শ্রী দেবাশিস পোদ্দার
তাই তাই তাই
মামাবাড়ি যাই।
মামাবাড়ি ভারি মজা
কিলচড় নাই।
সকলের মনে হয় কিনা জানি না, আমার তো শিশুকাল থেকেই মনে হত যে এই ছড়াটা শুধুমাত্র আমার জন্যেই লেখা হয়েছে। পূর্ব কলকাতার কাঁকুড়গাছিতে আমাদের মামাবাড়ি। ভি.আই.পি. রোড লাগোয়া সি.আই.টি. বিল্ডিং। ভি.আই.পি. এলাকা তো বটেই।
প্রতিবছর নিয়মকরে মামাবাড়ি যাওয়া চাই-ই চাই। গরমের ছুটিতে, পুজোর ছুটিতে আর বড়দিনের ছুটিতে।গরমের আর পুজোর ছুটিতে একা একা আর বড়দিনের ছুটিতে বাবা,মা,ভাই…সব একসাথে।চব্বিশে ডিসেম্বর রেজাল্ট আউট হলেই সবাইমিলে মামাবাড়ি।ওই কটা দিন মামাতো ভাই বোনেরা আর আমরা সবাইমিলে বাবার সাথে একেকদিন একেক জায়গায় বেড়াতে যেতাম। কোনোদিন চিড়িয়াখানা, কোনোদিন সার্কাস, কোনোদিন বোটানিক্যাল গার্ডেন আবার কোনোদিন যাদুঘর বা বিড়লা প্ল্যানেটরিয়াম প্রভৃতি। বড়দিনের ছুটিটা দুম্ করে শেষ হয়ে যেত এসব করতে করতেই।
মামাবাড়িতে বাবার খাতিরটাই ছিল অন্যরকম। বাবাই ছিলেন মামাদেরও অলিখিত অভিভাবক। শুনেছি ওপার বাংলা থেকে এদেশে আসার পরে আমার দুই মামা হাবরাতে আমাদের বাড়িতেই বাবার কাছে থেকে লেখাপড়া করত। তখন এটাই স্বাভাবিক ছিল। বাবাকে মামা মামিরা বলত “দাদাবাবু”। দাদাবাবু ডাকটা যে কতটা শ্রদ্ধার, ভরসার সেটা ওই ছোটো বয়সেও ঠিক বুঝতে পারতাম। মামাবাড়িতে দাদাবাবুর সাথে আলোচনা ছাড়া কোনো বড় কাজের কথা ভাবাই যেত না তখন। দিদি-দাদাবাবুর সাথে বড়দিনের ছুটিতে একদিন থিয়েটার দেখাটা একদম বাঁধা ছিল মামীদের। সেখানে আমরা ঠাঁই পেতাম না কখোনো। ওটা বড়দের ব্যাপার। উত্তর কলকাতায় তখন রংমহল, সারকারিনা, স্টার … এইসব হল গুলিতে নিয়মিত বানিজ্যিক থিয়েটার হত। নামীদামী ফিল্ম আর্টিস্ট রাই এসব থিয়েটারে আভিনয় করত। পরে বড় হয়ে আমরাও কখনো সখনো দেখেছি দু-একটা। আজ সেসব শুধুই ইতিহাস।
মামাবাড়ির প্রতি আমারই টানটা ছিল সবচেয়ে বেশি। আদরের ভাগনে বলে কথা। দিদিমা তো সাংঘাতিক ভালোবাসত আমাকে। সবসময় নজর রাখত যাতে আমার কোনোরকম অসুবিধে না হয়। শুধু তাই-ই নয়, মাঝেমধ্যে সবার অলক্ষ্যে দশ বিশ টাকা গুঁজেও দিত আমার হাতে। আমিও টপ্ করে নিয়ে নিতাম টাকাটা। কি আনন্দ যে হত তখন !! বছরে দু-তিনবার করে আসতাম বলে কাঁকুড়গাছিতে বেশ একটা বন্ধু বান্ধবের দলও হয়ে গিয়েছিল ছোটোবেলা থেকেই। সেই দলে প্রায় সমবয়সী মামাতো ভাইয়েরা তো ছিলই, সাথে ছিল আশেপাশের ফ্ল্যাটের ছেলেরাও। সবাই মিলে ঠাকুর দেখতে বেরতাম দুর্গাপূজোর সময় নিজেরা একা একা। বড়রা কেউই থাকত না তখন আমাদের সঙ্গে। কিন্তু যে দুদিন হোল্ নাইট ঠাকুর দেখতাম সেইদিনগুলিতে আমাদের সাথে থাকত সকলের প্রিয় “মন্টু মেসো”। দিলদরিয়া জমাটি মানুষ। বড়মামীর বোন লাহরী মাসির হাসব্যান্ড। বেলেঘাটায় বাড়ি। ঢোলা পাজামা আর পাঞ্জাবী পরত। একদম টিপটপ,ফিটফাট। জর্দাপান খেত খুব। মন্টুমেসো চলে আসত মামাবাড়িতে রাত দশটার মধ্যেই। আমরাও রাতের খাবার খেয়ে পুজোর ড্রেস পরে রীতিমতো ফান্টুস মেরে বেরোতাম মন্টুমেসোর সাথে হোল্ নাইট ঠাকুর দেখতে। নর্থ, সেন্ট্রাল, সাউথ সব একেবারে ফালা ফালা করে ফেলতাম ওই দু রাতে। ঠাকুর দেখার শেষে সকাল বেলায় একদিন যেতাম দক্ষিনেশ্বরে। মা ভবতারিনীকে প্রনাম করে গরম গরম কচুরি খেয়ে ফিরতাম কাঁকুড়গাছিতে।
মামাদের ব্যবসায়ী বাড়ি। শিয়ালদা আর কটকে জামা কাপড়ের রিটেইল দোকান। পরে কলকাতায় কাপড়ের ব্যবসা থেকে মিষ্টির ব্যবসা তে শিফট করে মামারা। শিয়ালদার সাথে সাথে আরও একটি নতুন দোকান হয় উল্টোডাঙ্গা মেইন রোডের ওপরে ঠিক পুরোনো পনের নম্বর বাস স্ট্যান্ডের উল্টোদিকে। লক্ষ্মী নারায়ন মিষ্টান্ন ভান্ডার। দারুন কোয়ালিটির মিষ্টি … দারুন সেল। একেবারে রমরমা ব্যবসা তখন। পুজোর সময় আমাদের মানে মামাতো দুইভাই আর আমার ডিউটি পরত এই মিষ্টির দোকানে। এত ভীড় হত যে সবাই মিলেও সামলাতে পারতাম না। বেশিরভাগ দিনই ক্যাশ বাক্সের দায়িত্বে থাকতাম আমি। প্রচুর স্টক … প্রচুর সেল। কারখানা থেকে মিষ্টির ট্রে-গুলো দোকানে আসতে না আসতেই বিক্রি হয়ে যাচ্ছে। একটানা বেচাকেনা করে ছুটি পেতাম প্রায় সন্ধ্যেবেলায়। ঠাকুর দেখতে যেতে হবে তো। ছুটির সময় বকশিস পেতাম প্রতিদিন প্রত্যেকে কুড়ি বা তিরিশ টাকা করে। টাকা হাতে পেয়ে মহানন্দে কাঁকুড়গাছির বাড়িতে ফিরতাম হেঁটে ‘লিলি বিস্কুট’ কারখানার পাশ দিয়ে। ফিরতে ফিরতে প্ল্যান করতাম আজ কোন দিকে ঠাকুর দেখতে যাব।
এরকমই একদিন সন্ধ্যেবেলায় যখন কাঁকুড়গাছি ফিরছি তখন নিছকই কৌতুহল বশতঃ রাস্তার পাশের এক তুকতাক করা যাদুখেলা দেখতে দাড়িয়ে পড়লাম। একটা জমাট মতো ভীড়। চারিদিক ঘিরে দর্শক দাঁড়িয়ে আছে আর মধ্যিখানে চলছে বিচিত্র যাদুখেলা। সে এক সাংঘাতিক কান্ড। দাঁড়িয়ে তো গেলাম কিন্তু ওখান থাকে আর নড়তে পারছি না। যে লোকটা যাদুখেলা দেখাচ্ছে সে এমনভাবে বলছে যে, কেউ যদি ওই জায়গা থাকে একচুলও নড়ে তাহলে তার তক্ষুনি রক্তবমি শুরু হবে আর প্রানেও সে বাঁচবে না। রীতিমতো ভয় পেয়ে গেলাম এসব শুনে। হঠাৎ দেখি, আমাদের পাশে একটা লোক দুম করে মাটিতে পড়ে গেল আর তার মুখ দিয়ে রক্ত বেরোচ্ছে। দেখে তো আমাদের সকলেরই মোটামুটি কাঁপুনি শুরু হয়ে গেল। যাদুকর তখন বলল যে, ওই লোকটি তার কথা না শুনে ওখান থেকে চলে যাচ্ছিল বলেই নাকি এই অবস্থা হয়েছে। তারপরে দেখি যাদুকর ওর দলেরই একটা বাচ্চা ছেলের পেটের মধ্যে একটা ধারালো তলোয়ার ঢুকিয়ে দিল। গলগল করে রক্ত বেরতে লাগল। যাদুকর তখন বলতে লাগল, “এবারে যার কাছে যা টাকা পয়সা আছে সব দিয়ে দিন। নাহলে এই বাচ্চাটা এক্ষুনি ছটফট করতে করতে মারা যাবে।” আমাদের কিশোর মনের তখন কি করুণ অবস্থা !! দুঃখে কষ্টে ভয়ে রীতিমতো কান্না পেয়ে যাচ্ছিল। কিভাবে ওখান থেকে পরিত্রাণ পাবো তাই-ই শুধু ভাবছিলাম। বাচ্চাটা চোখের সামনে মরে যাবে ভেবে ভয়ে হাত পা ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছিল। আমরা পকেটের ওই দিনের বকশিসের পুরো টাকাটাই যাদুকরকে দিয়ে দিতে বাধ্য হই ওইদিন। ওখানে উপস্থিত প্রায় সকলেই তাদের পকেট থেকে যথাসম্ভব টাকা পয়সা বের করে দিয়ে দেয়। টাকাপয়সা পেয়ে পরে ওই বাচ্চাছেলেটিকে যাদুকর বাঁচিয়ে দেন। ছেলেটি হেঁটে চলে বেড়াতে থাকে। যাদুখেলা শেষ হয়। আমরাও ভারাক্রান্ত মন নিয়ে চরম বোকা হয়ে মামাবাড়িতে ফিরে আসি। পরে নিজেদের মধ্যেই আলোচনা করে বুঝতে পারি যে চরমভাবে ঠকে সর্বস্বান্ত হয়েছি সেদিন। সিম্পলি বোকা বানিয়ে আমাদের লুঠে নিয়েছে যাদুকর।
ঐদিন আর আনন্দ করে ঠাকুর দেখা হয়নি। শুধু ঐ ঘটনার আলোচনা আর পর্যালোচনাতেই রাত কাবার হয়ে গেছে।
ঘটনাটা এতটাই আকষ্মিক আর অভুতপূর্ব ছিল যে আজও মনে রয়ে গেছে ঐ সাংঘাতিক দৃশ্য গুলি। কলকাতা শহরে এরকম রাস্তার পাশের যাদুখেলা বা অন্য কোনো খেলা দেখতে পরে আর কখোনোই দাঁড়াইনি। ঐদিনের ঘটনা চরম শিক্ষা দিয়ে গেছে।
কথায় বলে মানুষ নাকি শেখে দুভাবে।
হয় দেখে শেখে, না হয় ঠেকে শেখে।
কিন্তু আমরা সেদিন দেখেও শিখিনি, ঠেকেও শিখিনি …
শিখেছিলাম শুধুমাত্র ঠকে।
শ্রী দেবাশিস পোদ্দার
এম.এস্.সি. পদার্থ বিদ্যা, বি.এড.
প্রধান শিক্ষক, বনমালিপুর প্রিয়নাথ ইনস্টিটিউশন
বারাসাত, কলকাতা – ৭০০১২৪।
যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের এক্স ব্লু ( ১৯৮৫-১৯৮৭) ফুটবলার।
হৈ হৈ করে বাঁচতে পছন্দ করি।
খেলাধূলা, সিনেমা দেখা, গান শোনা, আড্ডা দেওয়া প্রভৃতিতে আগ্রহী।
Facebook আর WhatsApp-এ প্রবল আসক্তি।
সুন্দর সত্যি ঘটনা অবলম্ননে লেখা খুব ভাল।