শ্রাবণী চ্যাটার্জী
০৬/১০/২০১৯
সুজয়া,
আমার বেড়ানোর গল্পগুলো তোকে নাকি ভীষন রকম আকৃষ্ট করে। তাই সব জায়গা ঘুরে বেড়িয়ে এসে সময় করে তোকে লিখে জানাতে হয় কি দেখলাম, কেমন দেখলাম।
পুজোর সময় অত্যধিক জন-সমাগমের কারণে,শহরের পুজোর প্রতি আমাদের, বিশেষ করে আমার আকর্ষণ খুবই কম। গ্রামের পুজোগুলোতে একটু হলেও যেন প্রাণের স্পর্শ লেগে থাকে। বিশেষ করে পুরোনো বনেদি বাড়ির প্রাচীন পুজোয় মা দুগ্গার মুখের দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলে মনে হয় সত্যিই যেন মা এসেছেন। সেখানে আছে মাটির গন্ধ,মনের টান, আর প্রাণের স্পন্দন।
দুর্গা পুজোর সপ্তমীর দিন একটা গাড়ি ভাড়া করে হঠাৎই আমরা চারজন বেরিয়ে পড়েছিলাম শান্তিনিকেতন ভ্রমণে। আমি, কত্তামশাই, এবং আমার পুত্র যাওয়ার ঠিক ছিল কিন্তু বড় ভাসুর ভীষণ উৎসাহী হয়ে সঙ্গী হলেন। সেখানে যা যা দেখেছি, যে সব জায়গায় ঘুরেছি সে সব জায়গা সম্মন্ধে নতুন করে কিছু বলার নেই। খুবই সাধারণ হয়ে গিয়েছে ওই জায়গাগুলো। কিন্তু সেখান থেকে যেখানে গিয়েছিলাম সে স্থান আমার কাছে পুণ্যভূমি। যদিও সেখানে যাওয়াটা ছিল সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিত। কারণ, কোনওরকম পরিকল্পনা ছাড়াই আমরা বেরিয়ে পড়েছিলাম পুজোর ক’দিন একটু নিরিবিলিতে কাটাবো বলে। ধোঁয়াশায় না রেখে এবার জানাই কোন্ সে পুন্যাত্মার দর্শন পেয়ে আমি উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠেছিলাম।
অষ্টমীর সকালে “সুরুল রাজবাড়ী”তে গিয়ে দুগ্গা-মায়ের অঞ্জলি দিযে বেরিয়ে এসে চা খেতে খেতে সারাদিনের গন্তব্য স্থান কোথায় কোথায় হতে পারে তা নিয়ে আলোচনা করছি এমন সময় কল্যানবাবু (ভাসুর) বললেন,গাড়ি নিয়ে যখন এতদূর এসেছি তাহলে আমরা ‘মিরিটি’ চলে যাই চলো। এ সুযোগ আর কোনওদিন পাবো কিনা জানি না! কেননা ওনারও তো বয়স হচ্ছে!
আমি বুঝতে না পেরে জিজ্ঞাসা করলাম কি আছে সেখানে? কার বয়সের কথা বলছেন?
উনি বললেন মিরিটিতে আমাদের প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জি’র পৈতৃকবাড়ি এবং ওনার জন্মভিটে। প্রতিবছর দুর্গাপুজো হয় সেখানে। সেই প্রাচীন পুজো এবারে 121 বছরে পদার্পণ করলো। ওনার নামেই পুজোর সংকল্প হয়। তাই পুজোর কদিন উনি দেশের বাড়িতেই থাকেন। অষ্টমীতে নিজে তন্ত্রধারক হয়ে দুর্গাপুজো করেন, চন্ডীপাঠও করেন। চলো না সেখানে যাই! সেই প্রস্তাবে আমরা সকলে রাজি হয়ে গেলাম।
গাড়ি চলতে শুরু করলো, মাঝে কংকালী তলায় (সতী পিঠের এক পীঠস্থান)নেমে কত্তামশাই তাঁর দাদাকে নিয়ে মায়ের পুজো দিয়ে এলেন। আধ ঘন্টা সময় পেরিয়ে আবার গাড়ি চলতে শুরু করলো। সেখান থেকে কীর্নাহার হয়ে মিরিটি যেতে হয়। ‘মিরিটি গ্রাম’ বীরভূমের লাভপুর ব্লকের অন্তর্গত।
কীর্নাহার-এর পর থেকে ধূ ধূ গ্রাম শুরু হলো। কত নাম না জানা গ্রাম জনপদ পেরিয়ে গাড়ি ছুটে চলেছে। পাকা রাস্তা এদিকে তেমন নেই। তার উপর ক’দিনের বৃষ্টিতে গ্রামের কাঁচা রাস্তাগুলো জলকাদায় ভরে হয়ে উঠেছে। যাচ্ছি তো যাচ্ছি! দুপাশে শুধু বিঘের পর বিঘে চাষের জমি,আর তার মাঝেখান দিয়ে বরাবর রাস্তা চলে গিয়েছে। এতক্ষণে কোনও দোকান-পসার পাইনি। অনেক দূরে দূরে গ্রাম তার বেশিরভাগ বাড়িগুলোই মাটির চারচালা বা আটচালা। চালাঘর, গোয়াল ঘর, পুকুর, মড়াই, সবজি বাগান পেরিয়ে গ্রামের ভেতর দিয়ে যেতে ভালোই লাগছিল। অজানা পথের সঙ্গী (গুগল) জানালো আর মাত্র সাত কিলোমিটার পথ বাকি আছে গন্তব্যে পৌঁছতে। ভেতর থেকে নিজেকে কেমন যেন শিহরিত লাগছিল। যেন রোমাঞ্চকর কোনও অভিযানে বেরিয়েছি আমরা।
গাড়ি ছুটে চলেছে আপন গতিতে। ভাসুর গল্প বলছেন….. আগে এই কীর্নাহারে রাষ্ট্রপতি প্রায়ই আসতেন। এখানে ওঁর বড়দিদি (অন্নপূর্ণা বন্দ্যোপাধ্যায়)থাকেন। ওনার আদরের ছোট ভাই পল্টু (প্রণব মুখোপাধ্যায়) প্রতিবার এসে দিদির বাড়ি থাকতেন। আবার দিদিকে ‘মুখার্জি ভবনে’ নিয়ে গিয়ে রাখতেন। আগে তো পুজোর সময় দিদি নিজেই চলে আসতেন। এখন বয়সের ভারে আসতে পারেন না।
ক’দিন বৃষ্টির পর অষ্টমীর সকাল থেকেই রোদ ঝলমলে শরৎকালের আকাশ যেন খুশিতে মেতে উঠেছে। গাড়ি এসে দাঁড়ালো “মুখার্জি ভবন” এর কয়েক হাত দূরে। গেটের সামনে বেশ কিছু গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে,আর সামনে আছে সিকিউরিটি গার্ড। বাড়ির লাগোয়া নতুন হেলি-প্যাড তৈরি করা হয়েছে। তবে এটাও জেনেছি যে উনি গতরাতে গাড়িতেই এখানে এসেছেন। ভাবছিলাম এই বয়সে এতখানি ভাঙাচোরা কাঁচা-পাকা মেঠো পথ পেরিয়ে তিনি এলেন কি করে!
ফিসফিসিয়ে ভাসুরকে কে বললাম ভয় করছে, যদি ঢুকতে না দেয়?
উনি বললেন…তাহলে বাইরে থেকেই ফিরে যাবো। এটা তো আমাদের মতো সাধারণ (গ্রাম্য) বাঙালির কাছে একটা ‘পীঠস্থান’ এর মতো। সব মন্দিরে কি সবাই ঢুকতে পায়! তবু তো কাছাকাছি এলাম, এটাই অনেক পাওয়া। তবুও একবার দেখা যাক ভেবে আমরা গাড়ি থেকে নেমে গেটের সামনে আসতেই সিকিউরিটি চেক করে ভেতরে ঢুকতে দিলো। আমরা একে অপরের মুখ চাওয়া-চাইয়ি করলাম।
গেট পেরিয়ে ভেতরে ঢুকতেই চোখে পড়লো স্থায়ী দুর্গা মন্দির। নির্ভয়ে সামনে এগিয়ে গেলাম,তখনই দেখি উনি চন্ডীপাঠ করে দুর্গামন্দির থেকে নামছেন। এস পি জি, নিরাপত্তা রক্ষী,অতিথি-অভ্যাগতদের মধ্যে দিয়ে আমরাও এগিয়ে গেলাম একদম ওঁনার সামনে। আমার ভাসুর বললেন,স্যার আমরা হুগলি ডিস্ট্রিক্ট থেকে এসেছি, আপনাকে একটা প্রণাম করতে চাই… উনি মুখ তুলে তাকালেন। এস পি জি হাত দেখালেন, এখন না। উনি বাড়ির ভেতরে ঢুকতেই সবার সঙ্গে আমরাও সেই বাড়ির ভেতরে গেলাম। সেখানে কোনও বিধি নিষেধ নেই, নিরাপত্তার কড়াকড়ি নেই!
আমি অভিভূত এই ভেবে যে,একজন সাধারণ নাগরিক আমি যে কিনা স্বয়ং রাষ্ট্রপতি’র বাড়িতে তাঁর ঘরের সামনের লনে বসে আছি! নিজেদের ধন্য মনে হচ্ছে। বাড়ির ভেতরে সব তাবড় তাবড় মানুষ জনের সঙ্গে আমরাও বসে রইলাম। বাড়ির লাগোয়া বিরাট বড় উঠোন,সেখানে প্যান্ডেল হয়েছে অতিথি-অভ্যাগতদের বসার জন্য,সকলে নানারকম উপহার নিয়ে বসে আছেন। মাঝখানে প্রাচীন কালের একটা হাতল লাগানো মেহগনি বা আবলুস কাঠের চেয়ার পাতা। প্রতিদিনের যত্নে চেয়ারের কালো রঙটা আরও মসৃন হয়ে উঠেছে। শুনলাম,সন্ধি-পুজো শেষ করে উনি এখানে বসে সবার সঙ্গে কথা বলবেন। বিভিন্ন চ্যানেলের রিপোর্টাররা এসেছেন,তারাও দৌড়-দৌড়ি করছে ছবি তোলা ও খবর সংগ্রহ করার জন্য।
ঘরের সামনে কর্তব্যরত এস পি জি দাঁড়িয়ে আছে। উনি সকালের পুজো করা কাপড় ছেড়ে আবার নতুন কাপড় পরে নিয়ে সন্ধি পূজোয় বসবেন। এমন নিষ্ঠা-ভক্তিপূর্ণ ব্রাহ্মণ সন্তান খুব কমই আছে। শুনেছি রাষ্ট্রপতি হিসাবে ‘রাইসিনা হিলস্’ এর বাসিন্দা হয়েও ভোরবেলা ঘুম থেকে উঠে নিত্যপূজা সেরে তবে তিনি জলগ্রহণ করেন।
উঠোন পেরিয়েই তাঁর ঘর। আর উঠোনের চৌকাঠ পেরিয়েই দুর্গা-মন্দির, দুর্গা-দালান। একচালা মাটির দোতলা পৈতৃক বাড়িটা এখনও আছে। সেখানে এখন আগে দুর্গা-মায়ের ভোগ হয়,তারপর দুপুরে সমস্ত লোকজন,অথিতি-আমন্ত্রিতদের খাওয়ার জন্য যে আয়োজন থাকে সেসব পদ রান্না হয়। সব থেকে অবাক হলাম দেখে যে একজন রাষ্ট্রপতি হয়েও উনি অত্যন্ত সাদামাটা জীবন যাপন করেন।
অনেকক্ষণ বসে বসে লক্ষ্য করলাম রাষ্ট্রপতির বাড়ি বলতে যেমন হওয়ার কথা বাড়িটা ঠিক তেমন নয়! অতি সাধারণ গ্রামের মানুষের বাড়ি যেমন হয় ‘মুখার্জি ভবন’ ঠিক তেমনই। একচালা বাড়িটাকে রেখে তার সঙ্গেই এল টাইপের বারান্দা যুক্ত তিন-চারটে ঘর, কল-বাথরুম আর দোতলায় তিনটে ঘর আছে। দুর্গা মন্দির থেকে নেমে বাড়ির ভেতরে ঢুকে আসার সময় তাঁকে বারান্দা পেরিয়ে পুরোনো কল বাথরুমে যেতে দেখিছি। বাথরুমের শেষপ্রান্তে খিড়কি দরজা পেরিয়ে বাগান সেখানে মধ্যাহ্ন ভোজনের আয়োজন হয়েছে। দলে দলে গ্রামের লোকজন আসছে মধ্যাহ্নভোজনে অংশ নিতে। সেখানে এক পংক্তিতেই সকলের নিমন্ত্রণ। আমাদেরও দুপুরে খেয়ে আসার জন্যে বলা হয়ে ছিল, কিন্তু অনেকটা পথ ফিরে আসতে হবে তাই সম্ভব হযে ওঠেনি।
হঠাৎ দেখি উনি দরজা খুলে বেরোলেন। সিল্কের ধুতি-জোড় পরিহিত বাঙালি ব্রাহ্মণ রাষ্ট্রপতি আমার চোখে যেন শুদ্ধতার প্রতিমূর্তি হয়ে ধরা দিলেন। ধীর পায়ে চললেন মন্দিরের দিকে। আমরাও ওনার সঙ্গে মন্দিরে এলাম। ওনার বেশ ক’টা ছবি তুললাম একদম সামনে থেকে। আমি ছবি তুলছি দেখে উনি ভীষন সুন্দর করে তাকিয়ে ছিলেন। সবাই তখনও দুর্গা মন্দিরে উঠতে পারেনি,আমি ওনার বাড়ির লোকের সঙ্গে মন্দিরে উঠে এলাম।
এত সৌভাগ্য কি করে হলো জানিনা! সবাইকে ছাড়িয়ে একেবারে উনার পাশে বসে মা দুগ্গার ছবি তুললাম ভিডিও করলাম। বাড়ির কুলপুরোহিত পুজো শুরু করলেন। ঢাক কাঁসর ঘন্টা শাঁখ বেজে উঠলো। চুরাশী বছর বয়সী নির্জলা উপবাসী রাষ্ট্রপতি তখন তন্ত্রধারক। বলিষ্ঠ মন্ত্রোচ্চারনে শুরু হলো সন্ধিপূজো। তারপর নিজেই অঞ্জলির ফুল সকলের হাতে তুলে দিয়ে শুরু করলেন মন্ত্রপাঠ। সেই মুহূর্তে অঞ্জলি দিয়ে নিজেকে ধন্য মনে হলো। সন্ধি-পুজোর প্রদীপ জ্বালানোর সময় ছোট্ট করে জিজ্ঞাসা করলাম,আমি একটা প্রদীপ জ্বালাতে পারি? পাশ থেকে উনি বললেন, জ্বালাও। সেই মুহূর্তের আনন্দের স্বাদ আমি ভাষায় প্রকাশ করতে পারবো না। প্রদীপ জ্বালালাম,শুধু আমি একা নয়, সবার সঙ্গে আমার ভাসুর এবং কত্তামশাইও এসে প্রদীপ জ্বালিয়েছিল।
এটা আমার জীবনের এক পরম প্রাপ্তি। কারণ,উনি ভারতের রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জী বাঙালীর গর্ব, আমার কাছে আদর্শ মানুষ, যাঁর জীবনী ও জীবনবোধ আমাকে মুগ্ধ করেছে। তাছাড়া,রাজাকে তো রাজা সাজে সবাই দেখি,তিনি যখন সাধারণ মানুষের মাঝে সাধারণের মতো ধুতি-গেঞ্জি, জোড় পরে চন্ডীপাঠ, পুজো-অঞ্জলি করেন তখন তিনি অন্য মানুষ। আর সেটাই আমাকে অভিভূত করেছে। যেন একেবারে সাধারণ বাড়ির পুজো,তেমন কোনও জৌলুস নেই। দুর্গামন্দিরে বাড়ির আত্মীয়-পরিজন যাঁরা পুজোর জোগাড় করছেন সবাইকে নিয়ে জনা পনোর হবে,তার মধ্যে আমরাও আছি। এছাড়া নিরাপত্তা রক্ষী,এস পি জি, আর ফটোগ্রাফার আর সাংবাদিকরা আছেন মন্দিরের নিচে। সর্ব সাকুল্যে ৫০-৬০জন লোক প্রাক্তন রাষ্ট্রপতির বাড়ির দুর্গা পুজোয় হাজির। হলেও বা রাষ্ট্রপতি,তিনি যে বাঙালি ব্রাহ্মণ সন্তান,সেটা তাঁর আচার-আচরণ নিয়ম নিষ্ঠা সমস্ত কিছুতেই বজায় রেখেছেন।
পুজো শেষ হলো। মা দুর্গাকে প্রণাম করে আমি ওনাকে প্রণাম করার জন্যে উদ্যোগী হতেই হাত দেখিয়ে বললেন ঠাকুরের সামনে কাউকে প্রণাম করতে নেই! মাকে প্রণাম করো। কথাটা শুনে যেন সরাসরি দেবতার প্রসাদ লাভ করলাম বলে মনে হলো। সেই মুহূর্তে আমি বাকরুদ্ধ! মনে হলো আমরা যেন সৌভাগ্যের অধিকার পেয়েছি।
হাত জোড় করে আমরা প্রণাম জানালাম। উনি মন্দির থেকে নেমে ওনার বাবা-মার ছবিতে প্রণাম করে আবার বাড়ির ভেতরে ঢুকে গেলেন নিরাপত্তা-বেষ্টিত হয়ে। তারপর আমরা ওনার বাড়ি থেকে বেরিয়ে এসে আবার গাড়িতে উঠলাম। হাওয়ার গতিতে পঞ্চাশ কিমি পথ পাড়ি দিয়ে ফিরে যেতে যেতে মন ভরে উঠছিল আর একটা কথাই মনে হচ্ছিলো যা পেলাম তা চিরদিন মনের মণিকোঠায় সাজানো থাকবে। আর সারাজীবন ধরে তার সুখস্মৃতি বহন করে ধন্য হবো আমি এবং আমরা সবাই।
ইতি,
‘নন্দিনী’