Home বিবিধ, প্রবন্ধ ফিরে দেখা (পর্ব-৪)
বিবিধপ্রবন্ধ

ফিরে দেখা (পর্ব-৪)

গোপা মিত্র

[যাদের স্নেহচ্ছায়ায়, শিক্ষায়, আদর্শে আমি বেড়ে উঠেছি বা যাদের সাহচর্যে আমার জীবনের সেরা মুহূর্তগুলি কাটিয়েছি, তাদের কেউই আজ আমাকে সঙ্গ দেওয়ার জন্য এই পৃথিবীতে বেঁচে নেই। আমার এই স্মরণিকা তাদের উদ্দেশ্যে শ্রদ্ধা নিবেদনের এক ছোট্ট প্রচেষ্টা মাত্র।]

 

পর্ব-৪

কাকু

(প্রথম পর্ব)

 

অনেকেই হয়ত ভাবছেন, বাবা মা’কে বাদ দিয়ে প্রথমেই কাকুর কথা কেন? ভাবাই অবশ্য স্বাভাবিক। এই ‘কেন’-র উত্তর অবশ্য আমার কাছে বেশ স্পষ্ট। সব মানুষের জীবন যেমন একই খাতে বয়ে চলে না, সব মানুষের চরিত্রও তেমন একই রকম হয় না। বাবা মা’দের তো দায়িত্বই, ভালোবেসে তাদের ছেলেমেয়েকে বড় করে তোলা, তাদের রক্ষণাবেক্ষণ করা। কিন্তু কাকুদের ওপরও কি সেই দায়িত্ব বর্তায়? আমাদের কাকু অবশ্য তেমনই একজন মানুষ ছিলেন, যিনি সারা জীবন আমাদের ভালোবেসে, প্রয়োজনে অপ্রয়োজনে আমাদের পাশে যেমন দাঁড়িয়ে ছিলেন, তেমনই আমাদের আগলেও রেখেছিলেন। বাবা মা’ও তাকে সেই সম্মানটাই দিত – সব সময় আমাদের বলত যে, আগে যাও কাকুকে গিয়ে বল বা কাকুর কাছ থেকে মত নিয়ে এসেছ তো? কাকুর কোনো ছেলে মেয়ে ছিল না- আমরাই ছিলাম তার ছেলেমেয়ে, তার ধ্যান জ্ঞান সব। আমাদের জন্য, ফল্গু ধারার মত বয়ে চলা কাকুর সেই ভালোবাসা আমরা প্রতি মুহূর্তেই অনুভব করতাম। বাবা আর কাকু ছিল আমাদের কাছে সম-মর্যাদার। তাই কাকুর কথা প্রথমে লিখতে আমার বিন্দুমাত্র কুন্ঠা বোধ হল না। 

 

বাড়ী যেমন দাঁড়িয়ে থাকে স্তম্ভের ওপর, আমাদের পরিবার তথা সংসারও তেমন দাঁড়িয়েছিল কাকুও ওপর। সব দিকেই নজর ছিল কাকুর। বাবা কাকু দুজনের আয়েই সংসার চলত ঠিকই- কিন্তু বাবাকে বলা চলে, ‘Sleeping Partner’ বরাবরই দেখেছি, সংসারের আয়ব্যয়ের হিসাব থেকে, কাকে কি দিতে হবে, কি বাজার হবে, সব দায়িত্বই ছিল কাকুর হাতে। এখন বুঝি, কাকু এই দায়িত্বটা স্বেচ্ছায় নিয়েছিল, বাবার পড়াশোনায় যাতে কোনো ব্যাঘাত না ঘটে, সেইজন্য। বাবা কাকুর মিল ছিল চোখে পড়ার মত। ঝগড়া তো দূরের কথা, কোনোদিনও দেখিনি দুজনে দুজনের সঙ্গে উঁচু গলায় কথা বলছে। কাকু দায়িত্ব সামলালেও সব কিছুই কিন্তু বাবাকে জানিয়ে করত- তবে আমাদের বা বাড়ীর কারো সামনেই বাবাকে কিছু বলত না। তাহলে বলত কখন? কাকু হয়ত কোথাও থেকে ফিরল বা কোথাও বার হচ্ছে, বাবা বৈঠকখানা ঘরে একলা শুয়ে কিছু পড়ছে, কাকু সেইসময়ই বাবার সঙ্গে যাবতীয় প্রয়োজনীয় কথা সেরে নিত। বাবা আর কাকু দুজনেই দুজনকে যেমন বিশ্বাস করত তেমন ভরসাও করত। 

কাকু ছিল খুবই সৌখীন মানুষ। কখনো কখনো কোট, প্যান্ট, শার্ট, পরলেও ধুতি সার্টেই ছিল বেশী স্বচ্ছন্দ । তবে কোনো সামাজিক অনুষ্ঠানে সব সময়ই কোঁচানো ধুতি আর গিলে করা পাঞ্জাবী পরত – অবশ্য সাদা ছাড়া অন্য কোনো রঙের শা র্ট বা পাঞ্জাবী পরতে কখনো দেখিনি। শুধু মাত্র সৌখীনই নয় কাকুর যে কতরকম শখ ছিল! সেইসব শখের সামিল হয়ে আমরাও কখন যেন অজান্তে প্রকৃতি পরিবেশ সম্বন্ধে সচেতন হয়ে উঠেছিলাম। 

হঠাৎ একদিন ভোরবেলা ঘুম থেকে উঠে দেখি, কাকু যেন কোথা থেকে ছোট এক খাঁচা ভর্তি কতগুলো রংচঙে পাখী নিয়ে এসেছে – তাদের কেউ সবুজ, কেউ হলুদ, কেউ নীল আবার কেউ পাঁশুটে, কি যে সুন্দর সব দেখতে! পরে নাম জেনেছিলাম, সেগুলো নাকি বদ্রী না বজ্রী পাখী। এল তো মাত্র কয়েকটা পাখী, কিন্তু অচিরেই তাদের সংখ্যা বৃদ্ধি হলে, দুটো বেশ বড় খাঁচা তৈরী হল, একটা রইল নীচের উঠোনে আর একটা দোতলার ছাদে। তাদের খাবার কাঁকরী দানা এল, তাদের জন্য ছোট ছোট কাঠের ঘর হল- তাদের সেই ছোট্ট ঘরে তারা ডিম পেড়ে আরো পাখীর জন্ম দিতে লাগল, তারপর খাঁচার মধ্যে এদিক সেদিক উড়ে বেড়াতে লাগল আর কিচিরমিচির করে ডাকতে লাগল। স্কুল থেকে ফিরে আমাদের রোজকার রুটিন হয়ে গেল তাদের খাঁচার সামনে দাঁড়িয়ে তাদের সংখ্যা গোনা- তাদের সংখ্যা আরো বাড়ল কি, কোনো পাখী কি ডিম পেড়েছে! সূচনা করেছিল কাকু, এবার আমরাও সেই শখের সামিল হয়ে গেলাম। 

আবার একদিন দেখলাম, কাকুর ঘরে মাঝারি উচ্চতার এক বইএর আলমারীর উপরে বিশাল এক অ্যাকুইরিয়াম এসে বসল। তারপর তলায় ছোট ছোট নুড়ি বিছান জল ভরা সেই অ্যাকুইরিয়ামে লাল, কাল, ডোরাকাটা কতরকম মাছ- মলি, টাইগার, এঞ্জেল খেলা করে বেড়াতে লাগল। তাদের খাবার, কেঁচোও এসে গেল। কাকু নিজের হাতে তাদের জল বদলানো থেকে শুরু করে তাদের নিয়মিত খাবার দেওয়ার দায়িত্বও তুলে নিল। কাকুর ঘরে ঢুকলে প্রথমেই নজরে আসত জলের মধ্যে ভেসে বেড়ানো সেইসব রঙীন মাছগুলোর দিকে। 

উত্তর কলকাতার সেই ঘিঞ্জি এলাকায় বড় গাছ লাগানোর তো কোনো সুবিধা ছিল না, তাই কাকু আমাদের ছাদ ভর্তি করে ছোট বড় টবে নানাধরণের ফুল গাছ লাগিয়েছিল –তাদের কোনো গাছ  যেমন বর্ষব্যাপী তেমন কোনো গাছ ঋতুকালীন ফুল দিত। বেল যুঁই জবা নয়নতারা কামিনী যেমন ছিল তেমনই ছিল লিলি রজনীগন্ধা গাঁদা ডালিয়া চন্দ্রমল্লিকা গোলাপ। এছাড়াও ছিল কয়েক প্রজাতির ক্যাকটাস, পাম। বাইরের সিঁড়ি দিয়ে দোতলার ছাদে উঠলেই বোগেনভিলিয়া অভ্যর্থনা জানাত, ছাদের পাঁচিল থেকে ঝাঁপিয়ে নেমেছিল ছোট ছোট লাল ফুলের এক ক্যাকটাস, মিলি। আমরা কেউই ফুল ছিঁড়তাম না, শুধুমাত্র তাদের রংবাহারী সৌন্দর্য আর গন্ধ উপভোগ করতাম। এই সব ফুলের মধ্যে আমার সবচেয়ে প্রিয় ছিল হাল্কা গোলাপী বর্ণের লিলি। বর্ষাকালে যখন তারা মাথা উঁচু করে ফুটে থাকত তখন যেন সারা বাগানে আলো ছড়াত। কাকুর এই ফুলগাছের শখের সামিল হয়ে আমরাও যেন কখন অজান্তে গাছপালা ভালোবাসতে শুরু করেছি, যা এখনও আমাদের মধ্যে রয়ে গেছে। 

পাখী, মাছ, ফুলগাছ –এসবের শখ তো অনেকের মধ্যেই থাকে, তবে শখের টানে ফানুস তৈরী করা, এমনটা কি খুব দেখা যায়? পুজোর পরেই কাকু বসে যেত ফানুস  তৈরীতে। কোথা থেকে যে শিখেছিল, কে জানে? তখন তো আর ইউটিউব ছিল না, তবে? আসলে শখের টানে মানুষ বোধহয় অনেক কিছুই শিখে নেয়! বড় বড় কাগজ এল, ময়দা গুলে গরম করে বাড়ীতেই তৈরী হল আঠা। তারপর সেই কাগজ কেটে, জুড়ে ফানুসের আকৃতি দেওয়া হয়ে গেলে, ব্যবস্থা হল তার তলায় আগুন ধরাবার। এবার এল সেই দিন – কালীপূজোর আগের বা পরের দিন প্রাক সন্ধ্যায় বাড়ীর সকলের উপস্থিতিতে সেই ফানুস ওড়ানো হল আমাদের ছাদ থেকে। আমরা হাততালি দিয়ে চীৎকার করে সেই ফানুস ওড়ানোকে স্বাগত জানালাম। 

কাকুর সবথেকে সেরা অথচ ব্যতিক্রমী শখ ছিল, ক্যালেন্ডারের ছবি কেটে খাতায় বাঁধিয়ে রাখা। পূর্ণদৈর্ঘের মোটা মোটা একাধিক ব্রাউন কাগজ, দুদিকে মোটা পিজ্‌বোর্ড দিয়ে, কাকু দোকান থেকে বাঁধিয়ে নিয়ে আসত, ঐ অনেকটা তখনের অ্যা্লবামের মত। তারপর, ক্যালেন্ডারের ছবিগুলো সুচারুভাবে একটা একটা করে কেটে, ময়দার আঠা দিয়ে সেগুলো ব্রাউন কাগজের ওপর মেরে রাখত। নিজের অফিস বা বন্ধুদের সূত্রে কাকু কত যে দারুণ দারুণ ক্যালেন্ডার নিয়ে আসত, সে আর কি বলব! সেই সব ছবির অ্যা লবাম ভর্তি ছিল দেশ বিদেশের কি সব দারুণ দারুণ রঙীন ছবিতে। দেশের তাজমহল, কোনার্ক, চিত্রকোট জলপ্রপাত যেমন ছিল তেমনই ছিল আইফেল টাওয়ার, কলোসিয়াম, ও নায়গ্রা জলপ্রপাত, দেশীয় বাঘ,‌ হাতী, গন্ডার যেমন ছিল তেমনই ছিল ক্যাঙারু, পেঙ্গুইন, জিরাফ, নন্দলাল বসু, যামিনী রায়, রবি বর্মার চিত্রকলা যেমন ছিল তেমনই ছিল লিওনার্দো দা ভিঞ্চি, ভ্যানগগ্‌, বা বত্তিচেল্লী, অজন্তার গুহাচিত্র যেমন ছিল তেমন ছিল সিস্‌টিন চ্যাপেলের চিত্রকলা, ছবি সহ আবিস্কার ও আবিস্কারক, বিখ্যাত সব ব্যক্তিক্ত, দেশ বিদেশের প্রকৃতি চিত্র – আরো কত কি বলব? কতগুলো খাতা, কত ছবি – আমাদের কাছে সেই খাতাগুলো যেন ছিল আলাদীনের প্রদীপের মত এক আশ্চর্য জগৎ। ছবি মারা হয়ে গেলে কাকু খাতাগুলো চাবি বন্ধ করে আলমারীতে রেখে দিত। আমরা অপেক্ষায় থাকতাম, আবার কবে কাকুর সময় হবে, ছবিগুলো আবার দেখতে পাব! তারপর একদিন যখন হত সেই অপেক্ষার অবসান, বালিকা বা কিশোরী বয়সের মুগ্ধ বিস্ময় ভরা চোখ দিয়ে আমরা অপূর্ব এই পৃথিবীর স্বাদ গ্রহণ করতাম। আজকাল অবশ্য অপেক্ষার আনন্দ, মুগ্ধতার বিস্ময় সবই হারিয়ে গেছে জীবন থেকে, ইচ্ছে হলেই তো ইন্টারনেটের এক ক্লিকেই চোখের সামনে ধরা দেয় সমগ্র জগৎপৃথিবী।

কাকুর আরো একটা শখের কথা আমি বলিনি, কারণ সেটা ছিল কাকুর একান্তই ব্যক্তিগত- ডাকটিকিট সংগ্রহ। এর কথা অবশ্য আমরা জেনেছিলাম অনেক পরে, যখন কাকু আমাদের তিনজনের মধ্যে টিকিটগুলো ভাগ করে দিয়েছিল।

কাকু যে শুধু নিজের শখ নিয়েই ব্যস্ত থাকত, তা কিন্তু নয়, সব দিকেই কাকুর নজর ছিল। তাইমা ইংরিজী জানলেও, ইংরিজীতে কথা বলায় সড়গড় ছিল না। কাকু তাই তাইমাকে কথ্য ইংরিজী শেখাবার জন্য একজন দিদিমণি বহাল করেছিল, কারণ কাকুর সাহেব বস্‌ যখন তার মেমসাহেবকে নিয়ে আসতেন, তখন তাইমাকেই তো তাদের আপ্যায়ন করতে হত!

আজ যখন লিখতে বসেছি তখন আমার মনের মধ্যে অনেকগুলো প্রশ্ন জাগছে। আচ্ছা, কাকুর এই শখগুলো কি ছিল শুধু তার নিজের জন্য? যদি তাই হয়, তাহলে কাকু এই শখগুলোর সঙ্গে আমাদেরও সংপৃক্ত করেছিল কেন? কেন, আমাদের গাছ, ফু্ল,‌ মাছ, পাখী চিনিয়েছিল, তাদের যত্ন নিতে শিখিয়েছিল? কাকু কি পুথিঁগত বিদ্যার সঙ্গে আমাদের হাতে কলমেও কিছু শেখাতে চেষ্টা করেছিল? কাকু কি বোঝাতে চেয়েছিল প্রকৃতি পরিবেশ নষ্ট করতে নেই,‌ তাদের রক্ষা করতে হয়? আর ঐ সব ক্যালেন্ডারের, রংচংএ ছবির মাধ্যমে কাকু কি এই বৈচিত্রময় পৃথিবীর সঙ্গে আমাদের পরিচয় করিয়ে, বলতে চেয়েছিল, “আমরা চলে যাব, পিছনে পড়ে থাকবে এই বিচিত্র পৃথিবী, যা জানা বা চেনার দায়িত্ব থাকবে তোমাদের নিজেদেরই হাতে”? এসব প্রশ্নের উত্তর যিনি দিতে পারতেন আজ আর তিনি আমাদের মধ্যে নেই, আমরা শুধু তার দূরদর্শী চিন্তার একটা ধারণা করতে পারি মাত্র!

চতুর্থ পর্ব সমাপ্ত

 

 

গোপা মিত্র

ফিজিক্স অনার্স। একসময়ে কিছুদিন শিক্ষকতা করলেও, প্রকৃতপক্ষে গৃহবধূ – কিন্তু পায়ের তলায় সর্ষে। ভ্রমণের নেশা প্রবল। ভারতের বাইরে কোথাও না গেলেও দেশের মধ্যেই প্রচুর ঘুরেছেন। পাহাড়, সমুদ্র, জঙ্গল, ঐতিহাসিক স্থান – কোনোওকিছুই বাদ নেই। এখনও সুযোগ সুবিধে হলেই বেরিয়ে পড়েন। দু-কলমের জন্যে জীবনে প্রথমবার কলম ধরা।

Author

Du-কলম

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!