গোপা মিত্র
বছর ঘুরে আবারও এসে গেল দুর্গা পুজো। মা দুর্গা, মা আনন্দময়ী আসছেন এই ধরাধামে আমাদের সারা বছরের ক্লান্তি দুঃখ কষ্ট অভাব অভিযোগ দূর করে আমাদের মুখে হাসি ফোটাতে। আকাশে বাতাসে শোনা যাচ্ছে তার পদধ্বনি। শিউলি ফুলের গন্ধ, কাশ ফুলের চামর ব্যজন, এক ঝলক মৃদু মন্দ বাতাসের বয়ে আনা আমোদিত সুবাস, আকাশে সাদা মেঘের আনাগোনা আর সকালের উজ্জ্বল আলোর ঝরণাধারা, সকলে একসঙ্গে মিলিত হয়ে যেন গেয়ে চলেছে তারই আগমণী – তোমরা কি সবাই প্রস্তুত? পুজো যে এসে গেলো!
পুজো আমার কাছে এক আবেগ, আনন্দ, উচ্ছ্বাস। সারা বছরের জমিয়ে রাখা ইচ্ছেগুলো এই সময়েই তো পূর্ণতা পায়। কর্মব্যস্ত একঘেঁয়ে জীবনের মাঝে পাওয়া কদিনের ছুটিতে অনেকেই মুক্তির স্বাদ নিতে বেড়িয়ে পড়ে কোনো অজানার সন্ধানে, পুরোনো সম্পর্কগুলো ঝালিয়ে নিয়ে কেউ আবার মজে যায় আড্ডায়, মুখের স্বাদ বদলাতে কেউ পৌঁছে যায় রেঁস্তোরায় বা বাড়ীতেই ট্রাই করে কোনো নতুন রেসিপি, নিজেকে সুন্দর করে সাজাতে রূপচর্চার পরে অনেকেই সেজে ওঠে নতুন ধরণের পোষাকে, অনেকদিন সিনেমা থিয়েটার না যেতে পেরে সুযোগ পেয়ে অনেকেই লাইন দেয় কোনো হলের বাইরে বা কেউ আবার বাড়ীতেই নির্ভেজাল আলস্যে দিন কাটিয়ে দেয়।
আমার ইচ্ছে অবশ্য এদের কারো সঙ্গেই মেলে না। নতুন জামা কাপড় তো অবশ্যই পরবো, তবে তারপরে হারিয়ে যাব আনন্দে উদ্বেলিত জনারণ্যের ভীড়ে। এ যেন এক মিলনমেলা – উচ্চনিচ, ধনীদরিদ্র, জাতিধর্ম, বাচ্চাবৃদ্ধ নির্বিশেষে এই যে আনন্দমেলা এতে সামিল হয়ে আমার আনন্দও যেন বহুগুণ বৃদ্ধি পায়।
ষাটের দশকে, মেট্রো, টিভি, ইন্টারনেট বিহীন যুগে, আমি যখন স্কুল ছাত্রী, তখনও পুজোর উন্মাদনা ছিল, ঠাকুর দেখাও ছিল। তবে পাড়ার পুজো ছাড়া কলকাতার উত্তরের লোকেদের গতিবিধি সচরাচর উত্তরের নামীদামী ঠাকুর দেখার মধ্যেই যেমন সীমাবদ্ধ থাকত, দক্ষিণের লোকেরাও তেমনই দক্ষিণের ঠাকুর দেখেই সন্তুষ্ট থাকত। ব্যতিক্রম অবশ্য ছিল, যাদের নিজস্ব গাড়ী ছিল তাদের ক্ষেত্রে।
আমার পুজো অবশ্য ব্যতিক্রমী ছিল। পুজোর দিনগুলো আমার কলেজ প্রিন্সিপাল বাবা বাড়ীর বাইরে বেরোতই না, পড়াশোনা নিয়ে ব্যস্ত থাকত। কাকু আর তাইমা (কাকিমা) অবশ্য ট্যাক্সি ভাড়া করে নবমীর দিন সকালে মামার বাড়ী থেকে, কারণ তখন আমরা মামার বাড়ীতেই রয়েছি, আমাদের তুলে নিয়ে যেত যতদূর সম্ভব আমাদের ঠাকুর দেখাতে। বাগবাজার থেকে কলেজ স্কোয়ার, উত্তরের সব বিখ্যাত ঠাকুরই আমরা প্রায় দেখে নিতাম। বাগবাজারের বিশাল সাবেকী একচালার ঠাকুর, আর কলেজ স্কোয়ারের রমেশ পালের গড়া ঠাকুর সবচেয়ে ভালো লাগত। তখন এটাই রেওয়াজ ছিল বাড়ীর বড়রা ছোটদের ঠাকুর দেখাতে নিয়ে যাবে – বন্ধুদের সঙ্গে তো নয়ই এমনকি একসঙ্গে ভাইবোনেরা মিলেও কোথাও যাওয়া চলত না। একটু বড় হলে, ক্লাস নাইন-টেনে, বন্ধুদের সঙ্গে যাওয়ার পারমিশান মিললেও, কোন্ কোন্ ঠাকুর দেখতে যাচ্ছি, এসব জানিয়ে যেতে হত। শর্ত থাকত, সাড়ে আটটা ন’টার মধ্যে বাড়িতে ফিরতেই হবে।
পুজোর কদিন আমরা তিন বোন মায়ের সঙ্গে মামার বাড়ী, কৈলাস বোস ষ্ট্রীটে থাকতাম। মামার বাড়ীর ঠিক সামনেই দুর্গা পুজোর মন্ডপ – দোতলার জানলা থেকে আমাদের দৃষ্টি সবসময়েই থাকত সেদিকে নিবদ্ধ। তাছাড়া সেখানে আমাদের মামাতো ভাই বোনেরাও তো রয়েছে, কাজেই এমন আড্ডার সুযোগ কেই বা ছাড়ে?
ভোরবেলা সবাই তৈরী হয়ে, পাড়ার দোকান থেকে আনা ছোট্ট ছোট্ট কচুরি, সঙ্গে হালুয়া খেয়ে নতুন জামা জুতোয় সজ্জিত হয়ে মেজমামা বা সেজমামার সঙ্গে আমরা সব ভাইবোন মিলে বার হতাম ঠাকুর দেখতে, অবশ্যই হেঁটে হেঁটে যতদূর যাওয়া যায় ততদূর পর্যন্ত। আমাদের প্রত্যেকের হাতেই থাকত একটা করে গ্যাস বেলুন বাঁধা, যাতে আমরা দলছুট হয়ে না যাই। ঐ বেলুনই ভীড়ে আমাদের চিনিয়ে দিত। একদিন যেতাম সিমলা ব্যায়াম সমিতি, বিবেকানন্দ স্পোর্টিং ক্লাব, বিডন ষ্ট্রীট, দমকলের ঠাকুর দেখতে। আবার অন্যদিন যেতাম আমর্হাষ্ট ষ্ট্রীটের দিকে ঠাকুর দেখতে। সেসময় মহম্মদ আলী পার্কের কাছে দমকলের এক অফিস ছিল। পুজোর সময় সেখান থেকে দমকলের গাড়ীগুলো সব সরিয়ে দেওয়া হত। আর সেই জায়গাতেই পুজো হত। সে সময়ের সবচেয়ে বিখ্যাত শিল্পী রমেশ পাল প্রতিবছর তাদের প্রতিমা গড়তো, গর্জন তেল মাখানো সেই দুর্গা প্রতিমা কি যে সুন্দর দেখতে লাগত! তবে তার দশ হাতের এক হাতে একটা ঘন্টা অবশ্যই থাকত।
সন্ধ্যেবেলা কোথাও বেরোতাম না। জানলায় বসে বসে সুসজ্জিত জনতার ভীড় দেখতাম, আর লাউডস্পীকারে ভেসে আসা হেমন্ত, মানবেন্দ্র, শ্যামল, ধনঞ্জয়, মান্না দে, সন্ধ্যা, লতার স্বর্ণকন্ঠের অসাধারণ গানগুলো শুনতাম না বলে, গিলতাম বলাই ভালো। শ্রীমানি মার্কেটের কাছেই ছিল সেজদিদার (ঠাকুমার দিদি) বিশাল বনেদী বাড়ী। দাদি (ঠাকুমা) পুজোর ক’টা দিন সেখানেই থাকত। সেজদিদার বাড়ীর পুজোয় আমাদের সবার নিমন্ত্রণ থাকতো। মার সঙ্গে একদিন সন্ধ্যেবেলায় আমরা সেখানে যেতাম। ঠাকুর দালানে পুজোর আয়োজন, ছাদে ম্যারাপ বেঁধে খাওয়াদাওয়ার এলাহী ব্যবস্থা। আত্মীয়স্বজন, পাড়া প্রতিবেশী সকলের সঙ্গে বসে সেই আনন্দভোজে অংশ নিতে কি যে ভালো লাগত! দেখতে দেখতে বিজয়া দশমী এসে যেত, প্রতিমা বিসর্জনের পর শুরু হতো আমাদের প্রণাম আর কোলাকুলি পর্ব। মাসীরাও, মাসতুতো ভাই বোনেদের নিয়ে এসে যেত। সেদিন রাতে আর কিছু খাওয়ার দরকারই হত না- সকলের কাছ থেকে পাওয়া মিষ্টি খেয়েই আমাদের পেট ভরে যেত। পরদিন বাড়ী ফিরে, বড়দের প্রণাম সেরে নিতাম। বাড়িতে তাইমা তখন সবার জন্য বানিয়ে রেখেছে গজা, মালপোয়া, চন্দ্রপুলি, নিমকি, ঘুগনী। এসব না খেয়ে জমা করে রাখতাম, পরে খাব বলে। তারপর যেতাম তিন পিসীমার বাড়ী বিজয়া সারতে। সেখানেও চলত মিষ্টিমুখ।
সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পরিবর্তন হতে লাগল দুনিয়ার। সত্তরের দশকে এসে গেল টিভি। তার হাত ধরে আস্তে আস্তে চলে এল কম্পিউটার, ইন্টারনেট। হতের মুঠোয় চলে এল সমগ্র কলকাতা। ঘরে বসেই জানা হয়ে যাচ্ছে কোন্ ঠাকুর ভালো, বা কোন্টা আহামরি কিছু নয়। থিম পুজো চালু হয়ে গেছে, প্রতিমার রূপকল্পও বদলে যেতে বসেছে। বিভিন্ন কোম্পানী নিজেদের ব্যবসায়িক স্বার্থে শুরু করেছে নানারকম প্রতিযোগিতা- সেরা পুজো, সেরা প্রতিমা, সেরা আলোকসজ্জা, সেরা মন্ডপ। এতেও না থেমে, চলছে সেরার সেরা পুজো। আগে যেখানে প্রতিমার আবরণ উন্মোচিত হত ষষ্টীর দিন, এখন সেখানে মহালয়ার দিন থেকেই প্রতিমা দর্শন শুরু হয়ে যাচ্ছে। ইতিমধ্যে চালু হয়ে গেছে মেট্রো রেল। কাজে কাজেই যাতায়াতের অসুবিধাও আর নেই। টিভি নেট ঘেঁটে প্রস্তুতি নিয়ে উত্তরের লোক চলল দক্ষিণ পর্যন্ত, দক্ষিণের লোক উজিয়ে এলো উত্তর প্রান্ত পর্যন্ত ঠাকুর দেখতে। আমারও কয়েক বছর সু্যোগ হয়েছিল ওদিকে টালা থেকে টালীগঞ্জ বেহালা চেতলা এদিকে দমদম পর্যন্ত ঠাকুর দেখার। থিমের পুজোর মন্ডপগুলো সত্যি অপূর্ব – কোথাও দিলওয়াড়া টেম্পল তো কোথাও বুর্জ এ খলিফা, কোথাও আবার এমন এক প্রাচীন ফাটল ধরা মন্দির যার চূড়ো থেকে গাছ গজিয়েছে তো কোথাও উঠে এসেছে এক আস্ত গ্রাম। সঙ্গের আলোক সজ্জা আর অন্দর সজ্জাও দারুণ – কোথাও রাজস্থানী পুতুল, কোথাও ডোকরার কাজ, কোথাও বাঁশের কাজ, আবার কোথাও বা হাতপাখা দিয়ে সেজে উঠেছে মন্ডপের অন্দর। মন্ডপ দেখতে দেখতে অনেক আশা নিয়ে ভীড় ঠেলে দেবী দুর্গার সামনে যখন এসে পৌঁছলাম তখন দেবীকে খুঁজে নিতে একটু সময় লাগল, রণরঙ্গিনী মা দুর্গা উপর থেকে লাফিয়ে নামছেন আর তার ছেলেমেয়েরা এদিক সেদিক ছন্নছাড়ার মত দাঁড়িয়ে ভাবছে এখন তাদের কি করা উচিত, কোথাও আবার আলো অন্ধকারের মধ্যে থেকে মাকে খুঁজতে এত সময় লাগল যে, ছেলেমেয়েদের খুঁজে পাওয়ার আগেই পিছনের ভীড়ের গুঁতো আমাকে এগিয়ে দিল, আবার কোথাও এত বিশাল দুর্গা মূর্তি যে মাথা তুলে দেখতে হল। এত উঁচু মায়ের মূর্তির পুজো হবে কিভাবে, এমন যখন ভাবছি, তখনই দেখলাম বিশাল মায়ের পায়ের কাছে ছোট একচালার এক মূর্তি, সেখানেই ঘট বসিয়ে পুজো হচ্ছে। তবে অনেক জায়গাতেই দেখলাম মন্ডপ যাই হোক্ না কেন, প্রতিমা আছে সেই একই রকম – মাঝে মা দুর্গা চারপাশ ঘিরে ছেলেমেয়ে। মা’কে সেখানে মা বলেই মনে হচ্ছে। এই কারণেই বাগবাজারের একচালার বিশাল সাবেকী দুর্গা প্রতিমা প্রতি বছর আমি একবার দেখতে যাবই।
ফ্ল্যাট কালচারের সঙ্গে সঙ্গে আবাসনের পুজোর গুরুত্বও অনেক বেড়ে গেছে। উত্তর কলকাতার যে আবাসনে আমি থাকি সেখানেও পুজো হয়ে আসছে অনেক বছর ধরে। হাঁটাপথে আশপাশের কিছু প্রতিমা দেখতে গেলেও আমার আর এখন অন্য কোথাও যেতে ভালো লাগে না। আবাসনের পার্কে বিশাল মন্ডপের এক পাশে বাঁধানো বেদীতে সুসজ্জিতা মায়ের পাশে ছেলেমেয়েরাও বিরাজমান, অন্যপাশে মঞ্চ প্রস্তুত সন্ধ্যেবেলার সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের জন্য, বেদী আর মঞ্চের মাঝের জায়গা চেয়ার টেবিল দিয়ে সাজানো দ্বিপ্রাহরিক আহারের জন্য। বেদীর উপরে পুজোর আয়োজন আর নিচে চেয়ার পেতে আবাসিকদের বসার ব্যবস্থা না বলে আড্ডা দেওয়ার ব্যবস্থাও বলা যায়। পার্কের দু’পাশেও মাথা ঢাকা বাঁধানো বসার জায়গা, যে যেখানে খুশী বসতেই পারে, আবার ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা দোলনায় দুলতে বা ছুটোছুটিও করতে পারে। মন্ডপের পিছনে ঠাকুরদের রান্নার ব্যবস্থা।
ভোগ রান্না এবং বিতরণে ভিলার নারীবাহিনী অগ্রণী ভূমিকা নেয়। অঞ্জলির পরে, ভোগ বিতরণ শেষ হলেই দুপুরের ভোজন শুরু হয় – এর দায়িত্ব অবশ্য ভিলার ছেলে মেয়েদের। দায়িত্ব প্রসঙ্গে একটা কথা অবশ্য এখানে বলাই যায়। বেশ ক’বছর আগে আমরা, ভিলার মহিলারা একবার পুজোর দায়িত্ব নিয়ে, সে কুমোরটুলি গিয়ে প্রতিমা বায়না দেওয়া থেকে আরম্ভ করে বাগবাজার ঘাটে প্রতিমা নিরঞ্জন দেওয়া পর্যন্ত, সব দায়িত্বই সুষ্ঠু ভাবে সম্পন্ন করেছিলাম – শেষমেষ কিছু সাশ্রয়ও করতে পেরেছিলাম যেটা পরে পুজোতেই কাজে লেগেছিল।
যাক্ ফিরে আসি খাওয়ার প্রসঙ্গে – পুজোর প্রথম দুদিন নিরামিষ হলেও শেষদিন আমিষ খাওয়া দাওয়া। টুকরো টাকরা আলাপের মধ্যে দিয়ে আমাদের খাওয়া শেষ হয়। শুরু হয় আমাদের দুপুরের মজলিস্ – কোল্ড ড্রিঙ্ক আসে, জমে ওঠে আমাদের আড্ডা। বিকেল পড়তেই যে যার বাড়ী। সাজসজ্জা সেরে আরতির ঢাকের শব্দে আবার সব হাজির মন্ডপে। আরতি শেষে শুরু হয় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। এতে অংশ নেয় ভিলার আবাসিকরা-ছেলে মেয়ে বাচ্চা বুড়ো থেকে পুরুষ মহিলা সকলেই। বাইরে থেকেও অবশ্য কোন একদিন শিল্পীদল আসে অনুষ্ঠান করতে।
পুজোর ক’দিনের আনন্দ উচ্ছ্বাস শেষে বেজে যায় বিসর্জনের বাজনা। ভিলার আবাল বৃদ্ধ বণিতা সন্ধ্যা হতেই এসে জমা হয় ভিলা পার্কে। ঠাকুর লরিতে ওঠা পর্যন্ত সবার অপেক্ষা। তারপর ব্যান্ড পার্টী ঢাক ঢোল বাজিয়ে শুরু হয় যাত্রা। যারা এতক্ষণ অপেক্ষা করছিল তারাও পদব্রজে এগিয়ে চলে ঠাকুরের সঙ্গে। বিশাল শোভাযাত্রা সহকারে এগিয়ে চলে মা দুর্গা। মাঝে মাঝেই যাত্রা থামিয়ে চলে ছেলেমেয়েদের উদ্দাম নৃত্য। আজ আর তাদের কেউ বাধা দেয় না, আজই তো শেষ – তারপরই তো যে যার কোটরে গিয়ে ঢুকবে। আবার এক বছরের অপেক্ষা।
বেশ কিছুদূর হাঁটার পর আমরা ফিরে আসি আমাদের আবাসনে, যারা শেষ পর্যন্ত সঙ্গে যাবার তারা রয়ে যায়। ভিলার প্রবেশপথে আমাদের জন্য মিষ্টি নিয়ে অপেক্ষারত কয়েকজনের কাছ থেকে আমরা মিষ্টিমুখ করে সকলকে বিজয়ার প্রীতি ও শুভেচ্ছা জানিয়ে ফিরে যাই যে যার ঘরে।
আমাদের পুজো তখনও শেষ হয় না, কালীপুজো দিয়েই সে বছরের উৎসবের পরিসমাপ্তি ঘটে। মাঝে অবশ্য একদিন একটা চমক থাকে। গতবারেও তাই ছিল। কালীপুজোর আগের দিন মন্ডপের সামনে খোলা আকাশের নিচে বসেছিল, ছৌ নাচের আসর। পুরুলিয়া থেকে এসেছিল ছৌ নাচের দল। তারা নাচে গানে অভিনয়ে পরিবেশন করল মহিষাসুরমর্দিনী ও শঙ্খচূড় বধ পালা। পুরুলিয়া না গিয়েও যে আমার ঘরের সামনে এমন অপূর্ব নাচ দেখতে পাবো তা ছিল আমার কল্পনার বাইরে।
পুজোয় আমি এখন আর কোথাও বেরোতে চাই না। যাবার দরকারই বা কি? টিভি নেট ঘেঁটে তো পুজো পরিক্রমা হয়েই যায়। আগের দিনে বনেদী বাড়ীর পুজোয় বাড়ী-বিচ্ছিন্ন সদস্যেরা সবাই এসে যেমন একসাথে মিলিত হয়ে আনন্দে মেতে উঠত, আমিও তেমনই আমার এই পাখীর খাঁচা থেকে বার হয়ে আমার পরিবার তথা আবাসনের বাসিন্দাদের সঙ্গে কদিনের মুক্তির আনন্দে মেতে উঠি। তবে অন্ততঃ একটা দিন সন্ধ্যে বেলায় রিক্সা চড়ে বেরিয়ে পড়ি যতদূর যাওয়া সম্ভব ততদূরে, আর দেখি সারা বছরের সেইসব শ্রমক্লান্ত অথচ এখন খুশীতে উচ্ছ্বল হাজার ওয়াটের আলো জ্বলা মুখগুলো, যে আলোয় তিলোত্তমা কলকাতার আলো ঝলমলে রূপও ম্লান মনে হয়।
আমি জানি, এই কদিনের পুজোর আনন্দ নির্যাস নিয়েই কেটে যাবে আমার সারা বছর। এবার প্রতীক্ষা সামনের বছরের পুজোর।
অসুরদলনী মা দুর্গা আমার কাছে নারী শক্তির প্রতীক। প্রতি বছর ধরাধামে এসে তিনি যেন আমাদের তথা নারীদের বার্তা দিতে চান ‘ওঠো, জাগো, তোমাদের মধ্যে ঘুমিয়ে থাকা শক্তিকে বাইরে বার করে আনো। হাতে তুলে নাও আয়ুধ। তারপর অসুররূপী দুর্জনদের নিধন করে পৃথিবীকে করে তোল বাসযোগ্য – নির্মল সুন্দর কলুষমুক্ত’।
— সমাপ্ত —
গোপা মিত্র
ফিজিক্স অনার্স। একসময়ে কিছুদিন শিক্ষকতা করলেও, প্রকৃতপক্ষে গৃহবধূ – কিন্তু পায়ের তলায় সর্ষে। ভ্রমণের নেশা প্রবল। ভারতের বাইরে কোথাও না গেলেও দেশের মধ্যেই প্রচুর ঘুরেছেন। পাহাড়, সমুদ্র, জঙ্গল, ঐতিহাসিক স্থান – কোনোও কিছুই বাদ নেই। এখনও সুযোগ সুবিধে হলেই বেরিয়ে পড়েন। দু-কলমের জন্যে জীবনে প্রথমবার কলম ধরা।
প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত এক নিঃশ্বাসে পড়ে ফেললাম আর পড়তে পড়তে ফিরে গেলাম আমার ছোটবেলায়। মনকাড়া লেখা। ছবিগুলো বিশেষ করে রমেশ পালের গড়া মা দুর্গার ছবিটি বড় ভালো লাগলো।
খুব ভালো লাগল তোমার ভালো লেগেছে জেনে । মনে হচ্ছে আমার ভালো লাগা তোমার মধ্যেও ছড়িয়ে দিতে পেরেছি । আমার লেখা সার্থক । অনেক ধন্যবাদ ।
নিয়ম করে এত সুন্দর ভাবে লেখার অভ্যাস খুব কায়দা করে রপ্ত করে ফেলেছো দেখে খুব খুশি হলাম।
❤️👌🩷
ধন্যবাদ ।
Daarun. Relived my younger days. Last seen Pujo in Kolkata in 2004. Nearly 20 years back. I could relate a lot to your narration. Great reading. Feeling nostalgic.
Thank you . Come back once more. Experience the changes and enjoy the grandeur of puja .
সুন্দর লেখনী। চোখের সামনে ভেসে উঠলো কত সুখস্মৃতি!
অনেক ধন্যবাদ ।
তোমার লেখার subject এর horizon বেড়ে যাচ্ছে দিন দিন।লেখা টা খুব ভালো লাগলো। আরো ভাল লাগল যখন দেখলাম আমাদের পুজোর নিয়ে লিখেছ,আর তারপর ছবি দিয়েছো।ছোটবেলায় আমার পুজো কেটেছে দিল্লিতে ওখানে এতো জাঁকজমক ছিলো না তাও relate করতে পারছি তোমার লেখার মাধ্যমে ।
ধন্যবাদ ।তোমার comment আমাকে আরো উৎসাহিত করল ।মনের ভাবনা গুলো লিখতে চেষ্টা করি । তোমরা পড় বলেই আমি লিখি ।
Very nicely written.
Thank you .