Home বিনোদন, প্রবন্ধ বনমালী তুমি …
বিনোদনপ্রবন্ধ

বনমালী তুমি …

কুসুমিকা সাহা

ভাষাও এক আশ্চর্য টিউন, কখনও বি-ফ্ল্যাট, কখনও জি-শার্প–একই সরগম কোথাও গমগম, কোথাও মধ্যম। এমন মানুষেরা যারা সমান দক্ষতায় সব সুরের সমস্ত ওঠানামা জুড়ে বিচরণ করেন, বোধকরি ক্ষণজন্মা এবং ক্ষণস্থায়ী … 

ঋতুপর্ণ ঘোষ, চলচ্চিত্র জগতের তেমনই এক বিরল জাদুকর, যাঁর ছোঁয়ায় জীবন্ত হয়ে উঠত সকল রকম অনুভূতির প্রকাশ। আজকের দিনে তাঁকে বা তাঁর কাজকে যথাযথ মর্যাদা দিয়ে স্মৃতিচারণ করতে গেলে যতখানি অবাধ ব্যাপ্তির প্রয়োজন, তা এই দু এক কথার স্বল্প পরিসরে সম্ভব নয় কখনই, তবুও আজকের দিনে তিনি তাঁর আপন মহিমায় উদ্ভাসিত হবেনই …

কোনও কবিতা, কোনও গান, গল্প উপন্যাসের দু-চারটে পংক্তির কাছে এলে মাঝে মাঝেই নিস্তব্ধ, নিশ্চল হয়ে যায় মুহূর্তরা। সিনেমার কোনও কোনও দৃশ্যও সেই একইভাবে সময়কে দাঁড় করিয়ে দেওয়ার ক্ষমতা রাখে যা দেখে মনে হতে বাধ্য ‘এমনভাবেও ভাবা যায়?’ অথবা, এই তো সেই কথা যা বলতে চেয়েছিলাম, যার প্রকাশ নির্ভাষ অন্ধকারে হারিয়ে গিয়েছিল কখনও।

নিঃশ্বাস কমে আসছে, কতটা গভীর ভাবে বললে এ আলোর গভীরতা পর্দায় বোঝানো যায়? দৃশ্য রচনার পরিধি বা উল্টোচোখের বোধকে খাঁচার আঁধারের আটক থেকে বের করে সেই পূর্ণতায় পৌঁছে দেওয়ার মন্ত্র করায়ত্ত ছিল তাঁর। সাহসী, সৎ চলচ্চিত্রের স্বাদ ছুঁইয়ে দিয়েছিলেন তিনি আপামর মেইনস্ট্রিম দর্শকদের পছন্দে। একের পর এক ভালো ছবি উপহার দিয়েছেন তিনি আমাদের। উনিশে এপ্রিল, দহন, শুভ মহরত, দোসর, অসুখ এমন অসংখ্য গুণগতভাবে সমৃদ্ধ ছবি ছাড়াও আরেকটি প্রেমের গল্প, মেমোরিজ ইন্‌ মার্চ, আবহমান, দ্য লাস্ট লিয়র ইত্যাদি কিছু বহুচর্চিত, বহুল সমালোচিত ছবিও আছে তাঁর পরিচালনার তালিকায়।

তাঁর ব্যক্তিগত জীবনের প্রভাবও ছাপ ফেলেছে কি তাঁর কাজে? নাকি আরেকটি প্রেমের গল্পে তার চপল ভাদুড়ী হয়ে ওঠা বা চিত্রাংগদা দ্য ক্রাউনিং উইশ ছবিতে “just be, what you wish to be”-এর মত সাহসী সপাট উচ্চারণ শুনতে শুনতে আমরাই তাঁকে টেনে এনেছি সেখানে বেখেয়ালে। কেবলমাত্র ভালবাসা নামক শব্দটারই কত শত উচ্চারণ শুনিয়েছেন তিনি আমাদের।

কোনও এক সাক্ষাতকারে চলচ্চিত্রে সাহসী প্রকাশ সম্পর্কে কোনও মন্তব্যের উত্তরে তিনি বলেছিলেন “সাহসী আর হতে পারলুম কই, সেন্সরের কাঁচি চলে এল যে মাঝখানে।” আমাদের অক্ষমতা যে আমরা তাঁকে পুরোপুরি গ্রহণ করার উচ্চতায় পৌঁছাতে পারিনি। তবে তার পরেও তিনি যা দিয়ে গেছেন, সেখানে দাঁড়িয়ে তাঁর অভাব তাঁর ডানার দাপট জানান দেয় বারবার। 

অনেক কাজ বাকী রেখে চলে গিয়েছিলেন তিনি। তাঁর চলে যাওয়া আজও তৃষ্ণা জাগায়। তাঁর ফেলে যাওয়া শূন্যতা যেন আজও গুনগুন করে ” ক্যায়সি আজীব দাওত হ্যায় ইয়ে/ ঘরওয়ালা ইয়াঁহা লা পতা, সব ছোড়কে সুনসান”…

এই যে তাঁর শিল্পীসত্ত্বা আর ব্যক্তিসত্ত্বাকে মিলিয়ে মিশিয়ে ফেলছি বারবার,  হয়ত একের মধ্যেই অন্যটির পরিপূর্ণতা। না হলে কেনই বা দুচোখ জলে ভরে আসে আজও, যখন শুনি …

“সখী চির অভাগিনী হাম, বৈঠে একাকিনী পোহাল রজনী তবু না আইল শ্যাম” কেন তার ছবির গান দিয়েই তার অভিমান স্পর্শ করে ফেলতে চাই বারবার,? কেন মনে হয় তিনিই গাইছেন “অপনে নয়ন সে নীর বহায়ে, অপনি যমুনা খুদ আপ হি বনায়ে/ লাখ বার উসমে হি নহায়ে …”

অস্ফুটে, অজান্তেই সে গান শুনতে শুনতে খোয়াইশ জাগে … পরজনমে রাধা হয়ে ফিরুক বনমালী …

লেখিকা পরিচিতি

 

কুসুমিকা সাহা

সারাদিন কাটে সংসারের নানা কাজে।
লেখা আর গান তার ভালোবাসা।
সিনেমা দেখা এবং তার পর্যালোচনা করা তার অন্যতম শখ।

Author

Du-কলম

Join the Conversation

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!