Home প্রবন্ধ, সাহিত্য ও সংস্কৃতি বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস – দ্বিতীয় ভাগ – তৃতীয় পর্ব
প্রবন্ধসাহিত্য ও সংস্কৃতি

বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস – দ্বিতীয় ভাগ – তৃতীয় পর্ব

শৈবাল কুমার বোস

৪) অনুবাদসাহিত্য ও শ্রীরামপাঁচালী

ভারতীয় আদর্শের ধারাকে অব্যাহত রাখতে গিয়ে মধ্যযুগের শাসকরা মূলত তাদের পছন্দের কবি লেখকদের মধ্যস্ততায় অনুবাদের কাজ করিয়েছেন। একটি জাতির সামগ্রিক সংস্কৃতিকে জানতে হলে তার মানস প্রবণতা জানা দরকার। মুসলমান শাসকেরা যখন হিন্দু সংস্কৃতিকে অনুধাবন করতে চাইলেন তখন হিন্দু পুরাণের অনুবাদ আবশ্যিক হয়ে ওঠে। রামায়ণ, মহাভারত, ভাগবতের মধ্যে এমন বহু আখ্যান যা গল্পের আখ্যানকেও হার মানিয়ে দেয়। সেখানে আদর্শ নীতি তত্ত্ব অপেক্ষা অনেক বেশী গুরুত্ব পেয়েছে সাধারণ জীবনের সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্নার কাহিনী। যে কারণে মধ্যযুগের কবিরা অনুবাদ রচনায় আত্মনিয়োজিত হয়েছিলেন। এই প্রসঙ্গে বলে রাখা ভাল যে মধ্যযুগের কবিরা অনেক ক্ষেত্রে বাঙ্গালী পাঠকের মনের মতো করে আখ্যান সাজিয়েছেন। এই আখ্যান এতটাই মনকে আকর্ষণ করেছিল যে জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে প্রত্যেক পাঠক সেই আখ্যান শুনতে আগ্রহ বোধ করেছে। যারা সংস্কৃত ভাষা জানতো না সেই সাধারণ মানুষ সহজ সরল ভাষার মাধ্যমে ভারতীয় পুরাণের গল্প আত্মস্থ করলেন। বর্ণগত-বিত্তগত-বর্গগত বিভাজনে যারা নীচুতলার মানুষ বলে চিহ্নিত হয়েছিল তাদেরকে হিন্দু সংস্কৃতির সঙ্গে পরিচয় করানোর তাগিদ অনুভব করেছিলেন উচ্চবর্গের মানুষরা। কেননা তারা ইতিমধ্যেই উপলব্ধি করেছিলেন যে নিম্নবর্গের এই বৃহৎ মানুষজনের থেকে মুখ ফিরিয়ে রাখলে কখনো হিন্দুধর্ম ও সংস্কৃতির পুনর্জাগরণ সম্ভব নয়। ইতিমধ্যে লোকায়ত দেবদেবী, লোকায়ত দর্শন, লোকায়ত দর্শন, লোকায়ত ধর্ম পালন নিয়েই ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলেন নিম্নবর্গের মানুষজন, ফলে তাদেরকে ঘরে ফেরানোর তাগিদ অনুভব করেছিলেন তথাকথিত উচ্চবর্ণের মানুষজন। সেই কারণে সংস্কৃত ভাষার গুরুগম্ভীর কাব্যপ্রাঙ্গণ থেকে নানা তথ্য তুলে এনে বাঙ্গালী পাঠকের উপযোগী করে পরিবেশন করার দায় নিয়েছিলেন অনুবাদক কবিরা। সংস্কৃতে অনভিজ্ঞ অল্পশিক্ষিত বা অশিক্ষিত মানুষের কাছে হিন্দুধর্মের মূল বক্তব্যকে পৌঁছে দিতেই এই অনুবাদের প্রয়োজন হয়ে উঠেছিল।

মাইকেল মধুসূদন কৃত্তিবাস ওঝাকে এ বঙ্গের অলংকার বলেছিলেন। তিনি সত্যি এ বঙ্গের অলংকার। তিনি অনুবাদ সাহিত্যের আদিকবি। তার অনুবাদ আমাদের বাঙ্গালী জীবনের ঘরোয়া মর্মস্পর্শী মর্মানুবাদ। তাই তার শ্রী রাম পাঁচালী আজও বাঙ্গালীর ঘরে ঘরে সমাদৃত।

কৃত্তিবাসের শ্রীরাম পাঁচালী মূল বাল্মীকি রামায়ণের মতোই সপ্তকান্ডে বিভক্ত – ১) আদিকান্ড –  বিষ্ণুর চার অংশে প্রকাশ, রত্নাকর দস্যু ও রামনামের মাহাত্ম্য, মান্ধাতার উপাখ্যান, হরিশ্চন্দ্রের উপাখ্যান, সগরের অশ্বমেধ যজ্ঞ ও বংশনাশ, গঙ্গামাহাত্ম্য, সৌদামরাজার উপাখ্যান, দশরথের বিবাহ ও দশরথের প্রতি অন্ধকের অভিশাপ, দশরথের কৈকেয়ীকে বরদানের অঙ্গীকার, দশরথের অশ্বমেধ যজ্ঞ্ শ্রীরামের জন্ম বিবরণ, সীতার জন্ম বিবরণ, অহল্যা উদ্ধার, রামের হরধনুভঙ্গ ও বিবাহ, পরশুরামের দর্পচুর্ণ ইত্যাদি, ২) অযোধ্যাকান্ড – রামের অভিষেক, কৈকেয়ীর বর প্রার্থনা, রামের বনবাস, ভরতের অযোধ্যায় আগমন, দশরথের মৃত্যু, সিংহাসনে রামের পাদুকা রেখে ভরতের রাজ্যশাসন ইত্যাদি, ৩) অরণ্যকান্ড – রামের চিত্রকূট অবস্থান, অত্রিমুনির আশ্রমে গমন, বনান্তরে ভ্রমন, শূর্পনখার নাসিকাচ্ছেদন, রাবণের সীতা হরণ, , সীতা অন্বেষণ, ইত্যাদি, ৪) কিষ্কিন্ধাকান্ড – সুগ্রীবের সাথে রামের মিলন, রাম কর্তৃক বালি বধ, সুগ্রীবের অভিষেক, জটায়ুর সাথে রামের যুদ্ধ, সীতা অন্বেষণে সৈন্য প্রেরণ, সম্পতির কাছে সীতার সন্ধানলাভ ইত্যাদি, ৫) সুন্দরকান্ড – হনুমানের জন্মবৃত্তান্ত, সাগর উল্লঙ্ঘন, অশোকবনে সীতার সন্ধানলাভ, লঙ্কাদহন, সাগর বন্ধন ইত্যাদি, ৬) লঙ্কাকান্ড – রাম-রাবণের প্রথম যুদ্ধ, কুম্ভকর্ণের অকালনিদ্রাভঙ্গ, কুম্ভকর্ণের পতন, ইন্দ্রজিতের পতন, লক্ষ্মণের শক্তিশেল, রামের সাথে রাবণের যুদ্ধ, রামের অকালবোধন, রাবণবধ ইত্যাদি, ৭) উত্তরকান্ড – রামের অশ্বমেধ যজ্ঞ, লবকুশের সাথে রামের যুদ্ধ, সীতার পাতাল প্রবেশ, রামের স্বর্গগমন ইত্যাদি।

মূল বাল্মীকি রামায়ণের সাথে কৃত্তিবাসের রামায়ণ পাঁচালী বর্ণিত কাহিনী ও চরিত্রের পার্থক্য যথেষ্ট। কৃত্তিবাস তার এই মহাকাব্যের রচনার পিছনে দুটি কারণের কথা বলেছেন – প্রথমত পৃষ্ঠপোষক রাজার আদেশ, দ্বিতীয়ত লোকশিক্ষার সামাজিক দায়িত্ববোধ। বাল্মীকি রচিত মূল রামায়ণ কাহিনী অবলম্বনে কৃত্তিবাস তার রামায়ণ রচনা করলেও বাল্মীকির রামায়ণের আক্ষরিক অনুবাদ করেননি। প্রাচীন বাংলা সাহিত্যের পাঁচালীর আদর্শে তার রামায়ণ রচনা করেছেন। কৃত্তিবাস রচনা করেছেন বাঙ্গালীর মন নিয়ে বাঙ্গালীর মতন করে তার রামায়ণ। শ্রীরাম পাঁচালী মহাকাব্য নয় – বাল্মীকির মহাকাব্যের সেই সংযত গম্ভীর রূপ করুণ গ্রাম্য গানে বাংলা পয়ারের ছন্দে পরিণত হয়েছে বাঙ্গালীর ভক্তিরসে। তার চরিত্রাদর্শে ও চরিত্রচিত্রণে ও তাই মহাকাব্যের ভাস্কর্য বলিষ্ঠতা নেই, আছে বাঙ্গালীর পটুয়ার নিপুণ স্বচ্ছন্দে রেখার মাধুর্য। বাল্মীকি রামায়ণের সাথে কৃত্তিবাসের রামায়ণ পাঁচালীতে  কাহিনী ও চরিত্রের পার্থক্য যথেষ্ট। মূলকাহিনীকে তিনি পরিবর্ধন ও পরিমার্জন করে নতুন রূপে পরিবেশন করেছেন। শুধু বাল্মীকি নয়, জৈমিনি ভারত, অদ্ভূত রামায়ণ, দেবী ভাগবত, মার্কেন্ডয় পুরাণ, পদ্মপুরাণ প্রভৃতি বিখ্যাত মহাকাব্য, পুরাণ ও তত্ত্বগ্রন্থ থেকে তিনি উপাদান সংগ্রহ করেছেন। কৃত্তিবাস বাল্মীকির যে সমস্ত কাহিনী পরিত্যাগ তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো ১) কার্তিকের জন্ম, ২) বশিষ্ঠ বিশ্বামিত্র বিরোধ ৩) বিশ্বামিত্র কথা ৪) অম্বরীশ যজ্ঞ, ৫) রামচন্দ্র কর্তৃক আদিত্য হৃদয় স্তব পাঠ। আবার যেগুলো তার মৌলিক কল্পনা প্রসূত বলে ধরা হয় সেগুলো হলো ১) সৌদাস-দিলীপ-রঘুর কাহিনী, ২) দশরথের রাজ্যে শনির দৃষ্টি, ৩) গনেশের জন্ম, ৪) সম্বরাসুর বধ, ৫) কৈকেয়ীর বরলাভ, ৬) গুহকের সাথে মিতালী, ৭) হনুমান কর্তৃক সূর্যকে বক্ষতলে ধারণ, 8) বীরবাহুর যুদ্ধ, ৯) তরণীসেন-মহীরাবণ-অহিরাবণ কাহিনী, ১০) রাবণবধের জন্য রাম কর্তৃক দেবী চন্ডিকার অকালবোধন ও নীলপদ্মের কাহিনী, ১১) গণকের ছদ্মবেশে হনুমান কর্তৃক মন্দোদরীর কাছ থেকে রাবণের মৃত্যুবাণ হরণ, ১২) মুমূর্ষু রাবণের কাছে রামের রাজনীতি শিক্ষা, ১৩) দেবর বধূদের অনুরোধে সীতা কর্তৃক খড়ি দ্বারা রাবণের মূর্তি অংকন, তা দেখে রামের মনে সীতার প্রতি সংশয় ও সীতা নির্বাসন, ১৪) লব-কুশের যুদ্ধ ইত্যাদি। যেসব ঘটনা বাল্মীকি রামায়ণ ছাড়া তিনি অন্য সূত্র থেকে নিয়েছেন তা হলো – ১) আদিকান্ডে হরিশ্চন্দ্র উপাখ্যান – দেবীভাগবত, মার্কন্ডেয় পুরাণ থেকে, ভগীরথের জন্মবৃত্তান্ত – যোগবশিষ্ঠ রামায়ণ ও পদ্মপুরাণ থেকে, কান্ডার মুনির উপাখ্যান স্কন্দপুরাণের কাশীখন্ড থেকে, ২) সুন্দকান্ডে সেতুবন্ধনের সময় রামের শিবপ্রতিষ্ঠার কূর্মপুরাণ থেকে, ৩) লঙ্কাকান্ডে চন্ডিকার অকালবোধন দেবী ভাগবত, বৃহদ্ধর্মপুরাণ ও কালিকাপুরাণ থেকে, গন্ধমাদন পর্বত থেকে বিশল্যকরণী আনার সময়ে হনুমানকে কালনেমির বাধাদেনের বৃত্তান্ত অধ্যাত্ম রামায়ণ থেকে।

কবি কৃত্তিবাসের কৃতিত্ব তার বিষয় নির্বাচন ও নির্মাণ কর্মের মধ্যে অন্তর্নিহিত রয়েছে – ১)বাঙ্গালীয়না – মূল রামায়ণের চরিত্র বাঙ্গালী না হলেও বাঙ্গালী চরিত্রের ভক্তিভাব, হৃদয়ের আবেগ সহ নানা সাধারণ বৈশিষ্ট্য লক্ষ করা যায়। বাঙ্গালীর আচার-অনুষ্ঠান, খাদ্যদ্রব্যের উল্লেখও রয়েছে যথাযথ ভাবে, ২) কৃত্তিবাসের রামায়ণে মুলরস করুণ হলেও ভক্তিরস ও হাস্যরসের প্রভাব এই অনুবাদে বিশেষভাবে লক্ষণীয়, ৩) দশরথ, শ্রীরাম, রাবণ, কুম্ভকর্ণ প্রভৃতি চরিত্রগুলির নানা কার্যাবলীর খুঁটিনাটির বিবরণ যেভাবে কৃত্তিবাস দিয়েছেন তার ফলে প্রতিটি চরিত্র বিশ্বস্ত হয়েছে, ৪) বাল্মীকি রামায়ণের নানা প্রসঙ্গ কৃত্তিবাস পরিহার করেছেন আবার কিছু নতুন প্রসঙ্গের অবতারণা করেছেন, ৫) কৃত্তিবাসের অনাড়ম্বর, সর্বসাধারণের উপযোগী করে এই ভাষাকে তিনি পরিবেশন করেছেন। তাই শ্রীরাম পাঁচালী কেবল অনুবাদ নয়, অনুসৃজন।

শ্রীরাম পাঁচালীর জনপ্রিয়তার কারণ হিসাবে বলা যায় – ১) জাতির সংস্কৃতি-ধর্মনীতির সামগ্রিক ঐতিহ্য বহন করছে শ্রীরাম পাঁচালী। অতি সাধারণ নিরক্ষর মানুষ থেকে মেধাসম্পন্ন বুধিমান মানুষও এই গ্রন্থে মনোনিবেশ করেন, ২) কৃত্তিবাস লোকমনোরঞ্জনের কাহিনী পরিবেশন করেছেন, যে কারণে বাঙ্গালীর সমাজজীবন উপস্থাপন করা এ কাজের মুল উদ্দেশ্য ৩) কৃত্তিবাস ভাষাকে করেছেন কাঠিন্যমুক্ত। ফলে যে কোনো পাঠক এই গ্রন্থকে গ্রহণ করেছেন আন্তরিকভাবে, ৪) তানপ্রধানের ধীর লয়ে মোহনীয় পরিবেশ সৃজন করেছে এই কাব্য। ৫) ভক্তিরস পরিবেশন মূল লক্ষ হওয়ায় এ কাব্যকে বাঙ্গালী পাঠক দেবতার লীলাখেলা বলে গ্রহণ করেছেন। বাঙ্গালীর সমাজজীবনে শ্রীরাম পাঁচালীর প্রভাব – ১) কৃত্তিবাসী রামায়ণ মূল্যবোধের অবক্ষয় থেকে বাঙ্গালীকে  আত্মরক্ষার অনুপ্রেরণা জুগিয়েছে, ২) উৎসব অনুষ্ঠানে পালা পার্বণে কৃত্তিবাসী রামায়ণের বিষয় অবলম্বন করে কথকতা, পাঁচালী, যাত্রা কবিগান অনুষ্ঠিত হয়ে চলেছে, ৩) বাঙ্গালী রামায়ণের পারিপারিক আদর্শ শিরধার্য করেছে।

ঋণ স্বীকার :
১) বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস দ্বিতীয় খন্ড – ডঃ সুকুমার সেন
২) বাংলা সাহিত্যের ইতিকথা প্রথম পর্যায় – শ্রী ভূদেব চৌধুরি
৩) বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস আদি ও মধ্য যুগ – ডঃ দেবেশ কুমার আচার্য
৪) বাংলা সাহিত্যের সামগ্রিক ইতিহাস – ডঃ দীপঙ্কর মল্লিক
লেখক পরিচিতি
শৈবাল বসু

নরেন্দ্রপুর রামকৃষ্ণ মিশন থেকে মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পাশ করার পর সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজ থেকে পদার্থ বিদ্যা নিয়ে স্নাতক। পেশাগত ভাবে গত ৩৪ বছর ধরে ব্যাঙ্কার। নেশাগত ভাবে শরদিন্দু ও ইতিহাস প্রেমী। বর্তমানে কলকাতা ও বাংলার ইতিহাস নিয়ে চর্চারত।

Author

Du-কলম

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!