Home বিবিধ, গল্প রাখে হরি মারে কে ! (পর্ব – ১)
বিবিধগল্প

রাখে হরি মারে কে ! (পর্ব – ১)

অঞ্জন বসু চৌধুরী

আমার জীবনের দুটি অধ্যায় যা কোনোদিনও আমার মন থেকে হারিয়ে যাবে না। দু রকমের অভিজ্ঞতায় আমি মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে এসেছি আর তাই আজ এই গল্পগুলো আপনাদের সামনে করতে পারছি। আজ প্রথম ঘটনাটি বলছি।

এই ঘটনাটি ঘটেছিলো, আজ থেকে ৪৪ বছর আগের (১৯৭৬) জানুয়ারী মাসের ২২ তারিখে। নেতাজী সুভাষ চন্দ্রের জন্মদিন উপলক্ষ্যে ২৩ শে জানুয়ারী আর প্রজাতন্ত্র দিবস উপলক্ষ্যে ২৬ শে জানুয়ারী আর মাঝখানে শনি আর রবি। সব মিলিয়ে চারদিনের ছুটিতে অফিস থেকে দীঘা যাওয়ার ঠিক করা হলো। কয়েকটা দিন সবাই মিলে হইহই করে কাটানো যাবে।

মানুষ ভাবে এক আর হয়ে আর এক। হঠাৎ BICP বলে একটা কোম্পানীর কাজ এসে পড়াতে আমার পক্ষে দীঘা যাওয়া সম্ভব হলো না। মনটা যদিও খারাপ হয়ে গেল। একদিকে বন্ধুদের ডাকে সাড়া দিতে পারলাম না সেই ভেবে মনটা ভারাক্রান্ত হয়ে থাকলো অন্য দিকে অফিসের কাজকেও অবহেলা করতে মন চাইল না। বন্ধুরা সব বেরিয়ে গেল আমি পড়ে রইলাম কলকাতায়।

২২ তারিখ সন্ধেবেলা অফিস থেকে বেরোনোর সময় আমার এক সিনিয়র দাদা আশিষ বান্যার্জীদা বললেন, “কি রে অঞ্জন মন তো খুব খারাপ যেতে পারলি না বলে!” আমি বললাম, “হ্যাঁ দাদা তা একটু খারাপ।” শুনে আশিষদা বললেন, “তুই এক কাজ কর তোর যত গানের রেকর্ড আছে, তার ভেতর থেকে বেশ কিছু নিয়ে আমাদের বাড়ি চলে আয় সন্ধ্যেবেলা। একেবারে খাওয়া দাওয়া করে যাবি।” আমিও বেশ খুশি হয়ে গেলাম। মন খারাপ করে বাড়ী বসে না থেকে গান বাজনা আর খাওয়া দাওয়া করে ভালই সময় কেটে যাবে।

সন্ধ্যে সাড়ে সাতটা নাগাদ বেরিয়ে পড়লাম আশিষ দার বাড়ী বরাহনগরে গোপাল লাল ঠাকুর রোডের দিকে। প্রসঙ্গত গান বাজনা ভালবাসতাম বলে আমার কাছে রামকৃষ্ণ শরনম,  শ্রীরাধার মানভঞ্জন, মান্না দে, মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, শ্যামল মিত্র এনাদের প্রায় সবার রেকর্ড ছিল। সেগুলকে বগলদাবা করে বেরিয়ে পরলাম। এসে দাঁড়ালাম বাগবাজার বাটার সামনে। পরনে নতুন জামা প্যান্ট আর পায়ে বুটজুতো  যার সোলটা চামড়ার। বাঁ হাতে ৫/৭ টা রেকর্ড। সেদিন বাস বাদুড়ঝোলা।  কিছুতেই বাসে উঠতে পারছিলাম না।  এই করতে করতে ৮ টা বেজে গেল।  

তখন তাড়াহুড়ো করতে শুরু করলাম। চার পাঁচটা একই রুটের বাস ছেড়ে দিয়ে ভাবলাম বিটি রোডের বাস ধরবো। এমন সময় দেখি ৭৮ নম্বর রুটের বাস আসছে। কোনো কিছু চিন্তা না করেই বাসে উঠে পড়লাম। বাসটা ভালই স্পীডে চলতে শুরু করলো। এমনকি টালা ব্রিজ, পাইকপাড়া, চিড়িয়ামোড় কোনো জায়গাতেই দাঁড় করালো না। হঠাৎ দেখলাম চিড়িয়ামোড় পেরিয়ে একটা অন্ধকার জায়গায় বাসটা স্টপেজ দিলো।

রাস্তাটা শুধু অন্ধকারই নয় সদ্য নতুন পীচ ঢেলে তৈরী করা হয়েছে। এবং স্টোন চিপস্‌গুলো তখনো ভালভাবে সমান হয়নি। সব এবড়োখেবড়ো হয়ে রয়েছে। বেশ কিছু যাত্রী নামার ছিল তাই কন্ডাকটর আমাকে বললো একটু নেমে দাঁড়াতে, যাতে আমি একটু খালি হওয়ার পর ভেতরে ঢুকে দাঁড়াতে পারি।

আমি দরজার কাছেই দাঁড়িয়ে ছিলাম, তাই নামার সঙ্গে সঙ্গে প্রায় জনা দশেক লোক হুড়মুড়িয়ে নামতে থাকলো। ঠিক সেই সময় হঠাৎ পাশ দিয়ে আরো একটা একই রুটের বাস ওভারটেক করে চলে গেল। আর তাতেই আমাদের ড্রাইভার সাহেব ইঞ্জিন স্টার্ট করে দিলেন। আর কণ্ডাকটর বাসের বেল বাজিয়ে দিল। যারা নামছিলেন তারাও তাড়াহুড়ো করে নামতে থাকলেন, আর আমিও এক হাতে রেকর্ড আর এক হাতে বাসের হাতল ধরে দৌড়তে থাকলাম কারন যেই নামবার যাত্রীরা সবাই নেমে যাবে আমি লাফিয়ে বাসে উঠে পড়বো। লাস্ট যাত্রী নামা অবধি দেখে, আমি লাফিয়ে বাসে উঠতে গেলাম আর তখনই হলো বিপত্তি। আমার জুতোর সোল বাসের পাদানিতে লেগে ঘষে গেল আর আমার পা দুটো স্লিপ করে বাসের সিঁড়ি থেকে সরে গেল।

আমার পুরো শরীরটা শূণ্যে ভাসতে ভাসতে থাকলো। যদিও আমি হাতলটা ধরেই রেখেছিলাম। মাথার মধ্যে এটা কাজ করছিলো যে আমি বাসের সামনের চাকার কাছে দাঁড়িয়ে আছি এবং পড়ে গেলে পেছনের চাকা একেবারে পিষে দিয়ে যাবে। পুরো ঘটনা ফ্র্যাকশন অফ আ সেকেন্ডের মধ্যে ঘটে যাচ্ছে। 

আমি সেই স্টোন চিপস্‌ উঠে থাকা রাস্তায় গিয়ে পড়লাম। বাঁ হাতে রেকর্ড ধরে বাসের সঙ্গে ঘষটাতে ঘষটাতে প্রায় ২০০ মিটার গেলাম। আমার সারা শরীর ছিঁড়ে ক্ষতবিক্ষত। হঠাৎ মাথাটা কাজ করল, মনে হলো আমি বাসের পেছনের চাকার থেকে একটু হলেও দূরে আছি। তখন হাতটা হাতল থেকে ছেড়ে দিলাম। আর আমার হাতের দু ইঞ্চি দূর দিয়ে বাসের চাকা বেরিয়ে গেল। আমি পড়ে রইলাম রাস্তায় অন্ধকারের মধ্যে।

সব থেকে বড়ো কথা বাস কণ্ডাক্টর আমাকে ওই অবস্থায় দেখে বোধহয় এতটাই হতভম্ব হয়ে গেল যে আর বাস দাড়ঁ করানোর প্রয়োজন মনে করলো না।

ক্ষতবিক্ষত আমি উঠে দাঁড়িয়ে রাস্তা পেরিয়ে বাড়ীর উদ্দেশ্যে রওনা দেবো কিন্তু বাস বা টাক্সি আমার জামা প্যান্ট ছেঁড়া রক্তাক্ত চেহারা দেখে থামলো না। প্রায় ঘন্টাখানেক বাদে একটি বাসের পাদানীতে দাঁড়িয়ে এলাম মাসীর বাড়ী বাগবাজারে। যদিও রেকর্ডগুলো অক্ষত ছিলো।

সেদিন প্রথম মনে হয়েছিলো “রাখে হরি মারে কে” কথাটা ভীষন সত্যি। জোর বাঁচা বেঁচে গেছিলাম সেদিন। পুরপুরি সুস্থ হয়ে উঠতে, আমার সময় লেগেছিল প্রায় ছয় মাস।

লেখক পরিচিতি

 

 

অঞ্জন বসু চৌধুরী

কর্মাসে স্মাতক ও এম বি এ পাস করে চাকুরি জীবনে ব্যস্ত হয়ে পড়লেও গান এবং গল্পের বই পড়া অঞ্জন বসু চৌধুরীর অন‍্যতম নেশা। এক সময়ে অসম্ভব সুন্দর মাউথ অরগ‍্যান বাজাতেন।

Author

Du-কলম

Join the Conversation

  1. ১৯৯৯-এর ১৫ই ডিসেম্বর, আমার সঙ্গেও একই ঘটনা ঘটেছিলো, CESC Victoria House-এর সামনে। আমারও এক হাতে ব‍্যাগ আর ব‍্যাগের মধ্যে সদ‍্য কেনা দুটো ক‍্যাসেট ছিলো, দুটোরই খাপ ভেঙে গেছিলো। তবে, আপনার মতো বাস থেকে রাস্তায় পড়ে যাওয়ার পরে, বাসের পেছনের চাকাকে এড়াতে পারিনি আমি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!