মেরী খাতুন
মানুষের জীবনে স্বাধীনতার থেকে বড় কিছু নেই। দেশ স্বাধীন হলেই মানুষের সর্বাধিক উন্নতির পথ প্রশস্ত হয়ে যায়। কবি রঙ্গলাল বন্দ্যোপাধ্যায় তাই বলেছেন—– স্বাধীনতা হীনতায় কে বাঁচিতে চায়। দাসত্ব শৃংখল বল কে পরিবে পায় হে, কে পরিবে পায়?”
পুরাতনের বিদায়ের মধ্যে দিয়েই ঘটে নবীনের আগমন। পুরনো শতকের সুখ-দুঃখ, জয়-পরাজয়, হাসি-কান্না ভুলে স্বাগত জানাতে হবে নতুন শতকেকে। নতুন শতক নতুন আশা-উদ্দীপনায়, প্রাণ-প্রাচুর্যে মানুষের হৃদয় ভরে তুলবে, না বিংশ শতাব্দীর চেয়েও হতাশার অন্ধকারে ভারতবাসীকে নিক্ষিপ্ত করবে?– এটাই জিজ্ঞাসা।
ভারতবর্ষের ইতিহাসে বিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধ খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ভারতবাসীর যা-কিছু আশা-আকাঙ্ক্ষা, সংশয় সবই এই প্রথমার্ধ জুড়ে। বিভিন্ন ঘটনায় পূর্ণ এই ভারতবাসীর মনে গভীর দাগ কাটতে সক্ষম হয়েছে। এই শতকের সূচনাতেই লর্ড কার্জনের “বঙ্গভঙ্গ আইন” অবিভক্ত বাংলার মানুষকে প্রতিবাদে সোচ্চার করেছে। সারা ভারত আন্দোলন ও প্রতিবাদে মুখর হয়ে উঠেছে। ব্রিটিশ শাসনের পীড়ন ও অত্যাচার থেকে মুক্ত হতে চেয়েছে ভারতবর্ষের মানুষ। অসহযোগ ও খিলাফৎ আন্দোলন ইংরেজদের মসনদকে কাঁপিয়ে তুলেছে। পাঞ্জাবের জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকান্ড দেশের আবালবৃদ্ধবনিতার মনে ইংরেজদের প্রতি ঘৃণা জাগিয়ে তুলেছে। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথও এই নৃশংস হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে ইংরেজ সরকারের দেওয়া ‘নাইট’ উপাধি পরিত্যাগ করেন। স্বদেশী আন্দোলনের ঢেউ সমগ্র ভারতবর্ষের জনজীবনকে উত্তাল করে তুলেছে।শতশত যুব-প্রাণ নিজের জীবন উৎসর্গ করেছেন দেশের স্বাধীনতার জন্য। এই সময়েই সংঘটিত হয়েছে পরপর দুটি বিশ্বযুদ্ধ। অবশেষে ১৯৪৭ সালে ১৫-ই আগষ্ট দ্বিখন্ডিত হবার ব্যথা বুকে নিয়ে স্বাধীন হয়েছে ভারত।
পন্ডিত জওহরলাল নেহরুর নেতৃত্বে জনগনতান্ত্রিক প্রজাতান্ত্রিক রাষ্ট্র ভারতবর্ষের মানুষ নতুন আশায় বুক বাঁধল। ১৯৫০ সালে আম্বেদকরের নেতৃত্বে রচিত হল ভারতীয় সংবিধান। পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার মাধ্যমে দেশের অগ্রগতি মন্থর গতিতে এগিয়ে চলল। নতুন নতুন কলকারখানা স্থাপিত হল,কৃষি ক্ষেত্রে ঘটল বিপ্লব। খাদ্যেও শিল্পোপযোগী কাঁচামালে স্বনির্ভরতার পথে ভারত এগিয়ে চলল। জন্ম হল শিল্পনগরীর। কিন্তু দেখা দিতে লাগল নানান সমস্যাও। জনসংখ্যা বৃদ্ধি, বেকারি, আবাসন সমস্যা, পরিবহণ সমস্যা, মুদ্রাস্ফীতি দেশের অগ্রগতির পথে বিরাট বাঁধা হয়ে দাঁড়াল। সমস্যা মোকাবিলার জন্য নানা পরিকল্পনা গৃহীত হতে থাকল।এরপর আছে প্রতিবেশী রাষ্ট্রের আগ্রাসী মনোভাব। শক্ত হাতে দমন করার প্রচেষ্টা হতে থাকল। হাজার হাজার শরণার্থীর বোঝা,প্রতিরক্ষা খাতে অতিরিক্ত ব্যায় ইত্যাদি সমস্যায় জর্জরিত ভারতবর্ষে দেখা দিল আর্থিক অসাচ্ছল্য, বাড়তে থাকল বৈদেশিক ঋণের বোঝা। তবে শুধুই কি হতাশা? চরম দুঃখের মধ্যেও উন্নতি হয়েছে পরিবহণ ব্যবস্থার। চক্ররেল-পাতালরেলসহ আধুনিক পরিবহণ ব্যবস্থার প্রচলন হয়েছে। অনেক ভারী ও মাঝারি শিল্প রূপায়িত হয়েছে। উন্মেষ ঘটেছে সত্যজিৎ রায়, উদয়শঙ্কর, রবিশঙ্কর, বিদ্রোহী কবি নজরুল, এ.পি.জে আব্দুল কালামের মতো বিশ্ববরেণ্য প্রতিভার। আর সর্বাপেক্ষা লজ্জাজনক ঘটনা হলো বিচ্ছিন্নতাকামী শক্তির হাতে প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর মৃত্যু। আজও সমগ্র ভারত অস্থির। কাশ্মীর, আসাম, পাঞ্জাব—সর্বত্রই বিচ্ছিন্নতাবাদীদের কালো হাত সম্প্রসারিত। আজ একটা চরম সংকটের মুখোমুখি এসে দাঁড়িয়েছে দেশ। সামাজিক, অর্থনৈতিক, ধর্মীয় সংকটের মধ্য দিয়ে আজ ভারতবর্ষ এসে দাঁড়িয়েছে।
স্বাধীনতার পর ৭৫ বৎসর অতিক্রান্ত। আজও ভারতের অগ্রগতির চিত্র নিতান্তই অস্পষ্ট। ভারতবাসীর মনে অনেক আশা-আকাঙ্ক্ষা জন্মেছে, ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়েছে। পরিকল্পনা খাতে হয়েছে অর্থব্যয়,কিন্তু কাজ হয়নি। ভারত পারবে কি তার এই পাহাড়প্রমাণ সমস্যার সমাধান করতে? সমস্যাকন্টকিত ভারতবর্ষ কি পারবে সমাধানের ফুল ফোটাতে? বরং ইতিহাসের ধারা অনুসরণ করলে বলা যেতে পারে সমস্যাবলী আরও ঘনীভূত হবে। জনসংখ্যার হার ক্রমশই বর্ধমান, কাজেই খাদ্যশস্যে ঘটবে ঘাঁটতি। পণপ্রথা,ধর্ষণের প্রকোপে নারী জাতি আজ অসহায়। বেকারত্ব,মুদ্রাস্ফীতি,দারিদ্র্য, অনাহার, মানুষের জীবনকে দুর্বিষহ করে তুলবে। বাড়বে বৈদেশিক ঋণের বোঝা। বিপন্ন হবে জনস্বাস্থ্য ও পরিবেশ। সাম্প্রদায়িক ও বিচ্ছিন্নতাবাদী শক্তি আরও মাথাচাড়া দিয়ে উঠবে। ঘন ঘন রাজনৈতিক পালাবদল দেশের অর্থনীতিকে পঙ্গু করে দেবে। প্রকট হবে নৈতিক অবক্ষয়, মানবিক মূল্যবোধের ঘটবে অপমৃত্যু। আশঙ্কা—হয়তো বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে ভারত। আগামী হয়তো ভারতবাসীর কাছে চরম অভিশাপ নিয়ে আবির্ভূত হবে।
কিন্তু হাজার সমস্যা থাকলেও নতুন ভাবে, নতুন ভঙ্গিতে বাঁচার আশা ভারতবাসী তো পরিত্যাগ করতে পারে না। চিরন্তন ঐতিহ্য অনুযায়ী ভারতবর্ষ অন্যায় ও অশুভ শক্তির বিরুদ্ধে মাথা তুলে দাঁড়াবেই। ঐক্য ও সংহতির সনাতন আদর্শ সমস্যাদীর্ণ ভারতবাসীকে একত্রিত করবে। সুস্থ, সবল, ঐক্যবদ্ধ ভারতবাসী শক্ত হাতে করবে সাম্প্রদায়িকতা দমন। সুন্দর ভারতবর্ষ গড়তে হয়তো প্রয়োজন কোনো যাদুদন্ডের স্পর্শের। তবুও আশাই পারে মানুষকে অভীষ্ট লক্ষে পৌচ্ছতে। সেই আশা বুকে নিয়ে ভারতবাসীকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। স্বাধীনতার উৎসবের দিনে আমাদের শপথ গ্রহণ করতে হবে–বহুকষ্টে অর্জিত স্বাধীনতা যেন আমরা ধর্মবিবাদে বিচ্ছিন্নতার উন্মত্ত নেশায় দিকভ্রান্ত হয়ে না হারাই। মনে রাখতে হবে আমরা মিলে-মিশে থাকলেই ভালোভাবে বাঁচতে পারবো। বিচ্ছিন্ন হলে আমাদের ধ্বংসের হাত থেকে কেউ রক্ষা করতে পারবে না।
জয় হিন্দ!
বন্দেমাতরম!