Home সামাজিক, গল্প সুনেত্রার ঘরবাড়ি
সামাজিকগল্প

সুনেত্রার ঘরবাড়ি

লেখক : দীপঙ্কর ঘোষ

সুনেত্রা বসে আছে। পাশের কোন বাড়ি থেকে মার্বেল কাটার শব্দ আসছে। তীব্র তীক্ষ্ণ ক্ষণস্থায়ী শব্দ। তারপরেই শোনা যাচ্ছে স্কুটার বাইকের চলে যাওয়ার শব্দ – হর্নের আওয়াজ। সব থামলে ঘড়িটার ক্লান্ত একঘেয়ে টিকটক টিকটক টিকটক। আস্তে আস্তে চোখ লেগে আসে। ভেজা চুল বিছানার বাইরে ঝুলিয়ে দিয়ে ধারে মাথা রেখে শুয়ে পড়ে। একটা কোকিল তীব্র কন্ঠে সঙ্গিনীকে ডাকছে। ডেকেই চলেছে। কোনও বাড়িতে গান বাজছে। আভি না যাও ছোড় কর্‌ – রফির গলায়। তবু তো বসন্ত শেষ হয়ে এলো। সব কিছু সুনেত্রাকে ছেড়ে চলে যাচ্ছে। মেয়ের বয়স বারো। সুনেত্রাই নাম রেখেছে বৃষ্টি। সেভেনে পড়ে। আর একঘন্টা পরে আসবে। তখন উঠে রাস্তার মোড়ে দাঁড়াতে হবে। মেয়েটা বড় ন‍্যাওটা। সব সময় গায়ে লেপটে থাকে। খাওয়া নিয়ে বিশেষ বায়না নেই। বড়ো মায়াবী মেয়ে। ভালবাসায় ভরা বড়ো বড়ো দুচোখ তুলে একবার মা বলে ডাকলেই পৃথিবী পূর্ণতা পায়। অঞ্জন বড়ো শান্ত। মেয়েও বাবার মতো হয়েছে। রাতে টানটান পরিস্কার বিছানায় দুপাশে দুজনকে নিয়ে শুলে বড় শান্তিতে ঘুম আসে। অঞ্জন আর বৃষ্টি দুজনেই সুনেত্রাকে ছুঁয়ে ঘুমোয়। ওর স্পর্শ না পেলে ওদেরও ঘুম আসে না – সুনেত্রার‌ও। 

সুনেত্রা এখন আটচল্লিশ। শ‍্যামলা ছোট্টোখাট্টো মানুষ। একঢাল চুল। রোগাটে শরীর – পূরন্ত নয়। এখনও মনে পড়ে প্রথম যৌবনের দিনগুলো। অঞ্জনের পাগলামি। সুনেত্রাকে পাওয়ার জন্যে শরীর খারাপের অজুহাতে অফিস কামাই। ওর ছত্রিশ বছর বয়সে বৃষ্টি হ‌ওয়ার পরেই অঞ্জন বর থেকে বাবা হয়ে গেল। বহু চেষ্টাতেও আর উপগত হতে পারে নি। তখন অঞ্জন পাগলের মতো করতো ; তখন ও বড় অস্থির ছিলো – সব কিছু চেষ্টা করা হয়েছিলো -কবিরাজী টোটকা অবধি করা হয়েছিলো। কিন্তু কোনও লাভ হয়নি। তখন সুনেত্রাই অঞ্জনকে বোঝায়। ওটাই তো জীবনের সব কিছু নয়। পরস্পরের প্রতি ভালবাসা , নির্ভরতা এটাই তো আসল। শেষ বয়সে তো আর যৌনতা থাকে না – তখন দুজনের প্রতি অনিঃশেষ ভরসা নিয়ে মানুষ বেঁচে থাকে – তাই ওরা দুজনেই এই অক্ষমতা মেনে নিয়েছিলো। তারপর দুজনের ভালবাসা আর‌ও গভীরতর হয়েছে। নির্ভরতা – অনুভূতিও। রাতে সুনেত্রাকে ছুঁয়ে না শুলে অঞ্জনের ঘুম আসে না। সুনেত্রার‌ও অঞ্জনের ছোঁয়াটা না পেলে অসহায় লাগে। ও’ও অঞ্জনের গায়ে একটা হাত আর বৃষ্টির বুকে আর একটা হাত তুলে দিয়ে ঘুমোয়। ওর মনে হয় ওর একটা নয় দুটোই সন্তান। এদেরকে ছেড়ে সুনেত্রার একটা বেলাও কোথাও মন টেঁকে না। সারাটা দুপুর প্রতীক্ষায় থাকে কখন সন্ধে হবে ওদের গলার স্বরে – উপস্থিতিতে ওর ছোট্ট ফ্ল্যাট বাড়িটা ভরে উঠবে। নেত্রা তুমি কোথায় আর মা একটু শোনো কথাদুটোর অপেক্ষায় ওর শূন্য দুপুরটুকু কাটে।রাতে স্নেহে প্রেমে পূর্ণ হয়ে স্বপ্নহীন প্রগাঢ় ঘুম। ভোরবেলায় উঠে ভালবাসার পুর দিয়ে রান্না করা। দুজনের টিফিন গুছিয়ে দেওয়া। তারপর ঝাড়পোঁছ। কাজের মাসির সঙ্গে সাতকাহন। অঞ্জন বড্ড সংসারী। সুনেত্রার থেকেও। কোথায় থাকবে চেয়ার – কোথায় টাঙানো হবে ছবি – দেওয়ালের রং। সঙ্গে রংমিলন্তি পর্দা। পরম যত্নে – পরম ভালবাসায় সাজানো গোছানো সুন্দর সংসার। 

****************************************************

সন্ধে হয়ে গেছে। ভীড় বাজারের চৌমাথায় সুনেত্রা। হাতে একটা পলিথিনের ব‍্যাগ। অটো চিৎকার। ফল‌ওয়ালার হাঁকডাক। গা ঘেঁষে রিক্সা। আলোময় দোকানপাট। গা জড়াজড়ি ভীড়। সুনেত্রা আজ বহুদিন পরে অলোকের বাড়ি গেছিলো। বিপত্নীক বাউন্ডুলে অলোক। কখনও পাহাড়ের গিরিগুহায় – কখনও বা মধ‍্যপ্রদেশের গহীন জঙ্গলে চলে যায়। সুনেত্রার সঙ্গে কোনও এক বিয়েবাড়িতে আলাপ। ক্রমশঃ পরিচয় গভীরতর হয়। না সুনেত্রা কোনোদিনই অলোকের প্রেমে পড়ে নি। ওর জীবনে ওর সংসার‌ই ওর প্রথম আর শেষ প্রেম। এখনও ও ভাবতে পারে না যে বৃষ্টি বড় হয়ে একদিন ওকে ছেড়ে চলে যাবে। পাহাড় নদী আর জঙ্গলের গল্প শুনতে একদিন অলোকের বাড়ি যাওয়া। হাজার হাজার ফটোর মাঝে নিজেকে হারিয়ে ফেলা সেও এক অভিজ্ঞতা। অলোক একদিন ওর ফটো তুলতে চাইলো। চিবুকে হাত দিয়ে মুখের ভঙ্গিমা ঠিক করে দিলো। সেদিন বহুদিন পরে ওর শরীরে আবার শিরশিরানি জেগেছিলো। ফিরে এসে একটা পাপবোধ মনটাকে বিষিয়ে তুলেছিলো। অথচ কিছুই না। একটুখানি চিবুক আর একবার আঙ্গুলের ছোঁয়া। একা ঘরে কেঁদেছিলো। হাজার খুঁজেও অলোকের প্রতি একটুও প্রেম অনুভব করে নি। তবুও কোন অদৃশ্য টানে মোহান্ধের মতো আবার গেছিলো অলোকের বাড়ি। তারপর আধো অন্ধকারে নিমগ্নতা – পিঠে পুরুষালি ছোঁয়া – চুম্বন আশ্লেষ – যোনিবৃন্তে – জগৎ সংসার ক্রমশঃ হারিয়ে ভুলে যাওয়া – ডুবে যাওয়া শরীরের দীর্ঘ পরিক্রমায়। এ্যাতো আকাঙ্ক্ষা কি সুনেত্রার শরীরে জমে ছিলো ? অথচ প্রেম নয় – কিছুটা বিশ্বাস – আর বাকিটা জ্ঞান। অলোক সম্পর্কে জ্ঞান। সুনেত্রা জানে অলোক ভবঘুরে ও কোনোদিন সুনেত্রার বৃষ্টি আর অঞ্জনে ভাগ বসাতে ও আসবে না। বেড়ানোর গল্প শরীরের ভ্রমণ তারপর বিস্মৃতি। আবার কোনও এক দিন আবার ওর গেট ঠেলে বোগেনভোলিয়ার ডাল হাতে সরিয়ে – একমাথা কাঁচাপাকা চুল আর হাই পাওয়ারের চশমা পরা মুখে চুম্বন। তিল আর আঁচিলের মাঝ দিয়ে নিবিড় মিলন। কতোদিন মাংস কিনে নিয়ে যায়নি অঞ্জন। আজ সুনেত্রা চমকে দেবে। ভীড় ঠেলে মাংসের দোকানে গিয়ে মাংস কিনে বাড়ির পথে হাঁটা দেয়। অঞ্জন আর বৃষ্টিকে ছেড়ে সুনেত্রা বেশীক্ষণ থাকতে পারে না। সুনেত্রা বাড়ি ফিরে যাচ্ছে।

লেখক পরিচিতি

দীপঙ্কর ঘোষ

একজন বৃদ্ধ চিকিৎসক। এক কালে মেডিক্যাল কলেজে পড়াতেন।  লেখালেখিই বাতিক। প্রবন্ধ কবিতা এবং ছোটো গল্প লিখে থাকেন। এ যাবৎ প্রকাশিত ব‌ইয়ের নাম “মানদাসুন্দরী ও মাতাল ডাক্তার” – এক মাতালের বেদনাবিধুর গল্প সমষ্টি। আর প্রকাশিতব্য “রঙিন কৈশোর” এবং “কিছু অসুখ কিছু কথা”, রূপালী প্রকাশনী থেকে।

Author

Du-কলম

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!