Home ভ্রমণ, প্রবন্ধ প্রথম বেড়ানোর অভিজ্ঞতা
ভ্রমণপ্রবন্ধ

প্রথম বেড়ানোর অভিজ্ঞতা

অঞ্জন বসু চৌধুরী

ট্রাভেল কথাটা ছোটবেলায় বুঝতাম না ঠিকমত কেননা তখনও ইংলিশ ল্যাঙ্গুয়েজটার প্রতি খুব একটা টান অনুভব করিনি। বেড়াতে যাওয়াটা বুঝতাম, ইচ্ছেও হতো কিন্তু যাবার সুযোগ খুব একটা ছিল না। হঠাৎ করে একটা সুযোগ এসে গেছিল।

আমার বাবা সারা বছরে একবারে ছুটি নিতেন। সেটা দুর্গা ষষ্ঠীর দিন থেকে ভাইফোঁটা পর্য্যন্ত। এছাড়া বাবাকে আর্ কোনদিন অফিস থেকে ছুটি নিতে দেখিনি “Sick Leave” ছাড়া।

যাই হোক, বেড়াতে যাওয়ার কথায় ফিরে আসি। একবার পুজোর পরপরই একাদশীর দিন আমরা বেড়াতে যাব ঠিক হলো। আমাদের ফ্যামিলি, শমিত ভঞ্জ মানে বুবুদার ফ্যামিলি, বাবার এক অভিন্নহৃদয় বন্ধু তাঁর ফ্যামিলি, প্যাটেল জামাইবাবু ও তাঁর ফ্যামিলি আর আমাদের কালুদা।

প্রসঙ্গত বলি কালুদা সেবার পুজোর সময় তমলুকে আমাদের সাথেই পুজো কাটিয়েছিল। সব মিলিয়ে বিয়াল্লিশ জনের একটা বড় পরিবার আমরা বেরিয়ে পড়লাম পুরীর উদ্দেশ্যে।

সময়টা ১৯৬৩/৬৪ র সময়। বাসে করে যাওয়ার ব্যবস্থা হলো। আর সঙ্গে চললো রান্নার জন্যে বিখ্যাত অর্জুন ঠাকুর। তাম্রলিপ্ত কো-অপারেটিভ সোসাইটি লিঃ থেকে বাস “Allot” করা হলো আমাদের জন্যে। আমাদের বিয়াল্লিশ জন সদস্যের মধ্যে বেশ কয়েকজন মহিলা ছিলেন। যার মধ্যে আমার দিদা ও শমিত ভঞ্জর ঠাকুমা অন্যতম।

যাই হোক সকলকে নিয়ে সকাল দশটায় বাস ছাড়লো। সঙ্গে বেড়ানোর অনুভূতি আর হাজার স্বপ্ন ঘিরে রইল সমুদ্র আর পুরীর জগন্নাথ দেব দর্শনের। বাসে যেতে যেতে খুব আনন্দ আর হৈচৈ হচ্ছিল। গাড়িতে খাবার খাওয়া সেই প্রথম।

পশ্চিমবঙ্গের বাইরে প্রথম পা রাখার অনাবিল আনন্দে মন তখন ভরে আছে। প্রাকৃতিক দৃশ্য অতুলনীয়। তখন তো আর এতো পলিউশন ছিল না। প্রথম দাঁড়ানো হলো ওড়িশার বারিপদাতে। গাড়ির টায়ার পাংচার হয়ে যাবার জন্য। টায়ার সারিয়ে ভদ্রক পৌঁছতে পৌঁছাতেই সন্ধ্যে হয়ে গেল।

সেই রাত্রে আমরা ভদ্রকে একটা মন্দিরে ছিলাম। বিশাল মন্দির, চারপাশে প্রচুর খোলা জায়গা। সেখানে রান্নাবান্না, খাওয়া-দাওয়া সব সারা হলো। মজার জিনিস হলো, ওখানকার কুকুরগুলো আমাদের এদিকে বাছুরের মত সাইজ।

পরেরদিন সকালবেলায় বড়রা ব্যস্ত হয়ে পড়লো বাজার ইত্যাদির কাজে। আর বাকি আমরা দলবেঁধে ভদ্রক স্টেশনে ঘুরতে গেলাম। দুপুরে খাওয়া-দাওয়ার পর আমরা সবাই বেরিয়ে পড়লাম বাস নিয়ে পুরীর উদ্দেশ্যে।

ভুবনেশ্বর পৌঁছলাম তখন প্রায় সন্ধ্যে। ভুবনেশ্বরে যেখানে ছিলাম আমরা এখনো মনে আছে– সামনে একটা বিশাল দীঘি ছিল। চারিদিক বাঁধানো। বসার সুন্দর জায়গা। এক কথায় মনোরম।

পরের দিন সকাল সকাল আমরা জলখাবার খেয়ে লিঙ্গরাজ মন্দির উদয়গিরি খণ্ডগিরি আর বিকেলে পুরীর জন্যে বেরিয়ে পড়লাম।

একেবারে পুরীর সমুদ্র সৈকতে গিয়ে উপস্থিত হলাম। বিপুল জলরাশি, নিজের অজান্তেই এসে পা ধুয়ে দিয়ে গেল। আমরা সমুদ্র কে প্রণাম জানালাম।

পুরী থেকে একটু বাইরে বেলাভূমির ওপর একটা বিশাল বাড়ি পেলাম। যেখানে অন্তত ছয় সাত খানা বড় ঘর আর্ বাথরুম। আর টানা লম্বা বারান্দা ছিল। খুবই ভালো লাগলো আমাদের এত সুন্দর ব্যবস্থাপনায়।

আমাদের ছোটদের তো কোন কাজ ছিল না তাই দিনরাত সমুদ্র আর সমুদ্র। আর তার সাথে অর্জুন ঠাকুরের রান্না করা নানারকম মুখরোচক পদ।

সকালে লুচি-আলুর সাদা সাদা চচ্চড়ি, দরবেশ। আর দুপুরে ভাত, ডাল, আলু ভাজা, ফুলকপির তরকারি, মাছের ঝোল, মাংসের কালিয়া, চিংড়ি মাছের মালাইকারি চাটনি। একেবারে ভরপুর খাওয়া দাওয়া।

নানারকম মজার ঘটনা এরই মধ্যে ঘটলো। এবার সেরকম দু একটা ঘটনা বলি। শমিত ভঞ্জর বড়দা বাচ্চু। প্রথমে সমুদ্র দেখে নামতে চায়নি। তারপর আর উঠতে চাইতো না। ঘন্টার পর ঘন্টা সমুদ্রে স্নান করতো।

একদিন হল কি আমাদের সাথে দেবেনবাবু বলে একজন ছিলেন তিনি গ্রামের মানুষ, দারুন সাঁতার জানতেন। তিনি একদিন সকালে স্নান করতে এসে একজন আমেরিকান যুবকের সাথে সাঁতার কাটতে কাটতে সমুদ্রের যেখানে সবথেকে বড় ঢেউ সেটাকেও পেরিয়ে চলে গেছিলেন।

আমার ছোট কাকা তো চিন্তায় পড়ে গেলেন, যে কি করে ফেরত আসবে! যাইহোক অনেক সময় পরে তিনি ফিরে এলেন। আমার কাকার কাছে প্রচন্ড বকুনি খেলেন।

এর পর আমাদের জগন্নাথ দেবের মন্দিরে যাওয়ার প্ল্যান হলো। একদিন ভোরবেলা সকলে মিলে জগন্নাথ দর্শন গেলাম। বাড়িতে জগন্নাথ দেবের ভোগ আনা হলো। সে তো অমৃত। একদম নতুন এক অভিজ্ঞতা আর অনুভূতি।

এর ভেতরেই নানা রকমের খুনসুটি হাসাহাসি, আড্ডা চলতে থাকলো। আমাদের মনোরঞ্জনের বিরাট অংশ জুড়ে ছিল গান। মাঝে মাঝেই গানের আসর বসতো। শমিত ভঞ্জর ছোট বোন কৃষ্ণাদির গানের গলা অসাধারণ ছিল।

কালুদা প্যাটেল জামাইবাবুর পেছনে লাগতো আর জামাইবাবু বলতো “এই কালু চুপ যা, বড় বেড়ে গেছিস”বলে হাসতে থাকতেন।

এইসব ছোটো ছোটো আনন্দের মধ্যে দিয়ে কখন যে দিন ফুরিয়ে যেত তা বুঝতে পারতাম না।

এইভাবে একদিন ফেরার সময় এসে গেলো। মন খারাপ সকলের। আমার তো দু চোখ ফেটে জল আসতে লাগলো।

সেবার আমরা আবার জামশেদপুর হয়ে ফিরলাম। সেখানে বাবুদার মামার বাড়ি। ওনারা সকলে আমাদের সাথে গেছিলেন। তাই ওদের ড্রপ করে ওদের ওখানে এক রাত্তির ওখানে থেকে আমরা বাড়ির পথ ধরলাম।

জীবনের প্রথম বাইরে বেরোনো আর তাকে ঘিরে আনন্দের মুহূর্তগুলো মনের মণিকোঠায় চিরদিনের জন্যে অমলিন হয়ে রয়ে গেল।

—   সমাপ্ত   —

লেখক পরিচিতি

 

 

অঞ্জন বসু চৌধুরী

কর্মাসে স্মাতক ও এম বি এ পাস করে চাকুরি জীবনে ব্যস্ত হয়ে পড়লেও গান এবং গল্পের বই পড়া অঞ্জন বসু চৌধুরীর অন‍্যতম নেশা। এক সময়ে অসম্ভব সুন্দর মাউথ অরগ‍্যান বাজাতেন।

Author

Du-কলম

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!