গোপা মিত্র
এই শীতে ‘স্মৃতির সরণী বেয়ে’ লিখতে বসে শীত ছাড়া কিছুই তো আর মনে পড়ে না। এমনিতে শীত অবশ্য আমার সবচেয়ে প্রিয় ঋতু- তাই তার কথা লিখতে বা বলতে আমি কখনোই ক্লান্ত বা বিরক্ত হই না। প্যাচপ্যাচে ঘেমো গরম, বা স্যাঁতস্যাঁতে ভেজা বর্ষা আমার একেবারেই নাপসন্দ। কবিরা অবশ্য বসন্তের মৃদুমন্দ বাতাস বা ফুলের গন্ধ নিয়ে অনেক কবিতাই লিখে গেছেন, তবে এখন কত বাড়ীতেই বা সেই বাতাসের বা ফুলের গন্ধের অবাধ প্রবেশ রয়েছে?
খুব ছোটবেলায় আমাদের তিনতলা বাড়ীতে লুটোপুটি রোদ্দুরে আমরা তার সঙ্গে লুকোচুরি খেলতাম। ডিসেম্বর মাসে অ্যানুয়েল পরীক্ষার পরে আমাদের তখন বেশ কিছুদিনের ছুটি। আমরা তিন বোনে, কখনো বা মা কাকিমার সঙ্গে রোদে পিঠ দিয়ে বসে সেই অলস দুপুরে গল্প করতাম বা কোনো বোর্ড গেম বা তাস খেলতাম। সূর্য যত পশ্চিমে নামত আমরাও আমাদের মাদুর সরিয়ে তার পিছনে ধাওয়া করতাম, সেই রোদ্দুরে পা দিয়ে আরাম করে শুয়ে হাতে ধরা কোনো গল্পর বই শেষ করার জন্য। কোনো কোনো দুপুরে আবার সকলে ঘুমিয়ে পড়লে চুরি করা আচার- সে কুলের, তেঁতুলের বা কোনো সব্জীর, নিয়ে এসে আমরা তিন বোনে বসে বসে খেতাম। কুলের আচার অবশ্য সরস্বতী পুজোর আগে খাওয়া চলত না।
শীত শুরু হলেই আমাদের বাড়ীতে শুরু হত বড়ি দেওয়ার উৎসব। আগের দিন এত এত ডাল ভেজানো হত, পরদিন তা শিলে বেটে, রোদে পিঠ দিয়ে বসে নতুন কাপড়ের ওপর বাড়ীর বড়রা, মা কাকিমা ঠাকুমা, নানা স্বাদের ছোট বড় নানা আকারের বড়ি দিত। একটা জাল আটকানো বড়ো ফ্রেমের ওপর রেখে দুপুরের রোদে তা শুকানো হত, সারা দুপুর কেউ না কেউ বসে তা পাহারা দিত যাতে কাক পক্ষী তাতে মুখ না দেয়। তবে বড়ি দেওয়ার আগে একটা নিয়ম তারা মানত। প্রথমেই তারা দুটো বড় বড়ি মাঝে বসিয়ে তাদের মাথায় ধান দুর্বো দিয়ে, একজনকে আবার সিঁদুর পরিয়ে বলত যে বুড়োবুড়ির বিয়ে হল। তারপর শুরু হত বড়ি দেওয়া। বড়ি প্রায় শুকিয়ে এলে কাপড় শুদ্ধু সেটা টাঙিয়ে দেওয়া হত তারে, কট্কটে শুকনো হবে বলে। সারা বছরই সেই বড়ি বিভিন্ন তরিতরকারীতে দেওয়া হত।
আমাদের ছাদ বাগানে তখন কত রকমের রঙ বাহারী ফুলের মেলা- ডালিয়া, জিনিয়া, চন্দ্রমল্লিকা, গাঁদা, গোলাপ, বোগেনভলিয়া, কস্মস্, পিটুনিয়া আরো কত কি! সেই ছোট বেলা থেকেই তাই আমরা তিন বোনেই এত ফুল তথা গাছ ভালোবাসি বা প্রকৃতি প্রেমিকরূপে বড় হয়ে উঠছিলাম।
শীতের সূচনাতে, নতুন ধান উঠলেই, মা নবান্ন করত। নতুন ধান, নতুন গুড়, নতুন ওঠা সব্জী, ফলের টুকরো দেওয়া সেই অপূর্ব নবান্নের প্রসাদ আমরাও পেতাম। এখন সেই নবান্নের রীতি উঠে গেছে। বোনটি (মেজ বোন) অবশ্য সেই রীতি এখনও ধরে রেখেছে। প্রতি বছরই তাই আমার নবান্ন খাওয়া হয়েই যায়। শীতের খাওয়াদাওয়ার কথা আর কি বলব? পাটালিগুড়, খেজুরগুড়, নতুনগুড়, নলেনগুড় দিয়ে যখন পিঠেপুলি বা পায়েস রান্না হত সারা বাড়ি তখন সেই গুড়ের গন্ধে ম ম করত। রাতে আর কোনো সব্জী বা তরকারী রান্নার দরকারই হত না, এই সব গুড় দিয়েই আমাদের রুটি খাওয়া হয়ে যেত। বাড়িতে আসত জয়নগরের মোয়া, কাকু যেন কোথা থেকে আনাতো, কি অপূর্ব তার স্বাদ – এখনকার মোয়ায় সেই স্বাদই বা কোথায়?
শীতে একবার চিড়িয়াখনায় যাওয়া আমাদের অবশ্য করণীয়র মধ্যে পড়ত। তাড়াতাড়ি স্নান সেরে তৈরী হয়ে আমরা সবাই রওনা দিতাম চিড়িয়াখানার উদ্দেশ্যে- সঙ্গে থাকত একটা শতরঞ্চি, শীতের কমলালেবু, কেক পেষ্ট্রী কলা আর ডিমসেদ্ধ। হাঁটতে হাঁটতে ক্লান্ত হলে কোথাও বসে একটু জিরিয়ে নেওয়াও যেমন হত ক্ষুধা নিবৃত্তিও তেমনই হয়ে যেত। সন্ধ্যার আগেই আবার ফিরে আসা হত বাড়িতে।
আমি তখন খুব ছোট।একবার শীতকালে বাবা মা ঠাকুমা বড়পিসীমা পিসেমশাইএর সঙ্গে গিয়েছিলাম মিহিজামে। তখন প্রায় সব পরিবারেরই কোনো না কোনো আত্মীয়ের একটা বাগানবাড়ী থাকত পশ্চিমে – শীতকালে সে সব জায়গায় হাওয়া বদলের জন্য যাওয়া হত সপরিবারে। তেমনই আমরাও গিয়েছিলাম – লন্ঠনের আলো, কুয়োর জল, খাটা পায়খানা, এক অন্যরকম ব্যতিক্রমী অভিজ্ঞতা, সেইজন্যই বোধহয় আজও মনে রয়ে গেছে। সারা দুপুর বাগানের আতা আর পেয়ারা গাছে উঠে আতা, পেয়ারা পাড়তাম, গেটের পাশে কাঠ গোলাপ বা কাঠচাঁপা গাছ থেকে ঝরা ফুল কুড়োতাম। একটু বড়ো হয়ে গিয়েছিলাম রাজগীরে কাকা কাকীমার সঙ্গে, বেড়াতে। তবে সেবারও মজার শেষ ছিল না।
আমাদের ছোট বোন আনু যখন প্রবাসী বাঙালি হয়ে দিল্লী নিবাসী হল, তখন প্রায় প্রতি শীতকালেই আমরা সেখানে যাওয়া শুরু করলাম। আনুর বিশাল কোয়ার্টারের একপাশে শীতকালীন সব্জীর আর একপাশে রংবেরংএর ফুলের বাগান। পালং শাক, মেথী শাক, টম্যাটো, বীন্স, গাজর, মুলো, বেগুন, বাঁধাকপি, ফুলকপি- যা দরকার হত টাট্কা সব্জী তুলে নিয়ে এসে খাওয়া হত। শুধুমাত্র যে দিল্লীতেই বসে থাকতাম ,তা নয়, প্রতিবারই আনুর সঙ্গে আমরা উত্তরাখন্ড, হিমাচল প্রদেশ, বা রাজস্থানের বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে বেরিয়েছি। শীতকাল এলেই তাই মনটা বলে ওঠে, চলো কোনো শীতের জায়গায় বেড়িয়ে আসি। এর ব্যতিক্রম অবশ্য এখনও হয় না, শীত এলেই বেড়িয়ে পড়ি কোনো পাহাড়ের সন্ধানে। যারা শীতকালে, শীতের জায়গায় যায় নি তারা এর মজাটাই বুঝবে না।
এই এত সব কারণ থাকতে, শীতকাল আমার সবচেয়ে প্রিয় হবে নাই বা কেন?
গোপা মিত্র
ফিজিক্স অনার্স। একসময়ে কিছুদিন শিক্ষকতা করলেও, প্রকৃতপক্ষে গৃহবধূ – কিন্তু পায়ের তলায় সর্ষে। ভ্রমণের নেশা প্রবল। ভারতের বাইরে কোথাও না গেলেও দেশের মধ্যেই প্রচুর ঘুরেছেন। পাহাড়, সমুদ্র, জঙ্গল, ঐতিহাসিক স্থান – কোনোওকিছুই বাদ নেই। এখনও সুযোগ সুবিধে হলেই বেরিয়ে পড়েন। দু-কলমের জন্যে জীবনে প্রথমবার কলম ধরা।
ভারি নস্টালজিক। সব থেকে ভালো লাগলো কলকাতায় সীমাবদ্ধ না থেকে স্মৃতি ঘুরে বেড়িয়েছে কলকাতার বাইরের সুখকর স্মৃতির সরণিতে।
ধন্যবাদ ।
সুন্দর লিখেছেন। জামতাড়া মিহিজাম জায়গার উল্লেখে আমিও নস্টালজিক হয়ে পড়লাম। সাবলীল বর্ণনা, যা আমার ভীষণ ভালো লাগলো।
লেখা ভালো ।
আমরা কোনদিন বাড়ির সবাই মিলে শীতকালে চিড়িয়াখানা গেছি বলে মনে পড়ে না ।
তবে শীতকালে আমাদের দিল্লীর বিভিন্ন বাড়িতে আমরা সবাই খুব আনন্দে সময় কাটিয়েছি। সব সুখকর স্মৃতি এখন মনের মধ্যে রয়েছে।
বাঃ তোমার লেখা টা দারুণ লাগল।লেখার ভাষাটা এত সুন্দর যে শীতের অলস দুপরের ছবিগুলো অপুর্ব ভাবে ফুঠে উঠেছে। খুবই ভালো লাগল।