Home বিবিধ, গল্প মিতিলের ভালোবাসা
বিবিধগল্প

মিতিলের ভালোবাসা

অনন্ত কৃষ্ণ দে

।। ১ ।।

আজ একদম মন ভালো নেই মিতিলের। তার ভালবাসার আর ভাললাগার দুজনই আজ তাকে ছেড়ে চলে গেছে। ভোর রাতে ঠাকুমা তাদের সবাইকে ছেড়ে চলে গেলেন। ঠাকুমা অনেকদিন ধরে হাঁপানিতে ভুগছিলেন। গতকাল রাতে খুবই বাড়াবাড়ি হয়েছিল। দু-দুজন ডাক্তার দুটো নল লাগিয়ে দিয়ে গেলো, মুখে আর যেখান দিয়ে হিসি করে। ঠাকুমা কদিন ধরে খাওয়া-দাওয়া করতে পারছিল না। চুপকরে শুয়ে ছিল আর কাঁপা হাত দিয়ে মিতিলকে ডাকছিল তার পাশে বসবার জন্য। মিতিল আর কুঁচে তার পাশে বসে থাকতো। কুঁচে মিতিলের প্রানাধিক প্রিয় বিড়াল। সে তাকে বন্ধুর মতই ভালবাসে। কুঁচেও তার খুব ন্যাওটা ছিল, সর্বক্ষণ ল্যাজ উঁচিয়ে তার পেছন পেছন ঘুরতো। পায়ে পায়ে লেগে থাকতো। মা-বাবা কুঁচেকে একদম ঠাকুমার বিছানাতে উঠতে দিতো না। সুযোগ পেলেই ও বিছানায় হিসি করে দিতো। মা তার জন্য মিতিলকে বেশি বকাবকি করতো। বাবা তো ওকে বিছানায় উঠতে দেখলেই লাঠি নিয়ে তাড়া করতো। বাবা বেড়ালটাকে ভালোওবাসতো। প্রত্যেকদিন নিজে খাবার পর কুঁচেকে মাছ-ভাত মেখে খেতে দিতো। মা বলতো, ‘মিতিল, কুঁচে এ বাড়ি সে বাড়ি চষে বেড়ায়, রাস্তায় যায়, ওকে মার বিছানায় উঠতে দিস না।‘ কিন্তু কুঁচেটাও খুব বদমাশ ছিল, রাতে পাড়া বেড়িয়ে বাবা-মা যখন নিজের ঘরে থাকতো, তখনই সে ঠাকুমার বিছানায় উঠে পড়তো। রাতে মাঝে মাঝে মা ঠাকুমাকে ওষুধ খাওয়াতে এসে কুঁচেকে দেখতে পেলেই ধুন্ধুমার বেঁধে যেতো। দৃশ্যটা দেখার মতো হতো, সামনে লেজ উঁচিয়ে কুঁচে, তার পেছনে মা আর সবার শেষে মিতিল। আর ঘর থেকে ঠাকুমার কন্ঠস্বর ভেসে আসতো, ‘বৌমা, ওকে মেরোনা, ও মা ষষ্টির বাহন।’ ব্যাস এতেই কাজ হতো, মা রণে ভঙ্গ দিতো।

ছাদে কয়লার গাদায় ক’দিন ধরেই পাশের বাড়ির মেনি বিড়ালটাকে আসা যাওয়া করতে দেখছিলেন রমা। দেখে মনে হচ্ছিলো মেনিটা একটা নিরাপদ জায়গা খুঁজছে। মেনিটাকে দেখে সন্তানসম্ভবা বলেই মনে হয়েছিল রমার। প্রথমে ব্যাপারটা সে এড়িয়ে গেছল। কিন্তু কিছুদিন বাদে ছাদে কয়লা নিতে এসে চক্ষু চড়কগাছ! তিনটে বেড়ালছানা। এখনই এদের বিদায় করতে হবে। না হলে সারা বাড়ি দাপিয়ে বেড়াবে আর মিতিল দেখতে পেলে তো রক্ষে নেই। তিনি নীচে এসে রাতদিনের কাজের লোক চপলার শরনাপন্ন হলেন। চপলা প্রথমে কিছুতেই রাজী হয়নি কিন্তু রমার পীড়াপীড়িতে একদিন খুব ভোর রাতে একটা থলে বন্দী করে একটা একটা করে দুটো বিড়ালছানা রমা দেবীর নির্দেশমত বাড়ির একটু দূরে দুধের ডিপোর কাছে পাচার করলেন। কিন্তু গোল বাঁধল তৃতীয় ছানাটা নিয়ে। সেদিন চপলার ঘুম থেকে উঠতে একটু দেরি হয়ে গেছিলো, লুকিয়ে ছাদের সিঁড়ি দিয়ে থলেতে বিড়ালছানা নিয়ে নামবার সময়, ছানাটা ম্যাও ম্যাও ধ্বনিতে থলের ভিতর থেকে তার অস্তিত্ব জানান দিতে থাকলো আর বামাল সমেত ধরা পড়লো মিতিলের কাছে। এ বাড়ির বেসিনটা ঠিক ছাদের সিঁড়ির নীচে, মিতিল ঘুম থেকে দাঁত ব্রাশ করছিলো, হটাত ম্যাও ম্যাও আওয়াজে সে এদিক-ওদিক তাকিয়ে চপলাদিকে ছাদের সিঁড়ি দিয়ে নামতে দেখলো, ব্যাস আর যায় কোথায়! মিতিলের চিৎকারে সাড়া বাড়িতে শোর পড়ে গেল, বাবা দৌড়ে চলে এলো, বাড়ির অন্য সদস্যরা সবাই ছাদের সিঁড়ির সামনে জড়ো হল। মিতিল সঙ্গে সঙ্গে বেড়ালছানাটাকে থলে থেকে মুক্ত করলো। সেইদিন থেকে এই বাড়ির সদস্য হল কুঁচে। কুঁচের জন্য দুধ, মাছের কাঁটা বরাদ্দ হলো, বাবা অফিস থেকে এলে কুঁচে চারপাশে ঘুরঘুর করতো।

।। ২ ।।

সেই থেকে বাবাও কুঁচেকে পছন্দ করতে লাগলো। কুঁচেকে নেকনজরে দেখতো শুধু মা আর চপলাদি, কেননা এদের অপারেশন ব্যর্থ হয়েছে। কিন্তু আস্তে আস্তে কুঁচের ভাগ্যের চাকা ঘুরতে লাগলো তাই এরাও এখন কুঁচের বন্ধু। একটা অবলা বেড়ালছানার প্রতি মিতিলের ভালবাসার কাছে এরাও হার মেনেছে, জীবনের এই অকৃত্রিম ভালবাসা বড়োদেরকে অনেক সুক্ষ সুক্ষ অনুভুতির শিক্ষা দেয়। এই বোধোদয় এদেরও হয়েছে, তাই মা আজ কুঁচেকে কোলে তুলে নেয়, চপলাদি হিসি পরিস্কার করতে আর গোল করে না।

সেই কুঁচেকে আজ সকাল থেকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। গতকাল সারারাত ধরে এই বাড়ির কাঊর চোখে ঘুম নেই, মার মুখে মিতিল শুনেছে, ঠাকুমাকে নিয়ে যমে মানুষে টানাটানি গেছে। মিতিল একটু ঘুমিয়ে পড়েছিলো। ঠাকুমার গলা দিয়ে যখন ঘড়ঘড় আওয়াজ বেরোতে লাগলো, তখন মা ওকে ঘুম থেকে তুলে দিয়ে বলেছিল, ‘মার শ্বাস উঠেছে, তুই পাশে গিয়ে বোস।‘ মিতিল দেখেছিল তার ঠাকুমার অস্থির অবস্থা আর তার প্রিয় মানুষের জন্য শুধুই চোখের জল ফেলেছিল। সেইসময় হঠাৎ লেজ, কান খাঁড়া করে দৌড়তে দৌড়তে কোথা থেকে যেন কুঁচে ওখানে এসে দাঁড়িয়েছিল, কিছু যেন একটা বোঝার চেষ্টা করছিলো, কিন্তু তারপর মিতিল আর তাকে দেখতে পায় নি।

দুপুরের দিকে কাঁচের একটা গাড়িতে করে বাবারা ঠাকুমাকে নিয়ে গেল। মা বলেছে, ওরা শ্মশানে যাচ্ছে, ওখানে থাকুমাকে পোড়ানো হবে। তারপর ঠাকুমা আকাশের তারা হয়ে যাবে। কাচের গাড়িটা চলে যাবার পর আস্তে আস্তে ঠাকুমার বিছানায় এসে খুব কাঁদলো মিতিল আর তখনই কুঁচেকে সারা বাড়িতে খুঁজে পেলো না সে। শ্মশান থেকে ফিরে বাড়ির অনেকের সাথে বাবাও পাশের বাড়িগুলোতে কুঁচের খোঁজ লাগালো কিন্তু তাকে পাওয়া গেলো না।

রাতে আকাশের দিকে তাকিয়ে একটা তারার দিকে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে মাকে মিতিল জিজ্ঞাসা করলো, ‘মা, ওটা ঠাকুমা? কুঁচেও কি ওখানে আছে?’ মেয়েকে দু হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরে হাউ হাউ করে কেঁদে উঠলেন রমা। এ প্রশ্নের উত্তর তার অজানা। তিনি আরো শক্ত করে আঁকড়ে ধরলেন তার একমাত্র মেয়েকে।

লেখক পরিচিতি

 

অনন্ত কৃষ্ণ দে

জন্ম কলকাতার বাগবাজারে। মহারাজা কাসিমবাজার স্কুল ও বিদ্যাসাগর কলেজে পড়াশুনা। বিজ্ঞানে স্নাতক। স্কুল, কলেজ, অণু পত্রিকা ও বিভিন্ন ম্যাগাজিনে লেখা। নাটক ও স্কাউটিং এর সাথে যুক্ত।

Author

Du-কলম

Join the Conversation

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!