সঞ্চারী গোস্বামী মজুমদার
“কলকাতা”এই নামটা শুনলেই সবার আগে যেগুলো মনে আসে তা হলো হাওড়া ব্রিজ, গঙ্গা, ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল, ট্রাম, ফুচকা, মাছের ঝোল, রসগোল্লা, দুর্গাপূজো এবং আরো কত কি। এই শহরের মধ্যে জড়িয়ে আছে অনেক ঐতিহাসিক, ঔপনিবেশিক, উজ্জ্বল এবং স্নিগ্ধ গল্প যা মন ছুঁয়ে যায়। কিন্তু সেই শহরের একটি অন্ধকার দিক আছে। এই শহরে এমন কিছু জায়গা আছে যা মানুষকে ভয় পাওয়াতে যথেষ্ট। এবার দেখে নেবো একে একে সেই সব জায়গাগুলি কি।
১. ন্যাশনাল লাইব্রেরী
ব্রিটিশ আমলে তৎকালীন গভর্নর জেনারেল, যার কাছে খুব বিরল এবং বেশ কিছু উল্লেখযোগ্য বই তার গ্রন্থাগার অর্থাৎ লাইব্রেরীতে সংরক্ষনে ছিল। এখনো এখানে বিভিন্ন ধরনের বই পাওয়া যায়। অনেক দুষ্প্রাপ্য বইও পাওয়া যায়।এটা বিশ্বাস করা হয় যে,লেডি মেডিক্যাল্ফে, যিনি গভর্নর জেনারেলের স্ত্রী ছিলেন, তার ছিল বইয়ের প্রতি আকর্ষণ এবং তিনি সবসময় সবকিছু পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখতে পছন্দ করতেন।

যে সমস্ত ছাত্র-ছাত্রীরা অনেক রাত অব্দি ওই লাইব্রেরীতে পড়াশোনা করে এবং নাইট গার্ড যারা থাকে তাদের কাছ থেকে অনেক সময় বেশি রাতে পায়ের শব্দ শুনতে পাওয়ার কথা এবং একটি ধূসর ছায়ামূর্তি প্রতিচ্ছবি দেওয়ালে দেখতে পাওয়ার কথা। 2010 সালে রেস্টরেশনের কাজ চলাকালীন মিনিস্ট্রি অফ কালচার অ্যান্ড আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়া একটা ঘর একতলায় আবিস্কার করে যা দরজা ছাড়া। একটা গুজব আছে যে এই ঘরটি ব্রিটিশ শাসনের সময়ে সিক্রেট চেম্বার হিসেবে ব্যবহার করা হতো।
২. দ্য রয়েল ক্যালকাটা টার্ফ ক্লাব
অনেক বছর আগে জর্জ উইলিয়াম নামে এক ব্যক্তি ছিলেন যিনি ‘রেস ফ্রিক’ ছিলেন। রেস জেতার ইচ্ছে এবং স্বপ্ন দুটো জিনিস ঘিরে ছিল তার পছন্দের সাদা ঘোড়া যার নাম হল প্রাইড। এই প্রাইড ছিল সব রেসের চ্যাম্পিয়ন। কিন্তু বয়স বাড়ার সাথে সাথে প্রাইড দুর্বল হয়ে পড়ে এবং একবার একটি ডার্বিতে হেরে যাওয়ার পরেরদিন তাকে ট্র্যাকে মৃত অবস্থায় পাওয়া যায়।

এটা অনেকেই বলেছে যে রয়েল ক্যালকাটা টার্ফ ক্লাব বা রেসকোর্সে দেখা গিয়েছে শনিবার রাতে চাঁদের আলোয় একটি সাদা ঘোড়া দৌড়াচ্ছে। এরকম দৃশ্য দেখে অনেকেরই ভয় পেয়েছে। কিছু মেইনটেনেন্স স্টাফ কুয়াশাচ্ছন্ন রাতে এই দৃশ্য দেখে এবং বলে “উইলিয়াম সাহেব কি সাদা ঘোড়া”।
৩. ভূত বাংলো
একসময়ের বাংলার গভর্নর জেনারেল উইলিয়াম হেস্টিংস এই বাড়িটি তার থাকার জন্য বানায় যার নাম বেলভেদের এস্টেট। এই জায়গাটা এখন বর্তমানে উইমেন্স কলেজ, যেটা ক্যালকাটা ইউনিভার্সিটির আন্ডারে। অনেকে বলে যে এখানে যে সমস্ত স্টাফ এবং হোস্টেলের মেয়েরা থাকে তারা নাকি একজন ইংলিশ সাহেবকে ঘুরতে দেখেছে তার ঘোড়া নিয়ে কলেজের প্রাঙ্গণে।
এই ঘটনা ছাড়া আরো কিছু বছর আগে একটি অল্প বয়সী ছেলে খুব অদ্ভুত ভাবেই মারা যায় ফুটবল খেলতে গিয়ে কলেজের গ্রাউন্ডে। কেউ কেউ বলে এই ছেলেটির ছায়ামূর্তি এ দেখা যায়। এছাড়া ওই জায়গা নিয়ে আরও অনেক রকমের কথা শোনা যায়।
৪. পার্ক স্টিট সিমেট্রি
পার্ক স্টিট সিমেট্রি হলো কলকাতার সবথেকে পুরনো গ্রেভিয়ার্ড যেটা তৈরি করা হয়েছিল ১৭৬৭ সালে। এই জায়গার নিজস্ব একটি সৌন্দর্য আছে। এখানকার গাছপালা প্রাকৃতিক সৌন্দর্য এবং সমস্ত খবর যা ব্রিটিশ আমল থেকে রয়েছে প্রত্যেকটি খুব সুন্দর। এই জায়গার নাম ভয় পাওয়ার জন্য যথেষ্ট। অনেকেই এখানে ছায়ামূর্তি দেখতে পায় দেওয়ালে, অদ্ভুত অদ্ভুত কিছু আওয়াজ শুনতে পায় যা কোন অশরীরি থাকার কিছু চিহ্ন।
কিছু বছর আগে এখানে বন্ধুদের একটি গ্রুপ আসে এবং ছবি তোলে। বলা হয় যে ছবি তুলছিল সে আচমকা খুব অসুস্থ হয়ে পড়ে এবং ছবিগুলো ওঠে তার মধ্যে কিছু অদ্ভুত ছায়ামূর্তি আসে। এছাড়াও আরও অনেক এই ধরনের ঘটনা ঘটেছে এই জায়গাতে।
৫. রবীন্দ্র সরোবর মেট্রো স্টেশন
রবীন্দ্র সরোবর একটি ব্যস্ত মেট্রো স্টেশন যেটা সাউথ কলকাতার বুকে অবস্থিত। ঘটনাচক্রে এই মেট্রো স্টেশনে অনেক বেশি মেট্রো সুইসাইডাল কেস হয়েছে। এটা বলা হয় যে অনেক বেশি রাতের দিকে যে সমস্ত মানুষরা সুইসাইড করেছে তাদের আত্মা ওই জায়গায় ঘোরে।
আবার অনেকে এটা বলে যে স্টেশনের পিলারে বা ট্রাকের ওপর অনেক ছায়া পড়ে। এইসব কারণগুলো এই জায়গাকে কলকাতার বুকে একটি হন্টেড প্লেস করে তুলেছে।
৬. কলকাতা ডক
কলকাতা ডক বা খিদিরপুর ডক তৈরি করে আয়ুধের নবাব ওয়াজিদ আলি শাহ। এই নবাবের সাথে ব্রিটিশেরা প্রতারণা করে যখন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বাণিজ্য করছিল। এই জায়গা ঘিরে অনেক রকম গল্প আছে।
অনেক নাবিক এবং ব্যবসায়ী এখানে কিছু ছায়ামূর্তি দেখেছে যা বলা হয় নবাবের ছায়া। এই ডক এর আশেপাশে এই ছায়ামূর্তি কে ঘুরতে দেখা গিয়েছে। বলা হয় যে নবাবের আত্মা আজও ঘুরে বেড়ায় ব্রিটিশদের কাছ থেকে প্রতারণার বদলা নেওয়ার জন্য।
৭.গঙ্গার ঘাট
গঙ্গার ঘাট অনেক আছে কলকাতাতে কিন্তু হাওড়া ব্রিজের কাছে যে গানগুলি আছে শোনা যায় তা ভুতুড়ে। এই গঙ্গার ঘাটে অনেক রকম অস্বাভাবিক মৃত্যু এবং সুইসাইডের ঘটনা জড়িয়ে আছে। বলা হয়েছে যে সমস্ত মানুষরা এ দুর্ঘটনায় মারা গেছে তাদের আত্মা এই জায়গায় ঘুরে বেড়ায়।
যে সমস্ত লোকেরা মল্লিক এবং জানানা ঘাটে সকালের দিকে যায় তারা দেখতে পায় কিছু ফ্যাকাশে হাত জলের থেকে বেরিয়ে আছে সাহায্যের জন্য। যদিও এই ধরনের ঘটনা বাস্তবেও ঘটতে পারে তাই আমাদের উচিত দেখেশুনে কাজ করা। কারণ অনেক সময় অনেকে প্রকৃত সাহায্যের জন্যও হাত বাড়ায়।
৮. রাইটার্স বিল্ডিং
এই বিল্ডিং ব্রিটিশ আমলের জুনিয়র স্টাফ এবং ক্লার্কদের অফিস ছিল। পরে এটি সরকারি অফিস হিসাবে পরিবর্তিত হয়। এই অফিসে অনেক বড় বড় এবং খালি ঘর রয়েছে। অনেকেই এখানে বেশি রাত অব্দি কোনো কারণবশত কাজ করতে বা থাকতে চায় না।
শোনা যায় যে যে সমস্ত নাইটগার্ডেরা ছিল বা যারা পাশের রাস্তায় বিক্রেতারা থাকত তারা সবাই সন্ধ্যের পরে এই বিল্ডিং থেকে কান্নার শব্দ শুনতে পেয়েছিল।
৯. উইপ্রো অফিস
কলকাতা সল্টলেকে অঞ্চলে এই অফিস অবস্থিত। এই জায়গা একটা সময় পুরো জলাভূমি ছিল। এই অফিস তৈরি করা হয় একটি কবরস্থানে। অনেকেই অনেক ছায়ামূর্তি দেখেছে এই বিল্ডিংএ। এই বিল্ডিং এর চার তলা সবথেকে বেশি ভুতুড়ে।
লোকেরা এই বিল্ডিং এ অনেক সময় অদ্ভুতভাবে জিনিস পড়ে যাওয়ার আওয়াজ শুনতে পেয়েছে উপরে বা নিচে যাওয়ার সময় লিখতে বা সিঁড়িতে করে। সিকিউরিটি গার্ড যারা থাকে তারা বলেছে রাতের দিকে তারা অনেক ধরনের অদ্ভুত আওয়াজ শুনতে পেয়েছে।
১০. লোয়ার সার্কুলার রোড সিমেট্রি
ব্রিটিশ জমানার একজন সিভিল সার্ভেন্ট যার নাম স্যার উইলিয়াম হে মাকনাঘটে (Sir William Hay MacNaghte)। অাফগান যুদ্ধে ওনাকে খুব নৃশংস ভাবে হত্যা করা হয়। ওনার স্ত্রী ওনার ছিন্নবিচ্ছিন্ন অংশগুলি এই সিমেট্রিতে কবর দেয়। রাতের দিকে অনেকেই এই সিমেট্রি থেকে অদ্ভুত ধরনের আওয়াজ পেয়েছে বলে জানা গিয়েছে।
এমনও কথা শোনা যায় যে আজও যারা ওনার কবরের সামনে ওনার হত্যার গল্প ও কারণ বলে, তখনই তার কবরের উপরে যে গাছ আছে সেটা থরথর করে কেঁপে ওঠে।
এই ১০ টি জায়গা ছাড়াও হয়তো আরো অনেক জায়গা আছে কলকাতার বুকে যা রহস্যময়। কিন্তু ভূত বা ভূতের জায়গা বলতেই এই দশটি জায়গার কথা অবশ্যই মনে আসে আমাদের। এই জায়গাগুলোর সাথে হয়তো আমার নিজের কোন অভিজ্ঞতা নেই। তাই হয়তো এই প্রত্যেকটি জায়গার সত্যতা আমি নিজে থেকে বলতে পারব না। তবে হ্যাঁ, গল্প হিসাবে যা শুনেছি তা থেকে এই জায়গা গুলি প্রত্যেকটাই যে কিছুটা ভুতুড়ে,সেটা জেনেছি।
Sanchari Goswami Majumdar
Loves to teach and practice dance. Likes to read books.