অলোক মুখোপাধ্যায়
মাথার উপর চালা নেই তো কি হয়েছে, হর ঘর তিরঙ্গা লাগাও! যেমন তেমন ব্যাপার নয়। স্বাধীনতার ৭৫ বছর পূর্তি বলে কথা। দেশ জুড়ে অমৃত মহোৎসব পালনের আহ্বানে সাড়া না দিলে হয়!
হাজার হাজার দেশপ্রেমিক বীর সন্তানের আত্মবলিদানে মুক্ত হয়েছিল পরাধীন ভারত। স্বপ্ন ছিল বৃটিশ রাজশক্তির অবসান ঘটিয়ে আপামর ভারতবাসীর জন্য জনকল্যাণমুখী রাষ্ট্রব্যবস্থা। স্বাধীন ভারতের সংবিধান প্রস্তাবনায় উল্লেখ ছিল একটি সার্বভৌম ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক সাধারণতন্ত্র গড়ে তোলার যাতে সকল ভারতীয় নাগরিক সামাজিক অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ন্যায়বিচার; নিজ নিজ বিশ্বাস মতে ধর্মাচারণের অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে পারেন। অগ্রাধিকার ছিল প্রত্যেক নাগরিকের অন্ন বস্ত্র বাসস্থানের। স্বাধীনতার ৭৫ বছরে পদার্পণ করে সাধারণ নাগরিক হিসাবে আমার মনে দেশের সাম্প্রতিক চিত্র ও বাস্তবতা একাধিক প্রশ্নের সম্মুখীন। আমার মতো অনেকের-ই মনে প্রশ্ন জাগা অমূলক নয় যে সংবিধানের উল্লেখযোগ্য সেই সব বৈশিষ্ট্য গুলো আজ কি অবস্থায়? নাই বা দেখলাম দেশের সার্বিক বেহাল অর্থনীতির চিত্র। কিন্তু দেশের বিপুল অংশের মানুষের জীবনজীবিকার ক্রমাগত অবনতি যে হচ্ছে সেই চিত্র আড়াল করার কোন উপায় আছে কি? ২০২২-এর ১৫ আগষ্টের মধ্যে ন্যূনতম সুবিধা সহ সকল নাগরিকের আবাস সুনিশ্চিত করার প্রতিশ্রুতি ছিল। অথচ প্রায় ২০ কোটি ভারতবাসীর কোনও বাড়ি নেই। প্রতিশ্রুতি ছিল কৃষকের আয় দ্বিগুণ হওয়ার। বিপরীতে কৃষিতে এমন সঙ্কট যে কৃষক চাষ আবাদ করা ছেড়েই দিচ্ছে। অর্থনীতির বিকাশে যে পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছিল বা হয়েছে তাতে মোট অভ্যন্তরীণ গড় (জিডিপি) কোনও বছরেই ৮ শতাংশে পৌঁছয়নি। অতিমারীতে প্রায় দু বছর আর্থিক বৃদ্ধির অধোগতি বাদ দিলেও চলতি সময়ের জুলাই মাস পর্যন্ত শিল্প এবং কৃষিতে উৎপাদন বৃদ্ধির হার খুব আশাপ্রদ নয়। আর্থিক বৃদ্ধির হার কার্যত থমকে গিয়েছে, সৃষ্টি হচ্ছে না নতুন কর্মসংস্থান। কর্মহীনতার হার ক্রমশ ঊর্দ্ধমূখী। সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যসামগ্রীর মূল্যবৃদ্ধির হার। রিজার্ভ ব্যাংক যাকে “সহনীয় মাত্রা” বলে থাকে সেই মাত্রা বিপদসীমার উপর দিয়ে চলেছে।
রাষ্ট্রসংঘের ২০১৮ সালের রিপোর্ট অনুযায়ী ভারত মানব উন্নয়নের সূচকে ক্রমশ নিম্নগামী। বিশ্বের ১৮৯ দেশের মধ্যে আজ ভারতের স্থান ১৩০ নম্বরে। অক্সফ্যাম এর রিপোর্ট বলছে বিশ্বের মধ্যে ভারতের আয়ে চরম বৈষম্য লক্ষ্যণীয়। দেশের মোট সম্পদের ৭৭ শতাংশ রয়েছে ১০ শতাংশ ধনী মানুষের হাতে। অদূর ভবিষ্যতে হয়তো কোনদিন প্রতীয়মান হবে যে ভারতই বিশ্বের সবচেয়ে বৈষম্যের দেশ। শুধুমাত্র আর্থিক ক্ষেত্রেই নয়! জাতপাত, ধর্মীয় বিদ্বেষ, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, নারীজাতির সম্মান, লিঙ্গবৈষম্য, কর্মসংস্থান ইত্যাদি প্রতিটি ক্ষেত্রেই স্বাধীনতার ৭৫ বছরে পদার্পণ করা ভারতই বিশ্বের অন্যতম সর্বব্যাপী বৈষম্যের দেশ হিসাবে পরিগণিত হবে।
এমতাবস্থায় দেশের স্বাধীনতার ৭৫ বছর উদযাপনের প্রেক্ষিতে সামাজিক মাধ্যমে যতই আবেগ উচ্ছাসের ছবি উঠে আসুক না কেন প্রদীপের নীচে অন্ধকারের বৃত্ত ক্রমশ বড় হবে যদি না দেশের শাসন ব্যবস্থার অভিমুখ আপামর দেশবাসীর প্রতি ইতিবাচক হয়।
স্বাধীনতা-হীনতায় কে বাঁচিতে চায় হে,
কে বাঁচিতে চায়?
দাসত্ব-শৃঙ্খল বল কে পরিবে পায় হে,
কে পরিবে পায়।
পরিশেষে রঙ্গলাল বন্দ্যোপাধ্যায়ের স্বাধীনতা-সঙ্গীত এর প্রথম কয়েক পংক্তি উল্লেখ করলাম কারণ শত সহস্র বীর দেশপ্রমিক ভারত মায়ের সন্তানের জীবনদানের বিনিময়ে গড়ে ওঠা স্বাধীন ভারতের রাষ্ট্রব্যবস্থার সুফল এখনও সব দেশবাসীর কাছে পৌঁছয় নি। অতএব সাধু সাবধান। ক্রমাগত না পাওয়ার যন্ত্রণা ও বৈষম্য যেন পূঞ্জীভূত ক্ষোভ সৃষ্টি না করে।