লেখক : দীপঙ্কর ঘোষ
একটা ছোট্ট প্যাকেট হাতের মুঠোয় ধরে শ্যামল অন্যমনস্ক এগিয়ে চলছে। চেনা অলিগলি বেয়ে। ভাদ্রের পড়ন্ত দুপুর। সূর্য কিঞ্চিৎ দক্ষিণ ঘেঁষা। এলোমেলো উড়ো মেঘ আকাশে ভাসে। উত্তর থেকে বাতাস বয়। কিন্তু গরম কমে না। মধ্যবয়সী শ্যামল হাঁটতে থাকে। নিম্নবিত্তের ছাপ শরীরে প্যাচপ্যাচে ঘামের মতো লেগে জড়িয়ে থাকে। আশেপাশে এ বাড়ি ও বাড়িতে রেডিও বাজে। হাসি কলতান। বড়ো বড়ো পুরোনো সব বাড়ি। বহু দিন হয়নিকো রং। পুরোনো দিনের জানালা। কিছু বন্ধ কিছু খোলা। পানের দোকানে গজল্লা। বাহারী চুলের যুবক আর স্বল্পবসনা নারীদের ভীড়। শ্যামল দুটো বাড়ির মাঝে সরু শান বাঁধানো একটা গলিতে ঢোকে। একপাশে নর্দমা। ঘোলা জল জমে আছে। এখানে বাড়িদের ফাঁক দিয়ে নীল আকাশ উঁকি মেরে দ্যাখে। শ্যামল একটা বাঁধানো উঠোনে এসে পৌঁছয়। সবজেটে শ্যাওলা রংয়ের দরজা – সব সময় অবারিত। মাথা থেকে একটা ছোট্ট বিনুনির মতোন শেকল ঝুলছে। শ্যামল একটু নিচু হয়ে ঢোকে। একটু হেঁটেই একটা বারান্দা। মাঝখানে সিঁড়ি। পর পর অনেকগুলো দরজা – কয়েকটা খোলা – হাওয়ায় তাদের পর্দা ওড়ে। ভেতরে নড়াচড়া – গেরস্থালির গন্ধ। যে সব দরজার বাইরের জুতো রাখা সেগুলো বন্ধ। শ্যামল সিঁড়ির দিকে যায়। সিঁড়ির নিচে চানঘর। একটা চৌবাচ্চা , একটা কল। সেখানে মেয়েদের ভীড়। কয়েকজন চান করছে। গামছা পরে কয়েকজন অপেক্ষায়। একজন বয়স্ক সিড়িঙ্গে মহিলা শায়া পরে মেঝেতে বসে দু আঙুলে ধরে বিড়ি টানছে। শ্যামলকে দেখে বলে ওঠে “আমাকেও সঙ্গে ন্যাও না নাগর – দ্যাখো সুখ ডবল হবে” হাসির হররা ওঠে। “বারো ভাতারির আবার পিরিতের মানুষ” শ্যামল মন্তব্যগুলো অগ্রাহ্য করে উঠে যায়। উঠতে উঠতে একটা বন্ধ দরজার সামনে এসে শেকলে শব্দ করে। “আমার শরীর খারাপ হয়েছে – নোক বসাবোনি।” শ্যামল অস্ফূটে বলে “দরজাখান খোলো … আমি।” দরজা ফাঁক হয়। একটা সদ্যযুবতী এলোচুলের মুখ উঁকি দ্যায়। প্রসাধনহীন ঘুমভাঙা চোখ। শাড়ি পরা মেয়েটাকে পাশ কাটিয়ে শ্যামল ভেতরে ঢোকে। একটা ছোট জানালা। তাতে শাড়ি কেটে পর্দা বানানো। একটা খাট। খাট ঠিক নয় চৌকি। তবে চওড়ায় বড়ো। সস্তা বেডকভার। দেরাজে একগাদা টনিকের বোতল – একটা রঙীন পুরোনো আমলের টিভি। একটা ঠাকুরের ছবি। দুটো ট্রাঙ্ক। তালা দেওয়া। শ্যামল খাটে বসে সিগারেট বার করে।
“আমায় কটা দ্যাও তো।”
“রেখে দাও।” ও প্যাকেটটাই এগিয়ে দ্যায়।
মেয়েটি কিন্তু সিগারেট ধরায় না। ব্রায়ের ভেতর ঢুকিয়ে রাখে। তারপর খাটে উঠে জানালা বন্ধ করতে যায়। শ্যামল বাধা দ্যায়। “না না দরকার নেই – কথা আছে।”
কিন্তু কথা হয় না। দুজনেই চুপ করে বসে থাকে। “চা খাবা?” ঘরে একটা হীটার আছে। ও বসে বসে চা বানায়। “দুধ ন্যাই কিন্তু।” শ্যামল চায়ে চুমুক দিয়ে বলে “মায়া তুমি চা খাবে না?” “নাঃ এই তো ভাত খেয়ে উঠলাম।” শ্যামল যুগপৎ চা আর ধোঁয়া পান করতে থাকে। “এ্যাতো দিন আসো নি … আমি তো ভাবছি …” একটু হাসির আভাস এলো কি ঠোঁটে? নিরুত্তরে সিগারেটের শেষটুকু চায়ের কাপে ডুবিয়ে দ্যায়।
“কাজের ধান্দায় গেসলাম”
মায়া গালে হাত দিয়ে ঝুঁকে বসে। ফলতঃ ওর স্তনবিভাজিকা আংশিক দৃশ্যমান হয়।
“হলো কিচু কতা?”
শ্যামল ঘাড় নাড়ে “হ্যাঁ হয়েছে।”
মায়া তাকিয়ে থাকে। শ্যামল আঙুল দিয়ে নিজের চুল এলোমেলো করে। করতেই থাকে।
“কী হলো ? কিচু হলো না?”
“হয়েছে। দোকানে ক্যাশের কাজ … মোটামুটি মায়না … একটা ঘর দেখেছি …বাথরুম আছে … জল আছে।” শ্যামল বাইরে তাকায়। দূরে মেঘেদের কাছে কাছে একটা চীল উড়ছে। একটা কাঠবিড়ালি চিড়িক চিক চিড়িক চিক করেই যাচ্ছে। শ্যামলের অল্প পাতলা হয়ে আসা চুল এ্যাকেবারে এলোমেলো হয়ে যায়। “ মোটামুটি মায়না … তুমি যাবে … মায়া?” মায়া বসে থাকে। পায়ের নখ খোঁটে। “আর হাজার দুয়েক টাকা যদি এদিক ওদিক করে … যাওয়ার সময় কালীঘাটে গিয়ে মায়ের সামনে সিঁদুর … মায়া … ? ” মায়া পায়ের নখ খুঁটতেই থাকে। শ্যামল আরেকটা সিগারেট চায়। মায়া বক্ষবন্ধনীর ভেতর থেকে পুরো প্যাকেটটা বার করে দ্যায়। আঁচল খসে পড়ে।
“আমার নাম মায়া নয়।” ও নখ খুঁটতেই থাকে। যেন নখের মধ্যেই ওর সব কথা মিশে আছে।
“এখেনে আসার আগে … আমার নাম ছেল সনকা … মাসি সনকা নামটা বদলে মায়া করে দ্যাছে … বাড়িতে সবাই …” ও নতমুখে আঁচল ঠিক করে “
“বাড়িতে আমাকে সবাই ….”
“চলো একদিন বাড়িটা দেখে আসি … ঘন্টাখানেক লাগবে … আমার সকাল আটটা থেকে ডিউটি … দুপুরে বাড়ি আসবো আবার বিকেল পাঁচটায় … তোমাকে একটু একা থাকতে হবে” শ্যামল হাসে। মায়া … না না এ্যাখন না সনকা বিছানায় উঠে বসে “যাবো একথা মাসি জানতি পারলি পরে ঠ্যাং ভেঙে দেবেনি …”
শ্যামল হাতের প্যাকেটটা এগিয়ে দ্যায় “এতে তোমার বেলাউজ পেটিকোট আছে – লাল রংয়ের – শাড়িটা তোমারে সঙ্গে নিয়ে কিনতে যাবো।”
“আমি এ্যাখন পিরিয়ড হয়েছে বলে নোক বসাচ্ছি না … বেশী দেরী করা যাবে না মশাই – আমি আর নোক বসাতি পারবোনি।”
সনকা ওর দামী জিনিসপত্র গয়না সব শ্যামলের হাত দিয়ে ওর নতুন ঘরে পাঠিয়ে দিয়েছে। আজ যাওয়ার দিন। সনকার আজ বড্ড ছেলেব্যালার কথা মনে পড়ছে। বাড়ির কথা। মাসি’কে বলেছে ডাক্তার দেখাতে যাবে। বুকের ভেতরটা ধ্বক ধ্বক করছে। ঠোঁটের ওপরে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমছে। হাতের তালু ভেজা। ছোটব্যালায় ওদের বাড়িতে পাশের বাড়ির এক মাসি আসতো। গাল মুখ চকচক করতো। যেন গর্জন তেল মাখা দুর্গা। টান টান করে বাঁধা চুল। ঘরোয়া শাড়ি পরা। সনকার আজ ঐ মাসিটার কথা মনে পড়ছে। হয়তো ওর নারীমনে ঐ চেহারাটাই স্বপ্ন হয়ে গেঁথে ছিলো। ও আজ ঐভাবে চুল বাঁধবে। টেনে টাইট করে। সামনের চুলগুলো বড্ড ছোট ছোট করে কাটা। কিছুতেই হচ্ছে না। সামনে ঝুলে থাকছে। সনকা আবার নতুন করে চুল বাঁধা শুরু করে।
রচনাকাল : ১৯/০৯/২০২০
দীপঙ্কর ঘোষ
একজন বৃদ্ধ চিকিৎসক। এক কালে মেডিক্যাল কলেজে পড়াতেন। লেখালেখিই বাতিক। প্রবন্ধ কবিতা এবং ছোটো গল্প লিখে থাকেন। এ যাবৎ প্রকাশিত বইয়ের নাম “মানদাসুন্দরী ও মাতাল ডাক্তার” – এক মাতালের বেদনাবিধুর গল্প সমষ্টি। আর প্রকাশিতব্য “রঙিন কৈশোর” এবং “কিছু অসুখ কিছু কথা”, রূপালী প্রকাশনী থেকে।
বছরের শেষ দিনে প্রকাশিত এই অন্য স্বাদের গল্পটিকে এককথায় প্রতীকী বলা চলে। পুরাতন যতো দুঃসহ স্মৃতিভারে ভারাক্রান্ত মানুষ, নতুন সময়ে নতুন আলোর দিশা দেখে। আশা করি কেশবতীর ভবিষ্যত জীবন সুস্থ ও সুখের হবে।
হয়তো শ্যামল ফিরবে …