সুদেষ্ণা মিত্র
১৯৯৪ সাল। বাংলা চলচ্চিত্র জগতের পরিবর্তনের প্রথম পদক্ষেপ। মুক্তি পেল উনিশে এপ্রিল। আক্ষরিক অর্থে মুক্তি পেল তৎকালীন বাংলা সিনেমার দর্শক – হিন্দি সিনেমার অন্ধ অনুকরণ থেকে যার মধ্যে না ছিল বোম্বের প্রফেশনালিজম, না ছিল বাংলা সিনেমার গভীরতা । চিত্র পরিচালক ঋতুপর্ণ ঘোষ। একমাথা ঘন কালো চুল আর বুদ্ধিদীপ্ত দুটি চোখের সেই মানুষটি উনিশে এপ্রিল নামের মধ্যে দিয়েই আনলেন বিপ্লব। আমার মতো অনেক “বোম্বে মার্কা সিনেমা” দেখে মূখ ঘুরিয়ে নেয়া বাংলা সিনেমার দর্শক ছুটলো উনিশে এপ্রিল দেখতে। মা মেয়ের টানাপোড়েনের অনবদ্য মনস্তাত্বিক বিশ্লষণের অতি সাবলীল উপস্থাপনা অভিভূত করলো আমাকে।
ভালো লাগার সেই শুরু। একের পর এক সিনেমা দেখেছি আর নিজের মনে বা বন্ধুমহলে কখনো সমালোচক কখনো বিষয়বস্তুর গভীরতায় একাত্ম হয়ে যাওয়া দর্শকের ভূমিকায় অবর্তীন হয়েছি বারবার। সৃজনশীলতার মধ্যে অভিনবত্ব ও মৌলিক চিন্তাধারার মিশেল সেই সৃষ্টিকে একাধারে জনপ্রিয় আবার বির্তকমুলক ও করে তোলে। ঋতুপর্ণ ঘোষের পরিচালনায় চোখের বালি ও নৌকাডুবি এই দুই রবীন্দ্রপোন্যাসের চলচ্চিত্রায়ন আমাকে সমালোচকের ভূমিকা নিতে বাধ্য করেছিল। উপরোক্ত দুটি চলচ্চিত্রের চরিত্রচিত্রণ এবং প্রয়োজনের অতিরিক্ত কিছু দৃশ্যের অযথা পরিবেশন আমার অযৌক্তিক বলেই মনে হয়েছিল। সৃজনশীল হলেই তাঁর মৌলিক চিন্তার আড়ালে বিকৃত ইচ্ছার প্রকাশ পর্দায় ফুটিয়ে তুলতে হবে? বোধহয় আমার এই সমালোচক মনের জবাব দেবার জন্যে মুক্তি পেল “চিত্রাঙ্গদা : দ্য ক্রাউনিং উইশ।
সম্পূর্ণ নূতন এক বিশ্লেষণ আমার কাছে এই চিত্রাঙ্গদা। সামাজিক চিরাচরিত প্রথার নান্দনিক প্রতিবাদ। রাজকুমারী চিত্রাঙ্গদার রাজকুমারের মতো বড় হওয়া সম্পূর্ণ তার পিতার ইচ্ছাধীন ছিল। অর্জুনের কাছে নিজেকে মিথ্যা পরিচয়ে নয় আত্মবিশ্বাসী এক নারীরূপে ধরা দিয়েছিল। চিত্রাঙ্গদা চলচ্চিত্রের কেন্দ্রীয় চরিত্র রুদ্র তার প্রেমিক পার্থর (লক্ষ্যনীয় চরিত্রটির নামকরণ) সঙ্গে প্রেমের স্বীকৃতির জন্য সামাজিক সকল সম্পর্ককে অস্বীকার করে নারীসত্বার সর্বাঙ্গীন বিকাশ চেয়েছিল। রুদ্র পার্থর প্রেমের প্রকাশ, আবেগ ঋতুপর্ণের নিজের সৃষ্ঠ সমস্ত রোমানন্টিসিজম কে অন্যরূপে দর্শকদের সামনে উপস্থিত করেছিল। এই চরিত্রের মধ্যে দিয়ে ঋতুপর্ণ তাঁর মনের বহু ভেতরে জমাট বেঁধে থাকা সম্পূর্ণ গোপন এক সত্বার প্রকাশ করেছিলেন। সাফল্য, ব্যর্থতা, প্রশংসা ও উপেক্ষার মাঝে ঋতুপর্ণ ঘোষের এই রূপান্তর আমার মতো সামাজিক নীতি নিয়মের সংস্কারে বেঁধে থাকা মানুষের কাছে এক চুড়ান্ত প্রতিবাদ।
হঠাৎ করে সব হিসেব নিকেশ চুকিয়ে চলে যাবার পর তাঁর কথা লিখতে বসে বারবার মনে পড়ছে তার সম্পাদকীয় কলমের কথা। ভ্যালেন্টাইনস্ ডে-র প্রাক্বালে যখন সারা পৃথিবী জুড়ে প্রেমের জোয়ার, তিনি তাঁর কলমে লিখেছেন বিরহের কথা। তাঁর কাছে বিরহ ছাড়া যে প্রেমের অধিষ্ঠান অসম্ভব। ঋতুপর্ণ বিস্মিতবোধ করতেন এই ভেবে, বাংলা সাহিত্যে বিরহ কেন শুধু নারীরই অধিকারভুক্ত! সমাজের প্রথার বাইরে বেঁচে থাকতে চাওয়া একাকী ‘ঋতু’ র কাছে বাংলা সাহিত্যের উজ্জ্বল ট্র্যাজিক নায়িকা “ঘরে বাইরে” উপন্যাসের নিখিলেশ। তৎকালীন সমাজ ব্যবস্থার বিরোধিতা করে নিখিলেশ বিমলাকে স্বাধীনতার আনন্দ যে অনুভব করিয়েছিল হয়তো তাই বিমলাকে তার আসল নিখিলশকে খুঁজে নিতে সাহায্য করেছিল। রবীন্দ্রনাথের নিখিলেশ আর ঋতুপর্ণ দুজনেই ছিলেন প্রথার বিরোধী, বিশ্বাস করতেন “বহু যতন করে” ঘর সাজিয়ে রাখতে “যদি আমায় পড়ে তাহার মনে”।
আমার এই শ্রদ্ধার্ঘ্য শেষ করবো ঋতুপর্ণ ঘোষের ‘খেলা’ চলচ্চিত্রের গানের কয়েকটি লাইন দিয়ে। বড়ই প্রাসঙ্গিক আমার কাছে এই লাইনগুলির অর্থ।
খেলা খেলা দিয়ে শুরু -
খেলতে খেলতে শেষ,
কেউ বলেছিল ছি ছি -
কেউ বলেছিল বেশ।
কেউ বেসেছিল ভালো
কেউ খুঁজেছিল আলো;
কেউ আলো খুঁজে পাইনি বলে
হয়ত নিরুদ্দেশ।
Bah khub bhalo likhechish.
অপূর্ব লেখা। আমি যখন প্রথম ওনার পরিচালিত “হীরের আংটি” চলচ্চিত্রটি দেখি তখনই চমকে উঠেছিলাম, মুগ্ধ হয়েছিলাম, বুঝেছিলাম এবার অনেক বড় কিছু ঘটতে চলেছে টালিগঞ্জে।
আমার খুব প্রিয় কিন্তু Memories in March.
তোমার কথা একদম ঠিক। আমারও প্রিয় memories in march.