গোপা মিত্র
[আমার এই লেখা কোনোদিনও কেউ পড়বে কিনা আমি জানি না। কিন্তু যাদের স্নেহচ্ছায়ায়, শিক্ষায়, আদর্শে আমি বেড়ে উঠেছি বা যাদের সাহচর্যে আমার জীবনের সেরা মুহূর্তগুলি কাটিয়েছি, তাদের কেউই আজ আমাকে সঙ্গ দেওয়ার জন্য এই পৃথিবীতে বেঁচে নেই। আমার এই স্মরণিকা তাদের উদ্দেশ্যে শ্রদ্ধা নিবেদনের এক ছোট্ট প্রচেষ্টা মাত্র।]
পর্ব-১
আমার পরিবার
ফিরে দেখা, এ যেন নিজের সঙ্গে নিজেই কথা বলা, কিংবা সামনে আয়না ধরে সময়ের পরিবর্তন নিজেই খুঁজে ফেরা। মনে প্রশ্ন, এতদিন পরে স্মৃতিচারণের প্রয়োজনই বা পড়ল কেন? বেশ তো চলছিল একঘেঁয়ে এই অবসর জীবন। আচ্ছা, অনেক দিন পরে যদি ছোটবেলার পুরোনো বন্ধুদের দেখা হয়, তখন কি তারা নিজেদের একসঙ্গে পথচলার দিনগুলোর কথা স্মরণ করে কিছু্ক্ষণের জন্য হলেও আনন্দ পায় না? আর তার রেশও তো থেকে যায় অনেকক্ষণ। আমিও হয়ত তেমনই ছোটবেলার সেই বর্ণময় আনন্দোচ্ছল মধুর মুহূর্তগুলো অবচেতন থেকে তুলে এনে আমার এই একঘেয়ে জীবনকে সামান্য ক্ষণের জন্য হলেও বদলে দিয়ে সেই খুশীর রঙে নিজেকে রাঙিয়ে তুলতে চাইছি!
আমার জন্ম উত্তর কলকাতার যে অঞ্চলে সেখানে বাড়ীগুলো সব গায়ে গায়ে, সহজেই এক ছাদ থেকে অন্য ছাদে যাওয়া যেত, যদিও কোনদিন সেখানে চুরি হয়েছে বলে শুনিনি। প্রতিবেশীদের সঙ্গে সদ্ভাব থাকলেও খুব যে যাতায়াত ছিল তা নয়। কোনো অনুষ্ঠান হলে অবশ্য যাওয়া আসা চলত।
জন্মের পর বোধবুদ্ধির উদয় হতে দেখলাম, আমার চারিপাশ ঘিরে রয়েছে মা, বাবা, কাকা (কাকু), কাকিমা (তাইমা), ঠাকুমা (দাদি) আর আমার দুই ছোট বোন। এই নিয়েই আমাদের ছোট, কিন্তু সুখী পরিবার।
দাদুকে অবশ্য আমি চোখে দেখিনি – আমার জন্মের আগেই তিনি মারা গিয়েছিলেন। তবে দাদির কাছে শুনেছি, তিনি এতটাই লম্বা ছিলেন যে, সে সময়ের রাস্তার গ্যাসলাইট থেকে তিনি নাকি সিগারেট ধরাতেন! মজা করে দাদিকে আমরা জিজ্ঞেস করতাম, ‘আচ্ছা দাদি, দাদুর সংগে তোমার মালা বদল কি করে হয়েছিল গো? দাদু একতলায় দাঁড়িয়েছিল, আর তুমি দোতলা থেকে দাদুর গলায় মালা পরিয়েছিলে নাকি!’ এই কারণেই আমাদের বাড়ীর সদর দরজা থেকে আরম্ভ করে সব দরজা, সঙ্গে জানলাগুলোও দরজার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে, খুব উঁচু উঁচু ছিল। দাদুই শুধু নয় আমার বাবা কাকা, তিন পিসি, দুই বোন সকলেই বংশের ধারা বজায় রেখে বেশ লম্বা। একমাত্র ব্যতিক্রম শুধু আমিই – মায়ের জিনের প্রভাব বোধহয় আমার উপর একটু বেশীই ছিল, তাই আমার উচ্চতা একেবারেই স্বাভাবিক। নিজের হীনমন্যতা বোধ থেকেই সম্ভবতঃ সেই ক্লাস সিক্স থেকেই আমি হিল পরা অভ্যাস করেছি। অথচ এখন সেই হিল আমি পরতেই পারি না, পায়ে ব্যথার জন্য। বয়সের সঙ্গে সঙ্গে কত কিছুই না বদলে ফেলতে হয়, বা মেনে নিতে হয়!
স্বাধীন ভারতের তখন শিশুকাল। ছাদ, বারান্দা, উঠোন, দালান, বাইরের সিঁড়ি, ভিতরের সিঁড়ি সব মিলিয়ে আমাদের খোলামেলা দোতলা (তখন দোতলা, পরে অবশ্য তিনতলা হয়েছিল) বাড়ীতে আলো হাওয়ার প্রবেশ ছিল অবাধ। সদর দরজার পাশে, রাস্তার ধারে বাবার বৈঠকখানা ঘর- একধারে তক্তপোশে বিছানা পাতা, মাঝখান সাজানো চেয়ার টেবিল দিয়ে- বাবা সেখানে ছাত্র পড়াচ্ছেন, চারিপাশে তার বই ভর্তি আলমারী। আমার গোল্ড মেডেলিস্ট ডক্টরেট বাবা ছিল কলেজের প্রফেসর, পরে অবশ্য প্রিন্সিপাল হয়েছিল। যতটা না বাবা পয়সা নিয়ে পড়াত, তার চেয়েও বিনামূল্যে তাদের সাহায্য করত বেশী। আসলে পড়তে এবং পড়াতে বাবা ভালোবাসত। সময় পেলে বাবা ঐ ঘরের বিছানাতেই একটুক্ষণ জিরিয়ে নিত।
বৈঠকখানার সামনেই বাঁধানো এক উঠোন—একপাশ দিয়ে তার দোতলায় ওঠবার সিঁড়ি, বাইরের সিঁড়ি। তার নিচে কাজের লোকেদের স্নান করার ব্যবস্থা, সঙ্গে টয়লেট। সেখানেই ছিল বিশাল এক চৌবাচ্চা, সময় মত কর্পোরেশনের জল এলে সেই চৌবাচ্চা ভরে যেত। পরে এই চৌবাচ্চার সঙ্গে পাম্প লাগিয়ে দোতলা তিনতলায় জল তোলা হত।
উঠোন সংলগ্ন অন্যপাশে ছিল কাকুর বসার ঘর,-সোফাসেট, কাচের খেলনা দিয়ে আলমারী সাজানো। এই ঘর সংলগ্ন ছিল, চেয়ার টেবিল পাতা খাবার ঘর। বিশিষ্ট জন এলে এই ঘরেই হত খাওয়াদাওয়ার আয়োজন। কাকু(কাকা) ছিল বিদেশী এক প্রাইভেট কোম্পানীর উচ্চপদস্থ অফিসার। সকাল বেলা গাড়ী এসে কাকুকে নিয়ে যেত। কাকুর কাছে কেউ এলে এই ঘরেই বসত। মাঝে মধ্যে দেখতাম, কাকুর কোনো সাহেব বস্ তাঁর স্ত্রীকে নিয়ে এসেছেন – তারপর নিচের ঘরেই বসে খাওয়াদাওয়া সেরে চলে যাচ্ছেন। অনেক পরে কাকু অবসর নিলে কাকুর বন্ধুরা এসে, এই ঘরেই বসাত ব্রীজের আসর। সারা দুপুর দোতলার কাকু/তাইমার ঘর থেকে সেই বয়স্ক মানুষদের চীৎকার চেঁচামেচি যেমন শোনাও যেত তেমন দেখাও যেত।
এরপরেই বলা যায় আমাদের অন্দরের শুরু। খাবার ঘর থেকে বার হলেই সামনে তিন দিক ঘিরে এক উঁচু দাওয়া। একদিকে তার বাড়ীর সবার স্নানঘর সঙ্গে টয়লেট। দাওয়ার সামনেই আবার এক উঠোন – সেখানেও রয়েছে কল, চৌবাচ্চা। এখানেই বাসন মাজার ব্যবস্থা। আমার চোখের সামনে ভেসে উঠলো এবার এক দৃশ্যছবি – তাইমা (কাকিমা) দাওয়ার একপাশে এক গামলা জল আর শাকসব্জী নিয়ে বসে সেইদিনের রান্নার তরকারী কেটে ধুয়ে থালায় সাজিয়ে রাখছে, সামনে একটু তফাতে বসে একজন কাজের লোক শিলনোড়া দিয়ে বাটনা বাটছে (কারণ তখন গুঁড়ো মশলার চল ছিল না), তারই একটু দূরে বসে দাদি নিজের পছন্দমত রান্নার ব্যবস্থা করছে, উঠোনে বাজার থেকে আনা মাছ পড়ে রয়েছে (কাজের লোকের হাত খালি হলে, কাটা হবে)। সাড়ে আটটা, প্রায় বাজে, দাওয়া সংলগ্ন রান্নাঘরে ঠাকুর, উনোনে রান্না চাপিয়ে দিয়েছে। একটু পরেই কাকু অফিস বেরোবে, আমরা স্কুলে যাবো। রান্নাঘরে ছোট, প্রায় দেড়ফুট উঁচু এক পাঁচিলের দুপাশে দুই কয়লার উনোন জ্বলছে, একটা আমিষ আর একটা নিরামিষ উনোন। এমন সময় আমি, উঠোনের পাশ থেকে দোতলায় উঠে যাওয়া ভিতরের সিঁড়ি দিয়ে চটি ফট্ফট করে নিচে নামছি মুখে ব্রাস পেষ্ট নিয়ে, উঠোনের কলে দাঁত মাজবো বলে। আমাকে দেখেই তাইমা বলে উঠল, ‘ঐ এলেন কুইন ভিক্টোরিয়া, যাক্ এতক্ষণে তাহলে তার সকাল হল’। ক্লাস সেভেন এইট থেকেই রাত জেগে পড়া আমার অভ্যাস, তাই ঘুম ভাঙতে আমার দেরী হত।
এবার মা’কে দেখা গেল সিঁড়ি দিয়ে নিচে নামতে। মা সবচেয়ে আগে ভোরবেলা ঘুম থেকে উঠে একতলার স্নানঘরের চৌবাচ্চার বাসি জল ছেড়ে, পরিস্কার করে, আবার নল বন্ধ করে দিত যাতে টাটকা জলে আবার চৌবাচ্চা ভরে যায়। তারপর স্নান সেরে, দোতলার ঠাকুরঘর মুছে, পূজো শেষ করে সংসারের কাজে হাত লাগাত। ততক্ষণে ঠাকুর ওপরে দোতলার এক ঘরে- আমরা এই ঘরটা বসার ঘর বা খাবার ঘর হিসাবে ব্যবহার করতাম, বাবা মা’কে চা আর আমাদের দুধ দিয়ে গেছে। ঘরেই রাখা একটা হীটারে মা পাঁউরুটি টোস্ট করে মাখন জ্যাম লাগিয়ে বাবার সঙ্গে আমাদেরও খেতে দিত। আমার রাত জাগা শুরু হলে অবশ্য দেরী করে ওঠার জন্য আমি শুধুমাত্র দুধই খেতাম।
বাবার খাওয়া হয়ে গেলে বাবা, নিচের বৈঠকখানাতে ছাত্র পড়াতে বসে যেত। আমরা স্নান সেরে স্কুল পোষাকে তৈরী হয়ে নিচে নামতাম। মা আমাদের তৈরী করে দিত। ততক্ষণে ঠাকুরের সকালের রান্না প্রায় শেষ- কাকু নিচের খাবার ঘরে, ভাত খেয়ে অফিস বেরিয়ে গেছে। তাইমা তরকারী কেটে ঠাকুরকে সেদিনের রান্না বুঝিয়ে দিয়ে ওপরে দোতলায় নিজের ঘরে উঠে গেছে। একতলায় যেখানে তাইমা এতক্ষণ বসে তরকারী কাটছিল সেই জায়গা মোছা হয়ে গেছে – ঠাকুর সেখানে আমাদের ভাত বেড়ে দিয়েছে। আমরা তিন বোনে তিনটে পিঁড়ে পেতে সেখানে এসে বসলে মা আমাদের একসঙ্গে খাইয়ে দিয়ে আমাদের স্কুলে রওনা করিয়ে দিত। এবার মা সংসারের অন্য কাজকর্মে ব্যস্ত হয়ে পড়বে। মা লেখাপড়া জানলেও, স্কুল পাশ করেনি অথচ ছিল প্রখর বাস্তব বুদ্ধিসম্পন্না। কিছু শুনে শেখা বা দেখে শেখার গুণ ছিল মায়ের মধ্যে। আমাদের তিনতলায় ঘর ওঠার সময়ে মা ইঞ্জিনিয়ারকে বুঝিয়ে দিয়েছিল, কিভাবে কি করতে হবে। প্রথমে অসম্ভব বলে অরাজী হলেও মায়ের যুক্তি তিনি মেনে নিয়েছিলেন এবং সেভাবেই সব কিছু হয়েছিল। পরে ব্যাংক ম্যানেজার আমাদের ছোট পিসেমশাই মা’কে বলেছিলেন, “তোমার ব্রেণটা দেখছি বাঁধিয়ে রাখতে হবে।”
ছোটবেলায় ভাত খাওয়াতে বসে মায়ের কথাগুলো এখনো আমার কানে বাজে। তখন মা আমাদের সব্জীর গুনাগুন আমাদের মত করে বোঝাতে চাইত, “আলু খেলে পোষ্টাই (পুষ্টি নয়) হয়, ডাল খেলে গায়ে জোর হয়, শাক খেলে মাথায় চুল হয়, চিনি খেলে হাড় শক্ত হয়, মাছ খেলে চোখের জ্যোতি বাড়ে।” বড়ো হয়ে বুঝেছি মায়ের বলা এ সব কথাগুলোই কিন্তু ঠিক ছিল।
বাড়ীর কাছেই ছিল আমাদের স্কুল। আমাদের পুরনো কাজের লোক বয়স্কা গোলাপদি আমাদের তিনজনকে স্কুলে পৌঁছে যেমন দিত, ছুটির পরে ফিরিয়েও তেমন আনত, আবার দুপুরে টিফিন খাওয়াতেও যেত। গোলাপদি, আমাদের বাড়ীর রাতদিনের কাজের লোক, বয়স আরো বাড়লে, দেশে চলে যায়। আজীবন আমাদের বাবা কাকা তাকে পেনশন হিসাবে টাকা পাঠাত।
এভাবেই আমার পরিবার পরিজনদের স্নেহচ্ছায়া নাকি ছত্রছায়ায়, একদিন যে ছোটবেলার শুরু হয়েছিল আজ প্রায় তা পৌঁছে গেছে পরিণতিতে। আজ যখন পিছন ফিরে দেখি, নিজেকে আবিস্কার করি পরিণত চোখে আর একবার ফিরে যেতে ইচ্ছে করে আমার জীবনের ফেলে আসা সেই, সেরা দিনগুলোতে। মন চাইলেও, বাস্তবে জানি তা আর সম্ভব নয়, তাই হাতে কলম তুলে নিয়ে স্মৃতিচারণে বসি।
প্রথম পর্ব সমাপ্ত
গোপা মিত্র
ফিজিক্স অনার্স। একসময়ে কিছুদিন শিক্ষকতা করলেও, প্রকৃতপক্ষে গৃহবধূ – কিন্তু পায়ের তলায় সর্ষে। ভ্রমণের নেশা প্রবল। ভারতের বাইরে কোথাও না গেলেও দেশের মধ্যেই প্রচুর ঘুরেছেন। পাহাড়, সমুদ্র, জঙ্গল, ঐতিহাসিক স্থান – কোনোওকিছুই বাদ নেই। এখনও সুযোগ সুবিধে হলেই বেরিয়ে পড়েন। দু-কলমের জন্যে জীবনে প্রথমবার কলম ধরা।
খুব ভালো লাগল। 👍
ধন্যবাদ ।
Daarun lekha. Waiting for the next.
Thank you . I am honoured.
Tomar lekha pore Amar chelebelar Katha mone porche..jokhonee am tomader Bari jetam,Bordeau(tomorrow baba) nicer ghore chatra paraten ebong amake deke parasonar Katha jibes korten.tarpore mejdadu/natundida songe kotha bole chole astum.tomra dotalar ghore parasuna korte.ekhon seisab diner kotha monepore.Baroma songe dekha kortam.Boroma Amake jibe goja khete diten.
তোমার এসব কথা মনে আছে দেখে খুব ভালো লাগলো । কি সব মানুষ ছিলেন বল তো সব !
বাহ্ , চমৎকার লাগলো। এত পরিণত লেখা আর নিবিড় বর্ণনা । খুব ভালো লাগলো পড়ে ।
অনেক ধন্যবাদ ।
Darun laaglo Gopa mashi lekha ta pore. Shabolil bhasha. Sei purono barir onek kotha mone pore gyalo. Aro lekho.
অনেক ধন্যবাদ ।