বিবিধগল্প

লড়াই

সুব্রত ঘোষ

দিনটা শুরু হয়েছিলো গত ছ’মাস ধরে চলে যাওয়া দিনগুলোর মতো করেই। অর্থাৎ প্যান্ডেমিকের ভয়ে ঘরে সেঁধিয়ে বসে থেকে মাঝে মাঝে জানালা দিয়ে পান্তুয়ার মতো গোল গোল চোখে উঁকি মেরে দেখে অথবা ফাঁকা রাস্তায় কোভিড পেসেন্ট নিয়ে ছুটে যাওয়া য়্যাম্বুলেন্স দেখে মুখ শুকিয়ে নিজের হার্টবিট বাড়িয়ে ফেলে নিজেকে কোরোনার খপ্পরে পড়া এক রুগী কল্পনা করে; আর কোরোনা যদি কামড়ে ধরে সেই ভয়ে আধমরা হয়ে ঘণ্টায় ঘন্টায় ব্ল্যাক টী, গ্রীন টী আর ঘরেলু উপাচার কাঢ়া বা পাঁচন গিলে নিজের ইমিউনিটি বাড়ানোর চেষ্টা করে। যদি বরাত ভালো থাকে তাহলে সময়টা টিভিতে কোরোনা সংক্রান্ত খবর শুনে বা মোবাইলে ফরওয়ার্ড করা ভিডিও দেখে, অন্যদের কমেন্টস পড়ে আর বাড়তি সময় টুকু ঘরনীর সঙ্গে কথার ঘুড়ি উড়িয়ে তাতে জবরদস্তি প্যাঁচ লাগিয়ে দিয়ে বুড়ো বয়সে একটু হাসি মস্করা করে। গতরাতে ঘুম চটিয়ে রাতের মধ্যযাম পর্য্যন্ত জেগে মোবাইল ঘেঁটে কিছু ভিডিও আর মেসেজ দেখে যখন ঘড়ির দিকে তাকালাম, দেখলাম ওর হাত দুটো আমাকে দেখিয়ে দেখিয়ে নিঝুম রাতে টিকটিকির মতো আওয়াজ করে আড়াইটের খুঁটি ছুঁয়ে বেরিয়ে যেতে চাইছে। পাশে তাকিয়ে দেখি চোখ ধাঁধানো এল ই ডি বাল্বের সাদা আলোর জ্যোৎস্না -তলায় বয়সের ভারে ঝরে যাওয়া লাবণ্য আর অনেক সাংসারিক অভিজ্ঞতা অর্জনের ক্লান্তির ভাঁজ গালে ও কপালে ফেলে আমার ইহকাল – পরকালের সাথী পুরোনো দিনের স্বপ্ন দেখতে দেখতে ঘুমিয়ে পড়েছেন। তখনই কান থেকে হেডফোনের প্লাগদুটো খুলে “দুগ্গা দুগ্গা জয় মা কালী” বলে শুয়ে পড়েছিলাম। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে সকাল সকাল বিছানা ছেড়ে উঠে পড়ার অভ্যাসটা অনেকদিনই হয়ে গেল চলে গ্যাছে। তাই সকাল ন’টা নাগাদ বিছানা ছেড়ে উঠে দৈনন্দিন প্রাতঃকৃত্য সেরে প্রিন্ট মিডিয়ার সব রকম আশ্বাসনকে অগ্রাহ্য করে নিউজপেপারগুলোর গায়ে তেল মাখানোর মতো করে স্টেরিলাইজার মাখিয়ে ভাইরাস মুক্ত করে নিয়ে জম্পেস করে বসে ব্ল্যাক টী সহযোগে সকালটাকে তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করছি, ঠিক সেই সময়ে বাইরে রাস্তায় দুটি দলের তীব্র কর্কশ চিৎকার চেঁচামেচি আর লড়াই এর আওয়াজ পেয়ে ঘরের দরজা ফাঁক করে দেখতে হোলো। শান্ত পরিবেশে এই লড়াইয়ের ঘটনা সকালের সুন্দর আবহাওয়াকে হঠাৎ বেশ কয়েক ডিগ্রি গরম করে দিলো। প্রথম দিকটায় এড়িয়ে যেতে চাইলেও একটু পরে সেই চিৎকার চেঁচামেচিতে একটু বিরক্ত হয়ে গা এলানো আলসেমি ছেড়ে উঠতেই হোলো। দরজা খুলে মুখ বাড়িয়ে দেখি সাধারণতঃ নির্বিরোধ দুই পক্ষের মধ্যে ভীষণ ঝগড়া লেগেছে এবং দেখতে না দেখতেই দুই পক্ষের মধ্যে প্রচন্ড লড়াই শুরু হয়ে গ্যালো। যথেচ্ছ কর্কশ ভাষায় গালাগালি, তার সঙ্গে আঁচড়ে খিমচে একে অপরকে রাস্তায় ফেলে তার বুকের উপর চেপে বসে সমানে হাতের পাঞ্জা চালাচ্ছে । মনে হোলো মাঝে মাঝে কানের কাছ পর্য্যন্ত মুখ নিয়ে গিয়ে কিছু বলছে তবে মুখে কোনো আঘাত করছে না, বুক পেট তাক্ করেই হাত পা চালাচ্ছে। আবার এক মুহূর্তে উপরের জনকে দেখলাম নিচে শুয়ে উপরের পাঞ্জার ব্লো সামলাচ্ছে। তবে লড়াই প্রধানতঃ দুজনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকছে। বাকী দুটিতে নিজের পক্ষ সমর্থনে অন্য পক্ষের হাত বা পা ধরে টানছে। তবে সেটা লড়াই থামানোর চেষ্টা বলে মনে তো হোলোই না,বরং যে যার নিজের জনকে লড়াই চালিয়ে যাবার জন্য প্ররোচিত করছে বলেই মনে হোলো।

চোখের সামনে শহরবাসী আর সকলের মতো আমিও দূর থেকে ওই চারজনের প্রচণ্ড ঝগড়া মারামারি দেখছি, তবু এগিয়ে গিয়ে ওদের ছাড়িয়ে দেবার কথা মাথায় আসছে না। সেটা হয়তো আমাদের দিনদিন অত্যন্ত আত্মকেন্দ্রিক হয়ে ওঠার ফল! সহজে অন্য কারোর ব্যাপারে নাক গলানোর সদিচ্ছা বা মানসিকতা থেকে নিজেকে সরিয়ে রেখে ‘চাচা আপন প্রাণ বাঁচা’ পলিসি মেনে চলা। যারা লড়াই বা ঝগড়া মারামারি করছে, তাদের বয়স খুব একটা বেশি বলে মনে হয় না এবং ওদের দেহের গঠনও বেশ ছোটো। তবে ঝগড়া মারামারিতে দুপক্ষেরই যথেষ্ট দক্ষতা আছে বলেই মনে হোলো। আর মনে হোলো দুপক্ষেই একটি করে মহিলা বিদ্যমান যারা বাক্ বিতন্ডায় পটু। আর অপর দুটি নিশ্চয় পুরুষ, তাই তেড়েফুঁড়ে উঠে মারামারিতে লিপ্ত হচ্ছে। কে দেখছে আর কে দেখছে না সে ব্যাপারে ওদের কোনোই মাথাব্যথা নেই। ওদের শরীরের গঠন যেমন এক, ওদের পোষাক পরিচ্ছদেও কোনো তফাৎ নেই। দেখে বোঝা যায় ওটা ওদের কমিউনিটির আইডেনটিটি। এরকম নয় যে আমাদের কাছে ওরা নতুন। কারণ ওদের প্রায় সব সময়ই দেখি। আমাদের সঙ্গে কোনোরকম কথাবার্তা না থাকলেও এটা জানি যে ওরা এই এরিয়ারই বাসিন্দা আর ঘুরতে ফিরতে আসতে যেতে দেখা হয় প্রায়ই। দূর থেকে দেখেও বোঝা যায় যে ওদের দু পক্ষই বেশ রেগে আছে আর আক্রোশে ফুঁসছে। তাই মাঝে মাঝে ক্লান্ত হয়ে পড়ে দূরে সরে গিয়ে আবার ঝাঁপিয়ে পড়ছে একে অপরের উপর। মনে হয় ওদের সাংসারিক ব্যাপারের জের ঘরের মধ্যে না মিটে বাইরে রাস্তায় এসে ঠেকেছে  এমতাবস্থায় কিছু বলতে যাওয়ায় বিপদ আছে। দু তরফেই যদি মধ্যস্থতায় পাত্তা না দেয়, তবে নিজেরই প্রেস্টিজ লস্। উপর থেকে কিছু লোক হাসবে। তার থেকে দূর থেকে দেখাই সমীচীন। হাতাফাই করতে করতে ওরা রাস্তার একপাশে ফুটপাথের ধারে চলে গেছে বলে লোকে গাড়ি চালিয়ে যাবার সময় একবার তাকিয়েই চলে যাচ্ছে। জানালা খুলে দেখার ইচ্ছে বা সময় কোনটাই তাদের নেই। হয়তো ভাবছে লড়াই করে মরতে চাইছে, মরুক, তাতে কার কি যায় আসে?

এইভাবে বেশ কিছুক্ষণ ঝগড়া মারামারির পর দু পক্ষই বেশ কাহিল হয়ে পড়ে একসময় রণে ভঙ্গ দিলো। দেখলাম একপক্ষ কিছুটা দূরে সরে গিয়ে গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে যাচ্ছে বা বলা যায় তড়পে যাচ্ছে। আর দ্বিতীয় পক্ষ আমাদের বাড়ির দিকে এগিয়ে এসে সামনের মোড় থেকে ডানদিকের রাস্তা ধরলো। তবে তারাও চুপ না থেকে সমানে অপর পক্ষের কর্কশ বাক্যবাণের জবাবে যথেষ্ট কর্কশভাবেই প্রত্যুত্তর দিতে দিতে হাঁটছিলো। কিন্তু একভাবে গায়ে ফোস্কা পড়া কথা কাঁহাতক শোনা যায়, তাও যখন এক যৌবনমদেমত্তা যুবতী সঙ্গিনী বুক ফুলিয়ে সঙ্গে সঙ্গে হাঁটছে? তাই বাক্যবাণে জর্জরিত হয়ে পুরুষপুঙ্গব একবার ঘুরে দাঁড়িয়ে অপর পক্ষকে সমুচিত শিক্ষা দিতে উদ্যত হলো, একটু এগিয়ে যাওয়া সঙ্গিনী সঙ্গে সঙ্গে ফিরে এসে ওর মুখের কাছে মুখ নিয়ে গিয়ে কিছু বললো। ওরা কি বলাবলি করলো সেটা ঠিক বোঝা গেল না। মেট্রোপলিটন সিটিতে কত ভাষার আদান প্রদান হয়, সব বোঝা সম্ভব নয়। তবুও মনে হোলো যেন বললো ‘এদের সঙ্গে ঝগড়া চেঁচামেচি করে সময় নষ্ট করার কোনো মানে আছে? ওরা অর্বাচীন, কিছু বুঝবে না। তার চেয়ে বাড়ি যাই চলো, অনেক কাজ বাকি।‘ দেখলাম তাতে কাজ হোলো। সঙ্গীটি তাদের মেনে নিয়ে অপর পক্ষের কথার কোনো জবাব না দিয়ে তার সঙ্গে চলে গেল। অপর পক্ষ বার কয়েক চেঁচিয়ে যখন দেখলো কোনো জবাব আসছে না, তখন তারাও চুপ করে গিয়ে নিজেদের কাজে মন দিলো। চারিদিক কোলাহল মুক্ত হতে পাড়ায় আবার শান্তি ফিরে এলো।

আমিও আবার ফিরে এসে নিজের জায়গায় বসে সকালের কাগজটা হাতে তুলে নিতে নিতে ভাবলাম যে আমাদের প্রক্সিমিটিতে আসার আগেই কি দাঙ্গা-হাঙ্গামা-মারামারি, পরশ্রীকাতরতা ইত্যাদি মানবিক বদগুণগুলো পৃথিবীর অন্যান্য প্রাণীর মধ্যেও ভগবান একটু ঢুকিয়ে দিয়েছিলেন, না কি আমাদের সংস্পর্শে আসার পরেই তারা এইগুণগুলো এক্যুয়ার করেছে? তা যাই-ই হয়ে থাক, এই ধরণের সংক্রমণ কোভিড-19 এর ভয়ানক ভাইরাসের থেকেও ভয়ঙ্কর বলেই আমার মনে হয়। আমার কেন জানি না এটাও মনে হয় যে মানুষের শহর বা গ্রাম ছেড়ে সসাধারণভাবে নিজেদের স্বাভাবিক প্রাকৃতিক পরিবেশে থাকলে হয়তো এই গল্পের নায়ক নায়িকারা অর্থাৎ শালিকগুলো নিজেদের মধ্যে মানুষের মতো এমন চিৎকার চেঁচামেচি আর মারপিট করে সুন্দর একটি সকাল নষ্ট করতো না।

লেখক পরিচিতি

সুব্রত ঘোষ

সুব্রত ঘোষ কবি ও লেখক হিসাবে দিল্লিতে বিশেষ পরিচিত একটি নাম। প্রায় পাঁচ দশক আগে কর্মসূত্রে দিল্লিতে আসেন এবং গ্রুপ থিয়েটারে অভিনয়, যাত্রাভিনয় এবং বাচিক শিল্পী হিসাবে যথেষ্ট প্রতিষ্ঠা পান। পরবর্তীকালে সুব্রত ঘোষ কবিতা লেখা ও সাহিত্য সৃষ্টিতে মন দেন। তাঁর লেখা কবিতা, রম্যরচনা, গল্প, প্রবন্ধ, নাটক ইত্যাদি পশ্চিমবঙ্গ, মুম্বাই ও দিল্লির বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় এবং ই-পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে বা হচ্ছে। সুব্রত ঘোষ উত্তরবঙ্গ নাট্যজগৎ দ্বারা 2018 সালে ‘বিশিষ্ট কবি’-র স্বীকৃতি ও সম্মান লাভ করেছেন। তাঁর প্রকাশিত কবিতার বই ‘ইচ্ছে পাখি’ পাঠক ও গুণীজন দ্বারা সমাদৃত। সুব্রত ঘোষ দিল্লির ‘দ্যুতি সাহিত্য সভার’ একজন দায়িত্বশীল ব্যক্তি। তিনি একটি আন্তর্জাতিক সাহিত্য সংস্থার সঙ্গেও যুক্ত।

Author

Du-কলম

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!