Home বিবিধ, গল্প চর্বিত চর্বণ
বিবিধগল্প

চর্বিত চর্বণ

কল্যানী মিত্র ঘোষ

(এক প্রবাসী দম্পতির সুখী গৃহকোণ)

দূর্বা : এই, আমার মাথা খাও প্লীজ। ওনাদের এই ব্যাপারে আর কিছু বলোনা…. প্লীজ।

সায়ক : কেন? মাথা খেতে যাবো কেন? রান্না করবে না?? আমার খাবারের কি অভাব আছে নাকি? সোজা ফোন লাগাবো বাড়িতে বিরিয়ানী এসে যাবে।

দূর্বা : আরে বাবা! ওটা কথার কথা। কিছু যদি মাথায় ঢোকে তোমার।

সায়ক : ওঃ! আমার নিরেট মাথা? এটাই বলছো তো? নাকি এরও অন্য কোনো অর্থ আছে?

দূর্বা : না রে বাবা! সেটা বলিনি। আসলে তোমরা ছেলেরা অনেক পারিবারিক ব্যাপার বোঝো না, সেই অর্থে বলা।

সায়ক : না, সেরকম কোনো কথাই বলবে না। উঠতে বসতে ডাবল্ মিনিং, জান কয়লা করে দিলো একেবারে!

দূর্বা : এই তো, তুমিও তো এখন বললে! কয়লা করলাম? আমি? তুমি আমার জীবন দুর্বিষহ করে তুলেছো, প্রতিটি কথা তোমার মাকে বলে দিয়ে।

সায়ক : মানে? এই, তুমি কোন কথাটা বলতে বারণ করেছো? কি বলেছি আমি?

দূর্বা : কেন পরশু যে প্রায় মাঝরাত্তিরে তোমার মা ফোন করলেন আর বিজুর ঘুমটা ভেঙে গেলো, সারারাত আর ঘুমোলো না আমাকেও ঘুমোতে দিলোনা। তখন আমি বললাম যে ওনারা যেন একটু সময় বুঝে ফোন করেন একটু দেখো। আর তুমি কি করলে? সকালে ওনাদের ফোন করে বললে , শোনো তোমরা এরকম যখন তখন ফোন কোরো না, দূর্বার অসুবিধা হয়, ঘুমোতে পারে না।

সায়ক : হ্যাঁ, সত্যি কথাই তো বলেছি, এতে রাগ করার কি আছে? তুমি বলোনি যে, ওদের বলে দিতে?

দূর্বা : হ্যাঁ বলেছি, তা বলে আমার নাম করে বলবে; এটা আমি ভাবিনি।

সায়ক : যাব্বাবা, অসুবিধা হচ্ছে তোমার, বলতে বললে আমাকে, আর বললেই দোষ?

দূর্বা : নাঃ, তোমাকে বোঝাতেই পারবো না। ঠিক আছে! এরপর থেকে যা বলার আমিই বলবো।

সায়ক : বাঁচালে। আমি এসব ভায়া মিডিয়া একেবারেই পছন্দ করি না। আমিও ওদের বলে দেবো যে, এবার থেকে তুমিই যা বলার বলবে বলেছো।

দূর্বা : আহা ষোলো কলা পূর্ণ হবে তাহলে!

সায়ক : কলা, আবার ষোলোটা?

দূর্বা : এই! তুমি কোন স্কুলে পড়েছো গো? বাড়িতেও এসব শোনোনি নাকি? সারাক্ষণ যে সব বই পড়ো, সেগুলোও দেখি সব যুদ্ধের। তাহলে তোমার সঙ্গে কথা না বলে যুদ্ধই করি চলো।

সায়ক : আচ্ছা আমি এটাতে কি ভুল বললাম? এসব পারিবারিক ব্যাপার তুমি ভালো বোঝো, তুমি কথা বলবে, এটাই তো?

দূর্বা : আজ্ঞে না, এতে ওনারা ভাববেন যে আমি এটা তোমাকে শিখিয়ে দিয়েছি, তুমি আমার আঁচলে বাঁধা!

সায়ক : আমি?? তোমার শাড়ির ওই ওইটুকু আঁচলে? দূর! আমার মা কি শাড়ি পরে না নাকি? অমনি বলে দিলেই হলো?

দূর্বা : হে ভগবান! আচ্ছা ইংরিজি মিডিয়ামে না হয় পড়েছো, ইংরিজি বই পড়ো, গান শোনো মানছি, তা একটাও বাংলা সিনেমা কি দেখোনি?

সায়ক : হ্যাঁ দেখেছি তো। সত্যজিৎ রায়। সব। তুমি যে কোনো দৃশ্য বলো আমি মুখস্থ বলে দেবো।

দূর্বা : (স্বগতোক্তি) পথের পাঁচালী বা মহানগরে এসব উপমা টুপমা ছিলোনা? কে জানে বাবা, ভুলে গেছি!

সায়ক : আর হ্যাঁ, এবার তুমিও Saving Private Ryan, The Pianist, The English Patient এগুলো দেখতে থাকো। আমাদের কথা বলতে অনেক সুবিধা হবে। একটা কিছু কমন মাধ্যম তো চাই না কি!

দূর্বা : থাক আর বেশী আঁতলামি করতে হবে না। এই এইটাই আমার পছন্দ নয়, তুমি যা দেখবে সব অ-সা-ধা-র-ণ, আর আমার সব ট্র্যাশ! কি মধ্যযুগীয় মনোভাব!

সায়ক : ট্র্যাশ তো বলিনি, বললাম এগুলোও দেখো।

দূর্বা : দেখতাম তো আগে, মিথ্যে বোলো না। কিন্তু মাস ছ’য়েক আগে একদিন তোমাকে যখন বললাম এসো দুজনে বসে কৌশিক গাঙ্গুলীর জেষ্ঠ্যপুত্র সিনেমাটা দেখি, অনেক তা-না-না-না করে বসলে বটে, কিন্তু তার মধ্যে তিন বার বাথরুম গেলে, দু বার ড্রিংক ঢালতে উঠলে আর প্রায় সারাক্ষণ কচর-মচর করে চীনে বাদাম চিবিয়ে গেলে, সমস্ত ইমোশন ছিন্নভিন্ন হয়ে গেলো আমার। অথচ এই তুমিই যখন আমাকে The Shining দেখাতে বসালে আর আমি মাঝে মাঝে বিজু উঠে পড়লো কিনা দেখতে যাচ্ছিলাম আর তোমাকে পজ্‌ করতে বলছিলাম, কি রাগ তোমার, কন্টিন্যুটি নাকি নষ্ট হয়ে যাবে! এগুলো এক চোখোমি নয়? নাহ, এটা বললে তো আবার বলবে, একটা চোখ? আমার? আমি বলছি এগুলো মিউচ্যুয়াল রেসপেক্ট এর অভাব নয়? একটু ভেবে দেখো।

সায়ক : কোন্‌ কথা থেকে কোন্‌ কথা। হচ্ছিলো মা বাবা কে নিয়ে ….

দূর্বা : হ্যাঁ! সেটারও একটা নিষ্পত্তি হওয়া দরকার। কলকাতা থাকতে তো জীবনে মায়ের সঙ্গে গল্প করতে দেখিনি, এখানে আসার পর এতো ঘণ্টার পর ঘণ্টা ফোনে কি কথা হয়? তাও আবার দরজা বন্ধ করে?

সায়ক : ওহ্, এই ব্যাপার, আরে আমিও কি সব শুনি নাকি, ফোনটা স্পিকারে দিয়ে আমি ল্যাপটপে আমার কাজ করি আর মা বকবক করে যায়, স্পিকারে থাকে তাই মায়ের প্রাইভেসি রক্ষার্থে আমি দরজা বন্ধ রাখি।

দূর্বা : কি? এক মা তাঁর ছেলের সঙ্গে দুটো প্রাণের কথা মনের কথা বলতে চান আর তুমি সেটা উপেক্ষা করো? তোমরা পুরুষেরা কি বলো তো?

সায়ক : যাঃচ্চলে, এতো কেস ঘুরে গেলো!

দূর্বা : হ্যাঁ গেলো। আর তোমার আরও হাজারটা গুচ্ছ গুচ্ছ কেস, কতো আর বলবো!

সায়ক : কি কেস?

দূর্বা : কেন মনে নেই? বিজুর মুখেভাতের আগে মন্দিরে নিয়ে গিয়ে পুজো দিলাম, মুখে প্রসাদ দিলাম আর পুরোহিত মশাই জিজ্ঞেস করলেন ওর কি গোত্র ,তুমি একদম কনফিডেন্টলি ভরদ্বাজ গোত্র মানে আমার বাপের বাড়ির গোত্র, বলোনি? ঠাকুরমশাই বাচ্চার পদবী ও গোত্রের অমিল দেখে তোমার দিকে হাঁ করে তাকিয়ে রইলেন! নিজের গোত্রটাও জানো না!

সায়ক : আরে বাবা, ওসব নিয়ে কে মাথা ঘামায়? বাবা, মা কারোর একটা পেলেই হলো!

দূর্বা : আচ্ছা? তাই? তা কথাটা একবার তোমার মা’কে বলে দেখো প্লীজ!

সায়ক : আবার মা’কে নিয়ে টানাটানি কেন!

দূর্বা : কারণ ওনারও জানা দরকার যে, ওনার নাতির গোত্র বদল হয়েছে ওনার একমাত্র গুণধর পুত্রের কৃপায়!

সায়ক : আমার অতশত মনে থাকে না।

দূর্বা : হ্যাঁ! সেটা আমার থেকে কে ভালো জানে? এইতো সেদিন আমার স্কুলের বন্ধু অভীপ্সা নিউ ইয়র্ক থেকে ফোন করে বললো সায়কদা আমি অভীপ্সা বলছি, একটু দূর্বাকে ডেকে দিন না, ও হোয়াটস্‌অ্যাপ ধরছেনা, আর অমনি এক সেকেন্ডেই তুমি সব গুলিয়ে ফেলে কানে ফোনটা নিয়েই আমাকে চীৎকার করে ডাকলে, এই চট করে এসো, জিঘাংসা ফোন করেছে! ভুলে গেছো, ঠিক আছে। তা বলে জিঘাংসা?

সায়ক : ওই হলো, শেষটা তো মিলিয়ে দিয়েছি। সা-সা। উফ্‌ফ্‌! এসব কঠিন কঠিন নাম মনে রাখা যায়?

দূর্বা : আচ্ছা। এগুলো ভুলে যাও, আর যেগুলো ভুলে যাওয়া দরকার সেগুলো তো বেশ মনে রাখো!

সায়ক : কোনটা? কি করলাম আবার!

দূর্বা : কেন সেবার তোমার ফিনিক্সের বন্ধু যিনি বছরে অন্ততঃ চারবার আমাদের বাড়ি এসে থাকতেন, সে থাকুন, কিন্তু ওঁর গায়ে ভীষণ গন্ধ বলে আমি তোমাকে বলেছিলাম লিভিং রুমের ক্লসেটে উনি যেন বাইরের জামাকাপড় ঝুলিয়ে রাখেন। তা উনি আসার পর তুমি বেমালুম বলে দিলে তুই এইখানে জামা প্যান্ট ঝোলা, বেডরুমে গন্ধ নিয়ে দূর্বা কি একটা যেন বলছিলো। নেহাৎ আমি সীতা নই বলে মাটি দু ফাঁক হয়নি। আচ্ছা এগুলো কি তুমি ইচ্ছে করে করো?

সায়ক : না গো! আমার আসলে সব কেমন গুলিয়ে যায়, সত্যি বলছি।

দূর্বা : আচ্ছা, বিশ্বাস করলাম। তবে দয়া করে এইসব ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটিও না। এদেশে তো আর হুট বলতেই বাপের বাড়ি যেতে পারি না, তবে হেঁশেলটা পার্মানেন্টলি বন্ধ করে দিতে পারি। আনাও বিরিয়ানী কত আনাবে!

— সমাপ্ত —

Author

Du-কলম

Join the Conversation

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!