Home ভ্রমণ, প্রবন্ধ পথে ও প্রান্তরে — ৩
ভ্রমণপ্রবন্ধ

পথে ও প্রান্তরে — ৩

সুদেষ্ণা মিত্র

আজ আমাদের দ্বিতীয় দিনের পুরুলিয়া ভ্রমণ। প্রথম গন্তব্যস্থল মাত্র দেড়ঘন্টার ব্যবধানে বাকুঁড়ার শুশুনিয়া পাহাড় ও বিহারীনাথ মন্দির। এছাড়া আজ আমাদের বেড়াতে যাওয়ার তালিকায় আছে গড় পঞ্চকোট ও সত্যজিৎ রায়ের “হীরক রাজার দেশ” খ্যাত জয়চন্ডী পাহাড়।

ঘন সবুজ বিহারীনাথ পাহাড়ের কোলে অবস্থিত শান্ত পবিত্র শিবের মন্দিরটি দেখে ভারি ভালো লাগলো। প্রাকৃতিক দৃশ্য যেমন মনোরম তেমনই পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন মন্দির চত্বর। বলা হয় এই মন্দিরটি পশ্চিমবঙ্গের বিখ্যাত মন্দিরগুলির অন্যতম। সারা বছর যে কোনো পার্বনে বহু ভক্ত সমাগম হয়ে এখানে। বেশ কিছুক্ষণ এখানে সময় কাটিয়ে আমরা বেরিয়ে পড়লাম শুশুনিয়া পাহাড়ের উদ্দেশে। বিহারীনাথ থেকে শুশুনিয়া পাহাড় যাওয়ার রাস্তাটি নয়নাভিরাম। একপাশে শালতোড়ার জঙ্গল আর অন‍্যদিকে রুক্ষ খালি জমি। পিচ ঢালা চওড়া রাস্তার পাশের শালগাছগুলো ভর্তি হয়ে আছে সাদা ফুলে। পৌঁছোলাম শুশুনিয়া। খুবই পাথুরে আর সোজা খাড়া হয়ে উঠে যাওয়া এই পাহাড়টির চুড়োয় পৌঁছতে হলে ট্রেক করে যেতে হয়। লক্ষীকান্তবাবু বললেন প্রায় দু-ঘন্টা সময় লাগবে। তাই আমরা ট্রেকিং করবার প্ল্যানটা বাতিল করে দিলাম। যদিও চারপাশের অনেক উৎসাহী টুরিস্টদের দেখে আমার দুই ভাই উৎসাহিত হয়ে পাহাড়ে চড়তে শুরু করে দিল। আমরা বাকিরা মনোযোগী হয়ে পড়লাম পাহাড়ের নীচে সারি সারি দোকানের পাথরের নানা শিল্প সামগ্ৰী কেনবার জন্যে। প্রতিটি দোকানের কারিগররাই দোকানের মালিক। পাহাড় থেকে আনা পাথর কেটে গড়ে চলেছেন তারা বিভিন্ন হস্তশিল্প সামগ্ৰী। অবাক হলাম আমরা তখন, যখন ওনাদের দাম জিজ্ঞেস করলাম। একই জিনিষের দাম এক এক দোকানে এক এক রকম। শহরের মানুষ আমরা। ভাবলাম টুরিস্ট দেখে এমন দাম হাঁকছে। পরে দু একজন দোকান মালিক বা কারিগরের সাথে কথা বলে বুঝলাম এনারা সবাই শিল্পী। নিজেরাই নিজেদের শিল্পের দাম ঠিক করেন, ভরণপোষনের খরচা যাদের যেমন তার কথা মাথায় রেখে। যতটুকু প্রয়োজন ঠিক ততটাই রোজগার করেন, তাই দরদাম করা পছন্দ করেন না। সত্যিকারের শিল্পীদের কথা শুনে মন ভরে গেল। বেশ কিছু হাতের কাজের জিনিষপত্র কিনে রওনা দিলাম গড় পঞ্চকোটের দিকে। সূর্য তখন মাথার ওপর থেকে একটু একটু করে পশ্চিমে হেলছে।

সকালবেলা হোটেল থেকে সুস্বাদু লুচি আলুর তরকারী মিষ্টি এইসব খেয়ে বেরোনো হয়েছিল, তাই অনেকক্ষন ঘোরার নেশায় ক্ষিদে অনুভব করতে পারিনি। গাড়ীতে উঠে বসবার পর একে একে সবাইয়ের ক্ষিদে পেতে শুরু করল। সমস্যা দেখা দিল লক্ষীকান্তবাবুর সাবধান বানীর পর। তিনি বললেন গড় পঞ্চকোট আর জয়চন্ডী বেশ কিছুটা দুরে, তাই সাধারণত কেউ একদিনে চারটে জায়গায় যায় না। আপনারা যদি এখন খেতে নামে,‌ তাহলে অনেক দেরী হয়ে যাবে। জয়চন্ডী পাহাড়ের সূর্যাস্ত তাহলে দেখা হবে না। অগত্যা কি আর করা যাবে! গাড়িতে যা শুকনো খাবার ছিল তাই খেয়ে রওনা দিলাম গড় পঞ্চকোট।

বেশ কিছুটা রাস্তা আসার পর হঠাৎ লক্ষ্য করলাম চওড়া পীচের রাস্তাটা আস্তে আস্তে শুরু হয়ে যাচ্ছে। পাশের শাল শিমূলের জঙ্গল আরো বেশী ঘন হয়ে, গাড়ির জানলা ছুঁতে চাইছে। পীচের রাস্তা শেষ হতেই শুরু হলো সরু রাস্তা। তারপর নিকোনো উঠান, আলপনা বা নক্সা আঁকা দেয়াল, মাটির ঘর পেরিয়ে জনজীবনের সাক্ষী হয়ে আমরা এসে পৌঁছলাম পঞ্চকোট বা পাঞ্চেত পাহাড়ের নীচের এক বিশাল খোলা প্রান্তরে। গড় পঞ্চকোট – শিখর রাজার রাজধানী এই গড় একসময়ে বাংলার ইতিহাসের এক গৌরবান্বিত অধ্যায় ছিল। আলীর্বদী খানের এই রাজধানী দখল করা এবং মারাঠা বা বর্গীদের লুঠপাট এই গড়ের দূর্ভাগ্যের অন্যতম কারণ। তোরণ, সিংহদরজা বা রানীমহল আজ শুধুই কিছু ভাঙ্গা দেয়ালে আর থামে পরিণত হয়েছে। শুধু মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে পঞ্চরত্ন মন্দিরের চল্লিশ ফুট উঁচু চূড়াটি। একদিন যা ছিল দূর্মূল্য মণিমাণিক্য খচিত, আজ তার আর কিছুই অবশিষ্ট নেই। পড়ন্ত বিকেলে ধূ ধূ প্রান্তরে বিচ্ছিন্নভাবে দাঁড়িয়ে থাকা এই গড় পঞ্চকোট, কিরকম আজানা বিষাদে মনটাকে আচ্ছন্ন করে দেয়। গড় থেকে নামবার সময় এক কুয়ো দেখিয়ে লক্ষীকান্তবাবু বললেন “এই সেই কুয়ো বা কুয়া – যেখানে বর্গীদের হাত থেকে নিজেদের রক্ষা করবার জন্যে সতেরোজন নারী আত্মঘাতী হন। শুধু রাজপুত রানীরাই নন, বাংলার রানীরাও যে একইরকম ভাবে আত্মাহুতি দিতেন সম্মানরক্ষার্থে, সেটা ভেবে অবাক লাগছিল। ইতিহাস যদিও এই ঘটনার স্বীকৃতি দিতে পারেনি।

আবার শুরু হলো যাত্রাপথ। এবারের লক্ষ্য জয়চন্ডী হিলস্। তবে সে গল্প আবার পরের পর্বে।

 ~ ক্রমশঃ ~

লেখিকা পরিচিতি

 

সুদেষ্ণা মিত্র

এডিটর, দু ~কলম

Author

Du-কলম

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!