Home ভ্রমণ, প্রবন্ধ আমার ভ্রমণ বৃত্তান্ত – ১৯
ভ্রমণপ্রবন্ধ

আমার ভ্রমণ বৃত্তান্ত – ১৯

গোপা মিত্র

সিকিম

।। শেষ পর্ব ।।

(ইয়ুমথাং)

চলেছি ইয়ুমথাং-এর পথে, আমরা আট জন — ছ’জন বড়ো, দু’জন ছোটো। প্রথম থামা লাচুং-এ। সেখানেই আজ রাত্রিবাস। পরদিন ইয়ুমথাং বেড়িয়ে, আবার ফিরে লাচুং-এর হোটেলেই থাকা। তার পরদিন যাত্রা লাচেন – সেখানেই রাত্রিবাস। পরদিন গুরুদোংমার হ্রদ দেখে ফিরে আসা গ্যাংটকে।

উত্তর সিকিমের সবচেয়ে জনপ্রিয় গন্তব্যটি হোলো ইয়ুমথাং। গ্যাংটক থেকে মংগন, সিংঘিক, চুংথাং, লাচুং হয়ে পথ গিয়েছে ইয়ুমথাংএর দিকে। গ্যাংটক থেকে ১১,৬৯৩ ফুট উচ্চতার ইয়ুমথাং-এর দুরত্ব ১৫০ কিমি। এর আর এক নাম ‘ভ্যালী অফ ফ্লাওয়ার্স’। শুনেছি, এপ্রিল মে মাসে এই উপত্যকায় ফুলের প্লাবন হয়। বিভিন্ন প্রজাতির রডোডেনড্রন, প্রিমুলা, পপি তখন রঙীন করে তোলে এই উপত্যকা – যেন এক নন্দন কানন। সবুজ উপত্যকা তখন পরিণত হয় ইয়াকের বিচরণক্ষেত্রে। আবার শীতের সময়, ডিসেম্বর থেকে মার্চ, তুষারাবৃত ইয়ুমথাং-এর অন্যরূপ। আমরা চলেছি জানুয়ারী মাসে তুষারাবৃত ইয়ুমথাং-এর সৌন্দর্য উপভোগ করতে।

গ্যাংটক থেকে রওনা হয়ে প্রথম থামা মংগনে। সম্ভবতঃ সেখানে অনুমতিপত্র দেখাতে হয়। সব ব্যবস্থা অবশ্য ট্যুর অপারেটরই করে থাকে। সেখানেই হলো আমাদের খাওয়াদাওয়া। পাশ দিয়ে বয়ে চলেছে পান্না সবুজ কলস্বনা  তিস্তা নদী, আর পিছনে বনভূমি ছাওয়া গম্ভীর পর্বতশ্রেণী। কিছুদূর এগিয়ে পৌঁছলাম টং। এখানে আরোও একবার থামতে হলো। এরপর রাংরাং ব্রীজ পার হয়ে চুংথাং; এখানেই লাচুং-চু ও লাচেন-চু নদীর সঙ্গম। পরে এই দুই নদীই মিশে গেছে তিস্তায়। সিকিমীজ ভাষায় ‘চু’ শব্দের অর্থ নদী। এখানেই লাচুং ও লাচেন-এর পথ আলাদা হয়েছে। লাচুং অর্থাৎ Small Pass, লাচেন অর্থাৎ Big Pass. আমাদের গাড়ি ২১ কিমি দূরের লাচুং-এর পথ ধরলো।

লাচুং নদীর পাশ দিয়ে আমরা এগিয়ে চলেছি। এপর্যন্ত পথের এখানে সেখানে পড়েছে অসাধারণ সব জলপ্রপাত। হিমালয়ের পথে তো অনেক ঘুরেছি – দেখেছি অনেক জলধারা। কিন্তু উত্তর সিকিমের পথের এই সব ঝর্ণার সৌন্দর্য সকলের উপরে। পাহাড়, জঙ্গল, নদী আর সবুজ উপত্যকা, এই সব নিয়ে উত্তর সিকিমের পথ সৌন্দর্য অতুলনীয় বললেও কম বলা হয়।

পাহাড়ী রাস্তা ঘুরে ঘুরে ওপরে ওঠে। তাই সময়ও বেশী লাগে। লাচুং পৌঁছতে প্রায় বিকেল গড়িয়ে গেলো। আমাদের থাকার ব্যবস্থা স্নো লায়ন মাউন্টেন রিসর্টে। তিনতলায় আমাদের ঘর। পর্বতবেষ্টিত এই রিসর্ট তখন প্রচন্ড ঠান্ডা। চারিদিক ব্যপ্ত অন্ধকারে আমরা বুঝতেই পারছি না, আশেপাশে কি আছে। শুধু শুনতে পাচ্ছি হাওয়ার, নাকি কোনো জলপ্রপাতের শব্দ। ঘর থেকে আর বেরোলাম না। অন্ধকারে, ঠান্ডায় যাবোই বা কোথায়?তাড়াতাড়ি খেয়ে নিয়ে শুয়ে পড়লাম। কাল ভোরে উঠতে হবে। রিসর্টের নিজস্ব জেনারেটর বন্ধ করে দিলে বিদ্যুৎও চলে গেলো।

পরদিন ভোরে তৈরী হয়ে বাইরে এলাম। প্রায় ৯,০০০ ফুট ঊচ্চতার লাচুং এর অধিবাসীরা বেশীর ভাগই লেপচা বা তিব্বতীয়। পাহাড়ের ভাঁজে ভাঁজে তাদের ছোট ছোট বাড়ীগুলিতে তখন তাদের দৈনন্দিন জীবনযাত্রা শুরু হয়ে গেছে। পরিষ্কার নীল আকাশ। গ্যাংটক থেকে ১১৮ কিমি দূরত্বে অবস্থিত লাচুং নদী তীরবর্তী লাচুংকে জড়িয়ে রয়েছে তুষারাবৃত পর্বতমালা, মাঝেমাঝে ঊপর থেকে নেমে আসা কোনো স্বচ্ছধারার জলপ্রপাত আর অযত্নবর্ধিত বৃক্ষরাজি দ্বারা আবৃত সবুজ উপত্যকা। বেশীক্ষণ নয়, কিছুক্ষণ চুপকরে দাঁড়িয়ে রইলাম অপার সেই সৌন্দর্যের মাঝে। কিন্তু ইয়ুমথাং যাবার তাড়ায়, প্রাতঃরাশ সেরে বেরিয়ে পড়তে হলো।

প্রায় ১১,৭০০ ফুট উচ্চতার ইয়ুমথাং উপত্যকা লাচুং থেকে ২৫ কিমি দূরে অবস্থিত। লাচুং থেকে গাড়ি উপরে উঠতে শুরু করলো। পথিপার্শ্বের সৌন্দর্য অবর্ণনীয়। পর্বতশীর্ষ থেকে নেমে আসা পুরু বরফের স্তর পথিপার্শ্বে যেন বিছিযে দিয়েছে বরফের এক কার্পেট। আমাদের গাড়ি চলেছে তারই পাশ দিয়ে। উপর থেকে নেমে আসা জলপ্রপাতগুলিও তখন জমে বরফে পরিণত হয়েছে। পাশ দিয়ে বয়ে চলা নদীর জলধারাও তখন শীর্ণ দেখাচ্ছে দুপাশের বরফের বিস্তারের জন্য।

প্রায় ঘন্টাদুয়েক পর পৌঁছলাম ইয়ুমথাং উপত্যকায়। দিগন্তবিস্তৃত ইয়ুমথাং উপত্যকা তখন বরফে ঢাকা। সাগর তরঙ্গসম অজস্র পর্বতসারি যেন অতন্দ্র প্রহরীর মতো ঘিরে রয়েছে সমগ্র উপত্যকাটিকে। পর্বতমস্তক সজ্জিত তুষারকীরিটে, পাদদেশ তখন তার আবৃত ঘন অরণ্যে; আর তারই সামনে দিয়ে উপলবন্ধুর পথে উপত্যকাটির বুক চিরে বয়ে চলেছে স্বচ্ছ জলের কলস্বনা ইয়ুমথাং নদী।

আস্তে আস্তে বরফ মাড়িয়ে নেমে এলাম নদীর ধারে। তারপর বরফের উপরই কোনো রকমে বসে, স্পর্শ করলাম নদীর ঠান্ডা জল। ইচ্ছে হোলো, নদীবক্ষের ছোটবড়ো নুড়ি পাথরের উপর দিয়ে হেঁটে যেতে; কিন্তু সাহস হোলো না।

ইয়ুমথাং আমার পহেলগাঁও-এর স্মৃতি (আমার ভ্রমণ বৃত্তান্ত – ৫) ফিরিয়ে আনলো; সেই পর্বতবেষ্টিত সবুজ উপত্যকার মধ্যে দিয়ে উপল বন্ধুর পথে নূপুরের নিক্কন তুলে লীডার নদীর বয়ে যাওয়া। যদিও তুষারছাওয়া পর্বতমালা এত কাছে ছিলো না আর শরৎকাল বলে বরফ নয়, ছিলো সবুজের আধিক্য।

ইয়ুমথাং থেকে আরো ১৫ কিমি এগিয়ে গেলে ভারত চীন সীমান্তে পড়ে প্রায় ১৪,০০০ ফুট উচ্চতায় লাচুং নদীর তীরে ইয়ুমেসেমডং উপত্যকা। বন্ধুর পথ, বরফেও ঢাকা। এসময় সেখানে যাওয়া একেবারেই অসম্ভব।

বেশ কিছুক্ষ্ণণ ইয়ুমথাং-এর সৌন্দর্যে মগ্ন থেকে মুগ্ধ আমরা ফিরে চললাম লাচুং এর পথে। বরফের রাজ্যে আর এক বিস্ময় – ইয়ুমথাং নদীর এক জায়গায় রয়েছে এক গরমজলের কুন্ড। ইচ্ছে করলে সেখানে স্নানও করা যায়। আমরা অবশ্য কেউই সেখানে যেতে চাইলাম না। বরং ড্রাইভারকে অনুরোধ করলাম, এখনও তো হাতে সময় রয়েছে, সে যদি আমাদের অন্য কোনো বরফের রাজ্যে নিয়ে যায়। সে রাজি হোলো – অবশ্যই বাড়তি কিছু অর্থের বিনিময়ে।

লাচুং থেকে, লাচুং নদীর ওপর এক সেতু পেরিয়ে অন্য এক পথে সে আমাদের নিয়ে চললো ‘কাটাও’। ১৩,০০০ ফুট উচ্চতায় অবস্থিত কাটাও যেন এক বরফের রাজ্য, নাকি এক স্বর্গরাজ্য! তুষারাবৃত পর্বত আর হিমবাহ –এই নিয়েই কাটাও। সারাবছরই এখানে বরফ মেলে। কিছুক্ষণ বরফ ছুঁড়ে খেলে তৃপ্ত আমরা এসে দাঁড়ালাম বিশাল এক হিমবাহের সামনে, সরু এক বরফাবৃত পথের উপরে। দুপুরের সূর্যকিরণে, হিমবাহ তখন ঝলসাচ্ছে – যেন এক শাণিত তরবারি। কিন্তু এত বড়ো তরবারি আবার হয় নাকি! গ্লাভস খুলে স্পর্শ করলাম সেই তরবারি – না, হাত অবশ্য কাটলো না, তবে শরীরের মধ্যে দিয়ে যেন তাৎক্ষণিক এক হিমশীতল প্রবাহ ঝটকা দিয়ে সমস্ত শরীর কাঁপিয়ে দিল, নাকি অবশ করে দিলো।

ফিরে এলাম লাচুং-এর রিসর্টে। বৈকালিক আহারান্তে আমরা কেউই নিজেদের ঘরে গিয়ে চুপচাপ সময় কাটাতে চাইলাম না। পথশ্রমে কেউই আমরা ক্লান্ত নই। শীতে বেড়ানোর এই এক মজা; উপযুক্ত গরম পোষাক থাকলে ক্লান্তি কখনোই গ্রাস করে না। স্থির হোলো, আগুন জ্বালিয়ে রির্সটের অন্দরের উদ্যানে আমরা Bon Fire  করবো। রিসর্টের কর্মচারীরাই কাঠকুটোর ব্যবস্থা করে দিলো। সেই নির্জন রাতের অন্ধকারে, হীরকখচিত কালো আকাশের তলে, সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় সাড়ে ন’হাজার ফুট উচ্চতায়, প্রচন্ড ঠান্ডার মধ্যে বসে আছি আমরা কজন জ্বলন্ত এক অগ্নিকুন্ড ঘিরে। কানে আসছে শুধু একটানা ঝিঁঝিঁর ডাক, জলপ্রপাতের গর্জন বা মাঝে মাঝে হাওয়ার শোঁশোঁ শব্দ। এরপর শুরু হোলো অগ্নিপ্রদক্ষিণ কোরে ব্যকরণ না মানা আমাদের উদ্দাম নৃত্যগীত, যে যেমন পারে। সঙ্গে গল্প, কবিতা এসবও চললো, যতক্ষণ না খাবারের ডাক পড়ে। খাওয়াদাওয়ার পর লাচেন যাওয়ার প্রস্তুতি সেরে ঘুমিয়ে পড়লাম।

প্রাতঃরাশ সেরে প্রস্তুত হোয়ে, লাচুংকে বিদায় জানিয়ে রওনা হলাম লাচেনের পথে। আবার এসে পৌঁছলাম চুংথাং। এখান থেকে লাচেনের দূরত্ব ২৭ কিমি, উচ্চতা প্রায় ৯,০০০ ফুট। এবার লাচেন নদীকে পাশে নিয়ে বরফ কাদায় মাখামাখি রাস্তা ধরে, তীব্র ঠান্ডা হাওয়ার মধ্যে দিয়ে, নিস্তব্ধ নিঝুম লাচেনে যখন পৌঁছলাম, তখন মানুষ নয়, বড় বড় লোমওয়ালা কয়েকটি কুকুর আমাদের স্বাগত জানালো। সামনে দিয়ে চলে গেলো এক মিলিটারী জিপ- মাথায় জমা বরফ নিয়ে।

লাচেনে আমাদের রাত্রিবাস গুরুদোংমার লজে। দোতলা এই লজটি আসলে একটি ‘হোম-স্টে’। আমাদের ঘর দেওয়া হোলো একতলায়।

মাঝরাতে প্রচন্ড ঠান্ডায় আমার ঘুম ভেঙে গেলো – মনে হোলো, আমি Collapse করে যাচ্ছি। টর্চের আলোয় কল্যাণকে ঠেলে তুললাম। কারণ তখন আলো নেই। ওকে বললাম লেপ কম্বলের ওপর শালগুলোও চাপিয়ে দিতে। তারপর গরম মোজা, টুপি সব পরে মুড়িসুড়ি দিয়ে কখন না জানি ঘুমিয়ে পড়লাম।

ভোরবেলায় নিজেদের গরম জামায় মুড়ে, তৈরী হোয়ে লাচেন গ্রামের দিকে পায়ে পায়ে এগোলাম। বরফাবৃত পর্বতশ্রেণীর পটভূমিতে পাইন বৃক্ষশোভিত পর্বতের ঢালে তিব্বতীয় শৈলীতে নির্মিত ছোটো ছোটো বাড়ীগুলি দাঁড়িয়ে রয়েছে পাহাড়ে হেলান দিয়ে। মাঝে মাঝে উড়ছে প্রার্থনা পতাকা। অনুভব করলাম, এত ঠান্ডায় এখানের বাসিন্দারা কি কঠিন জীবনযাপন করে – হয়তো সবই অভ্যাস।

ফিরে এলাম হোটেলে। প্রাতঃরাশ সেরে মালপত্র সব গাড়িতে তুলে রওনা দিলাম গুরুদোংমার হ্রদের দিকে। সেখান থেকে আজই ফিরে যাবো গ্যাংটকের হোটেলে। প্রায় ১৭,১০০ ফুট উচ্চতায় অবস্থিত গুরুদোংমার সরোবর হিন্দু ও বৌদ্ধ উভয় ধর্মাবলম্বীদের কাছেই পবিত্র। লোকে বলে, তিব্বত থেকে ফেরার সময় গুরু পদ্মসম্ভব এই হ্রদের জল পান করেছিলেন।

লাচেন থেকে প্রায় ৬৫ কিমি দূরে এই হ্রদ। প্রায় ১৩,০০০ ফুট উচ্চতায় অবস্থিত থাঙ্গু গ্রাম হোয়ে সেখানে পৌঁছতে হয়।

আমরা বেশ ভোরেই রওনা হলাম। কারণ দুপুরের মধ্যেই ফিরে আসতে হবে। এমনিতেই রাস্তা বরফাবৃত। দুপুরে আবহাওয়া খারাপ হলে, ফৌজীরা আমাদের যেতে দেবে না। কারণ ফৌজীরাই এই পথের দেখভাল করে।

লাচেন থেকে একটু এগিয়ে আমরা এক নদী পার হলাম। তারপরই আমাদের গাড়ি উপরে উঠতে শুরু করলো। যত উপরে উঠছে পর্বতশিখরগুলি ততই কাছে এগিয়ে আসছে। সবই তুষারে সাদা। এবার একটা অপেক্ষাকৃত সমতল জায়গায় এসে পৌঁছলাম। এগুলি সবই অবশ্য ফৌজি এলাকা। এরপর আমাদের গাড়ি ভঙ্ককর চড়াই ভাঙতে শুরু করলো। এভাবেই আমরা দু’একটি গ্রাম পেরিয়ে এলাম। ক্রমশঃ গাছপালা কমতে লাগলো। অতি সন্তর্পণে আরো খানিকটা পথ এগিয়ে আমাদের গাড়ি এদিকের শেষ গ্রাম থাঙ্গু – লাচেন থেকে দূরত্ব ৩১ কিমি এসে পৌঁছোলো। গ্রামের প্রতিটি বাড়ীর ছাদই তখন সাদা। গ্রামবাসীরা তখন নিচের গ্রাম লাচেন বা অন্য কোথাও নেমে গেছে। থাঙ্গুর পরই পুরো মিলিটারী এলাকা। এখান থেকে গুরুদোংমার হ্রদ প্রায় ৩২ কিমি। চারিদিক সাদায় সাদা, যেদিকে তাকাই শুধুই সাদা।

আরো খানিকটা এগিয়ে গেলাম। কেমন একটা অস্বস্তি শুরু হোলো। প্রকৃতি তখন আবছা অন্ধকারে ঢাকা। জমা বরফে গাড়ি চালাতে তখন অসুবিধা হচ্ছে ড্রাইভারের। সে আর এগোতে চাইলো না; বরফে চাকা পিছলে যেতে পারে। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে আমরাও আর এগোতে রাজী হলাম না। গুরুদোংমার হ্রদ আমাদের দেখা হোলো না। আমরা ফিরে চললাম।

ড্রাইভার গাড়ি ঘুরিয়ে আবার নিয়ে চললো থাঙ্গুতে, সেখান থেকে যাবো চোপতা ভ্যালী। উত্তরাখন্ডেও রয়েছে এক চোপতা ভ্যালী। কিন্তু এই চোপতা ভ্যালী উত্তর সিকিমের।এই উপত্যকার বুক চিরে বয়ে চলেছে এক নদী। এখানে রয়েছে ইয়াক প্রতিপালন ও প্রজনন কেন্দ্র। গাড়ি যত এগোচ্ছে বরফের মাত্রা তত কমছে। প্রকৃতি এখানে রুক্ষ শুষ্ক।

এক সরু রুক্ষ পাহাড়ী পথে গাড়ি আমাদের নামিয়ে দিলো। আমাদের আশেপাশেই রয়েছে দু’একটি টিলার মত পাহাড়। একটু এগিয়ে সরু পথের যেখানে আমরা দাঁড়ালাম সেখানেই এই রাস্তা শেষ। তার সামনেই নেমে গেছে  জঙ্গলাকীর্ণ গভীর খাদ, তার ওপারেই বিস্তৃত পর্বতশৃঙ্খল। আমাদের বাঁদিকে অনেক অনেক নিচে বরফের আঁকিবুকি কাটা সবুজ চোপতা ভ্যালী আর তার মধ্যে দিয়ে বয়ে যাওয়া নদী। পাহাড়ী পথে প্রায় ট্রেক করেই সেখানে পৌঁছতে হবে। আমাদের পক্ষে তা একেবারেই অসম্ভব। আবার, প্রায় ১৩,০০০ ফুট উঁচুতে এত সরু পাহাড়ী পথে প্রচন্ড হাওয়ার ঝাপটায় নিজেদের ভারসাম্য বজায় রেখে নিচে ঝুঁকে বেশীক্ষণ এই উপত্যকা দেখাও অসম্ভব। সব সময় মনে হচ্ছে এই বুঝি হাওয়া এক ধাক্কায় নিচে ফেলে দেবে। তাড়াতাড়ি এসে গাড়িতে উঠলাম।

ফিরে চলেছি লাচেন হয়ে গ্যাংটকের পথে। কালই ফিরে যাবো কলকাতা।

বরফাবৃত পর্বতশ্রেণী, উপর থেকে নেমে আসা কোনো নাম না জানা জমে যাওয়া ঝর্ণা, বরফাচ্ছাদিত পথিপার্শ্ব, সবুজ উপত্যকা সেও তখন বরফের চাদরে ঢাকা, তারই বুক চিরে উপলবন্ধুর পথে কুলকুল করে বয়ে যাওয়া কোনো এক নদী, চারিদিকে বিস্তৃত ঘন জঙ্গলের মাঝে উঁকি মারা ছোটো ছোট কাঠের বাড়ীগুলি, এই সব কিছু নিয়ে উত্তর সিকিম যেন মর্ত্তে নেমে আসা এক স্বর্গরাজ্য – শুভ্র অমলিন।

ফিরে যাবো আমার সেই চিরচেনা পৃথিবীতে। কিন্তু স্মৃতির মণিকোঠায় রয়ে যাবে আমার এমন স্বর্গীয় সিকিম ভ্রমণের স্মৃতি।

সিকিমের বাঁকে বাঁকে ছড়িয়ে আছে এমনই অজস্র অমূল্য সব মণিমুক্তো। তারই কয়েকটি মাত্র সংগ্রহ করে আমি ছোট এক মালা গাঁথতে চেষ্টা করেছি। আমার এই লেখা তথা মালা যদি কারো ভালো লাগে বা পছন্দ হয়, তবেই আমার এই মালা গাঁথা সার্থক বলে মনে করবো।

— সিকিম ভ্রমণ সমাপ্ত —

লেখিকা পরিচিতি
 
 

 

গোপা মিত্র

ফিজিক্স অনার্স। একসময়ে কিছুদিন শিক্ষকতা করলেও, প্রকৃতপক্ষে গৃহবধূ – কিন্তু পায়ের তলায় সর্ষে। ভ্রমণের নেশা প্রবল। ভারতের বাইরে কোথাও না গেলেও দেশের মধ্যেই প্রচুর ঘুরেছেন। পাহাড়, সমুদ্র, জঙ্গল, ঐতিহাসিক স্থান – কোনোওকিছুই বাদ নেই। এখনও সুযোগ সুবিধে হলেই বেরিয়ে পড়েন। দু-কলমের জন্যে জীবনে প্রথমবার কলম ধরা।

Author

Du-কলম

Join the Conversation

  1. “পুরানো সেই দিনের কথা ভুলবি কি রে হায়
    ও সেই চোখে দেখা…..সে কি ভোলা যায়…”
    💐💐💐💐💐💐👌👌👌👌👌👌👌👌

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!