Home বিবিধ চিঠি
বিবিধ

চিঠি

অরূপ বন্দ্যোপাধ্যায়

গুরেজ, কাশ্মীর

০২.০১.১৯৯০

সুচরিতা,

আজ তিনমাস হল আমি বাড়ি ছাড়া। পড়ে আছি, বা বলা যায় বন্দী হয়ে আছি ভূস্বর্গের একেবারে শীর্ষে। সাধারণের পক্ষে এখানে প্রবেশ করা অসাধ্য। সরকার সেই স্বাধীনতা সবাইকে দেয়নি। আর দেবেই বা কেন? ভারতের এই বিশেষ ভূখণ্ডে জনরোষ এখন তুষের আগুনের মত ধিকিধিকি জ্বলছে। উপর থেকে দেখে কিচ্ছু বোঝার উপায় নেই। মাঝে মাঝে গোলাবারুদের আওয়াজ উপত্যকার নিস্তব্ধতা বিদীর্ণ করে দেয়, শান্তি ভঙ্গ করে। বিক্ষিপ্ত এমন কিছু ঘটনা ছাড়া সবকিছুই নির্মল, যেমন বয়ে চলেছে নীলম নদী। নদীর উপর দিয়ে বয়ে যায় শীতল হাওয়া। পাইন আর চিনার গাছের পাতায় ওঠে সরসর শব্দ। এত নিরবতায় কানে ঝিঁঝিঁ ধরে যায়।

নীলম নদীর নাম শুনে ভ্রু কুঁচকিও না। ঝিলম নদীর মতই কাশ্মীরে বয়ে গিয়েছে নীলম নদী। ভারতে উৎপত্তি, তারপর সে বয়ে গিয়েছে প্রতিবেশী দেশে। নদী তো আর সীমান্তের বেড়া চেনে না! খানিকটা সেখানে বয়ে গিয়ে আবার আমাদের দেশে সে বয়ে এসে মিশেছে ঝিলমে। 

এই নীলম নদীর ধারেই আমার যাবতীয় কাজের দায়িত্ব নিয়ে আসা। এসেছিলাম কিছু বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা নিরীক্ষা করব বলে, সরকারি আদেশে। এই উপত্যকা আমার অচেনা। সেই যে কবি বলে গিয়েছিলেন— “অচেনাকে ভয় কী আমার ওরে!” তবে ভয় যে একটু পাইনি তা কিন্তু নয়। নির্ভয় তখনই হয়েছিলাম, যখন শ্রীনগর থেকে গুরেজ যাবার পথে আমাদের জীপটাকে একজায়গায় এনে গুঁজে দেওয়া হয়েছিল মিলিটারি কনভয়ের পেটের ভিতরে। সারবদ্ধ সবুজ ট্রাকের মধ্যে হয়ত আমাদের গাড়িটা নেহাতই বেমানান লাগছিল, কিন্তু জীপের বাইরে বেরনো নিষেধ। থামার অবকাশ নেই। কোথায় কোন মৃত্যু ফাঁদ পেতে বসে আছে কে জানে? তবে সাঁজোয়া বাহিনীর সশস্ত্র জওয়ানদের সান্নিধ্যে ভয় গিয়েছিল কর্পূরের মত উবে। 

গাড়ির মধ্যে ঘুমে ঢলে পড়েছিলাম আমি ও আমার সহকর্মীটি। শুধু পরিচয়পত্র দেখতে চাইল চেক পোস্টের কাছে। তখন গাড়ি গেল থেমে। বাইরে পা দেবার সুযোগ পেয়ে অনেকক্ষণ বাদে একটা সিগারেট ধরিয়ে সুখটান দিতে দিতে চারিদিকে তাকিয়ে মনে হল, যেন স্বর্গদ্বারে পৌঁছে গিয়েছি। কাগজপত্র পরীক্ষা করছিলেন যে সামরিক অফিসার, তিনি সামান্য হেসে বলেছিলেন, “জলদি সিগ্রেট পি কে অন্দর বৈঁঠিয়ে জনাব!”

শীতের কামড় যে এত তীব্র হতে পারে, কস্মিনকালেও জানা হত না যদি না কাশ্মীরে এসে পড়তাম। আমার সুতির জ্যাকেট এই শীতের কাছে কিছুই নয়। হাড়ের ভিতর দিয়ে কাঁপুনি উঠছে। মাঝে মাঝে মনে হচ্ছে যদি ঠাণ্ডায় জমে বরফ হয়ে যাই! 

এখানে মানুষ একটা লম্বা আলখাল্লার মত উলের পোশাক পরে, ওরা বলে ফিরন। ফিরনের নিচে গলায় ঝুলিয়ে রাখে মাটির পাত্রে রাখা কাঠকয়লার ধিকধিকি আগুন। এতে শরীর গরম থাকে। ওরা বলে আঙ্গিঠী। পুরুষেরা কিছুটা কর্মবিমুখ হলেও মেয়েরা বেশ কর্মঠ। উপত্যকায় ভেড়া চরানোই বলো, শুকনো কাঠের বোঝা বয়ে নিয়ে আসাই হোক, বা রান্নাবান্না, সব মেয়েরাই করে। কিন্তু মানুষের জীবনযাত্রা বড় সরল, বড় ধীর লয়ে বয়ে চলে। কিন্তু কোথায় যে অশান্তি এদের মনে লুকিয়ে আছে, কে জানে? 

আমার অস্থায়ী আস্তানা হল প্রোজেক্টের গেস্ট হাউস, চারদিক পাহাড়ে ঢাকা গোল উপত্যকার মাঝে যেন একটা বড়সড় উঠোন। যেদিকে নজর যায়, শুধু বরফ ঢাকা পাহাড়। বৃষ্টির দেখা নেই, তাই বরফ পাত হচ্ছে না। ঝকঝকে নীল আকাশের গায়ে ভেসে বেড়ায় সাদা মেঘের দল। আকাশের রঙ এত নীল হতে পারে, এখানে না এলে জানতেও পারতাম না। এত নিস্তব্ধ চরাচর যে কানে ঝিঁঝিঁ লেগে যায়। অনেক দূরে মেষ পালকের গলা খাঁকারির আওয়াজ পাই, যেন দুই হাত দূরে। তাপমান মাপার যন্ত্রে দেখলাম শূন্যের নিচে পাঁচ ডিগ্রি। কোলকাতায় বসে যা তোমার কল্পনারও বাইরে।

একটা ছোট্ট পাহাড়ের মাথায় চড়তে হয় রোজ। সেখানে একটা কৃত্রিম সুড়ঙ্গ বানানো হয়েছে। সেই সুরঙ্গের দেওয়ালে যন্ত্রপাতি বসিয়ে কিছু পরীক্ষা করতে হয়। এখানে একটা বাঁধ তৈরি হবে। সেই কাজে ব্যবহার হবে আমাদের পরীক্ষার ফলাফল। সেসব পুঙ্খানুপুঙ্খ তোমার না জানলেও দিব্যি জীবন চলে যাবে। সেকথায় আর ঢুকতে চাই না। একদিন সুরঙ্গের বাইরে দাঁড়িয়ে কাছের একটা পাহাড়ের মাথায় নজর ফেলে দাঁড়িয়ে আছি, একজন মজদুর বলল, “পাহাড়োঁ মে কেয়া দেখতে হো হুজুর? কেয়া হ্যায়?”

চমকে গিয়ে বললাম, “ওই যে সূর্যের আলো ত্যারছা ভাবে সাদা পাহাড়ের মাথায় পড়ে কী অপূর্ব ছটার সৃষ্টি করেছে, তাই দেখছি।”

সে হেসে উঠে বলল, “আমি তো বাল্যকাল থেকেই এইসব দেখে আসছি! নতুন আর কী?”

বুঝলাম বিস্মিত হতে গেলে বাসস্থান ছাড়তে হয়। নইলে পৃথিবীর সব রূপ রস গন্ধ তো একঘেয়ে। নিজেকে ভাগ্যবান মনে করলাম। নাঃ, তোমাকে দেখানোর ইচ্ছে থাকলেও নিরুপায়। রাজনীতির বেড়াজালে পৃথিবীর কত সৌন্দর্য মানুষ চাক্ষুষ করতে পারে না। 

এখানে আর একটা স্রোতস্বিনী আছে, তবে সে তন্বী। সেই নদীর উপর দিয়ে রাস্তা চলে গিয়েছে, কাজেই একটা কাঠের সাঁকো আছে। একবারে একটা গাড়িই যেতে পারে। গুরেজ গ্রামের একমাত্র সংযোগ রক্ষাকারী এই রাস্তা, এই সাঁকো। সাঁকোর উপর দিয়ে একদিন হাঁটছি, নজরে এল একটা মিলিটারি চেক পোস্ট। আগে দেখিনি, কারণ গাড়িতে বসে যাবার সময় লক্ষ্যই করিনি। 

চেক পোস্টে একজন তরুণ সিপাই বালির বস্তার পিছনে বন্দুক তাক করে দাঁড়িয়ে। তাঁর নজর আমার দিকে। সৌজন্যমূলক হাসি হাসলাম। তার কঠিন চোখে পলক পড়ে না, হাসি কোথা থেকে আসবে। কতই বা বয়স হবে, বড়জোর উনিশ কী কুড়ি! হয়ত কোনও প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে নেহাত পেটের দায়ে ঘর ছেড়ে ফৌজে নাম লিখিয়েছে। 

ফেরার সময় দাঁড়িয়ে পড়লাম চেক পোস্টের সামনে। ভিতর থেকে মধ্যবয়সী ফৌজি বেরিয়ে এল। 

 “চায়ে চলেগি জনাব?”

 “খুব চলেগি! শুক্রিয়া!”, আমি একটু ধাতস্থ হই। বন্দুকধারী সিপাই কিন্তু সাঁকো থেকে নজর সরাল না। 

আমি পকেট থেকে সিগারেট বার করে বয়স্ক ফৌজির দিকে বাড়িয়ে দিতে সে বলল, “হামারে লিয়ে বাহার কে লোগো কা হাত সে কুছ ভী লেনে কী মানা হ্যায়।”

কী আশ্চর্য! একই দেশের হয়েও আমি বাইরের লোক! বুঝলাম কেউ ওদের উপর ঘুমের ওষুধ বা বিষপ্রয়োগ করতে পারে বলে এই আইন। এদের দায়িত্ব হচ্ছে সাঁকো সামলানো। একবার নাকি বিস্ফোরক লাগিয়ে সাঁকোটা উড়িয়ে দিয়েছিল কারা। আবার হয়ত একদিন হটাত করেই… কে জানে? আড়চোখে তরুণ সিপাইকে দেখে নিই। চা শেষ হলে আরও একবার ধন্যবাদ জানিয়ে চলে এলাম। এমন বিস্বাদ চা আমি জীবনে খাইনি।

এখন লিখতে গিয়ে আঙুল অসাড় হয়ে আসছে। তাই আজকের মত ইতি টানছি। এখন রাত আটটা। কোলকাতা এই মুহূর্তে কল্লোলিনী। এই প্রান্তে মানুষ ঘুমিয়ে অচেতন। কবে ফিরতে পারব জানি না। চিঠির উত্তর পাব না জেনেই লেখা। কাল মিলিটারি বাক্সে চিঠি দেব। ওরা নাকি স্ক্যান করে চিঠি পাঠায়। বাংলা কতটা বুঝবে কে জানে? তবে চিঠি পৌঁছে যাবে আশাকরি। 

ফেরার সময় শ্রীনগর থেকে তোমার জন্য একটা ফিরন নিয়ে আসব। ভালো থেকো।

ইতি,

অনির্বাণ

 

Author

Du-কলম

Join the Conversation

  1. খুব ভালো লাগলো।মনে হোলো আমি স শরীরে পৌছে গেছি অনির্বান এর পাশে।

  2. ভাল লাগল। এটা কি এবার কাশ্মীর নিয়ে ধারাবাহিকের প্রথম কিস্তি?
    কাশ্মীর আমি যাই নি। আর যাওয়াও হবে না।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!