অপর্ণা মুখার্জী
অনন্যা ও অর্কর বোম্বেতে তাদের সাজানো সংসার। অনন্যা তার সংসারের চাপে, অফিসের চাপে খুবই জর্জরিত। অর্ক তাকে হেল্প করলেও কিছু জিনিষ অর্ক মোটেই বুঝতে চায় না। অনন্যার দুই ছেলে, তাদের নিজেদের পড়া নিয়ে ব্যস্ত। তারা এখন স্কুল শেষ করতে চলেছে। আর অর্ক মন দিয়ে শুধু অফিসের কাজটুকু করতে পারে আর ছেলেদের সাথে সময় কাটাতে পারে। তার কাছে বেশি ঝামেলার কাজ চলে না। বড়ই শান্তি প্রিয় মানুষ। সে বাজার হাট কিছুই খুব একটা ভালো বোঝে না। অনন্যা কখনো কিছু বললে ওইটুকু সে আনতে চেষ্টা করে।
তার মনে হয় জীবন শূন্য থেকে শুরু করে আজ যেখানে পৌঁছেছে, তা যথেষ্ট। কিন্তু জীবনে যে আরও কিছু করার থাকে যা ভবিষ্যৎকে সুরক্ষিত করতে সাহায্য করে। সেই ব্যাপারে অর্ক বরাবর উদাসীন।
অনন্যার বাবা ছিলেন একজন প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী। তাই অনন্যা ছোটো বেলা থেকেই দেখে এসেছে কি করে সঞ্চয় করতে হয় ভবিষ্যতের জন্যে। শুরুতে সে কখনো অর্ককে চাপ দেয়নি, ভেবেছে অর্ক নিজেই ঠিক করে নেবে, কিন্তু যতো দিন যেতে লাগলো অর্কর এই উদাসীনতা অনন্যা কে ভাবিয়ে তুলতে আরম্ভ করলো।
অর্ক অনন্যার সব কথা যে শুনতো তাও নয়। সে সেটুকু শুনতো যেটুকু অর্কর নিজের ইচ্ছা হতো শোনার। অর্কর কাছে অনন্যা তার ভাবনার প্রকাশ করলে, সে প্রতিবারই আশ্বাস দিতে থাকে, কখনো না বলে না। কিন্তু কাজ কিছুই করেনা।
অর্ক তার নিজের সংসারে সবরকম সুবিধা দিলেও অনন্যার মন দিনের পর দিন ওই একটি কারণে অশান্তি পেতে থাকে। তার রাগের, অভিমানের ছায়া তার আর অর্কর সম্পর্কে পড়তে থাকে। নিজেদের মধ্যে প্রায় এ নিয়ে মনোমালিন্য চলতে থাকে, তবু অর্ক র বৈষয়িক চিন্তার উন্নতি হয়না। অনন্যা ভেবে পায়না সে কি করবে, এখন সে আগের মত আর অর্ক কে বোঝায় না, কিন্তু সে হার এখনো মানেনি।সে ভাবে এবার সে অর্ক কে ছাড়াই নিজে কিছু করবে। রোজ তার মন খারাপ লেগেই থাকে এই নিয়ে।
দিনের শেষে সন্ধ্যা নামে যখন, একলা বসে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে , অজান্তেই তার মনের কোণে অয়নের কথা মনে পড়ে। মন বলে ওঠে আজ যদি অয়ন থাকতো তার জীবনে হয়তো সে অনন্যার দুঃখ রাখতো না। সে তো সব কিছুতেই খুব পারদর্শী ছিল।
অনন্যা আর অয়ন খুব ভালো বন্ধু ছিল, তারা একই কলেজে পড়তো। তারা এক সাথে বন্ধুদের সাথে ঘুরতো, এক সাথে পড়তো, কখনো ওরা দুজনেই শুধু আড্ডা দিতো বা ঘুরতেও যেতো। বন্ধুর বাইরে কখনো যায়নি তারা। অয়ন খুব গুছিয়ে কথা যেমন বলতো, কাজও তেমন করতো। ঘুরতে ঘুরতে একদিন দক্ষিণেশ্বরে গিয়ে এক সন্ধ্যা গঙ্গার ধারে বসে, তাদের কিছু উপলব্ধি হয়, যা কেউ কাউকে না বললেও দৃষ্টি আকর্ষণ করে তাদের অব্যক্ত ভালবাসাকে, যা বন্ধুত্বের সম্পর্ক থেকে একটু আরও এগিয়েছে বলে দুজনেরই বোধ হয়। কিন্তু কেউ মুখ ফুটে কিছু বলেনি, কেননা বলার জন্যে হয়তো আরও কিছু সময়ের দরকার ছিল। তবে তারা গল্পের ছলে কথা দেয় আরও একটি সন্ধ্যা আবার এই ভাবেই কাটাবে।
কিছুদিনের মধ্যেই বাড়ির থেকে বিয়ের চাপ আসতেই অনন্যা তাতে না বলার সুযোগ হারায়। অনন্যার অর্কর সাথে বিয়ে হয়ে যায়। অয়ন বন্ধু হিসেবেই নিমন্ত্রিত হয়ে আসে। অয়ন সেদিন একটি সুন্দর ছোট্ট বক্সে উপহার নিয়ে এসেছিলো, দৃষ্টিতে দুজনেরই না বলা কথার অসহায়তা। আর পাঁচটা বন্ধুর মতো অয়নও বলে গেলো ‘ভালো থাকিস।’
বিয়ের পর দিন যখন উপহারগুলি খুলে দেখতে লাগলো, অনন্যা দেখলো অয়ন তাকে একটি সুন্দর ছোট্ট দক্ষিণেশ্বরের ঠাকুরের মূর্তি দিয়েছে। অনেকেই মনের কথা মন খুলে বলতে পারে না, সারা জীবন দ্বিধায় কেটে যায়, মনের কথা আর বলা হয়ে ওঠেনা। এতে ভুল আছে, না ঠিক আছে, কেউ জানেনা।
বিয়ের পর অনন্যা অর্কর সাথে নতুন শহরে গিয়ে নিজেদের মতো সংসার শুরু করে। কলকাতা থেকে আসার সময় বিয়েতে পাওয়া সব উপহার না আনতে পারলেও অয়নের দেওয়া ঠাকুরের মূর্তিটি সে রেখে যায়নি। আর সেভাবে বন্ধু মহলে ফিরে আসা হয়নি। অয়নকেও মাসখানেকের মধ্যে শহর ছাড়তে হয়, নতুন চাকরি নতুন শহরে, নতুন বন্ধুর খোঁজে জীবন শুরু হয় তারও।
মাস ছয়েক পর অয়নের মায়ের উদ্যোগে বিয়ে হয় তারও।
বর্নালীকে পেয়ে অয়ন নতুন করে বাঁচবে বলে সব শখ পূর্ণ করার চেষ্টায় ব্যস্ত হয়ে পড়লো। চাকরিতে সেও অনেক উন্নতি করে চললো, সময়ের সাথে তাদেরও দুটি সন্তান হলো। বর্নালী তার চাকরি ও ছেলে মেয়ে নিয়ে বেশ জমিয়ে সংসার করে চলে, আর তার সাথে তার অহংকার দিনে দিনে বাড়তে থাকে। নিজেকে নিয়ে সে কি করবে ভেবে পায় না।
অয়ন কখনো তাকে কিছুতে বাধা দেয় না। বর্নালী কোনো ইচ্ছার প্রকাশ করলেই অয়ন সাথে সাথে তা পূরণ করে দেয়। বর্নালীর কোনো স্বাধীনতায় সে বাধা দেয়না।
অয়ন সংসারের যাবতীয় কাজের খেয়াল রাখে, নিজে না পারলে লোক দিয়ে সেই কাজ সম্পূর্ণ করায়। যাতে বর্নালীকে কোনো কিছু না দেখতে হয়। শুধু বর্তমান নয় ভবিষ্যতের জন্যেও অয়ন ঠিক সেই ব্যাবস্থা করে চলেছে যাতে পরিবারে কারুর কোনো অসুবিধায় না পড়তে হয়। তবু বর্নালী তাকে কোনো কিছুতেই ভালো বলে না। উপরন্তু তাকে সন্দেহের চোখে দেখে। অকারণে অপবাদ দেওয়াটা যেমন বর্নালীর স্বভাব হয়ে দাঁড়াল, তাকে আকন্ঠ হজম করে যাওয়াটা হয়ে গেলো অয়নের অভ্যাস। সে কখনো প্রতিবাদ করতো না, বোঝানোর চেষ্টা করে বহুবার বিফল হওয়াতে তা বন্ধ করে দেয়। মানুষটা সংসারের শান্তি বজায় রাখার জন্য সকল অভিযোগ মাথায় পেতে নেয়।
অয়ন ভেবে পায় না আর কি করলে বর্নালী খুশী হবে। কোনো কিছুর অভাব তো সে রাখেনি। তবু কেন সুখী হওয়া গেলো না।
সুখের হাতটি বাড়ানো থাকে, তাকে ঠিক করে কাছে আনতে গেলে, স্বামী স্ত্রী উভয়েরই সমান জোর লাগে।
অয়ন যখনই অফিস থেকে বাড়ি ফেরে সেই পুরোনো দিন গুলি খুঁজে বেড়ায় যেখানে অনন্যা ছিলো, তাকে মনে করে মনের কোণে এক অপূর্ব সুখানুভূতি হয়। বাড়ি ফেরার ইচ্ছে হয়ে যায় শিথিল।
অয়ন আর অনন্যা, তারা এক হতে পারলো না, এদের দুই পরিবার দুই শহরে সময়ের সাথে লড়াই করে এগিয়ে চলেছে। সুখ একটি জায়গায় মন কে ছুয়ে থাকে সদাই, যেখানে ভালোবাসা জুড়ে আছে। একান্তে যখন অয়ন ও অনন্যা তাদের নিজেদের ঘরে সকল দুশ্চিন্তার মাঝে একে অপরকে মনে করে, মন অজান্তেই এক অদ্ভুত তৃপ্ততা অনুভব করে। সময় তাদের শহর আলাদা করে, ঘর আলাদা করে, এক সাথে একটি সন্ধ্যা পেলো না তারা, কিন্তু দূরে থেকেও বহু সন্ধ্যার সাথী হয়েছে একে অপরের।