Home সাহিত্য ও সংস্কৃতি, রকমারি অনাদৃত (স্বল্প-দৈর্ঘ্যের নাটক)
সাহিত্য ও সংস্কৃতিরকমারি

অনাদৃত (স্বল্প-দৈর্ঘ্যের নাটক)

বারীন চক্রবর্তী


সুসজ্জিত ড্রইংরুমের দুদিকে দুটি দরজা। একটি দরজা ঘরের ভিতরে যাওয়ার জন্য এবং অন্যটি বাড়ির বাইরে। বাইরে যাওয়ার দরজাটি বাম দিকে। ভিতরে যাওয়ার ডানদিকের দরজাটি কিছুটা দর্শকদের দিকে মুখ করে লাগানো হয়েছে। সেই দরজার ওপরে পর্দার সাথে সারিবদ্ধভাবে উইন্ড চেইন ঝোলানো। ছোঁয়া লাগলে আলোড়ন তোলে। দরজা দুটি থেকে কিছুটা দূরে অর্থাৎ মঞ্চের মাঝামাঝি জায়গায় দেওয়ালে একটি বড় জানালা। তার ওপর পেলমেট সমেত হাল্কা রঙের পর্দা। সেই পর্দার সাথে সামঞ্জস্যতা রেখে ঝালর লাগানো হয়েছে। পর্দা খোলা থাকলে বা ভাগ করা পর্দা দুটিকে রঙিন দড়ি দিয়ে বাঁধা থাকলে নীল আকাশের সাথে শহরের অ্যাপারমেন্টগুলির ছবি ফুটে ওঠে। জানালার পাশে তিন/চার ফুটের উচ্চতায় ঢাকনা দেওয়া একটি বড়  ল্যাম্পশেড রাখা রয়েছে। দেওয়ালের নিচের অংশ থেকে জানালা পর্যন্ত রঙিন কারুকার্য করা টাইলস জাতীয় কিছু লাগানো আছে। দেওয়ালের বাকি অংশটুকু হাল্কা রঙের প্রলেপ।  দেওয়ালের একদিকে চার/ পাঁচ ফিটের একটি লম্বা ড্যাংলার ঝোলানো। সেই ড্যাংলারের ওপর ইউরোপিয়ান দার্শনিকদের বিখ্যাত মানুষের হাস্যজ্বল ছবি। ভিতরে যাওয়ার দরজা থেকে কিছুটা দূরত্ব রেখে একটি কারুকার্যময় ঐতিহ্যবাহী টেবিল চেয়ার। সাদাকালো চেজ বোর্ডের মত দেখতে নকশায় তৈরি কাপড়ের সাহায্যে টেবিলটিকে ঢেকে রাখা হয়েছে। ড্রইংরুমের মাঝামাঝি জায়গায় সারিবদ্ধভাবে কয়েকটি বেতের চেয়ার রাখা আছে। চেয়ারগুলির সামনে রাখা আছে একটি মাঝারি ধরনের বেতের টেবিল। সেই টেবিলের ওপর রাখা আছে জলের পাত্র এবং গ্লাস। রঙিন ফুল দিয়ে সাজানো ফ্লাওয়ার ভাস এবং কিছু বইপত্র।

সময় বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা। মঞ্চের পর্দা উন্মোচন হওয়ার পর তিরিশ/বত্রিশ বয়সের একটি ছেলেকে টেবিলের ওপর ল্যাপটপ সামনে রেখে চেয়ারে বসে কাজ করতে দেখা যায়। সামনে রাখা কফির মগ। কফিতে মাঝেমাঝে চুমুক দিতে দিতে কানের দু’পাশে ব্লু টুথ হেড ফোন লাগিয়ে সে গান শুনছে। কাজ করতে করতে মাঝেমাঝে গুনগুন করে ওঠে সে। নাম তাঁর অনুরাগ কাশ্যপ। 

বাইরে মেঘের গুরুগম্ভীর আওয়াজ এবং  বৃষ্টির শব্দ। মাঝেমাঝে দরজা জানালা থেকে বিদ্যুতের চমক ঘরের মধ্যে প্রতিফলিত হতে থাকে। সাথে হাল্কা সুরে পুরানো হিন্দি গান শোনা যায়। কাজ করতে করতে মায়ের উদ্দেশে সে চীৎকার করে ওঠে।

অনুরাগ: মা! ও মা!

গায়ত্রী: (ভিতর থেকে) আবার কি হলো?

অনুরাগ: এবার মনে হয় বৃষ্টি থামবে না! দেখছ না, একনাগাড়ে পড়ে যাচ্ছে। এক কাজ করো, গরম গরম পকোড়া বানাও। তুমি আমি গল্প করতে করতে খাব, কেমন?

গায়ত্রী: তুই বলার আগেই ব্যাসন মেখে রেখেছি। পেঁয়াজ কাটা হয়ে গেছে।এবার আলু বেগুন কাটব।

অনুরাগ: একেই বলে টেলিপ্যাথি।

গায়ত্রী: ওরে, আমি যে মা।

অনুরাগ: সে আর বলতে!

গায়ত্রী: এবার একটু হাঁটাচলা কর। দুপুরে খাওয়াদাওয়ার পর, সেই থেকে একনাগাড়ে অনেকক্ষণ বসে কাজ করছিস। সন্ধ্যা হয়ে এল।

অনুরাগ: আর কিছুক্ষণ। তুমি ততক্ষণে পকোড়া বানিয়ে নিয়ে এস।

গায়ত্রী: ঠিক আছে। আমি এসে যেন দেখি কাজ বন্ধ রেখে পায়চারি করছিস।

(ল্যাপটপে কাজ করতে করতে বাইরে যাওয়ার দরজার দিকে অনুরাগের দৃষ্টি যায়। বিদ্যুতের আলোয় একজন মানুষের ছায়া পরিলক্ষিত হয়। মানুষটির ছায়া লম্বা এবং তির্যকভাবে ড্রইংরুমের ভিতরে প্রতিফলিত হয়।)

অনুরাগ: কে ওখানে দাঁড়িয়ে? এই যে শুনছেন? বাইরে প্রচন্ড বৃষ্টি হচ্ছে, আপনি ভিতরে আসুন। কি হলো? শুনতে পাচ্ছেন না? আপনি ভিতরে আসুন।

(অনুরাগ টেবিল ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে দরজার কাছে যাওয়ার চেষ্টা করে। তার আগেই একজন বয়স্ক মানুষ ধীরে ধীরে ড্রইংরুমের ভিতরে প্রবেশ করে। মানুষটির গাল ভর্তি খোঁচা খোঁচা সাদা দাড়ি। চোখে কালো দড়ি দিয়ে বাঁধা মোটা ফ্রেমের চশমা। উস্কোখুস্কো চুল। মলিন পোষাক। গাঢ় নীল রঙের ফতুয়ার ওপর মলিন সাদা জহর কোট। পায়ের একদিকে ছোট করে লাগানো কালো প্যান্ট থেকে বেল্টের বাকি অংশটুকু বাইরে বেরিয়ে ঝুলছে। বগলে ছেঁড়া রেক্সিনের ফোলিও ব্যাগ। পায়ে ছেঁড়া ক্যাম্বিসের জুতো। ড্রইংরুমের ভিতরে ঢুকে পোষাকে লেগে থাকা বৃষ্টির জল হাত দিয়ে ঝাড়তে থাকে সে। তারপর পকেট হাতড়ে রুমাল বের করে মুখ মুছতে থাকে। বয়স ষাটের ওপরে। মানুষটির নাম সোমনাথ ভারতী।)

সোমনাথ: (মুখে মৃদু হাসি।) ভিতরে আসব বলছেন?

অনুরাগ: এই বৃষ্টিতে বাইরে কতক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকবেন?

সোমনাথ: হ্যাঁ, অনেকক্ষণ ধরে দাঁড়িয়ে আছি।

অনুরাগ: দরজা তো খোলাই ছিল। নক (Knock) করতে পারতেন।

সোমনাথ: (রুমাল দিয়ে মুখ মুছতে মুছতে।) disgustful ! এই বৃষ্টি কখন যে থামবে? (কিছুক্ষণ পর অনুরাগের দিকে তাকিয়ে) সত্যিই তো! আগে যদি এই কথাটা মাথায় আসত, তাহলে এতক্ষণ আপনাদের বারান্দায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আমাকে ভিজতে হতো না! অবশ্য সেরকম ভেজা আমি ভিজিনি! বৃষ্টির ছাঁট এসে যতটুকু ভিজিয়েছে। ও এক্ষুনি শুকিয়ে যাবে। তবে জুতোটা সামান্য ভিজেছে। আচ্ছা, আপনি বুঝলেন কি করে, আমি

এখানে দাঁড়িয়ে আছি?

অনুরাগ: দরজা খোলা ছিল বলে, বিদ্যুতের আলোয় আপনার লম্বা ছায়া আমি দেখতে পেয়েছিলাম। আমি না ডাকলে তো আপনি দাঁড়িয়েই থাকতেন।

সোমনাথ: আচ্ছা, আপনিই বলুন, কারো বাড়ির দরজা খোলা থাকলেই কি ঢোকা যায়?

অনুরাগ: যায়! তবে ঢোকার আগে নিজের উপস্থিতি জানান দিতে হয়। যা আপনার আগেই করা উচিত ছিল।

সোমনাথ: আসলে আমার শারীরিক চেহারা দেখে কেউ ঘরে ঢোকাবে না ভেবেই আমি আপনাদের দরজায় নক করিনি। অথচ দেখুন, কি এমন সংযোগ, আমি যখনই কারো বাড়ির সদর দরজার সামনে কোন কারণে দাঁড়িয়েছি, কেউ না কেউ ড্রইংরুমে ডেকে আমাকে বসতে বলেছেন এবং নিজেদের ইচ্ছেমতো আপ্যায়ন করেছেন। আমি আশ্চর্য হলাম এই শুনে, এই ঘণ বর্ষায় বিদ্যুতের চমকে শুধুমাত্র আমার লম্বা ছায়া দেখে আপনি আমাকে ভিতরে আসতে বললেন।

অনুরাগ: সভ্য দেশের নাগরিক আমরা।

সোমনাথ: সভ্য! আচ্ছা, আমার দেশের নাগরিকদের আপনার কতটুকু সভ্য বলে আপনার মনে হয়?

অনুরাগ: আচার আচরণে তার আভাস পাওয়া যায় বলে মনে হয়।

সোমনাথ: আপনি কি শুধুই আচার আচরণ দেখে একজন নাগরিককে সভ্য বলে মনে করেন?

অনুরাগ: obviously !

সোমনাথ: দূর থেকে ক্ষণিকের আচার আচরণ দেখে আমরা মনে করি একজন মানুষ কত ভদ্র, কত নম্র, কত বিনয়ী, তাই না? আবার ঐ মানুষটির সাথে সম্পর্ক

গড়ে উঠলে বা ভাবের আদানপ্রদান হওয়ার সাথে সাথে কিছুদিনের মধ্যে বোঝা যায় ভদ্রতার আড়ালে সে মুখোশ পড়ে আছে।

অনুরাগ: এখন আর সেই ধরনের সম্পর্ক গড়ে ওঠে না। সম্পর্কগুলো তৈরি হওয়ার কিছুদিনের মধ্যেই ভেঙে যায়।

সোমনাথ: বলছেন? তাহলে দেখছি আপনার বাস্তব অভিজ্ঞতা আছে। স্টিফেন হকিং বলেছেন, “If you expect nothing from somebody you are never disappointed.”

অনুরাগ: Interesting ! এই দেখুন, এখন পর্যন্ত আপনার নাম জানা হলো না যে!

সোমনাথ: সোমনাথ ভারতী!

অনুরাগ: আমার নাম অনুরাগ কাশ্যপ। আপনি দাঁড়িয়ে আছেন কেন? বসুন।

সোমনাথ: (ইতঃস্তত করে) বসব বলছেন?

অনুরাগ: কেন বসবেন না? আপনি হলেন এখন আমার অতিথি!

সোমনাথ: দারুণ তো! আপনি আমাকে এর মধ্যে অতিথি বানিয়ে ফেললেন?

অনুরাগ: কোথায় থাকেন?

(অনুরাগ বেতের চেয়ারের সামনে টেবিলের ওপর রাখা জলের পাত্র থেকে গ্লাসের মধ্যে জল ঢেলে সোমনাথের হাতে তুলে দেয়। )

অনুরাগ: আপনার জল।

সোমনাথ: (জলের গ্লাস হাতে নিয়ে) ধন্যবাদ! এই গুমোট গরমে তেষ্টায় বুক ফেটে যাচ্ছিল!

( জল খেয়ে সোমনাথ রেক্সিনের ফোলিও ব্যাগ থেকে তেল চিটচিটে একটি খালি বোতল বের করে টেবিলের ওপর রেখে দেয়।)

সোমনাথ: যাবার সময় এই বোতলে জল ভরে দেবেন তো! এক বোতল জলে কি আর সারাদিন চলে! ও হ্যাঁ, আপনি কি যেন জিজ্ঞেস করেছিলেন?

অনুরাগ: কোথায় থাকেন?

সোমনাথ: স্থায়ীভাবে আমি কোথাও থাকি না। সারাদিন তো বাইরে বাইরে ঘুরে বেড়াই। রাতটুকুর জন্য কোন রকমে মাথা গোঁজার মত ঠাঁই পেলেই হলো। মেট্রোপলিটন শহরে কি আর থাকার জায়গা অভাব?

(অনুরাগ জলের পাত্র থেকে বোতলে জল ঢালতে থাকে।)

অনুরাগ: মানে?

সোমনাথ: এই ধরুন শহরের আউটস্কার্টসের (Outscarts) চতুর্দিকে যতগুলো বস্তি আছে, সেখানেই আমার মাথা গোঁজার ঠাঁই।

অনুরাগ: পরিবার?

সোমনাথ: ছিল! এখন নেই!

অনুরাগ: কেন?

সোমনাথ: নেতৃত্ব দেওয়ার মত ক্ষমতা ছিল না বলে।

অনুরাগ: কারণ?

সোমনাথ: আমি আমার পরিবারের সাথে কম্প্রোমাইজ করতে পারছিলাম না বলে!

অনুরাগ: পরিবার থাকলে অন্যান্য সদস্যদের সাথে অ্যাডজাষ্টমেন্ট করে চলতে না পারলে কষ্ট তো পেতেই হবে।

সোমনাথ: আপনার কাছে কষ্ট মনে হতে পারে! আমার কাছে মনে হয়েছে মুক্তি।

অনুরাগ: মুক্তি?

সোমনাথ: হ্যাঁ! মুক্তি! কারণ জীবনে সবথেকে বড় ভুল হল, আরো দশজনের মত পুরানো প্রথা অনুযায়ী বিভিন্ন কারণে আমাকেও পরিবারতন্ত্রের ওপর আস্হা রাখতে হয়েছিল। 

অনুরাগ: পরিবারতন্ত্রের ওপর আস্হা বা ভরসা রাখার আগে আপনার ভাবা উচিত ছিল।

সোমনাথ: যৌবনে সেই ভাবনা যদি মানুষ ভেবেই থাকত তাহলে এই বয়সে এসে আমার মত কেউ মুক্তির রাস্তা খুঁজে বেড়াত না। অবশ্য এই বয়সে এসে চোখের জল ফেলে যাঁরা পরিবারতন্ত্রের ওপর প্রতি মুহূর্তে অ্যাডজাষ্টমেন্ট করে দিন অতিবাহিত করছেন তাদের কথা আলাদা।

অনুরাগ: অ্যাডজাষ্টমেন্ট না করলে আপনি কোথাও টিকে থাকতে পারবেন কি?

সোমনাথ: কমার্স নিয়ে পড়াশোনা করেছি। দা স্কুল অব বিজনেস থেকে ম্যানেজমেন্ট করার পর ইনকাম ট্যাক্সের চাকরি পাই। চাকরি করার সাথে সাথে “সিকিউরিটিজ রেগুলেশন ইন ইন্টারন্যাশনাল ক্যাপিটল মার্কেটস”-এর ওপর পি এইচ ডি করি। চাকরিতে উন্নতি হয়। আয়কর বিভাগের অফিসে আমার কাজ ছিল ডিফল্টারদের অর্থাৎ বড় বড় ব্যবসায়ীরা যাঁরা ইনকাম ট্যাক্স ফাঁকি দেওয়ার চেষ্টা করত, তাঁদের নোটিশ পাঠান। পরপর রিমাইন্ডার পাঠালেও যখন সেই ব্যবসায়ীদের থেকে সাড়া পাওয়া যেত না, তখন দলবল নিয়ে অফিস এবং বাড়িতে তল্লাশি চালাতাম। কোথাও সাফল্য পেয়েছি। কোথাও ওপরতলার হুকুমে দোষীকে ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়েছি।

অনুরাগ: হুকুমে! কার হুকুমে?

সোমনাথ: রাজ্যে যে দল যখন ক্ষমতায় ছিল। সবকিছু ভেবেচিন্তে চাকরি ছেড়ে দিলাম।

অনুরাগ: চাকরি ছেড়ে দিলেন? আশ্চর্য! কেন?

সোমনাথ: চাকরির ক্ষেত্রে ঘুষ নেওয়া বাধ্যতামূলক হয়ে দাঁড়িয়েছিল।

অনুরাগ: বাধ্যতামূলক! আপনি নিতে না চাইলে কেউ আপনাকে জোর করবে?

সোমনাথ: নিজেদের সুবিধার জন্য আমার অফিসের কলিগেরা, আমার পরিবারের সব সদস্যরা, সুযোগের সদ্ব্যবহার করার জন্য চাপ সৃষ্টি করতে থাকল। অসহ্য মানসিক যন্ত্রণা নিয়ে চাকরি ছেড়ে দিতে বাধ্য হলাম।

অনুরাগ: তারপর?

সোমনাথ: ভি আর এস নিয়ে বাড়িতে বসে যাওয়ার পর আমি যেন পরিবারের কাছে বোঝা হয়ে গেলাম। বিনা কারণে দৈহিক নির্যাতন সহ্য করতে না পেরে একদিন প্রয়োজনীয় কিছু জিনিসপত্র নিয়ে বাড়ির বাইরে পা রাখলাম। মনে মনে ভাবলাম, এই শহরে আমার মত হাজার হাজার মানুষ পরিবারে থেকে বিভিন্ন কারণে মানসিক যন্ত্রণার শিকার হচ্ছেন! সুতরাং নিজেকে নিয়ে অত না ভেবে, পরিবারের প্রতি মায়া ত্যাগ করে নিজের রাস্তা নিজেকেই খুঁজে নিতে হবে।

অনুরাগ: কত বছর হলো, বাড়ির বাইরে আছেন?

সোমনাথ: হবে, তা প্রায় চার বছর!

অনুরাগ: রোজগারপাতি?

সোমনাথ: বিভিন্ন বস্তির বাচ্চাদের মাত্র ক’টা টাকার বিনিময়ে শিক্ষিত করে তোলার চেষ্টা করি। ওরাই আমাকে মাথা গোঁজার ঠাঁই করে দিয়েছে।

অনুরাগ: এছাড়া?

সোমনাথ: সারাদিন বিভিন্ন অফিসে অফিসে ঘুরে বেড়াই। রেশনের অফিসে , লাইসেন্সের অফিসে, বিদ্যুতের অফিসে, ইনকাম ট্যাক্সের অফিসে, প্রমাণপত্র সংগ্রহ করার অফিসে ঘুরে ঘুরে অজানা মানুষদের ফর্ম ফিল আপ করার পদ্ধতি সম্পর্কে সাহায্য করা। এছাড়া ইন্সিওরেন্সের এজেন্ট হিসেবে যতটুকু কমিশন হাতে আসে আর কি!

অনুরাগ: শুনে তো মনে হচ্ছে আপনার বেশ ভালোই রোজগার!

সোমনাথ: আয়কর অফিসে থাকাকালীন যা স্যালারী পেতাম, তার তুলনায় কিছুই রোজগার হয় না। এই কাজগুলোর মধ্যে কোন ভবিষ্যত নেই। মোটামুটিভাবে নিজের ভরণপোষণের জন্য এইভাবে দিন অতিবাহিত করছি।

অনুরাগ: আপনার শিক্ষাগত যোগ্যতা দেখে মনে হচ্ছে আপনি নিজের ভরণপোষণের জন্য আরো ভালো ভালো রাস্তা খুঁজে নিতে পারতেন। অন্তত আর্থিক অনটন থাকত না।

সোমনাথ: সে চেষ্টাও আমি করেছি। ঐ যে বললাম, কম্প্রোমাইজ বা অ্যাডজাষ্টমেন্ট আমার দ্বারা হবে না।

অনুরাগ: নিজের প্রশংসা করা, নিজের বাহাদুরি নিজে বলা, এগুলো আজকাল আমার কাছে বিরক্তিকর লাগে। আপনি কি মনে করেন, আমার দেশের এতগুলো মানুষ, সবাই বোকা?

সোমনাথ: আপনি আমাকে ভুল বুঝেছেন। আপনার প্রতিটি প্রশ্নের উত্তর দেওয়া মানে এই না…আমি নিজের আত্মপ্রশংসা বা সেল্ফ অ্যাডমায়ারেশনকে জাস্টিফাই করছি। আমরা যে ব্যবস্থার মধ্যে নিজেদের অ্যাডজাস্ট করে নিয়েছি সেখানে নীতিবোধ এবং নীতিবাক্যের কোন স্হান নেই।

অনুরাগ: সময় এখন অন্য কথা বলছে। নীতিবাক্যের নীতিমালা মেনে চলতে গেলে মানুষ না খেতে পেয়ে মরবে।

সোমনাথ: ( মুখে মৃদু হাসি) তাই বুঝি?  মানুষ না খেতে পেয়ে মরবে?

অনুরাগ: আপনার অভিজ্ঞতার কথা শুনে তো তাই মনে হচ্ছে। (প্রসঙ্গ পাল্টে) চা খাবেন, না কফি?

সোমনাথ: খাওয়াবেন বলছেন? তা খেতে পারি। (হাসতে হাসতে) তবে কফি হলে ভালো হয়। বহুদিন কফি খাই নি।

(অনুরাগ মায়ের উদ্দেশে চীৎকার করতে করতে ভিতরের ঘরে যাবার জন্য পা বাড়ায়।)

অনুরাগ: মা! মা! ও মা! একবার এদিকে এস তো!

(গায়ত্রীকে সে দেখতে পায়। ডানদিকের দরজা দিয়ে গায়ত্রী প্রবেশ করে। ভিতরের দরজায় ঝোলানো উইন্ড চাইম আলোড়ন তোলে। মুখে তাঁর মুখোশ। ডানহাতে সাজান ট্রের মধ্যে আছে দু’প্লেট পকোড়া এবং তিন-মগ কফি। বা হাতে মোবাইল। পোষাক গাঢ় সবুজ রঙের সালোয়ার এবং মেরুণ রঙের কামিজ। কামিজের হাতায় কারুকার্য করা। সামনের দিকের চুল সামান্য পেকেছে। বনেদি পরিবারের আভাস পাওয়া যায়। বাইরে থেকে বিদ্যুতের চমকের সাথে মেঘের গুরুগম্ভীর আওয়াজ ভেসে আসে। গায়ত্রীকে দেখে সোমনাথ ভারতী রেক্সিনের ব্যাগে জলের বোতল রেখে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ায়।)

গায়ত্রী: (মুখোশের ভিতর থেকে) চিনতে পারছ সোমনাথ?

অনুরাগ: (আশ্চর্য হয়! গলার স্বর নিচু করে।) একি! তুমি মুখোশ পড়ে? ফ্যানটাসটিক! ( সোমনাথকে) আমার মা! মা…তুমি ওনাকে চেন?

গায়ত্রী: দেখি সোমনাথ আমার গলা শুনে চিনতে পারে কিনা!

(সোমনাথ কিছুটা এগিয়ে আসে। মুখেচোখে কৌতূহল।)

গায়ত্রী: চিনতে পারলে না তো?

( কিছুক্ষণ পর গায়ত্রী মোবাইল এবং পকোড়ার ট্রে-টিকে টেবিলের ওপর রেখে মুখ থেকে মুখোশ সরিয়ে প্লেটে রাখা পকোড়া এবং একটি কফির মগ সোমনাথের সামনে নিয়ে যায়। গায়ত্রীকে দেখে সোমনাথ বিস্ময়ে বিহ্বল।)

সোমনাথ: গায়ত্রী! আমাদের গায়ত্রী। তাই না?

গায়ত্রী: হ্যাঁ! তোমাদের গায়ত্রী। চিনতে পেরেছ তাহলে?

সোমনাথ: দাঁড়াও দাঁড়াও! মাথায় জমে থাকা অতীতের ছবিগুলো এক এক করে সাজাতে দাও।

গায়ত্রী: মগজে জমানো তিরিশ বছর আগের ছবিতে শ্যাওলা ধরে গেছে সোমনাথ। তোমার কফি।

(গায়ত্রী ট্রেতে রাখা পকোড়ার প্লেট বেতের টেবিলে রেখে কফির মগ সোমনাথের হাতে তুলে দেয়।)

সোমনাথ: মগজে আমার শ্যাওলা ধরেনি, ধরেছে আমার শরীরে! আমাকে দেখে বুঝতে পারছ না?

গায়ত্রী: রান্নাঘরে কাজ করতে করতে তোমাদের কথা শুনছিলাম। তোমার গলা শুনে রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে এসে দেখি, তুমি! তোমাকে সারপ্রাইজ দেব বলে মুখোশ পড়েছিলাম।

(অনুরাগের দিকে তাকিয়ে)

সোমনাথ: ঐ যা:, ভুলে গেলাম! কি যেন নাম আপনার?

(সোমনাথ প্লেট থেকে পকোড়া নিয়ে মুখে রাখে।)

অনুরাগ: অনুরাগ কাশ্যপ।

গায়ত্রী: আমার ছেলে। ওকে আমরা আন্নু বলে ডাকি।

সোমনাথ: ঠিক আছে। আমি আপনাকে আন্নুজী বলে ডাকব।

গায়ত্রী: আন্নু বলে ডাকলেই হবে। আন্নুজী আবার কেন? ও তোমার থেকে অনেক ছোট।

সোমনাথ: আন্নুজী ! সরি! অন্নু, আপনার মা এবং আমি এক কলেজেই পড়তাম। আপনার মা ছিলেন হিন্দি লিটরেচারে অনার্স কোর্সে, আমি কমার্স। কলেজ ম্যাগাজিনে লেখালেখি করার সময় আমাদের পরিচয় হয়েছিল। ঠিক বলছি গায়ত্রী?

গায়ত্রী: কথা বলতে বলতে পকোড়া কফি দুটোই ঠান্ডা হয়ে যাবে সোমনাথ।

(সোমনাথের থেকে কিছুটা দূরত্ব রেখে কফির মগ হাতে গায়ত্রী বেতের চেয়ারের ওপর বসে পড়ে। অনুরাগ ল্যাপটপ বন্ধ করে ট্রেতে রাখা কফির মগ নিয়ে কিছুটা এগিয়ে আসে। প্লেট থেকে পকোড়া তুলে খেতে থাকে।)

সোমনাথ: (কফিতে চুমুক দিতে দিতে।) আজ আমার কি যে ভালো লাগছে, ভাষায় প্রকাশ করা যাবে না গায়ত্রী! মনে হচ্ছে…মনে হচ্ছে…আমি যেন আজ অতীতের সোনালী দিনগুলো আবার ফিরে পেয়েছি। জান গায়ত্রী…তোমার লেখা সেই কবিতাটা এখনও আমার মনে আছে। যে কবিতাটা পড়ে শহরের একজন বিখ্যাত কবি আমাদের বলেছিলেন, সোমনাথ… মেয়েটির প্রতি নজর রেখ! সুযোগ পেলে ভালো ভালো কবিদের ঘুম কেড়ে নেবে। ঐ যে…কি যেন কবিতাটা? আরে ঐ যে…!

(সোমনাথ কবিতা মনে করার চেষ্টাকরে। হঠাৎ মনে পড়ে যায়। )

সোমনাথ: হ্যাঁ, এবার মনে পড়েছে!

সোমনাথ: (মুখে কবিতা শোনা যায়। কবিতা বলতে বলতে সোমনাথ মঞ্চের সন্মুখে এগিয়ে আসে। )

ম্যায়,
ম্যায় হুঁ তুম্হারী অপরাজিতা
মেরী বিভিন্নতা হি তুম্হে
দেতী হ্যায় প্রেরণা,
ঔর মুঝে
মুঝে মিলতা হ্যায় আনন্দ
অতঃ য়হ কোন সা চিন্তন
কৌনসি দূঁরিয়া
আজ ভী মুঝে বাঁধে রাখতি হ্যায়
মেরা, আপনি প্রকাশ
আপনা অস্তিত্ব
হাঁ….
আজ ভী
তুম্হারে বিনা
ম্যায় হুঁ অধুরী
হাঁ, আজ ভী
তুম্হারে বিনা ম্যায় হুঁ অন্ধকার।

(গায়ত্রী চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ায়। সেই কবিতার বাকি অংশটুকু বলতে থাকে)

গায়ত্রী: ( মুখে কবিতা শোনা যায়। কফির সাথে পকোড়া খেতে খেতে অনুরাগ এবং সোমনাথ কবিতা শুনতে থাকে।)

তুম্হারে দিয়ে হুয়ে রূপ কে আঁধার পর,
ম্যায় খিলখিলাতি হুঁ, ফুলো কি তরাহ
কভী ভ্রমর কি তরহ গুনগুনাতি ভী হুঁ
ঔর কভী….,
নই দুল্হন কি তরাহ শরমাতি হুঁ
খুদ কো ছুপানে কে লিয়ে
লেকিন কব তক
কব তক ছুপাতি ফিরু ম্যায়
খুদ কো ছুপানে কি লিয়ে
লেকিন কব তক…
কব তক ছুপাতি ফিরু ম্যায়
আপনি বিবশতা কো।
হাঁ….,
ম্যায় হী জনম দেতী হুঁ তুম্হে,
সম্পর্ক সে বাঁধ ভী লেতী হুঁ
ম্যায় তুম্হে
ঔর তুম….,
আপনে অধিকার
আপনে অহংকার কে লিয়ে
মুঝে লে যাতে হো
জ্বলতি হুই এক অ্যায়সি জগহ পর
জাঁহা…
মেরী আঁসু ভী
ধো নাহি পাতে
কাল ঔর আজ কি ইস
অধুরী কাহানী কো
নহী চাহিয়ে তুম্হারী করুণা
সিরফ এক বার
এক বার, দেখ লো আইনে মে
আপনা চেহারা
মেরী তরাহ
তুম ভী হো অধুরে
হাঁ….
তুম ভী
ফির ভী কহতী হুঁ
ম্যায়….
ম্যায় হুঁ তুম্হারী অপরাজিতা।

অনুরাগ: (আশ্চর্য হয়ে) মা, এই কবিতা তুমি লিখেছ? কই, কোনদিন আমাকে বলনি তো! তিরিশ বছর পর একজন বাইরের মানুষ বাড়িতে এসে তোমার কবিতা মুখস্ত বলে গেল, আর আমি সন্তান হয়ে জানতেই পারলাম না, আমার মা কবিতা লেখেন!

গায়ত্রী: বিয়ে হয়ে যাওয়ার পর তোর মা শুধু পুতুলের মত গৃহবধূ হয়ে জীবন কাটিয়েছে আন্নু। বিয়ে হওয়ার পর তোর দাদু ঠাকুমা বাবা কাকা জ্যাঠা পিসিরা কেউ কোনদিন আমার ইচ্ছে, আমার পছন্দকে পাত্তা দেয়নি। প্রশংসা করা তো দূরের কথা, জিজ্ঞেসও করেনি, আমার কি ভালো লাগে! ভুলে যাস কেন, সেই ঘরের ছেলে যে তুই! আমি ছিলাম তোদের পরিবারে বাইরের মানুষ।

অনুরাগ: এতদিন পরে আমাকে এইসব কথা শুনিয়ে কি লাভ মা? দাদু ঠাকুমা বাবা কাকা জ্যাঠা পিসিরা অতীতে তোমার সাথে কি ধরনের আচরণ করেছে, তারজন্য তুমি আমাকে দায়ী করবে কেন? আমি তো তোমাকে কোনদিন অবহেলা করিনি!

গায়ত্রী: অবহেলা করার কথা তো আমি বলিনি। কর্তব্য এবং আন্তরিকতার মধ্যে যে ফারাক থাকে সেটা নিশ্চয়ই তুই ভালো করে বুঝিস!

অনুরাগ: মা! তুমি….!

সোমনাথ: (বাইরের দরজার দিকে তাকিয়ে) আবার সেই গুমোট গরম। বৃষ্টি বোধহয় থেমেছে!

(অনুরাগের মোবাইল বেজে ওঠে। অনুরাগ কথা বলতে থাকে।)

অনুরাগ: ইয়েস! রাইট! রাইট! উইদইন টোয়েন্টি মিনিটস আই উইল বি দেয়ার! 

(গায়ত্রীকে) মা, গাড়ির ওয়ার্কশপ থেকে ফোন এসেছে! গাড়ি নিয়ে যেতে বলল!

গায়ত্রী: ফেরার পথে বাজার করে নিয়ে আসিস তো। নিজে হাতে রান্না করব। (সোমনাথকে) সোমনাথ! কি খাবে বলো? ভেজ? না ননভেজ?

সোমনাথ: আমাকে নিয়ে তুমি আবার ব্যাস্ত হচ্ছো কেন? বেশ তো গল্প করছি।

গায়ত্রী: তাই কখনও হয় সোমনাথ? তিরিশ বছর পর তোমার সাথে দেখা। বুকের ভিতরে পাহাড়ের মত জমে থাকা আমার জীবনের ঘটনাগুলো শুনবে না?

অনুরাগ: বুকের ভিতরে পাহাড়ের মত জমে থাকা আমার জীবনের ঘটনাগুলো শুনবে না ? তোমার এই কথাগুলো শুনতে হেব্বি লাগল কিন্তু মা! (সোমনাথকে) ঠিক আছে আঙ্কেল! আপনি মায়ের সাথে গল্প করুন। আমি আমার পছন্দমত সবকিছু নিয়ে আসছি। ও কে!

(অনুরাগ বাইরে বেরিয়ে যাবার আগেই একজন ধোপদুরস্ত ব্যাক্তির প্রবেশ। সাদা ট্রাউজার এবং সাদা ফুলহাতা শার্ট। শার্টের ওপর কালো কোট এবং গলায় বো লাগানো। নাম হিমাংশু ভরদ্বাজ। বয়স ষাটোর্ধ। )

হিমাংশু: নমস্কার বহেনজী! দরজা খোলা ছিল! ভাবলাম, সোজা ঢুকে যাই। আমি এসে আপনাদের বিরক্ত করলাম না তো?

অনুরাগ: (হিমাংশুকে) আপনি বসুন! আমি একটু বাইরে থেকে ঘুরে আসছি।

হিমাংশু: (অনুরাগকে) দেরী করবেন না! আপনাদের সঙ্গে কিছু জরুরি কথা আছে।

অনুরাগ: ঠিক আছে। আপনি যা বলার মায়ের সাথে আলোচনা করুন। আমি এক্ষুনি চলে আসব। এই ধরুন আধ ঘন্টা।

(অনুরাগ বাইরে বেরিয়ে যায়। )

গায়ত্রী: আসুন হিমাংশুজী। বসুন। কেমন আছেন?

হিমাংশু: খুব ভালো! খুব!

(হিমাংশু বেতের টেবিলের একদিকে চেয়ারে বসে পড়ে। )

গায়ত্রী: চা খাবেন, না কফি।

হিমাংশু: না, খাব না। কোর্টে যতক্ষণ থাকি, গুনে শেষ করতে পারব না, কত কাপ চা কফি খেয়েছি। তারপর বাড়ি ফিরে রাতের খাবার খেতে ইচ্ছে করে না। আজ কোন কাজ ছিল না। ভাবলাম আপনার সাথে দেখা করে যাই।

গায়ত্রী: (হিমাংশুকে) আসুন পরিচয় করিয়ে দি। আজ থেকে তিরিশ বছর আগে যে কলেছে আমি পড়তাম, সেই কলেজে উনিও পড়তেন। নাম সোমনাথ ভারতী। তিরিশ বছর পর কাকতালীয়ভাবে আজ হঠাৎ দেখা। বৃষ্টি থেকে বাঁচার জন্য উনি এসে আমাদের বারান্দায় আশ্রয় নিয়েছিলেন। আমার ছেলে দেখতে পেয়ে ওনাকে ভিতরে বসতে বলে। ওনাকে দেখে

আজকে আমার কি যে আনন্দ হচ্ছে আপনাকে বলে বোঝাতে পারব না হিমাংশুজী।

হিমাংশু: নমস্কার সোমনাথজী! আমার নাম হিমাংশু ভরদ্বাজ। অ্যাডভোকেট হিমাংশু ভরদ্বাজ। এবার কাজের কথায় আসা যাক ম্যাডাম? আমার আবার একটু তাড়া আছে।

গায়ত্রী: বলুন?

হিমাংশু: (সোমনাথের দিকে তাকিয়ে) ওনার সামনে কি কিছু প্রশ্ন করা যাবে?

গায়ত্রী: নিঃসন্দেহে!

হিমাংশু: আপনি এই বাড়ি সম্পর্কে কি সিদ্ধান্ত নিলেন?

গায়ত্রী: দেখুন, সবকিছু চিন্তা করে আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি, এই বাড়ি আমি বিক্রি করব না।

হিমাংশু: স্ট্রেন্জ! একথা এতদিন বলেননি কেন? খামকা আমার সময় নষ্ট করলেন।

গায়ত্রী: আমি কি আপনাকে পারিশ্রমিক দেব না বলেছি? আপনাকে বলা হয়েছিল শুধু জমির কাগজপত্রগুলোকে দেখে নেওয়ার জন্য। প্রমোটারদের মত পারসেন্টেজ নিয়ে তো কোন কথা হয়নি।

হিমাংশু: অবশ্য আপনি বিক্রি করতে না চাইলে আমি বলার কে? তবে এই বাড়ি যে কিনবে, সে কিন্তু আপনাকে ভালো টাকাই দিতে চাইছে। স্কোয়ার ফিট অনুযায়ী বাজারে যা রেট চলছে, তার থেকে টোয়েন্টি পার্সেন্ট বেশি। তাছাড়া আপনার ছেলের যা যোগ্যতা, আর কয়েক বছর পর সে গ্রীণকার্ড হোল্ডার হয়ে আমেরিকায় বসবাস করবে। দু-তিন বছর পর সে এসে আপনাকেও নিয়ে যাবে। তখন এই টাকাগুলোকে ডলারে কনভার্ট করে বহাল তবিয়তে সারা বিশ্ব ঘুরে বেড়াতে পারবেন।

গায়ত্রী: ভাবছি বৃদ্ধাশ্রম বানাব।

হিমাংশু: বৃদ্ধাশ্রম? আর ইউ জোকিং?

গায়ত্রী: নো, আই অ্যাম নট জোকিং হিমাংশুজী। তাছাড়া আমি আমেরিকায় চলে যাব আপনাকে কে বলেছে?

হিমাংশু: আপনার ছেলে তো তাই বলল!

গায়ত্রী: সিদ্ধান্ত আমি নেব, না ও? আমি আপনি এবং আরো কয়েকজন মিলে যদি একটি বেসরকারি সংস্থা বা এন জি ও গড়ে তুলতে পারি, সেই চেষ্টা করুন না? টাকাপয়সার অভাব হবে না।

হিমাংশু: কিন্তু এই ব্যাপারে আপনি আপনার ছেলের সাথে আলোচনা করেছেন?

গায়ত্রী: আগামী দু-তিন মাসের মধ্যে ছেলে মোটা টাকার প্যাকেজ পেয়ে বিদেশে চলে যাবে। নিজের স্বার্থে আমি ওকে আটকে রাখতে চাই না। আমি যাব কিনা সেটা আমার সিদ্ধান্ত। এতদিন ইউনিভার্সিটিতে পড়িয়ে যে কটা টাকা জমেছে তাতে আমি বাকি জীবনটুকু কাটিয়ে দিতে পারব। তাছাড়া পেনশন তো আছেই।

হিমাংশু: আপনার সিদ্ধান্তকে আমি সম্মান জানাই ম্যাডাম গায়ত্রী কাশ্যপ। যদি কিছু  মনে না করেন একটা কথা বলব?

গায়ত্রী: কি বলবেন বলুন?

হিমাংশু: (মুখে দুঃখের ছাপ ফুটে ওঠে।) আপনার এই ড্রিম প্রজেক্ট তৈরি হলে আমাকে থাকতে দেবেন তো?

গায়ত্রী: নিজের পরিবার ছেড়ে আপনি বৃদ্ধাশ্রমে থাকবেন?

হিমাংশু: আপনার ঘরে ঢোকার পর আপনি জিজ্ঞেস করলেন না, আমি কেমন আছি? আমি বললাম খুব ভালো! খুব! তাই না? আসলে এই শহরের আরো দশজনের মত মানুষ যেমন পথ চলতে চলতে দেখাসাক্ষাৎ হলে পর পরস্পরকে মিথ্যা কথা বলে, ভালো আছি! আমিও আপনাকে মিথ্যা কথাই বলেছি ম্যাডাম।

আমি খুব একটা ভালো নেই। ভালো নেই! আচ্ছা আপনি অনুমতি দিলে যাই তাহলে? আবার দেখা হবে।

(হিমাংশু পকেট থেকে রুমাল বের করে চোখ মুছতে মুছতে বাইরে বেরিয়ে যায়। গায়ত্রী এবং সোমনাথ এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে।)

গায়ত্রী: আমি কখনও ওনার চোখে জল দেখিনি সোমনাথ! তাহলে কি উনি….!

সোমনাথ: মানুষ কোন পরিস্থিতির মধ্যে আছে কে জানে!

গায়ত্রী: এবার বলো, তুমি কেমন আছ সোমনাথ?

সোমনাথ: এতদিন ভালো ছিলাম না, এখন ভালো আছি। দেখে বুঝতে পারছ না?

গায়ত্রী: তিরিশ বছর আগের সেই সোমনাথের সাথে আজকের সোমনাথের কোন মিল নেই যে! শরীরের কি হাল করেছ তুমি? এই শহরে তোমার মত আরো

বয়স্ক মানুষজন আছেন সোমনাথ, কই তাদের তো এইভাবে ভবঘুরেদের মত ঘুরে বেড়াতে দেখা যায় না। আমার ছেলেকে তুমি যা যা বলেছিলে, তা কি সত্যি সোমনাথ?

সোমনাথ: আমার সম্পর্কে তোমার অতীতের অভিজ্ঞতা কি বলে গায়ত্রী?

গায়ত্রী: তিরিশ বছর আগের কথা কি আর মনে থাকে?

সোমনাথ: সরাসরি প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে এড়িয়ে যেতে চাইছ গায়ত্রী?

(গায়ত্রী অন্যদিকে তাকিয়ে চুপ করে থাকে। সোমনাথ আবার জিজ্ঞেস করে।)

সোমনাথ: কি হলো গায়ত্রী? তুমি কি কথা বলবে না?

(সোমনাথ বেতের চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ায়। গায়ত্রীর সামনে এগিয়ে আসে।)

সোমনাথ: গায়ত্রী! কিছুক্ষণ আগে তুমি বলেছিলে, বুকের ভিতরে পাহাড়ের মত

জমে থাকা তোমার জীবনের ঘটনাগুলো তুমি আমাকে বলবে। কি সেই ঘটনা গায়ত্রী?

গায়ত্রী: জান সোমনাথ, বিয়ে হওয়ার পর থেকে আমি কোনদিনই সুখের মুখ দেখতে পাইনি। শ্বশুরবাড়িতে দৈহিক নির্যাতনের শিকার হয়েছিলাম। দিনের পর দিন সেই নির্যাতন সহ্য করতে না পেরে একদিন পাঁচ বছরের শিশুকে নিয়ে আমি শ্বশুরবাড়ি ছেড়ে বাপের বাড়ি চলে আসি। কোর্টে বিভিন্ন ধরনের অ্যালিগেশন এনে অন্নুর বাবা আমার বিরুদ্ধে ডিভোর্স ফাইল করেন। আমি দৈহিক নির্যাতনের প্রমাণ দেখিয়ে কোর্ট থেকে সেপারেশন চাই। মহামান্য বিচারপতি শেষ পর্যন্ত আমার পক্ষে রায় দিলেন। আমি ডিভোর্সের পক্ষে সম্মতি দিলাম। আবার শুরু হয় মানসিক অত্যাচার। ছেলেকে নিজের কাছে রাখার জন্য আবার কোর্টে সে পিটিশন দাখিল করে। এবারও সে জিততে পারে না। কিছুদিন পরে জানতে পারলাম, একজন মহিলার সাথে ওর সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। সেখানেই ওর যাতায়াত।

সোমনাথ: তারপর?

গায়ত্রী: ভালোই আছে সে! রেজিস্ট্রি করে বিয়ে করেছে। তাঁদের ঘরে একটি সন্তানও আছে। মহামান্য বিচারপতি আমাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, আপনার সন্তান এখন ছোট। সুতরাং সন্তান বড় না হওয়া পর্যন্ত আপনি খোরপোষ দাবি করতে পারেন। সেই সময় নিজেকে কি মনে হয়েছিল জান? যে মানুষ আমার অস্তিত্বকে অস্বীকার করেছে, যে মানুষের থেকে কোনদিন ভালবাসা পেলাম না, যে গুণের কদর করতে জানে না, যাঁর আচরণের মধ্যে আন্তরিকতা নেই, তাঁর দেওয়া খোরপোষ গ্রহন করে আমি পরজীবী হয়ে বেঁচে থাকব? বাবা মা আমাকে লিখিয়ে পড়িয়ে মানুষ করেছে কিসের জন্য সোমনাথ? ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে নিজের বাবার তৈরি এই বিশাল বাড়িতে থেকে সমস্ত দুঃখকষ্ট ভুলে সেই ছেলেকে আমি বড় করেছি। শিক্ষিত করে তুলেছি। সেই ছেলে এখন ভালো কম্পানিতে কাজ করছে। তাঁরাই ওকে অফার দিয়েছে আমেরিকায় চলে আসার জন্য।

সোমনাথ: ভালো তো! এখানে একা না থেকে ছেলের সাথে আমেরিকা চলে যাও।

গায়ত্রী: না সোমনাথ! আমি আমার ছেলের সাথে আমেরিকা যেতে চাই না!

সোমনাথ: কেন?

গায়ত্রী: ভয় সোমনাথ!

সোমনাথ: কিসের ভয়?

গায়ত্রী: ও আমি তোমাকে বোঝাতে পারব না! তুমি কি আমার ছেলের বডি ল্যাঙ্গুয়েজ দেখে, কথা বলে, কিছুই বুঝতে পারলে না?

সোমনাথ: এইটুকু সময়ের মধ্যে একজন আরেকজনকে চেনা যায় না গায়ত্রী!

গায়ত্রী: আমিও রক্ত মাংসের গড়া মানুষ সোমনাথ! কারো ছত্রছায়ায় না থেকে আমি এখন নিজের মত করে একা বাঁচতে চাই।

সোমনাথ: একা একা বাঁচা যায় না গায়ত্রী! অন্নু তোমার সন্তান!

গায়ত্রী: না না না! নিজের মনে করে আমি আর কাউকে বাঁধতে চাই না সোমনাথ!

সোমনাথ: ঠিক আছে! অন্নু না হয় আমেরিকা চলে গেল! তারপর?

গায়ত্রী: এই বাড়িটাকে রিনোভেট করে বৃদ্ধাশ্রম খুলব। তুমি আমার পাশে এসে দাঁড়াবে না?

(সোমনাথ চুপ করে থাকে। বাইরে মেঘের গুরুগম্ভীর আওয়াজ শোনা যায়।)

গায়ত্রী: কি হলো সোমনাথ? কিছু বলবে না? তুমি আমার পাশে এসে দাঁড়ালে এই কাজে আমি কতটা মানসিক জোর পাবো তা তুমি জান? কি হলো! চুপ করে রইলে যে!

(সোমনাথ দেওয়ালে ঝোলানো চার/ পাঁচ ফিটের ঝোলানো লম্বা ড্যাংলারের ওপর মনীষীদের ছবিগুলো দেখতে দেখতে কথা বলতে থাকে।)

সোমনাথ: জান গায়ত্রী, আমি যেদিন পরিবার ছেড়ে, আত্মীয়স্বজন ছেড়ে, বন্ধুবান্ধব ছেড়ে মুক্ত আকাশের নিচে এসে দাঁড়ালাম, নিজেকে তখন কি মনে হয়েছিল জান? এই বিশাল পৃথিবীতে আমি কে? সত্যিই কি আমার এই পৃথিবীতে জন্ম নেওয়া উচিত ছিল? যাকে শুধু আরো দশজনের মত কতগুলো নিয়ম মেনে চলতে হবে?

গায়ত্রী: তুমি কিন্তু আমায় প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে এড়িয়ে যেতে চাইছ, সোমনাথ!

সোমনাথ: তোমার কথা শুনে আজ তিরিশ বছর আগের স্মৃতি চোখের সামনে ভেসে উঠছে গায়ত্রী। কে জানত তিরিশ বছর পর আমাদের আবার দেখা হবে! মনে পড়ে গায়ত্রী, সেদিনের কথা? তোমাকে অপেক্ষা করতে বলেছিলাম, তুমি শুনলে না! তোমাকে ঘরে তোলার আগে নিজের পায়ে দাঁড়াব বলে তোমার কাছে কিছুদিনের জন্য সময় চেয়েছিলাম। আমি তখন পি এইচ ডি করছি। সেদিন প্রতিশ্রুতি ভেঙে তুমি নিজের বাবা মায়ের কথায় অন্য আরেকজনকে বেছে নিলে! কারণ সেই পরিবারটি আর্থিক দিক থেকে স্বচ্ছল ছিল! আমার দিকে একবার ভালো করে চেয়ে দেখ, আমি কিন্তু আজকেও বেঁচে আছি। অনাদৃত হয়ে!

(কিছুক্ষণ থেমে।)

সোমনাথ: তুমি নিজের সন্তানের কথা বলছ গায়ত্রী? গায়ত্রী, আমরা হলাম প্রাচীনপন্থী! আমাদের সন্তানেরা ঐসব আদর্শের কথা শুনবেই বা কেন? সমাজের বুকে এখন গণতন্ত্র হত্যা করে ভোগতন্ত্র কায়েম করার চেষ্টা চলছে। ভোগতন্ত্র যেভাবে আষ্টেপৃষ্টে বেঁধে ফেলেছে, কেউ নিস্তার পাবে না। যদি না সে ঐ প্রলোভনের জালে ধরা না দেয়। তাকিয়ে দেখছ না ক্ষুদ্র স্বার্থে সম্পর্কগুলো কিভাবে ভেঙে যাচ্ছে। মিথ্যার জয়জয়কার! জীবনে প্রচুর অভিজ্ঞতা হয়েছে গায়ত্রী। আমি এখন নিজের মত করে বাঁচতে চাই। যে যাইই ভাবুক, স্বার্থপর সমাজের তৈরি করা মিথ্যা সম্পর্কগুলোর প্রতি আমার আর কোন মোহ নেই গায়ত্রী।

(বাইরে গাড়ির আওয়াজ। অনুরাগ ফিরে এসেছে। দুজনের কথপোকথনের মাঝখানে হঠাৎ লোডশেডিং হয়। বাইরে থেকে অনুরাগ মা মা বলে চীৎকার করতে থাকে। গায়ত্রী নিজের মোবাইল খুঁজতে থাকে।)

গায়ত্রী: একটু দাঁড়া! আমি মোবাইলের টর্চ জ্বালাচ্ছি। তারপর ঘরে ঢুকিস।

(গায়ত্রী টেবিল হাতড়ে মোবাইল খুঁজে পায়। মোবাইল জ্বালিয়ে সে বাইরে দরজার দিকে নিক্ষেপ করে। অন্যদিকে অনুরাগ নিজের মোবাইল জ্বেলে ঘরে প্রবেশ করে। হাতে বাজারের ব্যাগ। দুজনের মোবাইলের আলো জ্বলে ওঠার আগেই অন্ধকারে সোমনাথ বাড়ির বাইরে পা রেখেছে। গায়ত্রী ঘরের চতুর্দিকে মোবাইলের আলো ফেলতে থাকে এবং সোমনাথের নাম ধরে ডাকতে থাকে।)

গায়ত্রী: সোমনাথ! সোমনাথ! কোথায় গেল সে?

(আবার ঘরের আলো জ্বলে ওঠে।)

অনুরাগ: একি! উনি চলে গেলেন নাকি? আশ্চর্য! তুমি অপেক্ষা করো, আমি বাইরে দেখে আসছি।

(অনুরাগ বাইরে যাওয়ার জন্য দরজার দিকে পা বাড়ায়।)

গায়ত্রী: ওকে তুই খুঁজে পাবি না, অন্নু! ও কখনোই ফিরে আসবে না। আমি যে ওকে চিনি! কেউ ওকে বেঁধে রাখতে পারবে না অনুরাগ! কেউ না!

(অনুরাগ ফিরে আসে। গায়ত্রীর চোখে জল।)

অনুরাগ: মা, তুমি কাঁদছ?

গায়ত্রী: (চোখ মুছতে মুছতে) কই না তো! তুই বেশি দেখিস, তাই না? বোকা ছেলে!

(বাইরে বিদ্যুতের চমকের সাথে প্রচন্ড বৃষ্টির শব্দ শোনা যায়। ধীরে ধীরে মঞ্চ অন্ধকারে ডুবে যায়।)

 

~ : সমাপ্ত : ~

Author

Du-কলম

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!