্চপ্রদীপ নিয়ে সবাই কে তাপ বিতরণ, বাড়ি বাড়ি প্রসাদ দিয়ে আসা এরকম কত শত কাজের দায়িত্ব পেয়ে নিজেকে বড্ড গুরুত্বপূর্ণ মনে হতো।
দূর্গাপুজোর দিনগুলো স্বপ্নের মতো কাটতো, ইউনিভার্সিটি তে যাওয়া অবধিও সেই উদ্দাম উল্লাসে কোনো ভাঁটা পড়েনি। কলকাতার বাইরে থাকা কাকা তাঁর পরিবারসহ আমাদের পৈত্রিক ভিটের টানে চলে আসতেন। কি আনন্দ আমাদের ভাই বোনেদের, মনে হতো দিনগুলোকে দড়ি দিয়ে আষ্ঠে পৃষ্ঠে বেঁধে রাখি, কিন্তু তবু তারা পিছলে বেরিয়ে যেতো, অন্যান্য দিনের থেকেও যেন বেশী তাড়া থাকতো তাদের।
আমরা বোনেরা ওই উৎসবের কটা দিন চুটিয়ে সাজতাম, তারও দু মাস আগে থেকে পূজোর লেটেস্ট ফ্যাশনের সঙ্গে তাল রেখে জামা কাপড় কেনা হতো, কোনওবার ম্যাক্সি স্কার্ট, কখনও পাঠান স্যুট, মিডি, সালোয়ার কামিজ ইত্যাদি ইত্যাদি। তারপর ওই পাঁচদিন সকাল বিকেল নতুন পোশাক আর শ্যাম্পু করা চুলে চোখে একরাশ প্রত্যাশা নিয়ে ঠাকুর দেখতে যাওয়া হতো, কোনো মুগ্ধ চোখে চোখ পড়লে বুকের মধ্যে হাল্কা ভালো লাগার স্রোত বয়ে যেতো।
আমাদের বাড়িতে আরও একটি বিশেষ অনুষ্ঠান বেশ ঘটা করে করা হতো, সেটি হলো দশমী তে পাড়ার ঠাকুর বিসর্জন হয়ে যাবার পর মা দূর্গা কে চিঠি দিয়ে আবার পরের বছর আসার জন্য আগাম নিমন্ত্রণ করে রাখা।
সন্ধ্যেবেলা একটি বড় ঘরে মা দূর্গার ছবি টি নামিয়ে সুন্দর করে সাজানো হতো। এরপর বাড়ির বয়োজ্যেষ্ঠ এই অনুষ্ঠানের উদ্বোধন করতেন। তিনটি পাতাই অটুট আছে এরকম এক একটি বেলপাতা নিয়ে তাতে বেলপাতার কাঠি আলতায় ডুবিয়ে লিখতে হতো “শ্রী শ্রী দূর্গা সহায়”, ওটাই চিঠি, তারপর সেই পাতাটি মায়ের পায়ের কাছে রেখে মাকে সিঁদুর পরানো এবং মিষ্টি খাওয়ানো হতো, মায়ের কানে কানে বলতে হতো, “আসছে বছর আবার এসো মা!” বাড়ির প্রতিটি সদস্যের বয়োক্রম অনুযায়ী এই আচার লম্বা সময় ধরে চলতো এবং একদম শেষে আমার ডাক পড়তো।
এবার শুরু হতো বড়দের প্রণাম করা, সমবয়সীদের কোলাকুলি , ঘুগনি, নিমকি, মালপোয়া সহযোগে “বিজয়া”! সেই সঙ্গে মন খারাপও একটু একটু শুরু হতো, আবার প্রতীক্ষা আগামী বছরের, কিন্তু উৎসব এখনও শেষ হয়নি, লক্ষ্মী পুজো, কালী পুজো, খ্রীস্টমাস (সেও পুজোর ই মতো ), এইরকম উৎসবের ঢেউ এ ভাসতে ভাসতেই বড় হয়ে ওঠা।
উৎসব মানেই মহাভোজ, নিরামিষ বা আমিষ যাই হোক না কেন, ওই দিন গুলোতে সব সময় একটু বিশেষ ছোঁয়া রান্নাতেও লাগে। যেমন বিজয়া বা লক্ষ্মী পুজো যেন নারকেল নাড়ু ছাড়া অসম্পূর্ণ, অষ্টমীর খিচুড়ি আর লাবড়া, নবমীতে পাঁঠার মাংস, বড়দিনে কেক, ঈদ এ উমদা বিরিয়ানি আর সেমাই। আহা, এত রকমের আয়োজন ভাবাই যায়না!
এ তো গেলো সব প্রধান উৎসব, আর ছোট খাটো যেগুলো? সত্যনারায়ণ পুজো, জন্মদিন, বিবাহ বার্ষিকী, বিয়ে বাড়ি …. অন্তহীন আনন্দমেলা। ধর্মের সঙ্গে জুড়ে আছে বেশীরভাগ উৎসব, কিন্তু ধর্ম ছাড়াও যেগুলো রয়েছে সেগুলো ও নেহাৎ কম তাৎপর্যপূর্ণ নয়; একসঙ্গে বসে ক্রিকেট বা ফুটবল ম্যাচ দেখা, বাড়িতে হই হই কাণ্ড, ইলিশ অথবা চিংড়ির গন্ধে বাড়ি ম ম, পাড়ার অনেকেই একসঙ্গে জড়ো হতেন, ঘন ঘন কাপের পর কাপ চা আর তৎসঙ্গে টা।
এরপর কর্মসূত্রে বেশ ক বছর গুরগাঁও তে থাকার সুবাদে সেখানকার নানা উৎসবে যোগ দিতাম, নবরাত্রি, ডান্ডিয়া, দসেরা, হোলি, দিওয়ালী, কড়ওয়া চৌথ ইত্যাদি। শেষেরটি সিঁদুর খেলার মতই আমার অপছন্দের একটি অনুষ্ঠান, যদিও ভীষণ ভীষণ দামী শাড়ী গয়নায় সুসজ্জিতা পতিগতপ্রাণা সুন্দরী মহিলাদের দেখতে বেশ ভালই লাগতো। স্বামীদের মঙ্গল কামনায় সারাদিন নির্জলা উপবাস করে চাঁদ ও স্বামীকে দেখে তারপর কিছু মুখে দেন, বড় বড় বহুজাতিক সংস্থার উচ্চপদে অধিষ্ঠাত্রী মহিলাদেরও এটা শ্রদ্ধার সঙ্গে পালন করতে দেখেছি, বাংলার যেমন শিবরাত্রি, অনেকটাই সেরকম।
এরপর যখন আমেরিকাতে এসে পড়লাম, হঠাৎ করেই এক ঝটকায় সব কেমন ফাঁকা হয়ে গেলো, কেউ কোত্থাও নেই, কোনো অনুষ্ঠান করতেও গায়ে জ্বর আসতো, সেজেগুজে কি লাভ? কেই বা দেখবে? পুজো আর্চার দিনে গুগল থেকে মন্দির খুঁজে বার করে সেখানেই চোখের জলে মনের কথা অঞ্জলী হয়ে বেরিয়ে আসতো। এরপর ধীরে ধীরে খুঁজে পাওয়া গেলো এক বাঙালী সংগঠন, স্যান ডিয়েগোর “সৈকত”, ধড়ে প্রাণ এলো , দূর্গা পুজো …. হোকনা মোটে দু দিন, তবু তো শাড়ী , গয়না পরে মার মূর্তির সামনে পুষ্পাঞ্জলী দিতে পারবো, আরো শ পাঁচেক বাঙালীর সঙ্গেও মোলাকাত হবে, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, ধুনুচি নাচ সব হবে, উফ্ কি আনন্দ!
এরপর আনন্দে, হাসি ,খেলায় ষোলো বছর পেরিয়ে গেলো, তারপর এলো এই ভয়ানক কোভিড ১৯, সব আনন্দ কলতান এক লহমায় স্তব্ধ। এই দূর্গা পুজো হবে ঘরে বসেই, অনলাইনে, এটাই একমাত্র উপায় অদৃশ্য জীবাণুর সঙ্গে যুদ্ধে জিতে যাওয়ার। এই অশুভ শক্তি আমাদের উৎসবে বাধা সৃষ্টি করতে পারবেনা, স্যান ডিয়েগোর বাঙালীরা কোমর বেঁধে নেমে পড়েছেন এক “অন্য উৎসব” যজ্ঞে ….. নানাবিধ অনলাইন জলসা, নাটক, পুজো, অঞ্জলী, প্রসাদ ও খাবার বিতরণ, সব ব্যাবস্থাই নিখুঁত।
আশাকরি পবিত্র মন্ত্রোচ্চারণের মাধ্যমেই মা’কে আরো নিবিড় করে পাবো এবার। অন্যবার জাঁকজমক ও অন্যান্য বাহ্যিক আড়ম্বরে মাকে সেভাবে ডাকা হয় না, এবারে নির্জন গৃহকোণ থেকে আমাদের প্রার্থনা, “বিপদে আমি না যেন করি ভয়!”
সমাপ্ত
১৪ই অক্টোবর, ২০২০
আলোকচিত্র সৌজন্য : কল্যানী মিত্র ঘোষ