স্থিরা হালদার
এমনই এক শ্রাবণ মাস-অবিশ্রান্ত বারিধারার মাঝে বয়ে আনে এক বিশেষ দুঃখের স্মৃতি – ২২শে শ্রাবণ ১৯৪১ সাল – কবির চিরবিদায়ের দিন। এই পরিবারের কন্যা হয়েও সেই জোড়াসাঁকো বাড়িতে থাকা বা সেই বাড়ির জগদ্বিখ্যাত মানুষগুলির সঙ্গ লাভ করার সৌভাগ্য আমার হয়নি। কাজেই জোড়াসাঁকো বাড়ির সে সময়ে যা ঘটনা আমার ভান্ডারে সঞ্চিত আছে তা সবই আমার মা ও বাবার কাছে শোনা – কারণ তারা ছিলেন সেই সব ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী।
আমার মা তখন বছর পনেরোর বালিকা বধূ। তাঁর কাছেই শোনা সেদিনের কিছু টুকরো ঘটনা –
কবি গুরুতর অসুস্থ অবস্থায় জোড়াসাঁকো বাড়ির দোতলার ঘরে শয্যাশায়ী – চিকিৎসকরা জবাব দিয়ে গেছেন – তাঁকে আর ধরে রাখা যাবেনা – সকলের মন অত্যন্ত ভারাক্রান্ত। পরদিন অবস্থার অধিক অবনতি হওয়ায় সকাল থেকেই বাড়িতে আত্মীয় স্বজন ও বিশিষ্ট বন্ধু-বান্ধবদের সমাগম – কবি শেষ শয্যায় শায়িত – তাঁর ঘরে ভোর থেকেই শুরু হয়ে গিয়েছিল ব্রহ্মসংগীত। তাঁর মাথার কাছে বাড়ির কেউ বসে বেদ মন্ত্র পাঠ করছিলেন – পায়ের কাছে মাটিতে বসে ব্রাহ্ম সমাজের পুরোহিত স্তোত্রপাঠ করছিলেন, এমনকি একজন চৈনিক অধ্যাপকও তাঁর ঘরে ভগবানের নামজপ করে গিয়েছিলেন।
আসলে আজ যে মহাকবি তার পরম আত্মার সাথে মিলিত হতে চলেছেন, তাই তো সকলের একই প্রার্থনা তার যাত্রাপথ যেন সুগম হয়, সুন্দর হয় –
একেবারে মধ্যাহ্নের শেষ প্রহরে কবি চলে গেলেন।
এই কথা রেডিওতে ঘোষণা হওয়ার সাথে সাথে বাড়ির লোহার গেট ভেঙে পড়ল। এতক্ষণ যে ভক্তের দল তাদের প্রিয় কবির জন্য ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করছিলেন – কবি আর নেই শুনে আর বাঁধ মানলেন না – সমস্ত বাড়ি, রাজপথ তখন জনজোয়ারে ভাসতে লাগলো – কবিগুরু কে রাজ বেশে সাজানো হয়েছিল সাদা গরদের ধুতি-পাঞ্জাবি, কপালে চন্দন, গায়ের ওপর লাল একখানি উত্তরীয় – ফুলে ফুলে ঢাকা ছিল তাঁর পবিত্র দেহ –
বাড়ির ছেলেরা শুধুমাত্র কাঁধে করে তাকে দোতলা থেকে নিচে নামাবার সুযোগটুকু পেয়েছিল – তারপরেই জনসমুদ্রের ঢেউয়ে ভাসতে-ভাসতে চলে গিয়েছিলেন তিনি – অস্তগামী সূর্যের সাথে সেদিন জোড়াসাঁকোর রবিও অস্তাচলে গেলেন।
জনতার ভিড়ে সেদিন নিচে নামার উপায় না থাকায় দোতলার বারান্দায় এসে দাঁড়িয়েছিলেন অবনীন্দ্রনাথ, তাঁর প্রিয় “রবিকা”-কে শেষ বিদায় জানাবার জন্য –
একবার ক্ষণিকের জন্য চোখের সামনে ভেসে উঠেছিল লাল উত্তরীয় খানি – ব্যাস, চিরদিনের মতো হারিয়ে গেল তাঁর “রবিকা” – পরমুহূর্তে তিনি তাঁর পুত্রবধুর (অর্থাৎ আমার মা) কাছে একখানি কাগজ ও পেন্সিল চেয়েছিলেন, আমার মা নমিতা দেবী অত লোকজনের ভিড়ে কোন কাগজ খুঁজে না পেয়ে এগিয়ে দিয়েছিলেন ঘরের কোণে পড়ে থাকা একটি পাতলা কাগজের বাক্স – সদা আত্মভোলা মানুষটি কোন দ্বিরুক্তি না করে সেই কাগজটিতেই কিছু আঁকতে আরম্ভ করেছিলেন – পরদিন দেখা গেল তিনি তাঁর সমস্ত শিল্পীসত্তা উজাড় করে এঁকে রেখেছেন একখানি ছবি – কাল শেষবারের মতো তিনি তার “রবিকা”-কে যেমন দেখেছিলেন তেমনটি তিনি তাঁর মনের মাধুরী মিশিয়ে এঁকে রেখেছেন। এই স্বল্পবাক শিল্পী মানুষটি তাঁর শোক প্রকাশের মাধ্যম হিসাবে হয়তো সেদিন বেছে নিয়েছিলেন কাগজ পেন্সিল রং ও তুলি।
এই ছবিটি ছিল তাঁর অত্যন্ত প্রিয় অত্যন্ত কাছের মানুষ “রবিকা”-র প্রতি তাঁর শেষ শ্রদ্ধাঞ্জলি –
এইভাবেই সৃষ্টি হল অবনঠাকুরের সেই অন্যতম কালজয়ী শিল্পকর্মটি “রবীন্দ্রনাথের শেষযাত্রা”।
‘শেষযাত্রা’ ~ অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর