অনন্ত কৃষ্ণ দে
পূর্ব ভারতের যে জনমন্ডলী, বাংলাভাষী বলে, বাঙ্গালী নামে পরিচিত, তাদের ইতিহাসে মহত্তম সংগঠন হল শ্রীকৃষ্ণচৈতন্য ভারতীর আবির্ভাব। পঞ্চদশ শতক পর্যন্ত যে বাঙ্গালী জাতি ছিল স্বাতন্ত্র্যহীন ও মানসিক দিক থেকে নাবালকমন্ডিত, তার চরিত্রে তিনি এনে দিয়েছিলেন পূর্ণাঙ্গ মানুষের প্রত্যয়। পাখির মতোই খোলস ছেড়ে বেরিয়ে এসে দিগন্তে কিভাবে ঊড়তে হয়, সেই শিক্ষাই দিয়েছিলেন তিনি। প্লাবনি নদীর মতো এই পলিমাটির পেলব বাংলাকে ভাসিয়ে নিয়ে গিয়েছিল এক নুতন খাতে। প্রেমের বীর্যে তাকে দীক্ষিত করে সেই ধর্ম পথেই তার সাংস্কৃতিক আধ্যাত্মিক তথা সর্বাত্মক প্রকর্ষ ঘটিয়েছিলেন।
শ্রী চৈতন্যদেবের জন্মোৎসবের পঞ্চশত পঁয়ত্রিশ বছর পরেও চৈতন্যজীবনীর উপাদান নিয়ে আধুনিক দৃষ্টিতে নতুন করে ভাবনা, বিশেষ করে শ্রী চৈতন্যর আবির্ভাবের পূর্ববর্তী ও পরবর্তী অবস্থা, তাঁর প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ প্রভাব এবং পরিণাম ও প্রতিক্রিয়া নিয়ে বিশ্লেষনাত্বক আলোচনার মাধ্যমেই এই গৌড়ীয় বৈষ্ণব সাধনার অগ্রনায়ক যুগপুরুষ শ্রী চৈতন্যদেবের সার্থক মূল্যায়ন সম্ভব।
জগন্নাথ তনয় নিমাইএর জন্ম চোদ্দশ ছিয়াশি খৃষ্টাব্দে। গৌড়ীয় সুলতান তখন আলাঊদ্দিন হোসেন শাহ। নবদ্বীপের চিত্র মুরারির কড়চায় – পাপ ব্যাধি সমাকুল নবদ্বীপে মল-পঙ্কিল ম্লেচ্ছ হাতের কর শোষন চলছে নির্বিবাদে। এমন নৈরাজ্য, এরকম দুঃসময়েও জাতপাত, বর্ণবিচার, অত্যাচার নিজ সমাজেই চালিয়ে যাচ্ছে হিন্দু সমাজপতিরা। ইতিহাসের এক চরম তামস যুগ এ দেশের। দেশ তবু ছিল। ‘দেশ তখনও ছিল,’ রবীন্দ্রনাথ ‘ভারতবর্ষের ইতিহাস’ বলেছেন- ‘নহিলে এই সমস্ত ঊপদ্রবের মধ্যে কবীর, নানক, চৈতন্য, তুকারাম, ইহাদিগকে জন্ম দিল কে?’ দেশের আত্মাই দুঃসময়ে আবাহন করেন দেশিকোত্তমকে। চৈতন্য এলেন শচীমাতার দুলাল হয়ে। দুলাল কিন্তু দুরন্ত, দুর্বাক, দুর্বিনীত। দুর্দমনীয়। জীবনের শুরু থেকেই ঘা মেরে জাতীয় চেতনাকে জাগানোই তার ব্রত। তাই ‘চরিত্র পূজা’-য় রবীন্দ্রনাথকে বলতে শুনি – ‘নিরীহ বাংলাদেশে গোপালের মতো সুবোধ বালকের অভাব নাই। কিন্তু দুষ্টু, অবাধ্য, অশান্ত ছেলেগুলির কাছে স্বদেশের জন্য অনেক আশা করা যায়। বহুকাল পূর্বে একদা নবদ্বীপের শচীমাতার এক প্রবল দুরন্ত ছেলে এই আশা পূরণ করেছিলেন।
নিমাই এর জন্মের পরেই সর্বশাস্ত্রজ্ঞ অদ্বৈতাচার্য তাঁকে কৃষ্ণের অবতার বলে বরণ করেছেন। চৈতন্য-ভাগবতে দেখি নিমাই বলছেন –
“আমি তারে বলি পন্ডিত
একবার ব্যাখ্যা করে আমার সহিত।“
কৈশোরেই তাঁর পন্ডিত খ্যাতি। অখ্যাতিও ততোধিক। তিনি উদ্ধত, অসামাজিক অহংকারী।চৈতন্য বললেন, সর্বজীব কৃষ্ণদাস। তাঁর সেবক সবাই সমান। নিভৃত; ব্যক্তিকেন্দ্রিক ধর্মাচারকে তিনি টেনে আনলেন প্রকাশ্যে, সাম্যের সমভুমিতে, সাধারনের মিলন প্রাঙ্গনে। শঙ্কিত হল প্রতিক্রিয়াশীল সমাজ গোষ্টী। শুরু ষড়যন্ত্রের আঘাত। তা এলো অতি নির্মম ভাবে নেমে।
প্রগতির নায়কেরা প্রতিক্রয়ার হাতে আহত হয়েছেন বারে বারে। তবুও ইতিহাসের অগ্রগতিকে তারা রুখে দিতে পারেন নি। এই সূত্রে রবীন্দ্রনাথের ঊক্তিটি স্মরনীয় – ‘কতকগুলো লোক খেপিয়া চৈতন্যকে কলসির কানা ছুড়িয়া মারিয়াছিলেন। কিন্তু কিছুই করিতে পারিল না। কলসীর কানা ভাসিয়া গেল। দেখিতে দেখিতে এমন একাকার হইল যে, জাতি রহিল না, কূল রহিল না, হিন্দু- মুসলমানেরও ভেদ রহিল না। প্রতিক্রিয়াপন্থীদের যেমন পছন্দ হচ্ছিল না সমাজের এমন অভেদ- ঐক্য রূপ, রাজশক্তির ও বাঞ্ছিত নয় প্রজাপুঞ্জের এ রকম সংঘশক্তি, বিশেষ করে সে জোট যদি আবার হয় কোন বিধর্মী কে কেন্দ্র করে। রাজশক্তির কাছে নতজানু হতে আবির্ভূত হননি জননায়ক জগন্নাথ তনয়। তাই সংকীর্তন কাজির বাড়ি গিয়ে কীর্তনের অধিকারের সন্মতিস্বরূপ পাঞ্জা নিয়ে ফিরে এলো বিজয় মিছিল।
পৃথিবীতে অনেক ধর্মযুদ্ধ হয়েছে। রক্তও তাতে ঝরেছে অনেক। কিন্তু চৈতন্যর নেতৃত্বে এই ধর্ম –বিজয় হল রক্তপাতহীন। ইতিহাসে এমন নজির বেশী নেই। নজিরবিহীন আর একটি তাৎপর্যও, বিস্মিত নদীয়াবাসী দেখল, মুসলমান শাসনের অধীনে মুসলিম শাসনকর্তার হুকুমনামাকে কোনো হিন্দু প্রজার পক্ষে মুখের উপর ছিঁড়ে ফেলা সম্ভব। সম্ভব হলো নিমাই এর নেতৃত্বে গনসত্যাগ্রহে। এই প্রথম তারা আত্মবিশ্বাস ফিরে পেল। এখানে একটা কথা উল্লেখ্য, শ্রী চৈতন্যদেবের সমসাময়িক আর কোনো ধর্মনেতাকেই তাঁর মতো উচ্চবর্ণ থেকে নেমে এসে অন্ত্যজ, অন্য ধর্মকে বুকে টেনে নিতে হয় নি। তাঁদের কেউ জোলা, কেউ মুচি, কেউ বা সবজির ব্যপারি। কিন্তু নিমাই উচ্চবর্ণের ভরদ্বাজ গোত্রীয় পাশ্চত্য বৈদিক বংশজাত।
সমগ্র ভারতকে এক সাম্যধর্মের বাঁধনে সংহত করাই তাঁর সংকল্প। যথার্থ জাতীয় সংহতির পরিব্রাজক তিনি। দীর্ঘ ছয় বছর ব্যাপী তাই তাঁর ভারত পরিক্রমা। এই সফরেও জাতপাতে ঘা মেরেছেন তিনি। মথুরায় গিয়ে সেই সমাজে পতিত সনৌরিয়া ব্র্ব্রাহ্মণ কুলে কালি ছিটিয়ে বাস করেছেন গিয়ে শূদ্র চন্দ্রশেখরের ঘরে। আবার তিনি বাস্তববাদী। বৃন্দাবনে গুজব রটল যমুনায় দেখা দিয়েছেন কালীয় দমনকারী শ্রীকৃষ্ণ। তিনি সকলকে বারণ করেছেন অলৌকিক গুজবে কান না দিতে।
সন্ন্যাসীর প্রথা ভঙ্গ করে শ্রী চৈতন্যই দেন ধর্মপথে নারীর মর্যাদা, নারী মুক্তি। স্ত্রী জাতি গৃহাঙ্গনের বাইরে সামাজিক প্রতিষ্টা লাভ করেন, সেকালে যাঁর জন্য, তিনি চৈতন্য মহাপ্রভু। নারীর মর্যাদা কোথাও ক্ষুণ্ণ হলে রুখে দাঁড়ান তিনি। এই ঘটনার সূত্র ধরে রবীন্দ্রনাথ দেশহিত নিবন্ধে বলেছেন – “চৈতন্যর মনে যে প্রেমধর্মের আদর্শ তাহা কত উচ্চ, তাহা কিরূপ নিস্কলঙ্ক। —- দুর্বল মমতাকে তিনি স্থান দেন নাই।“
শুধু বিলাস বর্জন নয়, নিপীড়ত দরিদ্রের সঙ্গে একাত্মতার এই কৃচ্ছসাধন কোন জননায়ক করতে প্রস্তুত একালে? তাছাড়া কে পারেন পরধর্মে এমন উদার শ্রদ্ধা পোষন করতে? শাস্ত্রধর্মে যিনি দিকপাল স্মাত পন্ডিত বাসুদেব সার্বভৌমকে পরাস্ত করেন তিনিই মথুরা থেকে প্রত্যাবর্তনের পথে এক পীরের সঙ্গে সশ্রদ্ধ আলোচনায় কোরানের প্রশংশা করেন এবং প্রেমঘন আলোচনায় ‘সবার ঈশ্বরই এক’ এই সিদ্ধান্তে উপনীত হন। যা ছিল তাঁর বচন, তাই তার আচরন।
ভক্তরা তাকে যত প্রভু সাজাতে চেয়েছেন ততো তিনি চেয়েছেন দাসানুদাস হতে। জাতপাতের ভেদবন্ধন ভেঙ্গে দিয়েছিলেন তিনি প্রেমেন প্লাবনে। ঢেঊ লাগে তার বৌদ্ধ – মুসলমান সমাজেও। উৎকলের এক বৌদ্ধ সম্প্রদায় বৈষ্ণব হয়। মুসলমান সুফি রেজা লেখেন – ‘বৈষ্ণব সবার বন্ধু, সাবানের (সকলের) প্রেমসিন্ধু’। শতাধিক মুসলমান কবি রচনা করেছেন বৈষ্ণবপদ। এই মিলন ঘটতে পেরেছে চৈতন্য প্রবর্তিত, ‘সাবানের প্রেমসিন্ধু তীরে’। তাই নিমাই হয়ে উঠলেন নিপীড়ত মানবত্মার মহাপ্রভু, বঞ্চিতের ভগবান। দেবতাকে ছেড়ে তাঁর জীবন কথা হল লেখা। বঙ্গ ভাষায় বোধহয় এই প্রথম মানুষের জীবনী।
তবু তাতে পুরো পাই না আমরা তাঁকে – যায় না পাওয়া। পরাধীন দেশে কোনো বিপ্লবীর জীবনকথা সমসাময়িক কাল লিখতে পারে না। আর যুগ স্রষ্টাদের জীবন-বানীর যথার্থ মূল্যায়ন হয় না কালোত্তরনের আগে। ধীরে ধীরে বুঝি। যতো দূরে যাই, যতো তাঁকে হারাই, ততো তাঁকে পাই। তাই বছরের পাঁচশোর ও বেশি পৈঠা পেরিয়ে আজ দেখি তিনি ভাস্বর। শুধু ধর্মজগত নয়, বিশ্ব-বিপ্লবের প্রবক্তা, শ্রেনী সংগাম ও সাম্যবাদের চিন্তানায়ক – বিশ্ব মনীষার সকল পুরোধার শ্রদ্ধা প্রকাশ তাঁকে।
গান্ধীজির সত্যাগ্রহ তো সে দিনের। টলস্টয়েরও কয়েকশো বছর আগে সত্যাগ্রহের প্রথম নজির স্থাপন করেন চৈতন্য। চৈতন্যর আন্দোলনের হাতিয়ার যে ধর্ম তার মর্ম না বুঝে তথাকথিত বস্তুবাদীরা তাঁকে নিয়ে ব্যঙ্গ করতেও ছাড়েন নি। তারা ভুলে যান পৃথিবীর অপর প্রান্তে চৈতন্যদেবের সমসময়ে মারটিন লুথার যে খৃষ্টীয় আন্দোলন করেন সেই সময়ের নিরিখে তাকেই প্রগতিশীল বলেছেন ফ্রেড্রিক এঙ্গেলস। কেবল তাই-ই নয়, এই জাতীয় ধর্মান্দোলন সুগভীর তাৎপর্য বিশ্লেষন করে নেয়। জার্মানির কৃষক বিদ্রোহতে এঙ্গেলস বলেছেন – “ ষোড়শ শতকের যেগুলিকে বলা হয় ধর্মযুদ্ধ, সেগুলিতেও স্পষ্ট নির্দিষ্ট, বৈষয়িক শ্রেনী স্বার্থ, সেগুলিও শ্রেনীযুদ্ধ।
—- যদিও তখনকার শ্রেনী সংগ্রামগুলি চলত ধর্মীয় বাতাবরনের আড়ালে তাতে আসলের কিছু অদল-বদল হোত না। আলাদা করে চৈতন্যদেবের নাম অবশ্য তিনি করেন নি। সে নামটি যিনি করেছেন, চৈতন্যদেবের নাম করে যিনি তাঁকে শ্রদ্ধা জানিয়েছেন, তিনি কার্ল মার্কস। চৈতন্যদেবেকে তিনি জাতপাতের বিরুদ্ধে সংগ্রামী উদারনীতির প্রবক্তা এবং একজন রিফরমার বলে শ্রদ্ধা জানিয়েছেন।
আলোচনা শুধু এদেশে নয়, এখন চলছে গনতন্ত্রী, ধনতন্ত্রী, সমাজতন্ত্রী, সব দেশে তাঁকে নিয়ে গবেষনা, তাঁর নব মূল্যায়ন। সোভিয়েত রাশিয়ার চেশিলেভ, কোমারভ প্রমূখ বলেছেন চৈতন্য কথা। বেনগাদ লেভিনের ‘ভারতের ইতিহাস’-এ সপ্রশংস চৈতন্য স্মরণ। বাংলাদেশ থেকেও চৈতন্যকে নিয়ে এক সশদ্ধ স্মারক সংকলন প্রকাশ করেছেন বেঙ্গলি একাডেমি।
পূজা কীর্তনের কোলাহল, মন্দিরের ধূপের ধোঁয়া, মালা চন্দনের আড়াল থেকে চৈতন্যদেবের সত্য স্বরূপটি খুঁজে পাওয়া কঠিন ছিল দীর্ঘকাল। তঁকে নিয়ে যত গান, পৃথিবীতে আর কোনো মানুষকে নিয়ে বোধহয় এত গান রচিত হয় নি। এটা বিস্ময়ের সন্দেহ নেই। কিন্তু ব্রিভ্রম ও এতেই ঘটছে বেশি। কোনো কোনো পদকর্তার স্থুল হস্তাবলেপ ঘটেছে বৈষ্ণবতত্ত্ব ও শ্রীকৃষ্ণচৈতন্য ভাবমূর্তিতে। কালি লেপেছে কৃষ্ণ কথাতেও। চৈতন্যে শ্রদ্ধাশীল রবীন্দ্রনাথ এতে ব্যাথিত হয়ে কারো কারো প্রতি কটাক্ষ করেছেন বাধ্য হয়ে। চৈতন্যকে অবলম্বন করে বাঙ্গালীর দর্শন চর্চা এক বিশেষ রূপ গ্রহন করেছিল। অনেক বৈষ্ণব পন্ডিত কড়চা রচনা করে এই ধারাটি বজায় রেখেছেন। চৈতন্যদেবের তিরোধানের পর যেসব পদ রচিত হয়েছে তা গৌড়ীয় বৈষ্ণব শাস্ত্রের রসভাষ্য ও ধারক।
শ্রীচৈতন্য কেবল কীর্তন খোলার ঠাকুর নন, তিনি আমাদের অগ্রাভিযানের মহানায়ক। তাঁকে নিয়ে আজ বিশ্বজোড়া ভাবনা চিন্তা হচ্ছে, হবে। তাঁর জীবন থেকে মৃত্যু অবধি সবটাই জ্ঞাতব্য, গভীরভাবে বিশ্লেষণযোগ্য। সেই মহাজীবনের অনেক কিছুই আজ অজ্ঞাত। আবৃত তাঁর মহা মৃত্যুর অনেক রহস্য। আজ চৈতন্যর সম্পর্কে আমাদের নুতন করে জনচেতনার প্রয়োজন।