গোপা মিত্র
লোলেগাঁও রিশপ লাভা
।। দ্বিতীয় পর্ব ।।
(রিশপ)
চলেছি রিশপের পথে – আমরা চারজন। ৮,৫০০ ফুট উচ্চতায় কালিম্পং এর সর্বোচ্চ পর্যটন কেন্দ্র অনন্ত নৈঃশব্দের মাঝে ছোট্ট এই পার্বত্য গ্রাম রূপসী রিশপ। ‘রি’ অর্থ পাহাড় চূড়া, ‘শপ’ হলো প্রাচীন বৃক্ষ। অর্থাৎ পাহাড়চূড়ায় প্রাচীন বৃক্ষ হলো রিশপ।
‘টেবিল টপ মাউন্টেন’ চূড়ায় অবস্থিত ছোট্ট এই লেপচা গ্রাম ‘রিশপ’। তাই এ পথের সবটাই চড়াই – যেতে হবে জীপ নিয়ে। গাড়ী ছুটে চললো আরণ্যক পাহাড়ী পাকদন্ডী পথে। দুপাশের সারিবদ্ধ ঘনবৃক্ষরাজি, তারাও এগিয়ে চলেছে আমাদেরই সঙ্গে। কিছুটা যাবার পরই গাড়ী হঠাৎই লাফাতে শুরু করলো। রাস্তা খুবই খারাপ, পাথুরে, উঁচুনিচু, কোনরকমে মাত্র একটা গাড়ীই যেতে পারে। ঝাঁকুনি হচ্ছে ঠিকই, তবে দুপাশের পথ সৌন্দর্য সেই কষ্ট লাঘব করে দিচ্ছে।
গ্রাম রিশপের প্রবেশমুখে পাহাড়ের ঢালে ঢালে রয়েছে ছবির মত বাড়ীগুলি আর তাদের ছোটো ছোটো ক্ষেত। আর একটু এগিয়েই দেখলাম, মাঝে মাঝেই রয়েছে কোথাও পাহাড়ের বেশ উঁচুতে, কোথাও তার সামান্য নিচে বা কোথাও প্রায় রাস্তার সমতলে মাত্র গুটিকয় হোটেল বা গেস্টহাউস।
পশ্চিমবঙ্গ, সিকিম ও ভূটানের ত্রিবেণী সঙ্গমে অবস্থিত রিশপের সারা উত্তর আকাশ জুড়ে রয়েছে কাঞ্চনজঙ্ঘা, সিঙ্গালিলা, কাবরু ও পূর্ব হিমালয়ের নানা শৈলশিখরগুলি।
আমাদের হোটেল ‘লাভলি রিসর্ট’-এর অবস্থান রিশপের প্রায় প্রবেশপথেই। পাহাড়ের উঁচুনিচু ধাপে কাঠের তৈরী দোতলা এই হোটেলটি বড় সুন্দর। শীতের নানারকম মরশুমী ফুল, বিশেষ করে বিভিন্ন প্রজাতির গোলাপ ও গাঁদা দিয়ে সাজানো। হোটেলের বেশ নিচে পাহাড়ের এক ধাপে রয়েছে এক পার্ক – যেখান থেকে দূরের পর্বতশিখরগুলির সঙ্গে রিশপের আরণ্যক সৌন্দর্য ও তার ফাঁকে ফাঁকে ছোট ছোট বাড়ীগুলি ও তাদের ক্ষেতগুলি চমৎকার ভাবে দৃশ্যমান।
আমাদের ঘর দোতলায়, পাশাপাশি। সামনে টানা বারান্দা, ফুলগাছ দিয়ে সাজানো। পিছনেও ঘরের সঙ্গে রয়েছে এক ব্যলকনি। প্রভাত সূর্যের প্রথম আলো এসে পড়ে পিছনের এই ব্যালকনিতে আর সামনের বারান্দা থেকে দেখা যায় তিন দিকে বিস্তৃত তরঙ্গায়িত পর্বতরাজি।
জলযোগ সেরে আমরা এসে দাঁড়ালাম ঘরের সামনের বারান্দায়। ওরা – হোটেলের কর্মীরা, তখন অঙ্গুলি নির্দিশে আমাদের চিনিয়ে দিচ্ছে – ওই যে ধাপে ধাপে উঠে গেছে দূরের পাহাড়, ঐখানে সিকিম – পিছোতে পিছোতে আশ্র্য় নিয়েছে কাঞ্চনজঙ্ঘার পায়ের কাছে, ওই দূরে দেখা যায় ভূটান, আর ওই যে ঘন অরণ্যের মাঝে ওই নিচে লাভা আর উত্তরের ওই সারা আকাশ জুড়ে রয়েছে সপার্ষদ কাঞ্চনজঙ্ঘা। আকাশ পরিষ্কার থাকলে সূর্যোদয়, সূর্যাস্ত দুই দেখা যাবে এখান থেকে। ওইখানে দেখুন, পশ্চিমবঙ্গ সিকিম ভূটান, এই তিন ভূখন্ডের ত্রিবেণী আর তারই গা ঘেঁষে নেওড়া ভ্যালী জাতীয় উদ্যান।
লাভা থেকে ট্রেক করেও আসা যায় রিশপে। হাঁটাপথে এই দূরত্ব মাত্র ৪ কিলোমিটার হলেও, গাড়ী করে কালিম্পং হয়ে আসতে এই দূরত্ব হয়ে যায় প্রায় ১১ কিলোমিটার।
কি অপূর্ব চারিপাশের প্রকৃতি! আমি আর প্রীতি দুজনে বেরোলাম হাঁটতে। রাস্তা তো মাত্র একটাই – উঠে গিয়েছে ওপরে। নিচে নামলে, ফিরে যাবো আবার যেখান থেকে এসেছিলাম সেখানে। দুজনে দুটো লাঠি অবশ্য আগেই জোগাড় করে নিয়েছি। ধুলোওড়া লালচে পাথুরে সরু রাস্তা, এবড়ো থেবড়ো, খুব সাবধানে পা ফেলতে হয়। গাড়ী এলেই একেবারে ধারে সরে যেতে হচ্ছে। এই প্রথম দেখলাম, রাস্তায় চরা গরুও আমাদের পাশ দিয়ে সরে গেলো। পথের ঠিক পাশেই অযত্ন বর্ধিত গাছের জঙ্গল। মাঝে মধ্যেই রয়েছে বাঁক। অপূর্ব এক নৈঃশব্দ যেন ঘিরে রয়েছে রিশপকে। মাঝে মাঝেই সেই নৈঃশব্দ ভেঙে দিচ্ছে কোন গাড়ীর আওয়াজ। আমরা উঠতে লাগলাম ওপরে, আরও ওপরে। রাস্তা এখানেই শেষ। এবার আমাদের সামনেই পথ নিচে নেমে গেছে একেবারে জঙ্গলাবৃত অতল খাদে আর ওপারেই তার প্রাচীর তুলেছে দিগন্তপ্রসারী ৩৬০ ডিগ্রী বিস্তারে সঙ্গীসাথী সহ কাঞ্চনজঙ্ঘা। মনে হয় খাদ পেরোলেই পৌঁছে যাবো তার কাছে।
দুপুরের আহার শেষে বারান্দায় বসে শুধু অনুভব করা রিশপের নৈঃশব্দ, উপভোগ করা তুষারশৃঙ্গমালার নৈসর্গিক সৌন্দর্য আর আস্বাদন করা প্রকৃতির রূপ রস বর্ণ গন্ধ – এছাড়া রিশপে আর কিছুই করার নেই, শুধুমাত্র জমজমাট আড্ডা আর ঘুরে বেড়ানো ছাড়া। আস্তে আস্তে বিকেলের রঙ মুছে যেতে লাগলো, সূর্য অস্ত যেতে বসেছে – আমরা বসে বসে প্রকৃতির সেই রঙ বদলের খেলা দেখতে লাগলাম।
পরদিন ভোরে আমি, প্রীতি, মোহনদা সবাই বারান্দায় দাঁড়িয়ে সূর্যোদয় দেখছি; কল্যাণ তখনো ওঠেনি। তুষার শৃঙ্গমালায় তখন আগুন লেগেছে, নীল কালো আকাশের বুকে তখন চলছেরং এর হোলি খেলা। আকাশের রঙ তখন বদলে যাচ্ছে ক্ষণে ক্ষণে – কখনও আবির, কখনও গোলাপী, কখনও লাল,আবার কখনও আগুনে। কালচে মেঘের সঙ্গেও চলছে তখন সূর্যের এই রঙ বদলের লুকোচুরি খেলা। নিচের রহস্যময় অরণ্যপ্রকৃতিও তখন সবে শুরু করেছে তার রহস্য উন্মোচন। এ যেন অপরূপ এক চিত্র কোলাজ। এই সব কিছুর সঙ্গে মিলে মিশে একাকার আমরাও তখন চিত্রার্পিত, মন্ত্রমুগ্ধ, বাকরুদ্ধ।
ঘরে এসেই আবারও বাক্যহারা। এ কি! কি হয়েছে? কল্যাণ বিছানায় বসা – ভিতরের মোটা গরম গেঞ্জি জলে ভেজা। গেঞ্জি ভিজলো কি করে? জিজ্ঞাসা করে জানলাম, বাথরুমের পাথরের মেঝের জলে পা পিছলে পড়ে গেছে। বাঁ কাঁধে খুব লেগেছে, হাত তুলতে পারছে না। কোন রকমে বার হয়ে এসে বিছানায় বসে আছে। সঙ্গে সঙ্গেই আমরা তাকে ব্যথা নিরোধক ওষুধ খাইয়ে দিলাম। এছাড়া আর তো কিছু করার নেই। কারণ এখানে কোন ডাক্তার নেই – এর জন্য গাড়ী করে দু আড়াই ঘন্টায় কালিম্পং পৌঁছতে হবে, তবে পাওয়া যাবে ডাক্তার। অবশ্য একথা আমাদের জানা ছিলো যে, কাঁধের এমন জায়গায় লাগলে বা চিড় ধরলে সেই জায়গা নড়াচড়া না করে বিশ্রাম দিলে আস্তে আস্তে সেরে যায়। এখানে প্লাষ্টার বা অন্য কিছু করা যায় না। ভাগ্যিস মাথা বা অন্য কোথাও লাগে নি – তা হলে যে কি হ’ত, জানি না! কলকাতায় ফিরে অবশ্য ডাক্তার দেখানো হয়েছিলো, X-Ray-ও করানো হয়েছিলো। কাঁধের হাড়ে চিড় ধরেছিল। ডাক্তারও যতটা সম্ভব হাত ও কাঁধ বিশ্রামে রাখতে বলেছিলেন। ৪/৫ মাস লেগেছিলো একেবারে সুস্থ হতে।
একটা কথা বলতে ভুলেছি – এখানে দোকান, বাজার, এমনকি ওষুধের দোকান বা কোন ডাক্তারও নেই। এদের নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিষপত্র সবই এরা নিয়ে আসে কালিম্পং থেকে। এপথে চলার উপযুক্ত কোন জিপে বা হুড খোলা কোন বড় গাড়ীতে গ্রামের সবাই মিলে একসঙ্গে চলে যায় কালিম্পং; তারপর সেখান থেকে নিজেদের প্রয়োজনীয় জিনিষপত্র নিয়ে আবার ফিরে আসে একই সঙ্গে। আমরা এমন গাড়ীতে সব্জি বাজারের সঙ্গে গ্যাস সিলিন্ডার, এমনকি ছোটখাটো ফার্নিচারও আনতে দেখেছি। কাজেই এখানে যারাই বেড়াতে আসে তারা নিজেদের প্রয়োজনীয় ওষুধপত্র বা জিনিষপত্র সঙ্গে নিয়েই আসে।
প্রাতঃরাশ সেরে কল্যাণ বিশ্রামেই রইলো, সঙ্গে মোহনদাও রইলেন। আমরা দুজনে বেরোলাম হাঁটতে। দুজনে আবার লাঠি ঠুকঠুক করে সেই একই পথে উঠে গেলাম ওপরে। এছাড়া তো আর পথ নেই – না হলে পথহীন ঐ উঁচুনিচু অযত্নবর্ধিত গাছের জঙ্গলে নেমে যেতে হয়। ওপরে পৌঁছে মুক্ত প্রকৃতির মাঝে বড়ফেমোড়া পাহাড়ের সান্নিধ্যে বেশ কিচুক্ষণ কাটিয়ে ফিরে এলাম হোটেলে।
বারান্দা থেকে দেখা, হোটেলের বেশ কিছুটা নিচে পাহাড়ের ধাপে, সেই পার্কের মত, বসার জায়গায় এবার চললাম। হোটেল থেকেই পথ গিয়েছে নেমে। চারিপাশের পাহাড় জঙ্গলের প্রাকৃতিক পরিবেশের মাঝে গ্রামের বেশ একটা চমৎকার চিত্র পাওয়া গেলো এখান থেকে। তাদের ছোট ছোট বাড়ীগুলি বা ক্ষেতগুলি এরই মাঝে সাজানো রয়েছে পাহাড়ের ধাপেধাপে।
হোটেলের খাবার ঘর একটু নিচে নেমে। বিকেলে চা খেতে গিয়ে সেখানেই আমাদের আড্ডা জমে উঠলো। রাতের খাওয়ার শেষে উঠে এলাম ওপরে। দূর পাহাড়ের গায়ে লোকালয়ের ঝল্মল্ করা আলোকবিন্দুগুলো কি আকাশজোড়া ছায়াপথ? বারান্দা থেকেই দেখলাম, আকাশে পূর্ণচাঁদের মায়া আর নিচে চরাচর ভাসানো জ্যোৎস্নাপ্লাবিত মোহময়ী নিস্তব্ধ প্রকৃতি।
গোপা মিত্র
ফিজিক্স অনার্স। একসময়ে কিছুদিন শিক্ষকতা করলেও, প্রকৃতপক্ষে গৃহবধূ – কিন্তু পায়ের তলায় সর্ষে। ভ্রমণের নেশা প্রবল। ভারতের বাইরে কোথাও না গেলেও দেশের মধ্যেই প্রচুর ঘুরেছেন। পাহাড়, সমুদ্র, জঙ্গল, ঐতিহাসিক স্থান – কোনোওকিছুই বাদ নেই। এখনও সুযোগ সুবিধে হলেই বেরিয়ে পড়েন। দু-কলমের জন্যে জীবনে প্রথমবার কলম ধরা।
অনবদ্য
ধন্যবাদ।
অপূর্ব দৃশ্যর সাক্ষী হয়েছো তুমি।হিংসে হচ্ছে আমার। যাইহোক তোমার লেখার মাধ্যমে আমি কিছুটা উপভোগ করতে পেরেছি।খুব সুন্দর লেখা ।পড়ে বেশ ভাল লাগল।
তোমার ভালো লেগেছে , তাতেই আমার খুশী, আমার আনন্দ ।