Home সম্পাদকের পছন্দ, বিবিধ, প্রবন্ধ স্বাধীনতা দিবসের দিনে এক অমলিন স্মৃতিকথা
সম্পাদকের পছন্দবিবিধপ্রবন্ধ

স্বাধীনতা দিবসের দিনে এক অমলিন স্মৃতিকথা

প্রিয়াঙ্কা ঘোষ

১৯৪৭ সালের ১৫ই আগস্ট আমাদের দেশে স্বাধীনতা এসেছিল। এই দিনটির মধ্যে দিয়ে প্রত্যেকটি ভারতবাসী মনে রাখে ব্রিটিশ শাসকদের বিরুদ্ধে দীর্ঘ লড়াইয়ের কথা। কত আন্দোলন, কত বিপ্লবীদের আত্মবলিদান,কত মানুষের রক্তক্ষয় এবং কত মুক্তিযোদ্ধাদের জীবন উৎসর্গের পরে দেশ স্বাধীন হয়েছিল। কিন্তু দেশ স্বাধীন হলেও ভারতবর্ষ বিভাজনের ফলে অনেক মানুষকে আজন্মকালের বাসভূমি ত্যাগ করতে হয়েছিল। এই বিষয়টি ভিটেমাটিহারা মানুষগুলোর কাছে ছিল চরম বেদনাদায়ক। অসংখ্য মানুষ সর্বস্বান্ত হয়ে এক অচেনা অন্ধকারের মধ্যে দিয়ে অনিশ্চয়তার পথে যাত্রা করেছিল। তাই তো কবি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় তাঁর লেখা যদি নির্বাসন দাও কবিতায় বলেছিলেন যে, “এ আমারই সাড়ে তিন হাত ভূমি; যদি নির্বাসন দাও/ আমি ওষ্ঠে অঙ্গুরী ছোঁয়াবো/আমি বিষপান করে মরে যাবো”।

কবি এখানে যথাযথই বলেছিলেন। নিজের ভিটেমাটি হারানো যেন মৃতুসম। কিন্তু তবুও ঐ অত্যাচারী ব্রিটিশ শাসকদের হাত থেকে নিস্তার পাওয়া গিয়েছিল। অনেক মানুষ স্বতন্ত্রভাবে স্বাধীন না হলেও দেশ স্বাধীন হয়েছিল। এক্ষেত্রে দেখতে গেলে এই দ্বাবিংশতি বর্ষে তথা আধুনিক যুগেও অনেক মানুষ আছে যারা স্বতন্ত্রভাবে স্বাধীন নয়। এমন মানুষ আছে যাদের মনে এখনও স্বাধীনতা আসেনি। যাদের মন এখনও কুসংস্কারের মায়াজালে আচ্ছন্ন হয়ে আছে। এক্ষেত্রে কবি শামসুর রহমান তাঁর লেখাস্বাধীনতা তুমি কবিতায় বারংবার মানুষের মনের মধ্যে স্বাধীনতা আনার কথা উল্লেখ করে করেছেন। সেখানে তিনি সবকিছুর মধ্যেই স্বাধীনতাকে আবিষ্কার করেছিলেন। কবির সৃষ্টি অনন্য। তবুও সব প্রতিকূলতাকে দূরে রেখে এই দিনটি নিজ গুণে অতুলনীয়। এই দিনটি প্রতি বছরই আপন গরিমায় ফিরে ফিরে আসে আর দেশের বিভিন্ন প্রান্তে এই দিনটি যথাযোগ্য মর্যাদায় উদযাপিত হয়ে থাকে।

এই দিনটিকে ঘিরে জীবনের অনেক মূল্যবান স্মৃতি রয়েছে। স্বাধীনতা দিবস এলেই স্মৃতির ঝুলি থেকে এই বিশেষ মূল্যবান স্মৃতিগুলোকে খুলে দেখার অনুভূতিটা অসাধারণ।

স্মৃতিচারণের সময়ে প্রথমেই ভেসে ওঠে স্কুল জীবনের স্বাধীনতা দিবস উদযাপনের স্মৃতি। আমাদের স্কুলে এই বিশেষ দিন উপলক্ষ্যে ছোটো করে একটা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হতো। স্কুল বাউন্ডারির মধ্যেই একটা ফাঁকা জায়গায় একটা বেদী করে সেখানে একটা বাঁশ পুঁতে তাতে পতাকা অর্ধনমিত অবস্থায় টানানো হয়। ঐ বাঁশটি এবং বেদীটিতেও সাদা রঙ করা হতো। সেই বাঁশে টানানো পতাকার সঙ্গে গাঁদা ফুল এবং অন্যান্য ফুল থাকত। তারপর আমাদের শ্রদ্ধেয়া বড় দিদিমণি বন্দেমাতরম স্লোগানে পতাকা উত্তোলন করতেন। তাঁর সঙ্গে থাকতেন স্কুলের সকল শিক্ষিকা এবং অন্যান্য কর্মীরা।আমরা সেকশান অনুযায়ী লম্বা লাইন করে দাঁড়াতম। সবাই সমস্বরে দিদিমণির সঙ্গে বন্দেমাতরম বলে উঠতাম। আমাদের স্লোগানে স্কুল বাউন্ডারি উদ্দীপিত হতো। তারপর শুরু হয়ে যেত বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। নাচ,গান,আবৃত্তি প্রভৃতি বিষয়ে স্কুলের মেয়েরা অংশগ্রহণ করতো। এই দিনে প্রতিযোগিতারও আয়োজন করা হতো। সমস্ত আয়োজন স্কুলের মেয়েরাই করতো। খুব সুন্দর অনুষ্ঠান হতো। আমরা মুগ্ধ হয়ে এই সমগ্র অনুষ্ঠানকে উপভোগ করতাম।

স্কুল জীবনে স্বাধীনতা দিবসের দিন সকালে থাকতো স্কুলের অনুষ্ঠান আর বিকেলে থাকতো আমার নাচের স্কুলের অনুষ্ঠান। নৃত্য শিক্ষিকার পরিচালিত দেশাত্মবোধক গানের ওপর সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি গীতিনাট্য অনুষ্ঠিত হতো। আমরা অর্থাৎ আমি এবং আমার বন্ধুরা অংশগ্রহণ করতাম। ঐ সময় প্রায় প্রত্যেক বছরই এই গীতিনাট্যটি অনুষ্ঠিত হতো। আবার কোনো কোনো বছর শুধু দেশাত্মবোধক গানের ওপরেই আমরা নৃত্য পরিবেশন করতাম।

এরপর স্কুল জীবন পার করে কলেজ জীবনে যখন পদার্পণ করলাম তখন ছোটবেলার নৃত্য শিক্ষা গুরুর হাত ধরে এলাম কলকাতার স্বনামধন্য নৃত্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠান কলাক্ষেত্রমে। সেখানে দুজন গুণী মানুষকে পেলাম স্যার এবং আন্টিকে। আমার পরবর্তী জীবনের নৃত্য শিক্ষা গুরু। তাঁদের হাত ধরে আজ অনেক দূর এগোতে পেরেছি। তাঁদের হাত ধরে অনেক নতুন জায়গা দেখার সুযোগ পেয়েছি। নৃত্যর অনুষ্ঠানের জন্য যাওয়া হতো সেইসব জায়গায়। এইরকমই স্বাধীনতা দিবসের আগে আন্টির সঙ্গে আমরা বেড়িয়ে পড়তাম। বেশিরভাগ রাজস্থানের দিকেই আমাদের অনুষ্ঠান থাকতো। তাই রাজস্থানের প্রায় সব জায়গাই আমার দেখা হয়ে গিয়েছে। আন্টির পরিচালিত দেশাত্মবোধক গানের ওপর সারযামিন গীতিনাট্য অনুষ্ঠিত হতো। সঙ্গাচ্ছাদ্ধ্বাম সংবোদাদ্ধ্বাম গানের মধ্যে দিয়ে অনুষ্ঠানের সূচনা হতো আবার চাক দে ইণ্ডিয়া গানে অনুষ্ঠানের সমাপ্তি হতো।

২০২০-র আগে প্রায় প্রত্যেক বছরই স্বাধীনতা দিবসের ২/৩দিন আগে আন্টির সঙ্গে আমরা ট্রেনে চেপে পাড়ি দিতাম মরু অঞ্চলের দিকে। সবার হুল্লোড় শুনেই ট্রেন এগিয়ে চলত। তারপর সেখানে পৌঁছে অনুষ্ঠানের জন্য মহড়া চলত আর মহড়ার ফাঁকে চলত আমাদের গল্প,আড্ডা,খাওয়া-দাওয়া এবং অনুষ্ঠান শেষে ফেরার আগে আন্টির সঙ্গে রাজস্থানের যেই জায়গায় যাওয়া হতো সেখানকার সৌন্দর্যকে উপভোগ করে নেওয়া হতো। একগুচ্ছ আনন্দ এক সঙ্গে এসে জড়ো হতো।

অনুষ্ঠানের আগে আন্টির অক্লান্ত পরিশ্রমের সঙ্গে মিশে যেত সবার অক্লান্ত পরিশ্রম, সেখানে চার থেকে পাঁচ হাজার দর্শকের সামনে আমাদের নৃত্য পরিবেশন করা এবং সব শেষে অনুষ্ঠানের সাফল্য লাভ। সব কিছু একত্রিত হয়ে সে এক অপূর্ব অনুভূতির সৃষ্টি করতো। আজও সেই দিনগুলো অমলিন। জীবনের প্রত্যেক পরতে ঐ দিনগুলো উজ্জ্বল হয়ে রয়েছে। শুধু মহামারীর জন্য দু বছর সবকিছু থমকে গিয়েছিল। কিন্তু এখন আবার সব অনুষ্ঠান আগের মতোনই মঞ্চস্থ হচ্ছে। তাই কখনো হয়তো আবার স্বাধীনতা দিবসের আগে এই গীতিনাট্যটি অনুষ্ঠিত হবে। সেই আশাই মনের মাঝে লালিত হচ্ছে। স্বাধীনতা দিবস এলেই ফেলে আসা সেই মূল্যবান দিনগুলোর কথা ভীষণ ভাবে মনে পড়ে যায়। সবচেয়ে বেশি জীবন্ত হয়ে ওঠে আমার নৃত্য শিক্ষা গুরুর সঙ্গে রাজস্থান যাওয়ার সেই দিনগুলোর স্মৃতি। সেই সময়কার প্রত্যেকটা মুহূর্ত স্মৃতির পটে অঙ্কিত হয়ে রয়েছে। তাই স্বাধীনতা দিবস এলেই এই অমলিন স্মৃতিগুলো মনের মাঝে ভেসে ওঠে। আমরা এইভাবেই নতজানু হয়ে বঙ্গমাতার উদ্দেশে শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করতাম। এইভাবেই অবনত হয়ে শ্রদ্ধার এবং মর্যাদার সঙ্গে স্বাধীনতা দিবস উদযাপন করতাম।

Author

Du-কলম

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!