সোমালী শর্মা
বয়স পঞ্চাশের কোঠায়; কিন্তু আজও নিধি ভুতকে যে বড্ড ভয় পায়। অন্তরে ভয় থাকলে কি আর করা যাবে? রাতে মায়ের পাশে শুয়ে শুয়ে মায়ের কাছে সেই ভুতেরই গল্প শোনার আবদার আর ঘুমিয়ে পড়ে স্বপ্নে সেই ভুত ব্যাটাদের আনাগোনায় ভয়ে চিৎকার। এনিয়ে মায়ের কাছে বকুনিও খেয়েছে নিত্যদিন।
শ্মশানটা ছিল নিধিদের বাড়ীর সামান্য ক্রোশ দুরে। আর প্রতিক্ষন দুর,দুরর–গ্রাম থেকে মড়াদের নিয়ে সৎকার করতে আসা সেই শ্মশানে। ওই যে মড়াদের কাঁধে নিয়ে যুবকেরা উচ্চস্বরে —-বল হরি হরিবোল—-করে চিল্লাতো। ওই ভয়ঙ্কর চিৎকারে শিশু নিধির শরীর হিম হয়ে যেত।
বর্ষাকালের গ্রামের রাত ভয়াবহ, রাতের প্রকৃতি বেশিমাত্রায় রুষ্ঠ।
এমনি এক বর্ষার অমাবস্যার রাতে দুর গ্রাম থেকে এক মড়া এসেছে জেলে পাড়ার মাধবের বৌ। বেশীদিন হয়নি তাদের বিয়ে হয়েছে। কয়েকদিনের ডায়রিয়াতেই তার প্রাণ কেড়েছে। মুষলধারে বৃষ্টি পড়ছে ,দুরে শেয়ালের হুক্কা হুয়া ডাক। তার মধ্যেই সেই বলহরির ধ্বনি। উঃ! বুকের ভেতরটা নিধির আতঙ্কে কুঁকড়ে যাচ্ছে। মা’কে শক্ত করে জাপটে থাকে, মায়ের কোলের ওমের পরশে সে সব ভয় কাটানোর চেষ্টায় মত্ত।এরকমটা হলে মা যে তাকে মধুসূদনের স্মরণ নিতে কইতো।
অত:পর তেনারই স্মরণ নিয়ে ভয় কাটানোর চেষ্টা আর মনে সাহস জোগানোর আকুল চেষ্টা ।
যাক, সেকথা। ফিরে আসি সেই কমলার শবদেহে। তারা ছিল অতিশয় গরীব। শবদেহ সৎকারের সামান্য কাঠটুকু জোগাড় করার ক্ষমতা ছিল না।মাধব যদিও কিছু কাষ্ঠ এদিক ওদিক থেকে জোগাড় করেছিল তাও ছিল বর্ষার জলে ভেজা।চিতা অনেক সাধ্য সাধনা করে জ্বালালেও বৃষ্টির প্রচন্ড দাপটে চিতার আগুন ক্ষীণ হয়ে নিভে গেছিল। কমলার জীবন প্রদীপখানির মতই।
শববাহীরা দেখল ওই নিভন্ত চিতা থেকে লালসিঁদুরে ঢাকা ললাটখানি নিয়ে কমলা এগিয়ে আসছে তাদের দিকে। শববাহীরা নারায়ণের স্মরণ নিতে নিতে যে যার ঘরের পানে।অভাবী সংসারের মাধবরা অভাগী কমলার শ্রাদ্ধ শান্তি করাতে পেরেছিল কিনা জানা নেই। হয়তবা না—–
কিছুদিন পরের কথা।পল্লী-বাংলার এক বর্ষার রাত, রাতটা অজ পাড়াগাঁয়ে তাড়াতাড়ি নামে ,তথাকথিত বিদ্যুতের আলো তখনো পৌছায়নি এ গাঁয়ে।অগত্যা হ্যারিকেনের আলো ভরসা।
দুরে শেয়ালের হুককা হুয়া প্রহর গোনার ডাক ,ব্যাঙের ও গ্যাঙর-গ্যাঙানি, সবমিলিয়ে এক ভয়াবহ নিশুতি রাত।
সদ্য বিবাহিতা নববধূ এসেছে আজ মুখার্জি বাড়িতে। বেনুবালা নির্জন জঙ্গলের ধারে পুকুর পাড়ে গেছিল প্রাত্যহিক কর্ম সারতে। ব্যাস ওই পুকুর ধারেই শেওড়া গাছেই তো তেনার বাস। লাল পেড়ে সাদাকাপড়ে মুড়ে পা ঝুলিয়ে বসে থাকে পেত্নি বুড়ি। অনেকেই যে দর্শন পেয়েছে তাঁর।
বেনুবালার ঘাড়ে যে সে চেপে বসলো। নববধূর মুখে পটর পটর খই ফুটতে লাগলো। এ বাড়ীর কারো বুঝতে বাকি রইলো না কান্ডখানা।
অগত্যা ওঝার দ্বারস্থ, চলতে লাগল ওঝার ঝাঁড় ফুঁক, সাথে পেত্নী তাড়ানোর বিভিন্ন কলাকৌশল। বেনুর বেশে পেত্নির অস্বাভাবিক কীর্তি-কলাপ, কাঁচা আঁশটে মাছ যে তাঁর প্রিয়। বিয়েবাড়িতে একটা দমবন্ধ করা গুমোট পরিবেশ।
এসব অশরীরী আত্মারা দুর্বল হৃদয়ের মনুষ্যের মধ্যে পুটুশ করে ঢুকে পরে।
অবশেষে ওঝার ঝাঁড় ফুঁকের দৌলতে, বেনুর ঘাড় থেকে নেমে যেতে বাধ্য হয় পেত্নী বুড়ি, আর জানান হিসাবে আমগাছের এক মগডাল ভেঙে রেখে যায়।
বেনুবালা আবার স্বয়ং-এ ফেরৎ আসে।
শুনেছে নিধি ভূত বিশ্বাসীদের মতে –মৃত্যুর পর আত্মার আসা যাওয়া থাকে। আর সে আত্মা যদি অতৃপ্ত হয় তাহলে অশরীরী ছায়ামূর্তি রূপ নিয়ে মানুষকে দেখা দিতে চায় । হয়তো বা তাঁর অতৃপ্ত আত্মার তৃপ্তির পথ খোঁজে।
আজও নিধির অন্তরে সেই ছোট্টবেলার ভয়েরা আকড়ে আছে। জীবন আজ অনেক পাল্টেছে। পরিবর্তনের হাওয়া বইছে। প্রযুক্তির বিকাশ ঘটেছে। নিধিদের গ্রামেও আধুনিকতার ছোঁয়া লেগেছে এখন আর শেয়ালের প্রহর গোনার আওয়াজ কানে বাজে না। ইলেকট্রিক আলোতে মুড়েছে গোটা গ্রাম। শ্মশানটাকেও নবনির্বাচিত সাংসদ ইলেকট্রিক চুল্লী করে দিয়েছে জনসাধারণের সুবিধার্থে। কিন্তু আজও নিধির অন্তরে সেই যে ছোট্টবেলার ভুতের ভয়টা স্হায়ীভাবে বসত করছে।
সে ভয়ের বাস্তবিকতা-অবাস্তবিকতা দুটোই নিধির পৌঢ় মনে অজানা।
নিজেকেই নিজে প্রশ্ন করে উত্তর মেলানোর চেষ্টা করে চলেছে।।