Home বিবিধ, গল্প ইঁদুরকল, চড়কষষ্ঠী ও মৃত্যু
বিবিধগল্প

ইঁদুরকল, চড়কষষ্ঠী ও মৃত্যু

লেখক : দীপঙ্কর ঘোষ

হাতুড়ে সন্ধ্যার‌ আলোকে ঘরে বসে স্মৃতিচয়ন করছিলেন। বাঁকুড়ার কারেন্টবিহীন‌ অন্ধকার রাত। ছোট্ট হাতুড়ে তখন লন্ঠনের‌ আলোয় সায়মাশ (সয়ম্+আশ =সন্ধ‍্যাহার) করছেন। একটা বাটিতে কেঁচোর মতো কত গুলো কী রয়েছে।

“ম্মা! ও-ম্মা! ইদিকে আয়! তরকারিতে পোকা!”

(ওনাদের তুই তোকারি সম্পর্ক ছিলো)

ওনার ডাক্তার‌ এবং মা জীবনানন্দ ছেড়ে দৌড়ে এলো।

“এ মা! ওগুলো পোকা নয়- মাছের তেলের তরকারি রে!” (ছোট ছোট রুই মাছের তেল)। সেই প্রথম চাঁটগাঁইয়া ঝালঝাল টকটকে লাল মাছের তেলের তরকারির সঙ্গে হাতুড়ের পরিচয়। ভাবতে ভাবতে যখন হাতুড়ের টাক‌ আর চোখ হাসিতে চকচক করছে, এমন সময় হঠাৎ মুঠোফোন বেজে উঠলো টুংটুং করে।

হাতুড়ে ঘড়ঘড়ে গলায় বললেন, “হ‍্যালো হাতুড়ে বলছি “

“আমি বিপন্নবিস্ময় বিশ্বাস বলছি। বড্ড বিপদে পড়েছি…”

“বিশদে বলুন।”

“আমার জ্বর কাশি আর শ্বাস কষ্ট- গরম পড়ার মুখটাতে- বছরে কয়েক বারই হয়-“

“তারপর বলুন বিপন্নবাবু।”

“আমি হোমিওপ্যাথি করছিলাম।”

“আপনি হোমিওপ্যাথি করেন? “

“না, আমি হোমিওপ্যাথি চিকিৎসা করি।”

হাতুড়ে বিস্মিত হলেন।

“তারপর?”

“……কিন্তু ….কিন্তু কমছে না….”

“করোনা পরীক্ষা করান।”

“করেছি তো নেগেটিভ‌ এসেছে।”

“কোথায় করিয়েছেন?”

“ওয়ার্ড‌ অফিসে।”

“অক্সিজেন স‍্যাচুরেশন কতো?”

“সেটাই তো মুশকিলের কথা….বড্ড কম, সত্তর মতোন হবে। অথচ সের’ম কষ্ট কিছু নেই” বিপন্নবাবু বিস্ময় প্রকাশ করেন।

হাতুড়ে সপ্রশ্ন হন। “কোভিড রিপোর্ট পেতে কতোদিন সময় লেগেছিলো? “

“কেন? সেদিন‌ই আধঘণ্টা পরে দিয়ে দিয়েছে।”

“না, চলবে না।‌ আর‌.এ.টি. পরীক্ষাটা নির্ভরযোগ্য নয়। আবার পরীক্ষা করান‌। এবার‌ আর.টি.পি.সি.আর …”

“কেন? আবার কেন…? সরকারি জায়গায়‌ই তো করা? প্রাইভেটে সব পজিটিভ দ‍্যায়… বোঝেন‌ই তো পয়সা কামাবার ধান্দা….”

হাতুড়ে তিতকুটেবিরক্ত হয়ে মুঠো ফোন নামিয়ে রাখলেন।

অমন সুন্দর মাছের তেলের স্বাদটাই উড়ে গেলো।

মনোক্ষুন্ন হাতুড়ে মাথার তলায় কনুই দিয়ে শয‍্যাগত হলেন।

পরের দিন‌ আবার ফোন। এবার হ‍্যালোর‌ উত্তরে বামাকন্ঠ।

“আমি শ‍্যাম সোহাগিনী বিশ্বাস বলছি। গতকাল‌ আমার স্বামী বিপন্নবিস্ময়বাবু আপনাকে ফোন করেছিলো। আজ বড্ড খারাপ‌ অবস্থা … আমরা প্রাইভেট হাসপাতালে নিয়ে যাচ্ছি … সরকারি হাসপাতালে আমাদের বিশ্বাস নেই…” বিশ্বাস‌গিন্নীর সুস্পষ্ট‌ অভিমত।

“তা বটে তা বটে!”

বিস্মিত হাতুড়ে ফোন রাখেন। পরেরদিন‌ আবার বিশ্বাসগিন্নীর ফোন।

“আমি গতকাল‌ আপনাকে ফোন করেছিলাম …”

“কিন্তু আপনি কে বলছেন ….”

“ওর কোভিড রিপোর্ট পজিটিভ‌ এসেছে .. ওকে আইসিইউতে নিয়ে যাচ্ছে। আমি কী করবো হাতুড়েদা?”

হাতুড়ে বুঝেছেন‌ ফোনটা সেই অবিশ্বাসী বিশ্বাসবাবুর বাড়ি থেকে এসেছে।

“কী আর করবেন? আপাততঃ প্রার্থনা করুন।”

“কার কাছে?”

হাতুড়ে স্তব্ধ হয়ে যান। নিরুত্তর ফোন নামিয়ে রাখেন। আর দুদিন পরেই কোভিডের মৃত্যুযান বিপন্ন বিস্ময়বাবুকে কোনও এক‌ অজানা সৎকার কেন্দ্রে নিয়ে যায় বিদায় জীবনের বিদায়। একটা ছোটো দোকানের মালিক দোকান বন্ধ করলেন।

পুনশ্চ ~ আর.‌এ.টি. (র‍্যাট) বা র‍্যাপিড অ্যান্টিজেন টেস্ট এখন বহুল ব‍্যবহৃত‌ একটা করোনা পরীক্ষা অথচ… অথচ পরীক্ষাটা এ্যাকেবারেই নির্ভরযোগ‍্য নয়। এতে নেগেটিভ‌ এলো মানেই করোনা নেই তা নয়। একেবারেই নয়। হাতুড়ে এই অবিশ্বাস্য পরীক্ষার জন্যে বহু রোগীকে হারিয়েছেন। ফলতঃ তাঁর রোগীর সংখ্যা এবং উপার্জন কমে যাচ্ছে। হাতুড়েকে দয়া করুন। মাস্ক পরুন‌ আর‌ ডাক্তারের নির্দিষ্ট করে দেওয়া পরীক্ষাটা করান। মনে রাখবেন, মরে গেলে আর বাঁচবেন না।

~ এক টেকো বুড়ো উবাচ ~

লেখক পরিচিতি

দীপঙ্কর ঘোষ

একজন বৃদ্ধ চিকিৎসক। এক কালে মেডিক্যাল কলেজে পড়াতেন।  লেখালেখিই বাতিক। প্রবন্ধ কবিতা এবং ছোটো গল্প লিখে থাকেন। এ যাবৎ প্রকাশিত ব‌ইয়ের নাম “মানদাসুন্দরী ও মাতাল ডাক্তার” – এক মাতালের বেদনাবিধুর গল্প সমষ্টি। আর প্রকাশিতব্য “রঙিন কৈশোর” এবং “কিছু অসুখ কিছু কথা”, রূপালী প্রকাশনী থেকে।

Author

Du-কলম

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!