শ্রীমতি শুক্লা ঘোষ
চোখ থেকে চশমাটা খুলে, হাতের বইটা মুড়ে রেখে, আরামকেদারায় পিঠটা টান করে শুলেন নীহারিকা। এই দুপুরের দিকটা, বারান্দার ধারে এই আরামকেদারায় বসে বই বা খবরের কাগজে চোখ বোলানো তাঁর রোজকার অভ্যেস। ভারী প্রিয় এই সময়টা তাঁর। কোনদিন বই পড়তে পড়তে চোখটা লেগে আসে। দুপুরের রোদটা পড়তেই তাঁর এই বহুতল আবাসনের কচিকাঁচারা, তাঁর ব্লকের পাশের খেলার জায়গাটাতে ভীড় জমায়। তাদের কলরবে ঘুম ভেঙে যায়। অল্পক্ষণের মধ্যেই কিছু কলেজ-পড়ুয়া ছেলেমেয়েরা একসাথে স্বাস্থ্যভ্রমণে বেরিয়ে পড়ে। আবাসনের ভিতরেই তারা হাঁটাহাঁটি চালায়। অধিকাংশের কানেই হেডফোন গোঁজা, তাই কথা বলতে গেলে গলা চড়িয়েই বলতে হয়। তাদের কলকাকলিও তাই কানে আসে। বেশ লাগে। বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যে নামার আগেই, তাঁর রাতদিনের পরিচারিকা মালতী এসে দাঁড়ায় চায়ের কাপ হাতে। চা টা শেষ করে আরামকেদারা থেকে ওঠেন নীহারিকা।
কিন্তু আজকের দুপুরটা অন্যরকম। আষাঢ় মাসের আকাশ, ঘন কালো মেঘে ঢেকে গিয়ে মুষলধারে নেমেছে বৃষ্টি। মালতী গেছে কাছেই কোথাও তার আত্মীয়ার বাড়ি দেখা করতে, এতক্ষণে এসে পড়ার কথা, কিন্তু নিশ্চয়ই বৃষ্টিতে আটকে পড়েছে। আরামকেদারায় গা টা এলিয়ে দিয়ে বাইরে বৃষ্টির দিকে চেয়ে থাকেন তিনি। জল আসার ভয়ে বারান্দার কাঁচের দরজাটা টেনে দিয়েছেন। সেই কাঁচের বাইরে পৃথিবীটা এই মুহূর্তে ঝাপসা। কাছেই কোথাও একটা বাজ পড়ল। এমন দিনগুলোতে, কেন কে জানে, মন পিছন দিকে হাঁটতে চায়। আজও তাই হলো। হঠাৎ করেই বহুবছর আগের, এমনি বৃষ্টির একটা দুপুর ভেসে উঠলো তাঁর চোখের সামনে।
বহুযুগ আগের কথা। তখন তিনি কলেজ-পড়ুয়া। তিনি, অনুত্তমা আর পৃথা ছিলেন অভিন্ন-হৃদয় বন্ধু। এখনও তাই। ছোট্টবেলার স্কুলজীবন থেকে যে বন্ধুত্বের সূত্রপাত হয়েছিল, আজ জীবন সায়াহ্নে এসেও তা একইরকম দৃঢ়। স্কুলের গণ্ডি পেরিয়ে তিনজনই বাংলা অনার্স নিয়ে তখন ভর্তি হয়েছেন, সেকালের এই নামী কলেজটিতে। কিন্তু মিলের এখানেই শেষ নয়। পড়াশোনার পাশাপাশি, তিনজনেরই অদ্ভুতভাবে ছিল অলৌকিকের প্রতি অমোঘ আকর্ষণ। বুদ্ধি দিয়ে যার ব্যাখ্যা চলে না, সেরকম কিছুর খোঁজ পেলেই তাঁদের কৌতুহল বাধা মানত’ না। কলেজের ক্লাসের ব্রেকে একদিন এরকমই কিছু অলৌকিক বা অতিপ্রাকৃত ঘটনা নিয়ে যখন আলোচনা জমে উঠেছে, ঠিক তখনই অনুত্তমা বলে উঠলেন “অ্যাই শোন্, প্ল্যানচেট করবি?” হঠাৎ এমন একটা প্রস্তাবে স্বাভাবিকভাবেই হকচকিয়ে গেলেন বাকি দুই বন্ধু। প্ল্যানচেটের কথা তাঁরা সকলেই শুনেছেন বা পড়েছেনও, কিন্তু নিজেরা প্ল্যানচেট করার ভাবনাও কখনো মাথায় আসেনি। তাঁদের দ্বিধা দেখে অনুত্তমা আস্তে আস্তে আসল সত্যটি উদ্ঘাটন করেন। বলেন যে তাঁর নিজের দিদি, যাকে নীহারিকারা খুব ভালো করেই চেনেন, তার বন্ধুদের সঙ্গে একদিন প্ল্যানচেট করেছে, এবং সত্যি সত্যি কোন আত্মাকে ডেকে এনে, তার কাছ থেকে অনেক প্রশ্নের উত্তর জেনেছে। এই তথ্য জানার পর স্বভাবতই চাঞ্চল্য বাড়ে এবং অনেক দোনামনা করে তিনজনই শেষ পর্যন্ত সহমত হলেন, যে প্ল্যানচেট করবেন। জায়গার অসুবিধে নেই। অনুত্তমার ঠাকুর্দার মৃত্যুর পর, তাঁরা সদ্য তাঁদের রূপচাঁদ মুখার্জি লেনের পুরোনো বাড়ি ছেড়ে, কাছেই একটি নতুন বাড়িতে উঠে গেছেন। পুরোনো বাড়িটি তখন তাই ফাঁকাই পড়ে থাকে, যদিও সেখান থেকে সব আসবাব তখনও সরানো হয়নি। তিন বন্ধুতে ঠিক করে ফেললেন যে একদিন ক্লাসের পর, সিনেমা যাওয়ার নাম করে তাঁরা চলে যাবেন অনুত্তমাদের পুরোনো বাড়িতে এবং সেখানে গিয়েই হবে তাঁদের প্ল্যানচেটের হাতেখড়ি। যেমন ভাবা তেমনি কাজ। সপ্তাহখানেক বাদেই একদিন কলেজের পর তিন বন্ধু দুরু দুরু বুকে পৌঁছলেন অনুত্তমাদের আগের ঠিকানাতে।
কি কি লাগবে জানাই ছিল। চারটে আসন, ধূপ, গঙ্গাজল, মোমবাতি, একটা শ্লেট আর চক। সেদিনের দুপুরটাও ছিল ঠিক আজকের মতো আষাঢ়ের একটা ঘনঘোর দুপুর। তাঁরা অনুত্তমাদের বাড়িতে ঢোকার পরে পরেই নেমেছিল মুষলধারে বৃষ্টি। ঘরের ভিতর আলো আসলে চলবে না, তাই যে ঘরটি তাঁরা বেছেছিলেন, তার সব দরজা জানলা বন্ধ করে দিলেন তিন বন্ধু। ঘরের ভিতরে তখন নিশ্ছিদ্র অন্ধকার। তাড়াতাড়ি মোম জ্বালালেন পৃথা। এতক্ষণ পর্যন্ত তিন বন্ধুতে হাসিঠাট্টা ভালোই চলছিলো, কিন্তু অন্ধকার ঘরে মোমের আলোয় নিজেদের লম্বা ছায়াগুলো দেওয়ালের ওপর পড়তে দেখে, তিন বীরাঙ্গনারই কেমন যেন ভয় ভয় করতে লাগলো। যাইহোক, এতদূর এগিয়ে তো আর পিছিয়ে আসা যায় না। অনুত্তমার থেকে নিয়মগুলো ভালো করে বুঝে নিয়ে, তিন বন্ধু বসে পড়লেন গোল হ’য়ে। গঙ্গাজল ছিটিয়ে ধূপ জ্বালা হলো। মাঝে রইল মোমবাতি, শ্লেট আর চক। নীহারিকার ডানপাশে অনুত্তমা আর বাঁ পাশে পৃথা। উল্টোদিকের একটা আসন শূন্য রাখা হলো। আয়োজন তো হলো ভালোই কিন্তু আসল কথাটাই তো ভাবেননি তাঁরা। প্ল্যানচেট করে ডাকবেন কাকে? কিছুক্ষণ জল্পনা কল্পনা চলার পর হঠাৎ করে অনুত্তমাই বললেন “চল না দাদুকেই প্ল্যানচেট করি! দাদুকে তো তোরা দুজনেই খুব ভালো করে চিনতিস।” তিনজনেই সহমত হলেন। চোখ বন্ধ করে তিন বন্ধু একাগ্রমনে ভাবতে থাকলেন অনুত্তমার দাদুর কথা।
তিনজনের ডানহাত একসঙ্গে শ্লেটের ওপরে, তাতে চকটি ধরা আছে। ঘরে পিন-পড়া নিস্তব্ধতা। বাইরে মুষলধারে বৃষ্টি পড়ার শব্দ। বেশ খানিকক্ষণ চুপ করে থাকার পর অনুত্তমা প্রশ্ন করলেন, “দাদু, তুমি কি এসেছো?” কোন শব্দ নেই। একটুক্ষণ চুপ করে থাকার পর আবার একই প্রশ্ন। এবং এবারেও নীরবতা। তৃতীয়বার প্রশ্নের পর হঠাৎ নড়ে উঠল তিন বন্ধুর হাতে ধরা চক। “হ্যাঁ “। নিঃশ্বাস কেঁপে গেল তিনজনেরই। আরো বেশ কয়েকটা প্রশ্ন ভাবা ছিল আগে থেকেই। বেশিটাই তাঁদের আগামী পরীক্ষার ফল সংক্রান্ত। উত্তর এলো সবকটারই। পৃথা তাঁদের মধ্যে চিরকালই সবচেয়ে নরম মনের। তিনি এবার বিদেহী আত্মার উদ্দেশ্যে প্রশ্ন রাখলেন, “দাদু, আপনার কি এইভাবে এখানে থাকতে কষ্ট হচ্ছে?” শ্লেটে ফুটে উঠল “হ্যাঁ “। সবে পৃথা বলতে যাচ্ছেন যে “আজকের মতো তবে এখানেই থাক।”, হঠাৎ করে কি দুর্বুদ্ধি চাপলো নীহারিকার মাথায়। চিরকালই তিন বন্ধুর মধ্যে সবচেয়ে ডানপিটে তিনিই। হঠাৎ করেই কিঞ্চিত মজার ছলেই তিনি বলে উঠলেন, “দাদু, আপনি যদি সত্যি এসে থাকেন তাহলে পৃথার উপর ভর করুন।” বলা মাত্রই বুঝলেন কত’ বড় ভুল করেছেন! অনুত্তমা চাপা তিরস্কারের কন্ঠে বলে উঠলেন “এটা কি করলি ?” ততক্ষণে চোখ খুলে তাকিয়েছেন তিনজনই। পৃথার মুখ ভয়ে বিবর্ণ হয়ে গেছে, থরথর করে কাঁপছেন তিনি। হঠাৎ তাঁকে দেখে মনে হলো, তাঁর কিছু একটা কষ্ট হচ্ছে। চোখমুখ লাল হয়ে যাচ্ছে, বদলে যাচ্ছে চোখের ভাষা। অনুত্তমা প্রাণপণে বলে উঠলেন “দাদু, তুমি নীহারিকার কথায় রাগ কোরো না। তুমি তো জানো ও কিরকম ছেলেমানুষ। তুমি পৃথার কোন অনিষ্ট কোর না। ততক্ষণে সম্বিত ফিরেছে নীহারিকারও। বন্ধুর কষ্ট দেখে তিনি তখন আকুল কন্ঠে বারবার বলে চলেছেন “দাদু আমার অন্যায় হয়ে গেছে। আমাকে ক্ষমা করে দিন। আপনি পৃথার কোন ক্ষতি করবেন না। আপনি আজকের মতো ফিরে যান। দুই বন্ধুর এই আকুল অনুরোধ আরো খানিকক্ষণ চলার পর, হঠাৎ যেন নিস্তেজ হয়ে পড়লেন পৃথা। আচমকা প্রেশার ফল করলে মানুষের যেমন হয়, অনেকটা সেরকম। তারপর একটু জল খেয়ে, অনেকটা সময় নিয়ে, আস্তে আস্তে ধাতস্থ হলেন পৃথা। লজ্জায়, ভয়ে পৃথাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেললেন নীহারিকা। শুধু বলতে থাকলেন “আমায় ক্ষমা করে দে, আমায় ক্ষমা করে দে।” তবে তাঁরা সকলেই বুঝলেন যে বিপদ কেটে গিয়েছে। তাড়াতাড়ি উঠে সব জানলা দরজা খুলে দিলেন অনুত্তমা। বাইরে তখন বৃষ্টি থেমে গেছে। বর্ষার মেঘ কেটে গিয়ে ঝলমলে রোদ উঠেছে। বাইরের উজ্জ্বল আলো হাওয়ায়, কিছুক্ষণ আগের সেই অভিজ্ঞতা যেন অলীক বলে মনে হলো। বাড়ির বড়দের কাউকে এসব কথা ঘুণাক্ষরেও না জানানোর অঙ্গীকার করে, তিন বন্ধু যে যার বাড়ি ফিরে গেলেন সেদিনের মতো।
কত লম্বা সময়ে যে অতীতে ডুবে ছিলেন নীহারিকা! ডোরবেলের তীক্ষ্ণ আওয়াজে সম্বিত ফিরল তাঁর। খেয়াল করেননি কখন বৃষ্টি ধরে এসেছে। ঘরে এখন ছায়াছায়া অন্ধকার। নিশ্চয়ই মালতী ফিরল। দরজার দিকে পা বাড়াতে যাবেন, হঠাৎ পাশের টেবিলে শব্দ করে বেজে উঠল মোবাইলটা। হাতে নিয়ে স্ক্রিনে ফুটে ওঠা নামটা পড়ে প্রথমে যেন জোর ঝাঁকুনি খেলেন নীহারিকা। পৃথা। পরমূহুর্তেই নিজের মনে হেসে উঠলেন, এখনো তাহলে তাঁদের মধ্যে টেলিপ্যাথি কাজ করে!!
বিঃ দ্রঃ – এই গল্পের সব ঘটনাই সত্যি এবং সেই দুপুরে প্ল্যানচেট থেকে জানা তথ্যগুলো সবই পরবর্তীকালে মিলে গিয়েছিল।