Home বিবিধ, প্রবন্ধ রোজকার জীবনে গভীর ঘুমের প্রয়োজনীয়তা
বিবিধপ্রবন্ধ

রোজকার জীবনে গভীর ঘুমের প্রয়োজনীয়তা

সঞ্চারী গোস্বামী মজুমদার


 

প্রত্যেক মানুষের জীবনে ঘুমের প্রয়োজনীয়তা আছে।  কিন্তু কেন এই প্রয়োজনীয়তা? ঘুম কেন এবং কতটা দরকার?  এটার সাথে আমাদের মানসিক, শারীরিক এবং দৈনন্দিন জীবনযাত্রার উপর কি কোনো প্রভাব ফেলে?-  এইসব প্রশ্ন হয়তো আমরা অনেকবার ভেবেছি।  আবার কেউ কেউ ভাবেননি।  তাই আমার চেষ্টা হচ্ছে এবার একে একে এইসব প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার।

 আমাদের জীবনে ঘুম একটা গুরুত্বপূর্ণ স্থানে আছে।  কিন্তু দেখা যাচ্ছে যে আমাদের জীবনে রোজকার ব্যস্ততার জন্য ঘুম অনেকাংশেই পুরো হয়না বা আমাদের মনে হয় যে বেশি ঘুমিয়ে থাকলে  কাজে সময় নষ্ট হবে। যার ফলে আমাদের নানা রকম শারীরিক ও মানসিক সমস্যা হয়ে থাকে।

 

স্লিপ ডেফিশিয়েন্সি

 ঘুম থেকে উঠার পর সারাদিন কিভাবে কাটাবো অবশ্যই সেটা নির্ভর করে শারীরিক এবং মানসিক স্বাস্থ্যের উপর। ঘুমের সময় আমাদের শরীরকে সাহায্য করে কাজ করতে এবং শারীরিক স্বাস্থ্য বজায় রাখতে। শিশুদের এবং শিশুদের ঘুম পরিপূর্ণভাবে হওয়া উচিত তাদের ডেভেলপমেন্টের জন্য।

 অনেক সময়ে বহুদিন ধরে ঘুমের অবহেলা করলে নানা রকম শারীরিক সমস্যার সম্মুখীন হতে পারে যেমন অমনোযোগী হয়ে পড়া, বিভিন্ন দুর্ঘটনার মুখোমুখি হওয়া এবং অনেক সময় মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়তে হতে পারে।

 বিশ্বের সব বৈজ্ঞানিক দের মত আমাদের পূর্বপুরুষদের মতের সাথে আজ মিলে যাচ্ছে। তাঁরা বলতেন যে ঘুম হলো ব্রেইনকে বিশ্রাম দেওয়ার জন্য দরকারি এবং ঘুমের সময়টা নষ্ট না ভাবা  উচিত।  এই সময়টা হল গভীর নিউরোলজিক্যাল অ্যাক্টিভিটি টাইম  যখন আমাদের ব্রেনের মধ্যে নিউরো কেমিক্যাল ক্লিনজিং,  হারিয়ে যাওয়া মেমোরি রিনিউয়াল,  মেমোরি কনসলিডেশন এবং কমিটির মেইনটেনেন্স অর্থাৎ জ্ঞানের রক্ষণাবেক্ষণের সঠিক সময় এটা। 

 অনেকে  এটা বলে থাকেন যে অল্প ঘুমালে কোন ক্ষতি হয় না শরীরের বা মানসিক চাপ কোন হয়না। কিন্তু রিচার্জ করে বিজ্ঞানীরা  বলছেন যে ঠিক সময়ে শুয়ে পর্যাপ্ত ঘুম একটা মানুষের না হলে তার শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর খারাপ প্রভাব পড়বে।আর তার ফল স্বরূপ তার জীবনযাত্রা এবং নিরাপত্তা নিয়েও অনেক অসুবিধার মধ্যে পড়তে হবে।

 অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায় যে সঠিক পরিমাণে ঘুম হলে হয় এবং ব্লাড ভেসেলস এ সমস্যা থাকে সেটাও ঠিক হতে থাকে শুধু ঠিক করে ঘুমানোর জন্য।

অসম্পূর্ণ ঘুম যদি লাগাতার হতে থাকে তাহলে মানুষের শরীরে অনেক সময় নানা রকম খারাপ রোগ দেখা দেয়। সেগুলির মধ্যে হলো হার্টের সমস্যা কিডনির সমস্যা হাই ব্লাড প্রেসার ডায়াবেটিস স্ট্রোক এবং অনেক সময়  ওবিসিটির ও  সমস্যা দেখা দেয়।

 রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা

 ঘুম কম হওয়ার কারণে আমাদের শরীরে নানা রকম রোগের সম্মুখীন হতে হয় সেটা আমরা জেনেছি।  আর এর প্রধান কারণ হলো আমাদের শরীরের ইমিউন সিস্টেম অর্থাৎ রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা যেটা ধীরে ধীরে সময়ের সাথে সাথে কমতে থাকে স্বল্প ঘুমের কারণে। ফলে খুব সহজেই আমরা সামান্য শরীর খারাপ হলেও দুর্বল হয়ে পড়ি।  বলাবাহুল্য যে শরীরের যেকোনো রকম কষ্টকে কমাতে সঠিক পরিমাণে হওয়া ঘুম অবশ্যই দরকার।

প্রোডাক্টিভিটি বা কাজ করার ক্ষমতা

 ঘুম কম হলে অনেক সময় আমরা দেখতে পাই যে আমাদের সারাদিন কোন কাজে মন বসছে না বা জোর করে করলেও সেটা হয় ভুল হয় না হলে অনেক বেশি সময় লাগে।  এটা যে শুধু প্রাপ্ত বয়স্কদের ক্ষেত্রে হয় তা নয়।  অনেক সময় স্কুল বা কলেজ পড়ুয়া দের ক্ষেত্রেও একই ঘটনা ঘটে থাকে।  রোজ দিনে যদি দেখা যায় যে দুই-এক  করে কম ঘুম হচ্ছে তাহলে অনেকাংশেই কর্মক্ষমতা একটু হলেও কমবে। আর যদি কেউ এক-দুদিন না  ঘুমায় তাহলে অবশ্যই শরীর এবং ব্রেইন কর্ম ক্ষমতা হারাবে। 

 একটি মানুষের সারাদিনে সঠিক পরিমাণ ঘুমের প্রয়োজন নিজেকে সুস্থ এবং সচল রাখতে। একজন প্রাপ্তবয়স্ক উচিত সাত থেকে আট ঘণ্টা ঘুমানোর।

 একটি মানুষ যদি ইচ্ছা বা অনিচ্ছায় ঘুম অসম্পূর্ণ রাখে তাহলে তাকে বলা হয় স্লিপ ডেট।  প্রতিদিন দু’ঘণ্টা করে ঘুম কমলে এক সপ্তাহে  চোদ্দো ঘণ্টা হয় আর এক মাসে ষাট  ঘন্টা হয়।

 ঘুম কম হওয়ার কারণে নানা রকমের দুর্ঘটনা হতে পারে এবং এর আগেও অনেক জায়গায় এই ধরনের দুর্ঘটনা ঘটেছে। তার মধ্যে রয়েছে রোড-অ্যাক্সিডেন্ট,নিউক্লিয়ার রিঅ্যাক্টর  মেল্টডাউন, গ্রাউন্ডিং অফ  লার্জ সিপস এবং  এভিয়েশন অ্যাক্সিডেন্ট। আর এর ফলে যে ভয়াবহ  পরিস্থিতি হয়েছে তা বলে বোঝাতে  হবেনা। 

 বড়দের মতন ছোটদেরও ঘুমের একটা নির্দিষ্ট সময় আছে। প্রত্যেক বয়সের জন্য নির্ধারিত সময়ে গবেষকরা বলে দিয়েছেন।যেমন  নিচে দেওয়া তালিকার মধ্যে বয়স অনুযায়ী ঘুমের সময় সীমা বলা  হয়েছে:

 

                বয়স             ঘুমের সময়   
৪- ১২    মাস ১২-১৬  ঘন্টা সাথে ন‍্যাপ
১-২      বছর ১১-১৪   ঘন্টা সাথে ন‍্যাপ
৩- ৫    বছর ১০-১৩  ঘন্টা সাথে ন‍্যাপ
৬-১২    বছর -১২    ঘন্টা 
১৩-১৮  বছর   

৮-১০    ঘন্টা 

 

 

এবার দেখা যাক যে কি আর টি উপায়ে আমাদের ঘুম আসতে সুবিধা হবে।  সবার আগে যে কাজটা আমাদের করতে হবে সেটা হলো নিজেদেরকে একটা কথা বোঝানো যে ঘুমকে আমরা অবহেলা করব না।  আর ঘুমের সময়কে নষ্ট হিসেবে ধরব না কিছুতেই। তাহলেই আমরা ভালোভাবে মনোযোগ সহকারে কাজ করতে পারব। আর এবার একে একে আমি একটি উপায় বলব-

১. সব সময় ঘুমাতে যাওয়া এবং ঘুম থেকে ওঠার নির্দিষ্ট একটা সময় মেনে চলা  উচিত। বাচ্চাদের ক্ষেত্রেও একটা বেডটাইম রুটিন ফলো করলে ভালো হবে।

 

২.  সব সময় যে সময়টা ঘুমের জন্য নির্ধারিত করা হয় তা চুটির দিনেও বদল করা উচিত নয়। বেশিক্ষণ জেগে থাকা মানে সময়কে বদল করা যেটা খুব ক্ষতি  করবে ঘুম  সম্পূর্ণ  হতে।

 

৩.  সর্বদা উচিত এক ঘন্টা আগে ব্রেনকে স্ট্রেস না দিতে বা কোন এক্সারসাইজ ও না করতে।  তার সাথে উচিত টিভি,কম্পিউটার ইত্যাদি থেকে দূরে থাকতে যার থেকে  স্ট্রং রেস বের হয়।

 

৪.  শুতে যাওয়ার আগে ভারী খাবার বা অ্যালকোহল ড্রিংক না খেলেই ভাল হবে  ঘুম আসার জন্য।

 

৫.  নিকোটিন মানে সিগারেট,ক্যাফেইন মানে চা,কফি,চকলেট ইত্যাদি ঘুমের আগে খাওয়ার জন্য  ঘুমের সমস্যা হয়ে থাকে।

 

৬.  দিনের কিছুটা সময় উচিত  খোলা হাওয়ায় শরীরচর্চা।  কারণ সেটা করলে ভালো ফল দেবে ঘুমের ক্ষেত্রে।

 

৭.  বেডরুমে ঘুমের আগে সবসময় শান্ত,ঠান্ডা এবং অবশ্যই কম পাওয়ারের আলো জ্বালিয়ে রাখতে হবে।  খেতে ঘুম আসতে সুবিধা হয় অনেক বেশি।

 

৮.  নিজেকে রিল্যাক্স করতে পারলে হট বাথ বা অন্য রিলাক্সেশন টেকনিক ইউজ করুন যাতে আপনি অনেক বেশি আরাম পাবেন  এবং ঘুম আসতে অনেক সুবিধা হবে।

 

এই আটটি উপায় ফলো করলে অনেকটাই ভালো ফল পাওয়া যাবে বলে আশা করছি।

হোয়াটস অ্যাপ এর মধ্যেও কিছু ব্যতিক্রম আছে যেমন যারা শিফটে কাজ করেন।  তাদের ক্ষেত্রে ব্যাপারটা আলাদা হয়। তাদের কর্ম সময়ের সাথেই আর পাঁচজন সাধারণ মানুষের নির্ধারিত কাজ করার সময় এর মিল থাকেনা। যেমন যে পড়ুয়ারাদের সকালে উঠে স্কুল বা কলেজে যেতে হয় তাদের জন্যেও ব্যাপারটা খানিকটা একই।  সেক্ষেত্রে অন্য কিছু স্পেশাল উপায় আছে। আর সে উপায়গুলি হল:

 

১.  ন্যাপ নিন বেশি পরিমাণে আর যেটুকু সময় পাবেন তাতে ঘুমের মাত্রা বাড়িয়ে দিন।

 

২. কাজের সময় ব্রাইটলাইট অর্থাৎ তীব্র আলোতে কাজ করুন।

 

৩. ক্যাফেইন থাকা-খাওয়ার বা পানীয় বেশি না খাওয়ার চেষ্টা করুন।

 

৪. দিনে ঘুমানোর সময় বাড়ানো যাতে কম আসে।আর তার জন্য পারলে মোটা কাপড়ের পর্দা ব্যবহার করুন।

 

৫. দিনের বেলায় না ন্যাপ আমাদের সজাগ আর কর্মক্ষমতাকে বৃদ্ধি করে। তবে এটা লক্ষ্য রাখতে হবে যে রাতে যেন ঘুম ঠিক করে হয় আর একজন প্রাপ্তবয়স্ক উচিত না কুড়ি মিনিটের বেশি ন্যাপ নেওয়া।

 

৬. ছোটদের জন্য ন্যাপ অত্যন্ত দরকারী কারণ এতে বাচ্চাদের গ্রোথ আর ডেভেলপমেন্টে সাহায্য করে।

 আশা রাখছি এইবারে আর ঘুমের কোন সমস্যা থাকবে না।  আর যদি এরপরেও দিনের সময় ঘুমের সমস্যা হয় তাহলে উচিত একবার ডাক্তারের সাথে পরামর্শ করুন।

 আমাদের জীবনের ব্যস্ততার জন্য আমরা সবার আগে ঘুমেরই সময়কে কমাই।  কিন্তু এটা ভুললেও চলবে না যে ঘুম পুরো না হলে আমরা কর্ম ক্ষেত্রে মন দিয়ে কাজ করতেও পারবো না। দৈনন্দিন জীবনযাত্রা চালাতে অনেক ঘটনার মুখোমুখি হতে হবে এবং শরীরও ভালো থাকবে না।  তাই আমাদের সবার উচিত সব পরিস্থিতির মধ্যেও ভুলকে প্রাধান্য দেওয়া এবং একে কোন ক্ষেত্রেই অবহেলা না করা।



লেখিকা পরিচিতি

Sanchari Goswami Majumdar

Loves to teach and practice dance. Likes to read books.

 

 

 

 


 

Author

Du-কলম

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!