বিবিধপ্রবন্ধ

নবদ্বীপ

শৈবাল বসু

আমি চৈতন্যদেবের ইতিহাস লিখতে বসিনি। শুধু কতগুলো বিচিত্র তথ্য নবদ্বীপ ও চৈতন্যদেবের সম্বন্ধে জানতে পেরে সেগুলো লিখছি। পাঠকের ভাল লাগলে আমার পরিশ্রমের সার্থকতা। আমি কোনো সাহিত্যিক নই কাজেই এই লেখার মধ্যে সাহিত্যগুণ খুঁজতে যাওয়া বৃথা। এ শুধু নীরস তথ্যের কচকচানি।

নবদ্বীপ

নবদ্বীপ শহরটি বর্তমানে ভাগীরথীর পশ্চিম পাড়ে অবস্থিত। পূর্ব পাড়ে নদীয়া জেলা। শহরটি শাসনগত ভাবে নদীয়া জেলার অন্তর্গত যদিও ভৌগলিক ভাবে শহরটি বর্ধমান জেলা দ্বারা উত্তর দক্ষিণ ও পশ্চিমে পরিবেষ্টিত। পূবে ভাগীরথী। ব্যান্ডেল কাটোয়া রেল লাইন এর পশ্চিম সীমা যদিও শহর ধীরে আড়ে বাড়ছে।

নবদ্বীপ কত পুরানো ? অনুমান আজ থেকে কমবেশী দেড়শত বছর পূর্বে টুইনিং নামে জনৈক ভ্রমণকারী লিখে গিয়েছিলেন যে তিনি খ্রীষ্টজন্মের আড়াই হাজার বছর পূর্বে এই শহরের অস্তিত্ব ছিল বলে প্রমাণ পেয়েছেন। মহাভারতের সভাপর্বে ত্রিংশৎ অধ্যায়ে উল্লেখ আছে যে ভীমসেন পুন্ড্রাধিপতি বাসুদেব ও কৌশিকী কচ্ছের রাজা মহৌজাকে যুদ্ধে পরাজিত করে বঙ্গরাজ্য আক্রমণ করেন ও মহীপতি সমুদ্রসেন চন্দ্রসেন ও তাম্রলিপ্তবাসী রাজাকে পরাজিত করেন। অনেকে মনে করেন সমুদ্রসেন নবদ্বীপ সংলগ্ন বর্তমান সমুদ্রগড়ের রাজা ছিলেন ও চন্দ্রসেন নবদ্বীপ অন্তর্গত সুবর্ণবিহারের রাজা ছিলেন। খ্রীষ্টপূর্ব দুই তিন শতাব্দী পর্যন্ত রোমান বাণিজ্যপোত সাতগাঁ বা সপ্তগ্রাম হয়ে নবদ্বীপ পর্যন্ত আসত ব্যবসার উদ্দেশ্যে। কেউ কেউ মনে করেন যে শূরবংশীয় রাজাগণ নবদ্বীপের শূরডাঙা বা শ্বরডাঙায়, পালবংশীয় রাজাগণ সুবর্ণবিহারে ও সেনবংশীয় রাজাগণ সীমন্তদ্বীপের অন্তর্গত শোনডাঙা বা শ্যেনডাঙায় রাজত্ব করতেন। যদিও এই মতের স্বপক্ষে বিশেষ ঐতিহাসিক প্রমাণ পাওয়া যায় না। এই নবদ্বীপের অবস্থান নিয়ে মেজর রেনেলের ম্যাপে উল্লেখ আছে গঙ্গা বা ভাগীরথী ও জলঙ্গীর সঙ্গমস্থলে প্রাচীন নবদ্বীপ অবস্থিত। এই ম্যাপ ও তৎকালে প্রাপ্ত বহু নিদর্শন থেকে সেসময়কার নদীয়া জেলাশাসক মূরসাহেব ১৮৩০ খ্রীষ্টাব্দের ২৮শে ডিসেম্বর যে রায় দেন তাতে প্রাচীন নবদ্বীপের স্থান নির্দিষ্ট করা আছে। ১৮৯৬ সালের ১২ই আগস্ট তারিখে কলকাতা হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি স্যার কুমার পেথেরাম ও জজ রেম্পিনি স্পষ্টভাবে রেনেলের মতকেই সমর্থন করে গেছেন। মুসলমানরা এইস্থান অধিকারের পর নাম দিয়েছিল মেঞাপুর কারণ প্রচুর মুসলমান ওই অঞ্চলে থাকত। মহাপ্রভুর জন্মস্থান টিকে মুসলমান নামে অভিহিত করতে ভক্তবৃন্দ কুণ্ঠাবোধ করতেন তাই বৃন্দাবন দাস, মুরারী গুপ্ত প্রভৃতি আদিলেখকরা জন্মস্থান শুধু নবদ্বীপ উল্লেখ করেছেন। পরবর্তীকালে ভক্তিরত্নাকর রচয়িতা নরহরি চক্রবর্তীর মতন লেখকরা মেঞাপুরকে হিন্দুভাবাপন্ন করে মায়াপুর নাম দিয়েছেন। বর্তমান মায়াপুর এটাই। এ ব্যতীত নদীয়ায় দ্বিতীয় মায়াপুর নেই।

নবদ্বীপ নামের উৎপত্তি

নবদ্বীপ নামটির উৎপত্তি নিয়ে বহুমত। একমতে বঙ্গোপসাগরের  এই স্থান বাসোপোযেগী হবার সময় নয়টি দ্বীপ ছিল তাই নবদ্বীপ, আরেক মতে নতুন দ্বীপ সমুদ্রগর্ভ থেকে উথ্বিত হবার ফলে এর নাম নবদ্বীপ। ভক্তিরত্নাকরের লেখক নরহরি চক্রবর্তী নবদ্বীপ নয়টি দ্বীপ নিয়ে গঠিত লিখেছেন। তার ভাষায়:-

“গঙ্গা পূর্ব-পশ্চিম তীরেতে দ্বীপ নয়। পূর্বে অন্তর্দ্বীপ শ্রীসীমন্ত দ্বীপ হয়। গোদ্রুম দ্বীপ শ্রীমধ্য দ্বীপ চতুষ্টয়। কোলদ্বীপ ঋতুজহ্নু মোদদ্রুম আর। রুদ্রদ্বীপ এই পঞ্চ পশ্চিমে প্রচার। এই নবদ্বীপে নবদ্বীপাখ্যা এ আর। প্রভুভক্তি শিবশক্ত্যাদি শোভে সদায়।”

মহাপ্রভুর পূর্বপুরুষগণ

প্রথমেই স্পষ্টভাবে জানাতে চাই যে শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু বাঙ্গালী ছিলেন না। তার পূর্বপুরুষরা ওড়িশানিবাসী ছিলেন।

১১৩১ খ্রীষ্টাব্দে ওড়িশায় গঙ্গারাজ বংশ শুরু হয়। এনারা গঙ্গারাড়ি বা তমলুক-এ মেদিনীপুর থেকে ওড়িশা জয় করে গঙ্গা রাজবংশ প্রতিষ্ঠা করেন। রাঢ় অঞ্চলের প্রায় ত্রিবেণী সঙ্গম পর্যন্ত এদের রাজত্ব বিস্তৃত ছিল। গঙ্গাবংশীয় রাজারা পঞ্চগৌড়েশ্বর উপাধি নিতেন। পঞ্চগৌড় অর্থাৎ সারস্বত বা পাঞ্জাব, কান্যকুব্জ, গৌড়, মিথিলা ও উৎকল। ওড়িশার শিল্পকলার জন্ম যে বাংলায় তা অনেক ঐতিহাসিক স্বীকার করেন। ওড়িশার সর্বশ্রেষ্ঠ স্থাপত্য কোনার্ক মন্দির বাঙালী শিল্পের মহিমাদ্যোতক। এই সম্বন্ধে Sir William Hunter লিখেছিলেন যে “ It concentrates in itself the accumulated beauties of four architectural centuries of the Hindus… it comes from the climax of Bengal Art and wrung an unwilling tribute even from the Mahamodens – Hunter’s Orissa Vol I p 291”।

চৈতন্যদেবের পূর্ব পুরুষ মধুকর মিশ্র ছিলেন ওড়িশার যাজপুর নিবাসী। ওড়িশার রাজা কপিলেন্দ্রদেবের অত্যাচারে তিনি যাজপুর থেকে পালিয়ে শ্রীহট্টে বাস করতে থাকেন। যাজপুর থেকে সুদূর শ্রীহট্টে আসার কারণ কলিঙ্গরাজার আয়ত্বের বাইরে থাকা। কলিঙ্গে আসীন গঙ্গারাজাদের আধিপত্য ছিল দক্ষিণ রাঢ়ের বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে। মধুকরের চার পুত্র – উপেন্দ্র , রঙ্গদানাথ,  কীর্ত্তিদানাথ ও কৃত্তিবাস। উপেন্দ্র মিশ্রের সাত পুত্র, পঞ্চম পুত্র ছিলেন জগন্নাথ মিশ্র। ইনিই চৈতন্যদেবের  পিতা। জগন্নাথ শিক্ষাসমাপ্তির জন্য নবদ্বীপ চলে আসেন। সেই সময় শ্রীহট্টে দুর্ভিক্ষ ও ঘোর অরাজকতা ঘটেছিল। জগন্নাথ নবদ্বীপেই রয়ে যান। একই সময় আরো অনেকের সাথে নীলাম্বর চক্রবর্তী নামে এক বৈদিক ব্রাহ্মণ ও নবদ্বীপ চলে আসেন। তার কন্যা শচীদেবীকে জগন্নাথ মিশ্র বিবাহ করেন। তার আটটি কন্যা সন্তান হয় কিন্তু তারা প্রত্যেকেই আঁতুড় ঘরে বা অপ্রাপ্তবয়সে মারা যায়। এরপর এক পুত্র সন্তান হয় নাম বিশ্বরূপ। বিশ্বরূপের জন্মের ১১ বছর পর ১৪৮৬ খ্রীষ্টাব্দের ১৮ই ফেব্রুয়ারি জন্মগ্রহণ করেন চৈতন্য মহাপ্রভু।

তথ্যসূত্র:

বৃহৎবঙ্গ (প্রথম ও দ্বিতীয় খন্ড) – দীনেশচন্দ্র সেন

নদিয়ার ইতিহাস (প্রথম পর্ব)  – সম্পাদনা কমল চৌধুরী
বাঙ্গালার ইতিহাস (প্রথম পর্ব) – সম্পাদনা কমল চৌধুরী।
লেখক পরিচিতি
শৈবাল বসু

নরেন্দ্রপুর রামকৃষ্ণ মিশন থেকে মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পাশ করার পর সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজ থেকে পদার্থ বিদ্যা নিয়ে স্নাতক। পেশাগত ভাবে গত ৩৪ বছর ধরে ব্যাঙ্কার। নেশাগত ভাবে শরদিন্দু ও ইতিহাস প্রেমী। বর্তমানে কলকাতা ও বাংলার ইতিহাস নিয়ে চর্চারত।

Author

Du-কলম

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!