সুব্রত ঘোষ
ক’টা বাজে? পকেটে মোবাইল থাকা সত্ত্বেও অনেকদিনের অভ্যাসে কব্জি ঘুরিয়ে হাতঘড়িতে সময় দেখার চেষ্টা করলাম, কিন্তু কিছুই দেখা গেল না। একমাত্র খানিকটা কালো মতো অন্ধকার ছাড়া। দেখলাম আমার সাদা ডায়ালের হাতঘড়ি কখন যেন কিভাবে এইচ.এম.টি-র ব্ল্যাক ডায়াল পাইলট ঘড়ি হয়ে গেছে, আর ভেতরের সেই কালো অন্ধকারটা একটা সোনালী বলয়ের মধ্যে আটকে আছে। তবে বড় ছোট কোনো কাঁটাই চোখে পড়লো না। মনে পড়লো আমি দোকানে গিয়ে এইচ.এম.টি-র ব্ল্যাক ডায়াল পাইলট ঘড়িটাই কিনতে চেয়েছিলাম, কিন্তু আউট অফ স্টক থাকায় আমার ভাগ্যে জোটেনি। আসলে বড় বড় হোমরা চোমরাদের ডিমান্ড মেটাতে ব্যস্ত কিছুদিন পরেই হোল্ডিং কোম্পানি হয়ে যাওয়া দেশী এক ঘড়ির কোম্পানি আমাদের মতো চুনোপুঁটির খেয়াল রাখাটা খুব দরকারি মনে করেনি। অগত্যা সাধারণ সাদা ডায়ালের ঘড়ি কিনেই ড্যাং ড্যাং করে ফিরেছিলাম। তবুও তো এইচ.এম.টি-র ঘড়ি! সেই থেকে ঘড়িটা আমার বাঁ হাতের কব্জিতে, গাড়ি কিনে পুজো দেবার পর আমার ছেলের ডান হাতের কব্জিতে পার্মানেন্টলি বাঁধা লাল-হলদে ধাগার মতো — সর্ব ক্ষণের জন্য আছে। যাই হোক্, সাদা ডায়ালের সাধারণ ঘড়ি হোক বা কালো ডায়ালের পাইলট ঘড়িই হোক কোনো ঘড়িতেই যখন কাঁটা দেখা গেল না, তখন চেষ্টা করলাম ডিটেকটিভের মতো চোখ কুঁচকে আর রঘু ডাকাতের মতো ড্যাব ড্যাবে চোখে সময় দেখতে। যখন তাতেও বিফল হলাম, তখন মাথা ঘুরিয়ে চারপাশের নীলচে ধোঁয়া ধোঁয়া ভাব দেখে অনুমান করে নিয়ে মনকে বোঝালাম যে সময়টা খুব সম্ভবতঃ রাত আর ঊষাকালের সন্ধিক্ষণ হবে। গাছগাছালির ছায়ায় এদিক ওদিকে ছড়িয়ে থাকা কয়েকটা ইঁট সুরকির বাড়ি সামনের পুকুরের জলে উল্টো হয়ে মাথা ডুবিয়ে থেকে হাওয়া লাগা পুকুরের জলের হাল্কা ঢেউয়ের সঙ্গে কেঁপে চলেছে। চোখ সরিয়ে দৃষ্টি দূরপ্রসারী করতেই মনে হোলো সেই নীলচে অন্ধকারের মধ্যেই কেউ যেন হাওয়ায় গা ভাসিয়ে টিভি বা সিনেমায় দেখা বিজ্ঞাপনের মতো স্লো মোশানে ছুটতে ছুটতে আমার দিকেই আসছে। অবাক বিস্ময়ে আমি তাকাতেই হঠাৎ করে চারিদিক কেমন মন ভালো করা গাঢ় গোলাপী আলোয় ভরে গেলো আর ঠিক সেই সময়ই আনন্দ উপচে পড়া ঝকঝকে চোখে একমুখ হাসি নিয়ে ছুটে আসা মেয়েটিকে আমি চিনতে পেরে গেলাম। এগারো-বারো বছরের ফ্রকপরা আমার খুব চেনা ভীষণ ভালো লাগা মিষ্টি মেয়ে আলেয়া!
ততক্ষণে আমিও হঠাৎ তেরো চোদ্দ বছরের বয়ঃসন্ধিক্ষণে। আনন্দে বিগলিত আমার মনটা কেমন তড়াক করে লাফিয়ে উঠলো। দুজনেই দুজনকে চিনতে পেরেছি। হাসি হাসি মুখে দুজনেই দুজনের দিকে তাকিয়ে আছি। আনন্দে আটখানা হয়ে হাসতে হাসতে দুজনে দুজনের দিকে হাত বাড়িয়ে এগিয়ে গেলাম। একে অন্যের আঙ্গুল ছুঁয়ে ছুঁয়ে হাত ঘুরিয়ে হ্যান্ডশেক করতে যাবো্, সেই মুহূর্তে সামনের দৃশ্যটা আমূল বদলে গেল !
কলেজে ইকোর স্মার্ট ইয়াং প্রফেসর কে.বি.-র সঙ্গে সিম্পল সাদামাটা কিন্তু হঠাৎ করে ইদানিং সাজুগুজুতে মন দেওয়া মজে যাওয়া রেণুদির বাংলা ক্লাস বাঙ্ক করে সকলের নজর এড়িয়ে কলেজের এক কোণে গায়ে ছাই মাখা সন্যাসীর মতো আদ্যোপান্ত সাদা সাদা ছোপ নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা পুরোনো ইউক্যালিপ্টাস গাছের নীচে শাড়ি ঢাকা হাঁটুতে মুখ রেখে ফার্স্ট ইয়ারের আলেয়া ওর ওয়ান ইয়ার সিনিয়র আমার সঙ্গে ‘টু বি অর নট টু বি’ নিয়ে গভীর আলোচনায় রত। মাঝে মাঝেই দুজনে নির্বাক হয়ে একে অন্যের চোখের মধ্যে কিছু খুঁজছি নয়তো ঠোঁটে লজ্জা লজ্জা ভাবের স্মাইল টেনে মুখ নিচু করে ‘লাভস মি, লাভস মি নট্’ ব্যাপারে সিওর হবার জন্য ঘাস ফুলের পাপড়ি ছিঁড়ছি মন দিয়ে।
একটু পরেই আবার দৃশ্য বদল। চারদিকে ডিস্কো ফ্লোরের লাল নীল হারা পিলা বেগুনি সাদা জামুনি সব আলোর ঝ্যাক্ ম্যাক্ ঝলকানি। তার সঙ্গে রবীন্দ্রসঙ্গীত ক্লাসিক্যাল হিট ফিল্মি নাম্বার্,রঅ্যাপ ইত্যাদি সব রকম পুরোনো নতুন মিউজিক মিলিয়ে মিশিয়ে তৈরি ফিউশনের যথেচ্ছ বর্ষণে “অনেক দিনের অদর্শনের পরে দেখা পেয়ে মনে উঠেছে ভরে”, মাত্র এই কথাগুলো জানাতেই গলার শিরা ফুলিয়ে চেঁচাতে হচ্ছে সকলকে। জানুয়ারীর শেষে ঠান্ডা হাওয়া ভারি হয়ে উঠেছে নানান্ রকমের ফ্রায়েড স্টার্টার্, লুচি পোলাও্, চিংড়ি মাছের মালাইকারি্, মাটন দো পিঁয়াজি, ফিস ফ্রাই্, কাটলেট্, রোস্টেড চিকেন, রোস্টেড পনীর প্লাস দেশী ঘীয়ের হালুয়া, জিলিপি এই সবের সেকুলার গন্ধে। তার উপর রয়েছে সুবেশ সুবেশা অতিথি অভ্যাগতদের শরীর উপচে বেরিয়ে আসা কতো রকমের দেশী বিদেশী সেন্টের তেলচিটে্, হাল্কা বা উগ্র গন্ধ। সেই সব ককটেল গন্ধের সঙ্গে ডিজে-র কান ফাটানো সাউন্ড পাঞ্চ করে দেওয়া বাতাসের মধ্যে আলেয়ার মা-বাপের সিলেক্ট করা খরগোশের মতো দাঁত উঁচু বরটার পাশের চেয়ারে বসে খেজুরে আলাপের সময় মাঝে মাঝে আলেয়ার সঙ্গে চোখে চোখে আগেকার অনেক না-বলা-কথা সারতে সারতে আমি সেরে ওঠা কোভিড পেসেন্টের মতোই ক্লান্ত! আমার ভিতরে তখন রাগ অনুরাগ্, ক্রোধ্, হতাশা্, হিংসা্, কান্না্,ক্ষোভ বিতৃষ্ণা্, মাৎসর্য্য ইত্যাদি বহু রকম অনুভূতির তালগোল পাকানো একটা বড় ডেলা হৃদয় ছেড়ে গলা আর পেটের ফ্রি প্যাসেজের মধ্যে ওঠানামা করে মাঝে মাঝেই গা গুলিয়ে দিচ্ছে আর আলেয়ার এতদিন ধরে দেখা উপরের ঠোঁটে ন্যাচারাল কালো তিলের বিউটিস্পট সহ সুন্দর মুখটা ক্রমশঃ দূরে সরে যাচ্ছে – আবছা হতে হতে ক্রমেই হারিয়ে যাচ্ছে!
আমার দম আটকানো অবস্থায় যতই ওকে হাত দিয়ে থামতে বলছি্, ততই চোখে মুখে একটা ব্যথার হাসি ফুটিয়ে রেখে আলেয়া হারিয়ে যাচ্ছে। আমার বুক পেট আর গলার কম্বাইন্ড এফর্টে শুধুমাত্র একটু গোঙানির আওয়াজ বেরিয়ে এলো। নিদারুণ হতাশায় ওই দাঁত উঁচু বরের কাঁধে আমার মুখটা নেমে আসতে আসতেই আবার সেই শেষ রাতের নীলচে ধোঁয়া ধোঁয়া ভাবের আলোটা ফিরে এলো। দাঁত উঁচু বরটা আমাকে সান্ত্বনা দিতে ডান হাত তুলে আমার মাথাটা ওর রজনীগন্ধার মোটা মালা আর সোনার চওড়া চেন পরা গুচ্ছের পারফিউম ঢালা বৃষ-সদৃশ কাঁধে চেপে ধরার চেষ্টা করতেই সেই নীলচে কুয়াশার মধ্যে হঠাৎ আবার এক নাইটি পরা ফিগারের উপর স্পটলাইট! আগের মতোই দু’হাত বাড়িয়ে ছুটে আসছে আমার দিকে স্লো-মোশনে। দাঁতুর ঘাড়ে থুতনি ঠেকিয়ে আমি জুলজুল করে দেখছি। ক্রমেই পরিষ্কার হচ্ছে নাইটি পরা শরীরটা। যত কাছে আসছে ততই মনে হচ্ছে যেন কত চেনা। তার গলায় ঝুলছে বিরাট একটা গোড়ে মালা। ওর ঈষৎ ভারী বুকের উপর ঝুলতে থাকা গোড়ে মালাটা ছোটার সঙ্গে সঙ্গে এদিক ওদিক দুলে সমস্ত ব্যাপারটাকে অন্য এক মাত্রায় পৌঁছে দিচ্ছে। হঠাৎ আমার মন আড়চোখে তাকিয়ে ভাবে বিভোর মহাপ্রভুকে নগর পরিক্রমা করতে দেখলো। আমি সজাগ হয়ে উঠে মনটাকে বর্তমানে টেনে এনে আবার সমস্ত একাগ্রতা নিয়ে ওর দিকে তাকালাম। এখন অনেক পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছি। ওর গায়ের সেই চেনা গন্ধ এখন আমার নাকে এসে লাগছে – আমাকে উস্কাচ্ছে। ওর ফুটন্ত ছুটন্ত দেহবল্লরী মন ছেড়ে আমার শরীরের স্নায়ুতে টান দিচ্ছে। কি অমোঘ সে টান! চোখের সামনে এখন বারো বছরের ফ্রক্, ইউক্যালিপ্টাস গাছ্, ঘাসফুলের ছেঁড়া পাপড়ি, ঝাঁ চকচকে বিয়েবাড়ি — ডি জে – বেনারসী শাড়ি – দাঁতউঁচু বর পর্যন্ত প্যানোরামিক দৃশ্য সব আসছে ফিরে ফিরে। উত্তেজনায় আমি ওর কাঁধ থেকে থুতনি সরিয়ে নিয়েছি। ভাবতেই চাইছি না ওই কাঁধ আমাকে আশ্রয় দিতে চাইছিলো। এই মুহূর্তে মন ভীষণভাবে চাইছে ছুটে গিয়ে ওকে ‘হাগ’ করতে—শরীর চাইছে আরো অনেক কিছু করতে। মন চাইছে ও আরোও একটু দৌরে এসে একবার হোঁচট খাক। আমি ম্যানড্রেকের মতো সামনে অবতীর্ণ হয়ে ওর পড়তে থাকা দেহখানি তুলে ধরবো ওর মুখে রবীন্দ্রসঙ্গীত শুনতে শুনতে। খরগোশদাঁতু বরের কাছ থেকে সরে এসে ফিল্ম ডাইরেক্টরের মতো সিচুয়েশনটা ওকে বুঝিয়ে দিতে চাইলাম কিন্তু ও শুনতে পেল না। আমি তা ভ্রুক্ষেপ না করে শিকারের উপর নজর রাখা বাঘের মতো লাফ মারতে যাবো্, ঠিক সেই মুহূর্তে বিরক্তিকর একটা সহানুভূতি ঝরানো আওয়াজের সঙ্গে জোরালো আলোয় চোখ ধাঁধিয়ে গেল্, “তুমি কার সঙ্গে অতো হাত পা নাড়িয়ে কথা বলছিলে গো ? ইস্স্, কতো ঘেমেছো তুমি! এখনো তো বেশ ঠান্ডা রয়েছে – তবু ঘামছো!”
সুব্রত ঘোষ
সুব্রত ঘোষ কবি ও লেখক হিসাবে দিল্লিতে বিশেষ পরিচিত একটি নাম। প্রায় পাঁচ দশক আগে কর্মসূত্রে দিল্লিতে আসেন এবং গ্রুপ থিয়েটারে অভিনয়, যাত্রাভিনয় এবং বাচিক শিল্পী হিসাবে যথেষ্ট প্রতিষ্ঠা পান। পরবর্তীকালে সুব্রত ঘোষ কবিতা লেখা ও সাহিত্য সৃষ্টিতে মন দেন। তাঁর লেখা কবিতা, রম্যরচনা, গল্প, প্রবন্ধ, নাটক ইত্যাদি পশ্চিমবঙ্গ, মুম্বাই ও দিল্লির বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় এবং ই-পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে বা হচ্ছে। সুব্রত ঘোষ উত্তরবঙ্গ নাট্যজগৎ দ্বারা 2018 সালে ‘বিশিষ্ট কবি’-র স্বীকৃতি ও সম্মান লাভ করেছেন। তাঁর প্রকাশিত কবিতার বই ‘ইচ্ছে পাখি’ পাঠক ও গুণীজন দ্বারা সমাদৃত। সুব্রত ঘোষ দিল্লির ‘দ্যুতি সাহিত্য সভার’ একজন দায়িত্বশীল ব্যক্তি। তিনি একটি আন্তর্জাতিক সাহিত্য সংস্থার সঙ্গেও যুক্ত।