প্রবন্ধসাহিত্য ও সংস্কৃতি

চিঠি দিও

সুব্রত ঘোষ

চিরকাল একলাই সে দাঁড়িয়ে থাকে
শেড দেওয়া মুখ হাঁ করা
তকমা এঁটে চাবি দেওয়া পেটে
রাস্তার মোড়ে গাছটার নীচে দাঁড়িয়ে আছে
আজ কতকাল কতযুগ ধরে অতন্দ্র প্রহরী।
অমাবস্যার অন্ধকার গায়ে মেখে
স্নান করে পূর্ণিমার জ্যোৎস্নায়
নিশ্চিন্ত শস্যের খেতে নির্বিকার নির্বাক
কাকতাড়ুয়ার মতো নিদাঘ দুপুরে কিংবা
অবিশ্রাম বৃষ্টিতে ভিজে –
উদগ্রীব হাঁ মুখ লালটুপির নীচে।
যদিও ফুরায়েছে প্রয়োজন আজ তার, তবু ডাকে;
ডাকে যদি কেউ ভুল করেও
ফেলে যায় দু – একটা চিঠি তার বুভুক্ষু উদরে।
হোকনা তা লেখা পোস্টকার্ড বা ইনল্যান্ড লেটারে
তবুও আনন্দ পাবে জল কাদায় জং লাগা
তার বর্তমান অবজ্ঞায় উপেক্ষিত অবাঞ্ছিত শরীর।
আজকের দুরন্ত ডিজিটাল ফোর-জি সিক্স-জি’র দিনে,
প্রয়োজনে লেখা হয় চিঠি আজও যদিও।

তাই তো ডাকটিকিট ছাপে এখনোও।
শুধু এইটুকু জেনে বিমলিন পুরোনো শরীর নিয়ে
বয়স্ক বটগাছ তলায় নয়তো তে-রাস্তার মোড়ে
নির্বাক অচঞ্চল আরোও বহুদিন বহুকাল ধরে
মানুষের চিঠির আশায় পোস্ট বক্স থাকবে দাঁড়িয়ে।
যাওয়া আসার পথে চোখে যদি পড়ে কখনোও
পুরানো সেই দিনের কথা তুমি একটু ভেবো
লেখার মতো যদি কেউ নাও থাকে এখন
প্রাক্তনের নামেই একটা চিঠি পোস্ট করে দিও।

শ্রীচরণেষু মা,

আমি গতকাল রাত আটটার মধ্যেই পাটনা এসে পৌঁছেছি। রাস্তায় কোনও কষ্ট হয় নি। তোমার দেওয়া খাবার আমি ঠিক সময়মত খেয়েছি। তুমি তো কতো খাবার ভরে দিয়েছ মা,আর আমাকে বললে বেশি দাও নি। বেশ কিছু লুচি আর আলু চচ্চড়ি থেকে গেছে, মিষ্টিও কয়েকটা রয়ে গেছে। ঠান্ডার জন্য খারাপ হবে না। তাই ভাবছি রাত্তিরে আর বাইরে খেতে যাবো না, ওই খাবারই খেয়ে শুয়ে পড়বো। একটু ঠান্ডা ঠান্ডা লাগবে তাতে কিছু ক্ষতি নেই। তোমার হাতের তৈরী খাবার ঠান্ডাও ভালো লাগবে। ঝাল ঝাল আলুচচ্চড়িটা যা ফ্যান্টাস্টিক হয়েছে না মা কি বলবো। কাল রেস্ট নিয়ে পরশু থেকেই তো কলেজের ক্লাস শুরু। জানো মা, তোমাদের ছেড়ে আসার সময় মনটা খুব খারাপ হচ্ছিল বলেই অতক্ষণ বন্ধুদের সঙ্গে কাটিয়েছি। জানি তোমার আর বাবার সেটা ভালো লাগেনি। তোমরা রাগ করেছ আমার ওপর। ছাড়তে এসে স্টেশনে বাবা একটু চুপচাপ ছিল।

মা, আমার যে বন্ধুর আসার কথা ছিল সে এখনো এসে পৌঁছয়নি। হয়তো কাল আসবে। আজ এখনই এই চিঠিটা লিখে ডাকবাক্সে দিয়ে আসবো যাতে কালকের ডাকে বেরিয়ে যায়। দুদিন পরে এই চিঠি তুমি পেয়ে যাবে আর আমার জন্যে তোমার চিন্তাও দূর হবে। আচ্ছা মা, আমার জন্যে তোমরা এত চিন্তা করো কেন বলো তো? আমি তো এখন যথেষ্ট বড় হয়েছি।

মা, আমি বেরোনোর সময় বোনটি কাঁদতে কাঁদতে চলে গিয়েছিল সামনে থেকে। ওর কথা ভেবে খুব খারাপ লাগছে। কি বোকা মেয়ে বলো তো? আমি তো তিন মাস পরে ছুটি পড়লেই বাড়ি যাবো বেশ কয়েকদিনের জন্যে। তখন কতো মজা করবো। ওকে তুমি একটু বুঝিয়ে বোলো মা। আর লক্ষ্য রাখবে পড়াশোনায় যেন ফাঁকি না মারে। অঙ্কেতে বোনটি একটু কাঁচা। বাবাকে বলবে ওকে অঙ্কটা একটু ভালো করে বুঝিয়ে দিতে। এই পোস্টকার্ডে আর জায়গা নেই তাই আজ এইখানেই শেষ করছি। তুমি আর বাবা আমার প্রণাম নেবে। বোনটিকে আমার ভালোবাসা জানাবে।

 ইতি

তোমার …

আজ থেকে মাত্র তিন দশক আগে পর্যন্ত আমরা এই ধরণের চিঠিপত্র লিখতে অভ্যস্থ ছিলাম আমাদের দৈনন্দিন জীবনযাপনে। আত্মীয়স্বজনের মধ্যে তো বটেই, বন্ধুবান্ধব বা ছাত্র শিক্ষক সম্পর্কের মধ্যেও একটু হেরফের করে এই ধরনের চিঠিপত্রেরই আদান প্রদান হোতো। স্কুলের এমনকি কলেজের পাঠ্যক্রমেও এই চিঠি লেখার চর্চা অব্যাহত রাখার চেষ্টা ছিলো। এই চিঠি লেখাকে একটি আর্ট হিসাবে গণ্য করা হতো। সুন্দর হস্তাক্ষর ছাড়াও চিন্তাশক্তির উৎকর্ষতা বাড়াতে চিঠি লেখার প্রয়োজন বোধ হোতো। চিঠিপত্র আজও লেখা হয় কর্মক্ষেত্রে বা দফতরে কোর্ট কাছারি থেকে শুরু করে জীবনযাত্রার প্রতিটি প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রেই। তবে তা ব্যবহারিক চিঠি এবং বর্তমানে সব কাজকর্ম অনলাইন বা ডিজিটালি হওয়ার জন্য এই পোস্টকার্ডে বা ইনল্যান্ড লেটারে চিঠি লেখা বা চিঠি পাওয়ার সুন্দর অনুভূতিও আর প্রায় নেই। 

আগের মতো ছোট করে লেখা চিঠি বা পোস্টকার্ড লিখন আমরা আর দেখি না। পোস্ট অফিসে ধর্ণা দিলেও মনে হয় পোস্ট কার্ড বা আগেকার হাল্কা নীল রঙের ইনল্যান্ড লেটার আর পাওয়া যাবে না। আর যদিও বা পাওয়া যায়, সেটায় মনের কথা লিখে ভরানোর মতো ধৈর্য বা মানসিকতা আমাদের আর আছে কি না সে বিষয়ে যথেষ্ট সন্দেহের অবকাশ আছে। কারণ আজকের ডিজিটাল কাজকর্মের যুগে কেবলমাত্র দুই তিন শব্দে যখন আত্মীয়স্বজনের মনের চিন্তা, দুশ্চিন্তা বা আশঙ্কা দূর করা মাত্র কয়েক মিনিটের ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে, তখন কে আর এত কাঠখড় পুড়িয়ে অযথা সময় নষ্ট করে মাথা ঘামিয়ে নিজের মনের ভাব প্রকাশ করার মতো বোকামি করতে চায়? যতোই তা মা ছেলের বা গুরুশিষ্যের সম্পর্ক হোক না কেন? তবু এ কথা তো অস্বীকার করার উপায় নেই যে হাজার হাজার মাইল দূরে থেকেও মনের যে সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম অনুভূতির সাক্ষী হয়ে চিঠি প্রেষক আর প্রাপকের মধ্যে এক আত্মীক বন্ধনের এক ভালোবাসার ও ভালোলাগার সেতু তৈরি করতে সক্ষম, সংক্ষিপ্ত অন লাইন মেসেজ বা ডিজিটালের সেই ক্ষমতা আছে বলে মনে হয় না।তাই কারোর মৃত্যুসংবাদ পেয়ে আজকের দিনে অনেকেই অনলাইনে না বুঝেই তিনটি মাত্র ইংরেজি শব্দ RIP ব্যবহার করে দুঃখ প্রকাশ করেন।তাঁরা একবারও ভেবে দেখেন না যে এই RIP শব্দটি সব ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়। অথচ নিদেন একটা পোস্টকার্ডের চিঠিতে আন্তরিকতার সঙ্গে সেই দুঃখ প্রকাশ সম্ভব হয় যা মৃত জনের আত্মীয়স্বজনের দুঃখ বা বেদনা ভাগ করে নিতে পারে।সেনাবাহিনীর কাছে বিশেষ করে সুদূর ফ্রন্টে বা বরফ আচ্ছাদিত পাহাড়পর্বতে মোতায়েন সৈনিকদের কাছে একটি চিঠির গুরুত্ব কত সেটা আমাদের অনুমানের বাইরে। বিবেকানন্দ, রবীন্দ্রনাথের মতো কতো প্রথিতযশা মহাপুরুষ তাঁদের আত্মীয় পরিজন বা জানাপরিচিতদের চিঠি লিখে তাঁদের মনেরকথা বলে গেছেন যা পরবর্তী প্রজন্মের কাছে পাঠানো নথি স্বরূপ হয়ে আছে। পরবর্তীকালে সেইসব চিঠিপত্র একদিন সাহিত্য রূপে আত্মপ্রকাশ করে। বেশি দিনের কথা নয়,আজ থেকে মাত্র পঞ্চাশ পঞ্চান্ন বছর পিছনে ফিরে তাকালে আমরা দেখতে পাবো চিঠির গোছা হাতে নিয়ে খাকি হাফ প্যান্ট আর হাফ শার্ট পরে ডাকপিয়ন দরজার কড়া নেড়ে বলছে “চিঠি আছে”, আর তা শুনতে পেয়েই রান্না করতে করতে খুন্তি ফেলে আঁচলে হাত মুছতে মুছতে ছুটে এসে দরজা খুলে হাত বাড়াচ্ছে বাড়ির বৌ। তার মনের উপচে পড়া আনন্দ একরাশ গোধুলির রঙ মাখিয়ে দিচ্ছে তার চোখে মুখে। আর সেই রঙ দেখে খুশি হয়ে বহুদিনের জানাচেনা মাঝবয়সি পিয়ন বলছে “কি মা লক্ষী, বলেছিলুম না তিন দিনের মধ্যেই তোমার চিঠি এনে দোবো? এবার খুশি তো?” আজ হাজার চাইলেও “ডাকিয়া ডাক লায়া” বা “চিঠি আছে” এইসব মন ভাল করা শব্দগুলো আমরা শুনতে পাই না। সুতরাং, পুরোপুরি যন্ত্রের দাস বা রোবোট না হয়ে গিয়ে অনুভূতিপূর্ণ মানবিকতা একটুখানি বজায় রেখে বর্তমান যুগেও আমাদের পুরোনো সংস্কারের হাত ধরে চললে, চিঠি লেখার মতো একটা সুন্দর অভ্যাস কিছুটা রাখলে খুব খারাপ কিছু করা হবে বলে আমার মনে হয় না। মাঝে মাঝে চিঠি দেওয়া নেওয়ার মাধ্যমে সম্পর্কের বন্ধন টিকিয়ে রাখার অনেক সহজ হবে বলেই আমার বিশ্বাস।

পৃথিবীতে কত প্রেম ভালোবাসা চিঠির মাধ্যমেই তো সফল পরিণতির দিকে এগিয়ে গেছে। কত সুপ্ত ভালোলাগা ক্রমে ভালোবাসা হয়ে উঠে চিঠির অক্ষর বিন্যাসে সুন্দরভাবে প্রকাশ পেয়েছে, তার কোনও হিসাব কেউ কোনদিন রাখে নি। তেমনই কত সুপ্ত ভালোলাগা ভালোবাসার রূপ নিয়েও ব্যক্ত হতে পারেনি কেবলমাত্র বহুআকাঙ্খিত একটি চিঠির অভাবে, সে দৃষ্টান্তও বিরল নয়।

সেইরকমই এক সুপ্ত ভালোলাগা ভালোবাসা হয়ে উঠেও শুধু একটি প্রত্যাশিত চিঠির জন্য তার পরিণতি নিদারুণ ভাবে অসমাপ্ত ও অসফল থেকে যাওয়ার গল্প অন্য আর একদিন করা যাবে।

লেখক পরিচিতি

সুব্রত ঘোষ

সুব্রত ঘোষ কবি ও লেখক হিসাবে দিল্লিতে বিশেষ পরিচিত একটি নাম। প্রায় পাঁচ দশক আগে কর্মসূত্রে দিল্লিতে আসেন এবং গ্রুপ থিয়েটারে অভিনয়, যাত্রাভিনয় এবং বাচিক শিল্পী হিসাবে যথেষ্ট প্রতিষ্ঠা পান। পরবর্তীকালে সুব্রত ঘোষ কবিতা লেখা ও সাহিত্য সৃষ্টিতে মন দেন। তাঁর লেখা কবিতা, রম্যরচনা, গল্প, প্রবন্ধ, নাটক ইত্যাদি পশ্চিমবঙ্গ, মুম্বাই ও দিল্লির বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় এবং ই-পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে বা হচ্ছে। সুব্রত ঘোষ উত্তরবঙ্গ নাট্যজগৎ দ্বারা 2018 সালে ‘বিশিষ্ট কবি’-র স্বীকৃতি ও সম্মান লাভ করেছেন। তাঁর প্রকাশিত কবিতার বই ‘ইচ্ছে পাখি’ পাঠক ও গুণীজন দ্বারা সমাদৃত। সুব্রত ঘোষ দিল্লির ‘দ্যুতি সাহিত্য সভার’ একজন দায়িত্বশীল ব্যক্তি। তিনি একটি আন্তর্জাতিক সাহিত্য সংস্থার সঙ্গেও যুক্ত।

Author

Du-কলম

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!