প্রবন্ধসাহিত্য ও সংস্কৃতি

আমার বই পড়া

অনন্ত কৃষ্ণ দে

সে দিনটা ছিল আমার জন্মদিন। শীতকাল, ডিসেম্বর মাস। আমার মা সাধারনত সকাল থেকে রাত অবধি  নানারখম পছন্দসই খাবার বানিয়ে আমার জন্মদিন পালন করতেন। সেবার বায়না ধরলাম, বন্ধুকে বলতে হবে।এর একটা প্রছন্ন কারণ ছিল, কেননা কিছুদিন আগে আমি সুশান্তর বাড়িতে ওর জন্মদিনে লুচি আর মাংস খেয়ে এসেছি। সুশান্ত আমার হাতে একটা ব্রাউন পেপারের মোড়ক উপহার দিয়ে বলল, ‘বই টা পড়িস’। ও চলে গেলে আমি মোড়ক উন্মুক্ত করলাম।বইটা ছিল রহস্যময় মোহেনজোদড়ো’।এই আমার প্রথম বই। একান্ত আমার নিজস্ব। বাড়িতে মাসিক শুকতারা আর মাঝে মাঝে কিশোর প্রত্রিকা আসতো কিন্তু এগুলো ঠিক মনের ক্ষুধা মেটাতে পারতো না। নিমেষেই পড়া হয়ে যেতো। এই বইটা তাই আমার খুব আপনজন হয়ে উঠলো। ভারতবর্ষের মোহেন-জো-দড়ো হল প্রাগৈতিহাসিক যুগের এক বিস্ময়। এশিয়ার সভ্যতার মাতৃভূমি মোহেন-জো-দড়ো হল তার পুরাতাত্ত্বিক প্রমান। ছোট বয়েস থেকেই ভাবী নাগরিকদের ইতিহাসের বিচিত্র রসে দৃষ্টি আকর্ষণ করার জন্যই এই বই। মোহেন-জো-দড়ো হোল আমাদের অতীতের এক পরম প্রাপ্তি। গৌরবময় ইতিহাস। পৃথিবীর আবিস্কারের জগতে এ যেন আর এক কলম্বাস। আজ বাংলাদেশের মেলায় কুমোরেরা যে অসংখ্য পুতুলের পসরা সাজায় তার অনেক পুতুলের সঙ্গেই মোহেন-জো-দড়োতে প্রাপ্ত মাতৃকা-মুত্তির মিল খুঁজে পাওয়া যায়। মোহেন-জো-দড়োতে প্রাপ্ত শীলমোহর, পশুপতি শিব, পোড়া মাটির তৈরী মেষ প্রভৃতি দেখে তখন মনে এক আলোড়ন জাগিয়েছিল। ছবিগুলো আমি পেন্সিল দিয়ে আঁকার চেষ্টা করতাম। ঐ বয়সে অবশ্য বুঝতে পারিনি কেন এমন একটি বিস্ময়কর সভ্যতা হারিয়ে গেল, অবলুপ্ত হল মাটির অন্ধকারে। আজ জানি, এই নিয়ে নানা পন্ডিতের নানা অভিমত আছে। মোহেন-জো-দড়োর ভাষা শীল মোহরে খোদাই করা, আজও আমরা যার পাঠোদ্ধার করতে পারিনি।

রহস্যময় মোহেন-জো-দড়ো পড়ার অল্পকালের মধোই আরো দুটি বই আমার হাতে এলো, এবার আর জন্মদিনের উপহার নয়, স্কুলের পুরস্কার বিতরনী অনুষ্ঠানে শিক্ষাগত পারদর্শিতার জন্য কবি সুকান্ত ভট্টাচার্যের মিঠে কড়া আর জুল ভার্ন এর বাংলা অনুবাদ জার্নি টু দি সেন্টার অব দি আর্থ মিঠে কড়ার ছড়া গুলো পড়তে তখন ভালই লাগতো। অতি কিশোরের ছড়া টা খুব মনে পড়ে, দুটো লাইন মুখস্থ করে সবাইকে শোনাতাম,

‘তোমরা আমায় নিন্দে করে দাও না যতই গালি,
আমি কিন্তু মাখছি আমার গালেতে চুন-কালি’।

ছড়াগুলো একেবারে আদ্দিকালের বদ্দিবুড়োর ছড়া নয়, টাটকা হাতে গরম করা ছড়া। পড়তে পড়তে হাসির মাঝেও তাই হাত মুঠো হয়ে যায় রাগে, চোখ জ্বলে উঠে। গোটা বইতে মিঠে রসে ভেজানো কড়াপাকের নানান ছড়া।

ভেজাল ছড়ায় কবি লিখলেন,

‘কলিতে ভাই ভেজাল সত্য ভেজাল ছাড়া গতি নেই
ছড়াটাকেও ভেজাল দিলাম, ভেজাল দিলে ক্ষতি নেই’।

পুরনো ধাঁধায় তিনি প্রশ্ন তুললেন,

‘বলতে পারো বড়োমানুষ মোটর কেন চড়বে?
গরীব কেন সেই মোটরের তলায় চাপা পড়বে?

মেয়েদের পদবী ছড়াটি খুব হাসির,

‘মেয়েদের পদবীতে গোলমাল ভারী,
অনেকের নামে তাই দেখি বাড়াবাড়ি;
‘আ’কার অন্ত দিয়ে মহিলা করার
চেষ্টা হাসির তাই ভুমিকা ছড়ার।
নাগ যদি নাগা হয়, সেন হয় সেনা,
বড়োই কঠিন হবে মেয়েদের চেনা’।

************************************************************

এর পরের বইটি ‘জার্নি টু দি সেন্টার অব দি আর্থ’ আমি রুদ্ধ নিঃশ্বাসে পড়েছিলাম।অনেকবার পড়েছিলাম। বৈজ্ঞানিক তথ্যের উপর ভিত্তি করে পৃথিবীতে যত সাহিত্যিক উপন্যাস লিখেছেন জুল ভার্ন এর নাম বোধহয় তাঁদের সবার উপর। জার্মেনির হামবুর্গ শহরে কনিগস্ট্রাস নামে যে রাস্তাটা আছে,সেইখানে পুরোনো একটা ছোটো বাড়িতে থাকতেন অধ্যাপক লিডেনব্রক আর তার ভাইপো অ্যাকজেল। আইসল্যান্ডের মস্ত বড়ো বৈজ্ঞানিক সাকনুউজম অ্যালকেমির গবেষনায় সাফল্য লাভ করেছিলেন।তিনি কোনো নুতন জিনিষ আবিস্কার করে সংকেতের সাহায্যে একটা চিরকুট লিখে গেছলেন, যাতে একশো ব্রত্ত্রিশটা অক্ষর ছিল। সঙ্কেতের কথাগুলো লাতিন। তার মানে করে অধ্যাপক লিডেনব্রক আর তার ভাইপো অ্যাকজেল যা বুঝলেন তা হলোঃ ‘ হে ভ্রামণিক! জুলাই মাসের গোড়ার দিকে যখন স্কার্টারিস পর্বতচুড়োর ছায়া পড়বে স্নেফেল অগ্নিগিরির মুখের উপর, তখন সে পথে অবতরন করলে তুমি পৌঁছতে পারবে পৃথিবীর অন্তঃপুরে’। এরপরেই শুরু কাকামনি আর ভাইপোর অভিযান স্নেফেলের উদ্দেশে। স্নেফেলের অনেকগুলো জ্বালামুখ। যে জ্বালামুখটা একেবারে পাতালে পৌছনো যায়, সেটা বোঝানোর জন্যই জুলাই মাসের কথা উল্লেখ করেছেন বৈজ্ঞানিক সাকনুউজম।ভলকিরিয়া জাহাজে উঠে অবশেষে তারা আইসল্যান্ডের রাজধানী রিজকিয়াভিকে পৌছোলেন। সেখান থেকেই দেখলেন বরফে মোড়া স্নেফেল পাহাড়, যা আকাশের মেঘ ভেদ করে মহাশূন্যে মাথা তুলে দাঁড়িয়েছিলো। শহরের যতদুর চোখ যায় শুধু আগ্নেয়গিরির মেলা। আইসল্যান্ড ভূতত্ত্বের দেশ। এখানে কতো কি যে দ্রষ্টব্য আছে তার ইয়ত্তা নেই।

বাংলা অনুবাদটি ছোটো হলেও নানা ঘাত প্রতিঘাত আর জীবন মৃত্যুর মুখোমুখি স্নেফেল পাহাড়ে উঠার যে বর্ণনা আছে তা এককথায় অনবদ্য। পড়তে পড়তে শেষ না দেখে ওঠা যায় না। ষোলই জুন ঘোড়ার পিঠে সমস্ত মাল পত্র চাপিয়ে অধ্যাপক লিডেনব্রক আর তার ভাইপো অ্যাকজেল রওনা দিলেন।ভেলায় করে নদী পেরোলেন, লাভার এবড়ো খেবড়ো পথ দিয়ে এগিয়ে চল্লেন। অজানার উজানে কাকা ভাইপোর যাত্রা, অন্য পৃথিবীর সমুদ্র পাড়ি, সত্যিই এক শিহরণ জাগায়। অন্তহীন পাতাল-সমুদ্রে খড়কুটোর মতো ভাসছে তাদের ছোটো ভেলাটি, আর তার উপর ছুটোছুটি করছে সাদা নীল একটা; ঝড়ে সমুদ্র ফুঁসছে, উদ্দাম হাতে করতালি দিচ্ছে ঝড়!!সত্যিই সেলাম জুল ভার্ন।

লেখক পরিচিতি

 

অনন্ত কৃষ্ণ দে

জন্ম কলকাতার বাগবাজারে। মহারাজা কাসিমবাজার স্কুল ও বিদ্যাসাগর কলেজে পড়াশুনা। বিজ্ঞানে স্নাতক। স্কুল, কলেজ, অণু পত্রিকা ও বিভিন্ন ম্যাগাজিনে লেখা। নাটক ও স্কাউটিং এর সাথে যুক্ত।

Author

Du-কলম

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!