Home সামাজিক, গল্প তথাস্তু
সামাজিকগল্প

তথাস্তু

তানিয়া দত্ত ঘোষ

দেখতে দেখতে এক বছর হয়ে গেল, এ বাড়িতে বিয়ে হয়ে এসেছে রাই। ছোট পরিবার, রাইয়ের স্বামী শুভ্র, ওর বাবা, মা আর ছোট বোন, শ্রুতি। নিরুপদ্রব সংসার। শাশুড়ি-মায়ের সাথে বনিবনা হয় না, এমন অনেক কথা শুনেছে বন্ধু বান্ধবের কাছে,  রাই। কিন্তু এখনো অবধি তার সেভাবে কোন সমস্যা হয়নি। শাশুড়ি-মা ভদ্র মহিলা অতি সুন্দরী, এখনও, এই পঞ্চান্নর কাছাকাছি বয়সেও। কিন্তু স্বভাবটি খুব নরম। মেজাজ এই বাড়িতে শ্বশুর মশাইয়ের। রাই লক্ষ্য করে দেখেছে যে সবার সামনেই উনি মাকে কটু কথা বলতে ছাড়েন না। এক সময় উচ্চপদস্থ সরকারী আমলা ছিলেন, তার রেশ রয়ে গেছে স্বভাবে। “আমিই এ বাড়ির সর্বময় কর্তা”, এই বোধটা ওনার মধ্যে  সব সময় কাজ করে।  বাস্তবিক, বাড়িটাও যেন ওনাকে কেন্দ্র করেই ঘোরে। তার স্বামী শুভ্র আছে মিডিয়া জগতের সাথে যুক্ত। ‘দাদা’-র বোনটি এম. কম.-এর ছাত্রী। এ বাড়িতে বাবার মুখের ওপর কথা বলার সাহস একমাত্র সেই রাখে। মাঝে সাঝে তো রীতিমতো ধমকও লাগায়। আমলা-বাবু তার ছোট মেয়েটির কাছেই একমাত্র খানিক জব্দ। বারান্দায় দাঁড়িয়ে চায়ের কাপ হাতে নিয়ে এইসব কথাই ভাবছিল রাই। আজ চা করেছেন শাশুড়ি মা। এ বাড়িতে রান্নাঘরে ঢোকার পর থেকেই, কাজ ভাগ করে দিয়েছেন মা। শ্রুতি পড়ুয়া বলে একটু ছাড় আছে তার। রবিবারের চা-টা শাশুড়ি মাই করেন। রাই রান্না ঘরে ঢুকলেই ধমক লাগান। তাই এইটুকু আয়েস সে উপভোগ করে, রবিবার সকালটাতে।

কিন্তু আজ আর উপভোগ করলে চলবে না, আজ প্রচুর কাজ আছে। বেডরুমে ঢুকে, ঘুমন্ত  শুভ্রকে একটু  “ওঠো ওঠো” বলে খুঁচিয়ে দিয়ে নিচে রান্নাঘরের দিকে পা বাড়ায় সে। শুভ্র বাঁ পাশ থেকে ডান পাশে ফিরে আবার ঘুমোতে থাকে।  আজ বাড়িতে অতিথি আসার কথা। সদ্য একটু একটু করে কলকাতা শহরে  লক ডাউন খোলা শুরু হয়েছে। আজ তাই পিসী শাশুড়ির আগমন ঘটবে এ বাড়িতে। ওনার এক মেয়ে, এক ছেলে। মেয়ে বড়, ইউ.এস.এ. বাসিনী, আর ছেলে ছোট, ব্যাঙ্গালোরে ইঞ্জিনিয়ার। পিসেমশাই আর পিসিমণি দুজনে আজ মেয়ে তো কাল ছেলের কাছে ঘুরে বেড়ান। এই জুন মাসেও তো ইউ. এস. এ. যাবার কথা ছিল। কিন্তু বাদ সাধলো বিশ্ব জুড়ে মহামারীর প্রকোপ। তাই কাটা টিকিট ক্যান্সেল করতে হলো। 

এই সময় কেউই কারো বাড়ীতে যাচ্ছে না, কিন্তু পিসিমণিদের আসার পেছনে অনেকগুলো কারণ আছে। এক লক-ডাউনে বাড়িতে থেকে থেকে হাঁপিয়ে গেছেন, দুই, মেয়ের কাছে যেতে না পারার দুঃখ ভোলা দরকার, আর তিন হ’ল, ছেলের বিয়ের সম্মন্ধ দেখছিলেন, তার থেকে চারটি মেয়েকে পছন্দ হয়েছে, সেই ব্যাপারে ফাইনাল  ডিসিশন নিতে হবে। দাদার মতামত ছাড়া বোন এ সব সিদ্ধান্ত মোটেই নেন না। বাবা, মানে শ্বশুর-মশাই তো বোন আসবে বলে বৌকে এটা রাঁধবে, ওটা রাঁধবে বলে অস্থির করে রেখেছে আগেই। এই দুঃসময়েও নিজে গিয়ে বাজার করেছেন বোন, ভগ্নীপতির জন্য। কচুর শাক, সর্ষে-পাবদা, মোচা-চিংড়ি, কিছুই বাদ নেই মেনুতে।  শাশুড়ি কিন্তু এত রান্না নিয়ে কোন আপত্তি করেন নি, এটা লক্ষ্য করেছে রাই। অবশ্য বাবাকে যতটুকু চিনেছে এই এক বছরে, তাতে মায়ের কোন ওজর আপত্তিতে কান দেবার মানুষই ইনি নন। রান্নাঘরে ঢুকে দেখল মা ইতিমধ্যেই শুরু করে দিয়েছেন সব্জি কাটাকাটি। রাইও এগিয়ে গেল, “দিন মা, মাছটা আমি ধুয়ে দিই”। 

রান্নার সাথে সাথে চলে জলখাবার তৈরি আর শ্বশুর-মশাইয়ের চোদ্দবার চায়ের ফরমাস মেটানো। রাই দেখে এই গরমে মা দরদর করে ঘামছেন কপাল বেয়ে নামছে ঘাম টপ টপ করে, “যান তো মা, একটু ফ্যানের নীচে বসুন, দুজনে একসাথে ঘেমে কাজ নেই, ততক্ষণ আমি দেখছি।” শান্তিতে বসতেও পারেন না শ্বশুর-মশাই, আবার এসে শুরু করেন তদারকি। মনে মনে শ্বশুরের ওপর বিরক্ত হয় রাই, এ কী! এতো অসংবেদনশীল মানুষ কেন উনি!  মা’রও তো বয়স হচ্ছে, তার ওপর জুন মাসের গরমে চার-পাঁচ পদ রান্না করা। মায়ের মুখটা গরমে ঘেমে লাল হয়ে উঠেছে। রাই অবাক হয়ে দেখে মায়ের ফরসা রঙ যেন আরো ফরসা লাগছে। রাই নিজেও যথেষ্ট ফরসা।  বিয়ের পর পর আত্মীয় স্বজনরা এলে বা কারো বাড়িতে গেলে অনেকেই বলতো তার শাশুড়ি কে- “নীপা, তোমার ছেলের বৌ তো গায়ের রঙে তোমাকে ছাড়িয়ে গেছে”। এই ধরনের কথায় রাই বিরক্ত হতো। গায়ের রঙ বা বাহ্যিক রূপ নিয়ে কথা বলা ব্যাপারটাই তার রুচিতে বাঁধে। খুব  তীব্রভাবে না হলেও রাই মৃদু ভাবে সে কথা জানিয়েও দিয়েছে দু’এক জনকে। তার জন্যে আবার অহংকারী বলে সুনামও জুটেছে তার। আসলে নীপবীথি, মানে তার শাশুড়ি মায়ের গায়ের রঙ নিয়ে একটু প্রচ্ছন্ন অহংকার ছিল। রাই সেটা বুঝতে পারতো। একদিন গল্পচ্ছলে উনি বলেই ফেলেছিলেন যে, ওনার আগে শ্বশুর মশাইয়ের জন্য নাকি জনা পনেরো পাত্রী দেখেছিলেন ওনার শাশুড়ি  মা। তারপর ওনার গায়ের রঙের জন্য সবাইকে ছেড়ে ওনাকে পছন্দ হয় বাড়ির সকলের। মনে মনে ভাবে রাই- “বোঝ! বাবার নিজের তো গায়ের রঙটি সাঙ্ঘাতিক! অমাবস্যার আঁধার রাতের মতো! তার আবার বৌয়ের গায়ের রঙ নিয়ে এতো বায়না! গত এক বছরে ধীরে ধীরে রাই, শাশুড়ি-মাকে  কিছুটা বুঝিয়ে উঠতে পেরেছে, যে গায়ের রঙ নিয়ে অহংকার করা বাতুলতা। একদম উচিত নয়। “তা ছাড়া গায়ের রঙ কালো হলেও ডাকসাইটে সুন্দরী হওয়া যায়, আরে নন্দিতা দাশ, স্মিতা পাতিল এদের দেখেন নি আপনি”? তবু ছোটবেলা থেকে সযত্নে লালিত অহংকার কি এত তাড়াতাড়ি যায়? 

“মা! তোমাকে তো আরো ফরসা লাগছে, কি ক্রিম মাখছো গো আজকাল”? ফিক্‌ করে একটু হাসেন শাশুড়ি। বলেন  “ছিঃ রাই, গায়ের রঙ নিয়ে আলোচনা করতে নেই জানো না?  আর শাশুড়ির সাথে মজা করা হচ্ছে?” 

এই হাসি, ঠাট্টা, রান্নার মধ্যেই এসে পড়েন পিসিরা। ব্যস হইহই পড়ে যায়। শুভ্র আর শ্রুতিও এসে জোটে মাঝের বসার ঘরে। জমে ওঠে আড্ডা। সকলেই এক আধ বার এসে রান্নাঘরে  উঁকি মেরে চলে যায়। আর কিছু না কিছু চাখাও চলতে থাকে। এ বাড়িতে, ছেলে মেয়ে দুজনেই মাকে ভালোবাসে ঠিক কিন্তু সেই ছোট থেকেই বেশী নির্ভর  করে পিসির ওপর। তাই এ বাড়িতে কোন জরুরী আলোচনা হবার থাকলে, সেটা পিসিমণি না এলে হয় না। এবং মায়ের ভূমিকা তখন বিশেষ গ্রাহ্য করা হয় না। অথচ রাই আশ্চর্য হয়, যখন জানতে পারে যে, মা জুলজি অনার্স নিয়ে গ্র্যাজুয়েট অথচ পিসিমণি বি. এ. কমপ্লিট পর্যন্ত করেন নি। তার বিয়েতেও দেখেছে রাই পিসিমণির কি দাপট, সম্বন্ধ করা থেকে অষ্টমঙ্গলা অবধি সবটাই পিসিমণি যা বলবে তাই। তবে মা আর পিসির মধ্যে কিন্তু কোনদিন কোন বিরোধ লক্ষ্য করেনি রাই।  কারণ, রাই দেখেছে, মা সব সময় বিতর্ক এড়িয়ে চলেন। তা ছাড়া কিছু বলতে গেলেই বাবার অহেতুক  মুখ ঝামটা খাবার সম্ভাবনা তো আছেই। “আচ্ছা মা , তোমার পড়াটাকে আর এগিয়ে নিতে ইচ্ছে করেনি? বা চাকরী করার কথা ভাব নি কখনো?” এক পিঠ ভাজা মাছের পিসগুলো উলটে দিতে দিতে জানতে চায় রাই।

মৃদু হাসেন নীপা, “সেই সময় চাকরী করলে, ছেলে-মেয়ে দুটোকে দেখতো কে?  তোমার বাবার তো তখন বাইরে বাইরে পোস্টিং? তা, তুমিও তো ভালো স্টুডেন্ট ছিলে, তুমি কাজ না করে বিয়েতে রাজী হলে কেন”? 

“ঠিক বলেছ মা, ওটা একটা মস্ত ভুল হয়ে গেছে। এম. এ. ফাইনাল দিতে না দিতেই তো বাবা মা উঠে পড়ে লাগল। তুমি তো জানো মা সবই”। রাই একটু চুপ করে যায়। সত্যিই তার মনে হয় জোর করে বিয়েটা তখন একটু আটকাতে পারত। আসলে শুভ্রর মিষ্টি মুখের প্রেমে পড়ে গিয়েছিল সে নিজেও। তারপর দু-একদিন আলাদা করে দেখা হবার পর তো দুজনেরই হাবুডুবু অবস্থা। তখন আর চাকরী বাকরীর কথা মাথায় থাকে!  প্রাথমিক ভাল লাগার ঘোরটা কেটে যাবার পর ইদানীং প্রায়শই মনে হয় একবার একটু চেষ্টা করবে নাকি? শুভ্রকে বলেও ছিল তার ইচ্ছের কথা। রাই  চুপ করে আছে  দেখে নীপা বলে উঠলেন, “একবার চেষ্টা করে দেখবে নাকি? এতো ভাল রেজাল্ট তোমার। আমি না হয় সংসারের জন্য কিছু করে উঠতে পারি নি। কিন্তু এখন তো দিন কাল অন্য রকম। আর তাছাড়া  জানো তো, নিজের একটা পায়ের তলার জমি খুব দরকার প্রত্যেক মেয়ের”। ইদানীং স্বামীর কথা বার্তার ধরন ধারণ ক্রমশ সহ্যের সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছে নীপবীথির। বরাবরই ছিল, কিন্তু রিটায়ার করার পর থেকে তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করার হার বেড়েই চলেছে। দোষটা ওনার নিজেরও। কোনদিন প্রতিবাদ করেন নি। কথায় কথায় যখন ঝুনুর সাথে তুলনা করেন তখন মনে হয় যে, একবার অন্তত বলেন যে, মেয়েদের ন্যূনতম শিক্ষা, গ্র্যাজুয়েট হওয়া, সেটাই হয়নি তোমার বোনের, অযথা ওর সাথে আমার তুলনা কোর না। কিন্তু নীপা বলেন না কিছুই। কারণ প্রতিবাদ করা তার ধাতে নেই। আগে দুঃখ পেতেন, চোখে জলও আসত, আজকাল আর কাঁদেন না। ক্ষোভ, দুঃখ যা হয় সেটা ভেতরেই চাপা থাকে। 

বসার ঘর থেকে হাঁক আসে, “কই গো কত দেরী আর?” “রাই, আমি চাটনিটা আর মাছ ভাজাটা রেডি করছি, তুমি একটু টেবিলটা সাজাও গিয়ে”। বলতে বলতে রাইকে তাড়া লাগায় নীপা।

খাওয়া দাওয়া শেষ হতে হতে প্রায় চারটে বাজলো। বসার ঘরেই সোফায়, ডিভানে আধ শোয়া হয়ে আড্ডা চলছে তখনো। হঠাৎ পিসিমণি, “ও দাদা তোমাকে তো একটা জিনিস দেখানোই হয়নি। দাঁড়াও দেখাই”, বলে উঠে গিয়ে ব্যাগ থেকে ট্যাবটা বার করলেন। এটা পিসিমণির নয়নের মনি, কারণ ছেলেমেয়ের  সাথে  ভিডিওতে  কথা বলেন তিনি এটার সাহায্যে। তারপর অন করে শ্রুতির হাতে দিয়ে বলেন “একটু ওই কোনার দিকের ওইটে, আরে হ্যাঁ হ্যাঁ ওইটে, একটু খোল”। শ্রুতি খোলে, একটা বাংলা নিউজ পেপারের পাতা।

“এটা পিসিমণি”? 

“হ্যাঁ, হ্যাঁ ওইটেই। নিচে দেখ, কার নাম লেখা আছে”।

 “শ্রীলেখা সেন।  ও মা! এটা বড়দিভাইয়ের লেখা নাকি গো”? এ তো দেখছি ‘কোলকাতার দিনকাল’ এর পাতা।  

“আরে হ্যাঁ দেখ না। লেখাটা নাকি খুব প্রশংসাও পেয়েছে। ও তো আজকাল এই সব লেখা টেখা নিয়েই আছে।“

“কোলকাতা দিনকালের সাব এডিটর তো শুভ্রাদি, বড়দিভাইয়ের বন্ধু না?”

শ্রুতির কথায় একটু থতমত খান পিসিমণি। “তাতে কি হয়েছে? ভালো না লিখলে কি আর ছাপতো রে?”

শ্রুতি তাড়াতাড়ি বলে ওঠে, আরে না না আমার শুভ্রাদির কথা মনে পড়ে গেল, ‘দিনকালের’ কথায়, তাই জানতে চাইলাম।

শ্রুতির কথায় পাত্তা না দিয়ে বলে চললেন পিসিমণি, “ ও দেশে বুঝলি কেউ বসে থাকে না, সবাই কিছু না কিছু করে। আর বরটাও পেয়েছে তেমনি ভালো, রান্না বান্না, লেখাপড়া সবেতেই ওস্তাদ, একেবারে তুলতুলির উপযুক্ত”। 

এই তুলতুলিকে রাই দেখেনি, ওর বিয়েতে আসতে পারেনি ওরা। তবে অনেক শুনেছে ওর কথা। সেই মেয়েও সাধারণ গ্র্যাজুয়েট, কিন্তু খুব স্মার্ট, আর নিজের পছন্দে যাকে বিয়ে করেছে, সে ছেলেটি উচ্চ শিক্ষিত। বিয়ের দেড় বছরের মধ্যেই বিদেশ পাড়ি, এবং বছর পাঁচেক হয়েও গেল এর মধ্যে। কে কার উপযুক্ত কে জানে! কথা বার্তা শুনলে মাঝে মাঝে হাসি পায়। আর কেউ বসে থাকে না কথাটা তো সম্পূর্ণ রাইকে উদ্দেশ করেই বলা। 

শুভ্রর সাথে একবার চোখাচোখি হলো রাইয়ের। “দেখি কি নিয়ে লিখেছে”? হাত বাড়ায় শুভ্র।

“আরে ওই রে যে নিগ্রো লোকটাকে পুলিশটা মেরে ফেললো না”? 

“ওঃ জর্জ ফ্লয়েডের ঘটনাটার কথা বলছ? ওটা নিয়ে লিখেছে? পিসিমণি, ওদের নিগ্রো বলে না, বলে অ্যাফ্রো-আমেরিকান।“

“কই দেখি আমাকে একটু দে তো”। নীপা হাত বাড়ায়। “রাই জানে মা খবরের ব্যাপারে খুব আপডেটেড থাকেন। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে খবর পড়েন। মাঝে মাঝে কিছু প্রশ্ন থাকলে ছেলেমেয়েদের  কাছে  জিজ্ঞেস করতে দ্বিধা করেন না। আর এই টপিকটা নিয়ে তো রাইয়ের সাথে বিস্তারিত আলোচনাও হয়েছে  তার। 

“দিচ্ছি দাঁড়াও এক মিনিট, পড়ে নি”। শুভ্র পড়তে থাকে। “বাঃ বেশ লিখেছে। পড়ে দেখ মা”। 

“বউদি কি খুব একটা বুঝবে”? পিসিমণির মন্তব্যে অবাক হয়ে তাকায় রাই। ভাই-বোন দুজনের মধ্যেই মানুষকে ছোট করার একটা সহজাত প্রবৃত্তি  আছে যেন। শ্বশুর মশাইয়ের গলা থেকেও একই সঙ্গে একটা তাচ্ছিল্যের ‘হুঁহ্‌হ্‌’ শব্দ ভেসে এলো মনে হল। শাশুড়ির দিকে তাকালো রাই। হঠাৎ মনে হল মায়ের চোখটা যেন একবার জ্বলে উঠল। ঠিক দেখলো কি?

“আরে! তুলতুলি তো শুধু ডেরেক শভিন আর জর্জ ফ্লয়েড কে নিয়েই লেখেনি দেখছি, ও তো আমেরিকায় পুরনো যে সমস্ত বর্ণ বৈষম্যের ঘটনা, মানে যেগুলোর কোন বিচার হয়নি, সেগুলোকেও তুলে ধরেছে।  আর তথ্য নির্ভরই শুধু নয়, বর্ণ বৈষম্য নিয়ে নিজের মতামতও বেশ সুন্দর গুছিয়ে বলেছে”। পড়তে পড়তে নীপা মন্তব্য করেন, “বাঃ! তুলতুলি এতদিনে সাজগোজ ফ্যাশন ছেড়ে একটা কাজের কাজ করল। প্রচুর পড়াশোনা করতে হয়েছে এটা লিখতে।” মাতৃ গরবে গরবিনী পিসিমণির মুখ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। সে দিকে লক্ষ্য না করেই নীপা বলতে থাকেন, “জান তো রাই, এটা একটা সামান্য প্রতিবাদ নয়, আমেরিকার প্রায় চারশো শহরে প্রতিবাদ করেছে মানুষ, সাদা, কালো নির্বিশেষে। প্রায় তেরোটা ইউনিভার্সিটিতে ফ্লয়েডের নামে স্কলারশিপ অবধি  ডিক্লেয়ার্ড হয়েছে।”

“বাহ! বৌদি, আপনি তো প্রচুর খবর রাখেন দেখছি”। পিসেমশায়ের কথায় হেসে ফেলেন নীপা, “তা একটু আধটু রাখি বই কি। সার্টিফিকেটগুলো মূল্যহীন হয়ে গেলেও আসল শিক্ষাটা তো ছেড়ে যায়নি ভাই এখনো। তা ছাড়া এটা এমনই একটা ঘটনা, যে মানুষের সমস্ত শিক্ষা দীক্ষাকে একটা বিরাট প্রশ্নের মুখে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে”।

বলতে বলতে রাইয়ের দিকে এগিয়ে দেন ট্যাবটা। “আমি না বুঝলেও রাই বুঝবে”, হেসে ননদের দিকে তাকিয়ে বলেন নীপা, “ও তো এম এ পাস, আমার থেকে আর একটু বেশি শিক্ষিত”।

বৌদির তথ্যভান্ডারের ব্যাপ্তি দেখে মনে মনে থমকালেও মুখে কখনই তা স্বীকার করার পাত্রী নন তার ননদটি। তাছাড়া নিজের স্বভাবটিকে বশে রাখার ক্ষমতাও  ওনার নিজের নেই। বৌদির কথার উত্তরে তাই চুপ না করে বলে ওঠেন, 

“আজকাল কি আর এম. এ. পাশের দাম আছে বৌদি? ঘরে ঘরে অমন এম. এ. পাশ ছেলে মেয়ে বসা, বেকার। চাকরী বাকরী পায় না”। রাইয়ের মুখ ক্রমশ শক্ত হয়। শ্রুতি বলে ওঠে, “তা কেন পিসিমণি, ভালো রেজাল্ট করলে  কেউ কি আর বসে থাকে”? 

“আরে তোদের ঘরেই তো রয়েছে রে, রাই কি করলো বলতো? সেই তো এম. এ. পাস করে ঘরেই তো বসা? তাই না?”

বাবা এতক্ষণ বোনের  সব কথায় মাথা নাড়ছিলেন। হঠাৎ রাইকে সরাসরি এরকম বলায়, তাড়াতাড়ি বলে ওঠেন, “ আঃ হা ঝুনু, রাইয়ের কথা আসছে কিসে? ওকে তো তুই-ই দেখে শুনে পছন্দ করে নিয়ে এলি। চাকরী বাকরী আর করে কাজ নেই এইসব বলে। এখন তুই ওকে এমন বললে হবে?” বলেই বিষয়টা হাল্কা করার উদ্দেশ্যে হেসে ওঠেন।

“আরে না দাদা, বলছি কি এমনি এমনি, মেয়ের কাছে থেকে শুনে শুনে, ওই দেশে এতোবার গিয়ে,  সব দেখে শুনে  আজকাল আমারও চিন্তা ভাবনার অনেক পরিবর্তন হয়েছে”।

এক পাতা লেখা নিমেষে পড়া হয়ে যায় রাইয়ের। অপমানের জ্বালাটা গোপন রেখে বলে ওঠে- “বেশ জোরালো প্রতিবাদী লেখাটা হয়েছে। ঠিক আছে তোমরা বোসো, আমি চায়ের জল চাপাই”। বলে আড্ডা ছেড়ে উঠে পরে রাই। আড়চোখে দেখে শুভ্রর মাথা নিচু। খারাপ লাগছে, কিন্তু পিসিমণির ওপর কোন কথা সে বলবে না, এটা জানে রাই।

মেয়ের গরবে আত্মহারা পিসিমণি বলেই চলে, “সে তো লিখবেই, ও তো হয়েছে একদম আমার মতো,  বরাবরই  খুব প্রতিবাদী ধরনের, কোন অন্যায় দেখলে সহ্যই করতে পারে না। সত্যিই তো শুধুমাত্র গায়ের রঙ কালো বলে তুই একটা লোককে মেরে ফেলবি। দেশ জুড়ে তো তাই নিয়ে প্রতিবাদের ঝড় উঠেছে। মেয়ে তো আমাকেও বলেছে, মা এর রেশ তোমাদের ভারতবর্ষেও ছড়িয়ে দেওয়া উচিত। সারা পৃথিবীর গর্জে ওঠা উচিত বর্ণ বৈষম্যের বিরুদ্ধে।” একটু দম ফেলেন পিসিমণি, “নেহাত এ দেশে এখন লক-ডাউন টা চলছে”।

“লক ডাউন না থাকলে কি করতে ঝুনু?”

রান্নাঘরের দরজার কাছ অবধি পৌঁছে অবাক হয়ে ফিরে তাকায় রাই শাশুড়ির গলার আওয়াজ শুনে।  এমন শ্লেষ ওনার গলায় কোনদিন শোনেনি রাই আজ অবধি। 

“লক ডাউন না থাকলে কি করতে ঝুনু? বর্ণ বৈষম্যের বিরুদ্ধে পথে শ্লোগান দিতে দিতে হাঁটতে”? 

বৌদির গলার স্বরে একটু চমকে যায় পিসিমণি, এ স্বর তার অচেনা। শ্বশুরমশাই, পিসেমশাইও মুখ তুলে তাকান। 

“কেন? না হাঁটার কি আছে বৌদি? সাদা কালো আবার কি? গায়ের রঙে কি বা আসে যায় বলো তো? আমি তো শুধু মিছিল নয়, ক’য়েক জায়গায় প্রতিবাদ সভা করার কথাও ভেবেছি। সে নিয়ে দু’এক জনের সাথে কথাও বলেছি। ওদের দেশে ওরা কতো কি করছে, আর আমরা একদিন মিছিলে হাঁটতে পারব না”?

শ্বশুরমশাইয়ের ক্ষীণ সমর্থন কানে আসে, “ঠিকই তো, একদম ঠিক।” স্ত্রীর এইরকম স্বর তিনি আগে শোনেন নি কখনো তাই গলার স্বরে তেমন জোরটা দিতে পারলেন না।

স্বামীকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে ননদকে বলেন নীপবীথি, “কেন পারবে না? নিশ্চয়ই পারবে। তবে, তোমার মুখ থাকবে তো ঝুনু? যখন সবাই জানবে যে তুমি  নিজে বিদেশী ফর্সা হবার ক্রীম ছাড়া মাখো না, আর এক মাস আগেও ছেলের বিয়ের জন্য ‘গৌরবর্ণা’ শব্দটা উল্লেখ করে পাত্রী চাইয়ের বিজ্ঞাপন দিয়েছ খবরের কাগজে”? 

আর একটাও কথা না বলে ধীরে ধীরে নীপা এসে রাইয়ের পেছন পেছন রান্না ঘরে ঢোকে। টক টকে ফরসা মুখ, আগুনের মতো দেখায় রাইয়ের চোখে। চেপে থাকা চোখের জলটা বাঁ হাত দিয়ে মুছে রাই বলে ওঠে “মা, ভাবছি   এবার ডাব্লু.বি.সি.এস.-এর জন্য তৈরি হব”। শাশুড়ি আলতো করে রাইয়ের মাথায়  একবার হাতটা বুলিয়ে দেন, হেসে বলেন, “তথাস্তু”।

লেখিকা পরিচিতি

 

তানিয়া দত্ত ঘোষ

পেশা : স্থপতি, নগর পরিকল্পক

সখ : কাজের ফাঁকে সু্যোগ পেলেই বেরিয়ে পরা, নাম না জানা পাহাড়ী জনপদের উদ্দেশ্যে, গান শোনা, আর  এক-আধটু লেখা।  বিষয় : ভ্রমণ বা ছোট গল্প।

Author

Du-কলম

Join the Conversation

  1. অসম্ভব সুন্দর লেখা। খুব ভালো লাগলো।

  2. খুব সুন্দর। লেখিকার কাছ থেকে আরোও এরকম লেখা আশা করি।

  3. দারুণ! বক্তব্যের ভার গল্পের স্বাচ্ছন্দ্য একটুও আটকাতে পারেনি। খুব ভাল লাগল

  4. ভীষণ ভীষণ ভালো লেগেছে। আরও অনেক লিখুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!