Home বিবিধ, গল্প নিজগৃহে উপেক্ষিতা
বিবিধগল্প

নিজগৃহে উপেক্ষিতা

শর্মিষ্ঠা সেন

কাব্যে উপেক্ষিতা শুনেছেন তো? অবশ্যই শুনেছেন, শোনবারই কথা, ইনিয়ে বিনিয়ে এসব অনেক কিছু পড়তে হয়েছিল ছাত্রজীবনে, নাকি ‘ছাত্রীজীবন’ বলবো? সেসব যেমন পড়েছি তেমন ভুলেও মেরে দিয়েছি, কিন্তু এখন সংসার করছি আর পদে পদে বুঝছি উপেক্ষিত হতে কেমন লাগে! আবার সেইসব গল্প, উপন্যাস, কবিতা ফিরে ফিরে পড়ি, আর ভাবি, সিলেবাস কারা ঠিক করেন? চপল বয়সে জোরজার করে ঐসব ভারী ভারী জিনিসপত্র পড়তে দিয়ে খামোখা ছেলেপিলে কে সাহিত্য বিমুখ করে তোলা (ভালো‌ ছেলেমেয়েরা পার্সোনালি নেবেন না, বোঝানোর জন্য বললাম আর কি!)। ‘রামের বিলাপ’ পড়ে স্কুলে খালি তুলনাই খুঁজে গিয়েছি, কোন রাম কোন সীতার বিহনে মণিহারা ফণি! মনে আছে বন্ধুগণ? আহা! মনে করতে বলেছি শুধু,‌ লেখা পড়ে গুছিয়ে কমেন্ট করার কথা ভেবে থাকলে হাত গুটিয়ে নাও বাপু, ঘরে ঘরে আগুন লাগানো এই কাঠফাটা গরমে? মোটেও ঠিক হবে না! আগুন লাগাতে হয় মাঘ মাসে টাসে, তাতে করে আগুন নিভে যাবার পর বেশ উমো উমো তাপে হাত পা সেঁকে বিবাহ-পরবর্তী দিনগুলোয় ফিরে যাওয়া যায়! নাকি? আহা কিসব সোনালী দিন ছিল সেসব! অতীত অতীত! যা গেছে তা মাথা কুটলেও ফিরে আসপে না গো! তা যে কথা হচ্ছিল, উপেক্ষিত থাকার কথা…

যেমনটা সবসময় হয়, আজও হলো, নতুন কিছু নয়, মাছ কড়ায় দেব দেব করছি আর ভাবছি আধখানা লিখে ফেলে রাখা গল্পটার কথা, প্রায় হপ্তাখানি ফেলে রাখা। আসলে হয়েছে কি, গল্পটার প্রধান প্রমুখ চরিত্র হনুমান, আজ্ঞে একদম ঠিক দেখলেন, হনুমানই! এখন তো হনুমানেরই বাজার! আরে ধুর মশাই, সব কিছুতে রাজনীতি টানবেন না, বলি পশু সংরক্ষণ, পশুপ্রেম এসব শোনা আছে তো নাকি? ধৈর্য ধরে পড়ুন। এবার লিখতে গেলে একটু হলেও আমায় হনুর জুতোয় পা গলাতে হচ্ছে! আমি তো আর অ্যাকচুয়াল লিখিয়ে নই যে চুরি ডাকাতি না করেও দিব্যি একখানা রোমহর্ষক লেখা নামাতে পারব, যা পড়ে আপনি মনে মনে একটু হলেও সন্দেহ প্রকাশ করবেন, মহিলা নির্ঘাত ডাকাত দলের অ্যাডভাইসার! আমাকে নিরন্তর ঐ প্রসেসে, মানে হনুমানের সাথে ভার্চুয়াল সহাবস্থানে থাকতে হচ্ছে… যেমন, এই কড়া ভর্তি গরম তেলের সামনে এলে হনুর রিঅ্যাকশন কী হবে? একটু তো আঙুল ছুঁইয়ে দেখবে…তারপর ছ্যাঁকা খেয়ে দারুণ লাফ মেরে সোজা ডাইনিং টেবিলে, সেখান থেকে আলুর ঝুড়িতে নজর, ওমনি ছ্যাঁকা ভুলে কচর কচর করে আলু তুলে মুখব্যাদান করে খাওয়া, বেগুনটা তুলে নেড়েচেড়ে ছুঁড়ে ফেলা ….তারপর একটু বেসিনের কাছে গিয়ে কলের মুখ খোলার চেষ্টা… এদিকে ঘরের মানুষগুলো সিঁটিয়ে সব একঘরে ধাঁ, ল্যান্ড কেবলের তার খুলে মুলে ছিটকে ল্যাপটপ সমেত তিনি ঘরে, মেয়ে ঠকঠক করে কম্পমান দরজার কোণে, শ্বশুরমশাই চিঁ চিঁ করে ডাকছেন, ‘ও মামনি গো, তোমার কি হবে গো!’ শাশুড়ি খুঁজছেন মশা মারার ব্যাট, যাতে করে হনুব্যাটা কে দু ঘা দেওয়া যায়…. এদিকে কড়ার তেল গরম হয়ে গিয়ে বার্নিং পয়েন্টের চরম সীমায় পৌঁছে গেছে….চিমনি চালানো হয়নি, ঘরময় ধোঁয়া, টের পেয়ে পেটির মাছ ছাড়তেই জাস্ট কুঁকড়ে রোল এবং ডান হাতে‌র পাতায় তেলের ব্যাকভলি! এদিকে মুখে তো হাসি। দিব্যি একখানা মজাদার ‘সিন’ রচনা করা গেল, এইতো এবার আবার গল্পের গরু গড়গড়িয়ে গাছে উঠবে…ভাবলাম, যাই গিয়ে বলি তাঁকে, উঁহ্ মা! কিসের কি! এমন ভ্রূকুটি কুটিল চেহারা, মনে হলো এর চে গন্ডার হাসানো সহজ হবে। গেলাম একদম নিজের হাতে পায়ে মানুষ করতে থাকা মেয়ের কাছে।‌ সে অঙ্ক করছিল‌। বললাম, কিরে সেই ভ্যানিশ হওয়া অঙ্ক করছিস? সে মহা খচে মচে উত্তর দিল, ‘মা ঠিকঠাক টার্ম ইউজ করো তো! ভ্যানিশিং মেথড! এমনিতে হচ্ছে না!’ বুঝলাম এও শুনবেনা। আর কাকে কি বলবো! বাকী দুজনের কথা নাই বা বললাম। শ্বশুরবাড়ির লোকজন সর্বত্র ওৎ পেতে! এফ.বি তে, হোয়া গ্রুপে সাইলেন্ট থেকে দিনরাত স্টকিং। একটু বেফাঁস হালচাল দেখলেই গুজুর গুজুর, ফুসুর ফুসুর! অতএব চলে এলাম রান্নাঘরে।‌ বুঝলাম সবার পেট ভর্তি, তাই আপাতত আমি ইনভিজিবল! জলখাবারের অমলেট, পরোটা হজম হয়নি এখনও। মাছ ভাজা হতে হতে আরো একখানা হাস্যকর সিচুয়েশন ভেবে ফেললাম। এবার একা একাই ব্যাপারটা উপভোগ করে ভাবলাম এবার আর সম্পাদক মশাই বাতিলের ঝুড়িতে ফেলতে পারবেন‌ না। বলেছি নাকি গত মাসে তিনখানা গল্প বাতিল হয়েছে? কি কষ্ট! সর্বত্রই উপেক্ষা! এমনই তো হয়, হয়ে আসছে!

এ্যাদ্দিন তাও অফিস ছিল, রাত বিরেতে ঘরে ফিরে একটা ‘কইগো’ ডাক বরাদ্দ ছিল, এখন করোনা কালে দেড় বছর চব্বিশ ঘন্টা পাশাপাশি কাছাকাছি থাকার ফলে যত তাঁকে দেখছি তত ম্যাগনেটিজম চ্যাপ্টারের সমস্ত কিছু মনে পড়ে যাচ্ছে! হায় কোথায় গেল সেইসব দিন যখন ১৫০ কিলোমিটার দূর থেকেও অনুভব করা যেত সম্পর্কের উত্তাপ! এখন আমি হয়েছি ওই খরখরে খেজুর গাছের মতো, তিনি কাছে আসতে ভয় পান বোধহয়, ঠিকঠাক উঠতে নামতে না পারলে গা গতর ছুলে যাবার ভয় কিংবা হালফিলের এই সামাজিক দূরত্বের অভ্যাস, কাছে না ডাকার অন্যতম কারণ! অথচ আমার মধ্যকার রস আজও প্রবহমান। শুধু তিনি বুঝতে পারছেন না। তাঁর পাশটিতে বসে চাতকের মতো ‘মুখপানে চেয়ে’ থাকলেও ফিরতি কিছু পাওয়া যাচ্ছে না। মনোযোগ সব ঐ ল্যাপটপে! অথচ কি আশ্চর্য, চাকরির বয়স আর বিয়ের বয়সের ফারাক ধরে হিসেব করলে আমার এতটা অমনোযোগ পাওয়ার কথা নয়।

বাড়ির মানুষের পাশে পাশে একটু বসে থেকে মুখের কথা বুকে চেপে ফেরে আসি নিজের গর্তে, বসে থাকি বাগানে। গাছেদের চেহারা বৈশিষ্ট্য দেখে চিড়িক দিয়ে বদ বুদ্ধি মাথায় আসে। মনে হয়, নিকুচি করেছে মনোযোগের, বরং এদের সংস্পর্শ বাঁচিয়ে নিজের কাজগুলো করে ফেলি ঝটপট। ‘বেবিজ টিয়ার্স’ গাছের মতো। ওরা ক্রিপার। কিন্তু আলোর দিকে ধেয়ে যায়। আমি উঁচু আংটায় টবে রেখেছিলাম ওদের, একটু ছায়া ছায়া জায়গাটা, কিন্তু দেখলাম অনেক নতুন শাখা উপশাখা বার করে খুব সুন্দর করে নিজেকে মোহময়ী করে তুলেছে আরো। কিছু গাছ আছে না রোদ্দুর না পেলে বাড়েও না ফুল ও ফোটায়না, এ তাদের মতো নয়। ঠিক খুঁজে নিয়েছে আলোর উৎস। অভিমানী হয়নি কোন এক বদ দুপেয়ে রোদ থেকে সরিয়ে দিয়েছে বলে। বরং শিখিয়েছে, দ্যাখো বাপু, কেউ মাথায় তুলে বসিয়ে রাখেনি বলে কাঁদুনি গেয়োনা, নিজের আলোটুকু নিজে খুঁজে নাও।

অতএব, অপেক্ষায় বসে থাকা আর নয়, উপেক্ষা করুন জনগণকে। তোমরা কাজের মানুষ তাতে কি, আমার অকাজ নিয়েই আমি ব্যস্ত থাকতে পারি বেশ। দিব্যি দুপুর গড়িয়ে সন্ধ্যে নেমে গেল। আরাম করে এককাপ চা খেয়ে আবার কিছু অকাজ করব’খন। এই তো জীবন! ভালো থাকুন সকলে।

চিত্র সৌজন্য https://images.app.goo.gl/vPr1Q9rsqsqVF8nN8

Author

Du-কলম

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!