সুলগ্না রায়
সত্যজিত রায় বাংলা চলচ্চিত্রের এক বিশাল ঘরানা। তিনি চলে যাওয়ার পরে বাংলা সিনেমার ঋতু পরিবর্তন হয়েছিল যার হাতের ছোঁয়ায়, সেই যাদুকর হলেন শ্রদ্ধেয় ঋতুপর্ণ ঘোষ। অত্যন্ত শিক্ষিত, মার্জিত, পরিশীলিত ঋতুপর্ণ ঘোষ ছিলেন কলকাতার সম্পদ। জন্ম কলকাতায়, 1963-তে। South Point School এর ছাত্র, JU থেকে Economics নিয়ে Graduate — কিন্তু এইটুকু দিয়ে এই ব্যক্তিত্বকে বিচার করা যাবে না। এই Biodata আরো হাজারো লোকের আছে। কিন্তু সবাই ঋতুপর্ণ নন্। যা সবার থেকে ঋতুপর্ণ ঘোষকে আলাদা করে চিনিয়ে দেয় — তা হলো ওনার লেখনী, ওনার মননশীলতা, ওনার চিন্তাধারা।
চলচ্চিত্র পরিচালনা শুরু করার আগে তিনি চাকরি করতেন একটি বিজ্ঞাপন সংস্থায়। সেই মাধ্যম থেকেই আমরা সাধারণ মানুষ পরিচিত হতে শুরু করি তার কাজের সাথে। হিন্দি বিজ্ঞাপনের বাংলা ডাবিং না করে নিখাদ বাংলাতে বিজ্ঞাপন তৈরী করে তিনি মন কেড়ে নেন, চোখ টেনে নেন। ‘বোরোলীন’ আর ‘শারদ সম্মান’ দুটো কাজই বাজিমাত করে দিয়েছিল। বুঝতে পারলাম What is ঋতুপর্ণ ঘোষ। এরপর একে একে বাঙালির মস্তিষ্কে Sparkling হতে থাকে। আমরা দেখতে থাকি ঋতুপর্ণ ঘোষ পরিচালিত একের পর এক বাংলা সিনেমা। ‘উনিশে এপ্রিল’, ‘দহন’ দেখে বাঙালী বুঝে যায় যে চলচ্চিত্রের একমাত্র বিষয় প্রেম বা পারিবারিক দ্বন্দ্ব হতে পারে না। রোজকার জীবনযাত্রার অনেক না বলা কথা, অনেক কঠিন সত্যেরও চলচ্চিত্রায়ন সম্ভব এবং সেটা শৈল্পিক বিভঙ্গতেই। এরপর একে একে আসতে ‘অসুখ’, ‘বাড়িওয়ালি’, ‘উৎসব’, ‘তিতলি’ — আমরা বুঝতে পারি সত্যজিত ঘরানা থেকে বেরিয়ে, ভেসে চলেছি ঋতু ঘরানায়। মনের গভীরে থাকা অনেক কথা, অনেক আবেগ, অনুভব করতে পারি আমরা তার বানানো সিনেমায়।
Bollywood-কে Tollywood-এর সাথে মিলিয়ে মিশিয়ে দিতে চেষ্টা করেছেন। ‘চোখের বালি’, ‘Raincoat’, ‘লাস্ট লিয়র’ বানালেন মুম্বাই থেকে নামকরা শিল্পীদের আনিয়ে। Success-ও পেলেন। চেষ্টা করছিলেন আরও নানারকম গবেষণা মূলক কাজ করার। নিজে অভিনয় করতে লাগলেন। বানালেন ‘আরেকটি প্রেমের গল্প’ — অন্য ধারার গল্প — আপাত দৃষ্টিতে জীবনীমূলক — মধ্যবিত্ত সমাজ নিতে পারলো না —মস্তিষ্কে, মননে, একটু বেশিই ধাক্কা লেগে গেল।
কিন্তু ঋতু পরিবর্তন অব্যাহত রইলো। এবার আরও জোরে ধাক্কা দেওয়ার প্রস্তুতি। জাগিয়ে দিতে চাইলেন বাঙালি দর্শককে। যেন বলতে চাইলেন — আর জেগে ঘুমিও না দর্শক। নিজের কাছে নিজেকে লুকিয়ে রেখো না। সাবলীল ভাবে, অ-সঙ্কোচিত ভাবে নিজের সমকামী সত্তাটিকে চলচ্চিত্রায়ন করতে চাইলেন। তৈরী হলো ‘চিত্রাঙ্গদা’। এতে অভিনয়ও করলেন অত্যন্ত বলিষ্ঠতার সঙ্গে, পুরস্কারও পেলেন। কিন্তু দর্শকমনে এই ছবির কি প্রভাব পড়লো সেটা দেখার আর সুযোগ হলো না তার।
থেমে গেল বাংলার ঋতুরাজ। 2013 সালের 30শে মে। মাত্র 49 বছর বয়সে, ঘুমের মধ্যেই থমকে গেল তার কলম, ক্যামেরা আর মস্তিষ্ক। কিন্তু তিনি যে দৃষ্টিভঙ্গি, যে নান্দনিক চলচ্চিত্রশৈলী প্রোথিত করে দিয়ে গেছেন আমাদের মধ্যে, তার তুলনা নয়, তার প্রবাহমানতা বিদ্যমান রয়েছে আজও। তাঁর বক্তব্য, তাঁর ভঙ্গিমাকে আপন করে, তাঁর দেখানো পথেই চলার চেষ্টা করছেন এখনকার পরিচালকরা। তাঁরই জয়রথচক্র ঘুর্ণায়মান।
খুব ভালো লাগলো
Khub bhalo laglo lekhata.