Home বিবিধ, গল্প অথ লোডশেডিং কথা
বিবিধগল্প

অথ লোডশেডিং কথা

কুসুমিকা সাহা

# না চাওয়ার গল্প

তখনও আমাদের বাড়িতে টিভি আসেনি, এক পাড়াতুতো জেঠুর বাড়িতে আমরা ছোটরা গুপী গাইন বাঘা বাইন দেখতে গেছি। গুপী বাঘা হাততালি দিয়ে বলল ‘শুন্ডি’.. হা হতোস্মি, কোথায় কি? চাদ্দিক অন্ধকার। প্রাণপণে ঠাকুরকে ডাকছি, অত ডাক বোধহয় পরীক্ষার রেজাল্টের সময়েও ডাকিনি। তখন ঠাকুরও বোধকরি এত ব্যস্ত ছিলেন না, কারণ সে ডাকে সাড়া মিলেছিল খানিক পরে হলেও। কারেন্ট এলে ঘরে আর কি আলো জ্বলল, আলো তো সব আমাদের মুখে …

# চাওয়ার গল্প 

গরমের ছুটির জন্যে মুখিয়ে থাকতাম, পড়তেই মাসির বাড়ি, ইছাপুর। একটু ভেতরের দিকেই, ফলে গ্রামের খোলামেলা পরিবেশ। বাড়ি, সামনে পেছনে প্রচুর জায়গা, বাগান। উল্টোদিকে একটা ঝিল ছিল। শহুরে সীমাবদ্ধতায় অভ্যস্ত আমার মুক্তির আস্বাদ ছিল ওই বাড়ি, সাথে মাসির আদর আর মাসতুতো ভাইবোনদের সঙ্গলোভ তো ছিলই। সন্ধ্যের পর প্রায় রোজই লোডশেডিং হত। আর এইটুকুর জন্যে দিনভর মুখিয়ে থাকতাম আমরা ছোটরা। আমার না হয় বইখাতার ঝামেলা ছিলনা, কিন্তু ভাইবোনদেরও তো না থাকতে হবে, আর বড়দের কাজকম্মোও চুলোয় যেতে হবে। তারপর হবে মাদুর পেতে, হ্যারিকেন জ্বালিয়ে বাড়ীর সামনে ওই মাদুরে শুয়ে বসে, ঝিলের হাওয়া খেতে খেতে গল্প, গান। সে সময়েও প্রার্থনা করতাম, তবে তা কারেন্ট না আসার জন্যে …

# শাপে বর

আর্লি টু বেড, আর্লি টু রাইজ জীবনের যে সময়টাতে মূলমন্ত্র হিসেবে শেখানো হত, সেই গতে বাঁধা নিয়ম মানার দিনগুলোতে অনিয়মের কিঞ্চিৎ সুযোগেও মনে আনন্দের ফোয়ারা ছুটত। হয়ত কোনওদিন খাওয়াদাওয়ার পর শুতে গেছি সবাই মিলে। এমন সময় লোডশেডিং। আহা, আমাদের ছোটদের হাতে যেন পড়ে পাওয়া চোদ্দ আনা। একটি একটি করে সব বাড়ীর দরজা খুলে বাবা কাকু জেঠুরা রাস্তায়, মায়েরা ছাদে, এবং আমরাও মায়ের অতিরিক্ত বাধ্য সন্তান হয়ে ছাদে। বাবাদের ওজনদার আলোচনা, মায়েদের পারিবারিক গল্পগাছার মধ্যে আমাদেরও কিছুক্ষণের হাহা হিহি খিকখিক খুকখুক …

# বরে শাপ

কলেজে পড়তে বন্ধুরা সবাই মিলে একবার প্ল্যানচেট করার হিড়িক উঠেছিল। সব দলেই কিছু অত্যন্ত বিপজ্জনক চরিত্র থাকে, যারা না বাবা মাকে ভয় পায় না টিচারদের না ভূতেদের। তো সেইরকম কিছু সঙ্গগুণে বা দোষে আলো নিভিয়ে মোমবাতি জ্বালিয়ে ডাকা হল তাঁদের। একখানা কাপ ঘুরে ঘুরে কিছু প্রশ্নের উত্তরও দিল। সব মিটে যাওয়ার পর যখন “আচ্ছা হয়ে গেছে” বলে একখানি স্বস্তির শ্বাস ছেড়ে আলোর সুইচ অন করা হল, সে আর জ্বলে না। আসলে হয়েছিল লোডশেডিং, কিন্তু আমাদের বুদ্ধি তখন সমস্ত যুক্তির ঊর্ধ্বে। সেই মুহূর্তের ওই কিংকর্তব্যবিমূঢ় বদন ক’খানির নেহাৎ কোনও ছবি নাই, না হলে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ হরর ফোটোগ্রাফের সম্মান  পেত নির্ঘাৎ …

# সিলসিলা ইয়ে চাহত কা

নাহ, মাঝে মাঝে প্রদীপ নিভে যাওয়াও বেশ। প্রেম সবসময়ই নির্জনতা খোঁজে, নিভৃত আড়াল চায়। সে প্রেমিক প্রেমিকার একছাদ থেকে অন্য ছাদে পাঠানো একচিলতে আলোর সংকেতই হোক, অথবা নব বরবধূর বানভাসি জ্যোৎস্না রাত। সর্বত্রই প্রেক্ষাপট হিসেবে অকপট আলোর থেকে একান্ত আঁধার বেশি কাঙ্ক্ষিত … 

এখন আর লোডশেডিং হয়না সেভাবে। হলেও অন্য অনেক কিছুর মত এরও ব্যাক-আপ সিস্টেম আছে ঘরে ঘরে। হারিয়েছে সন্ধ্যেবেলায় কারেন্ট যাওয়ার চিন্তায় মা কাকিমাদের হ্যারিকেনের চিমনী ঘষে মুছে পরিষ্কার করে রাখা, হারিয়েছে কর্মব্যস্ত দিনযাপনে হঠাৎ করে কাছাকাছি চলে আসার একচিলতে সুযোগ। আর এ সবের সাথে হারিয়ে গেছে অনেক ছোট ছোট রহস্য রোমাঞ্চ ভাললাগা খারাপ লাগা …

লেখিকা পরিচিতি

 

 

কুসুমিকা সাহা

সারাদিন কাটে সংসারের নানা কাজে।
লেখা আর গান তার ভালোবাসা।
সিনেমা দেখা এবং তার পর্যালোচনা করা তার অন্যতম শখ।

Author

Du-কলম

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!