শ্রী দেবাশিস পোদ্দার
বারোয়ারি পুজোতে তখন ধুনুচি নাচ প্রতিযোগিতা মাস্ট। একটা সন্ধ্যা ধুনুচি নাচের জন্যেই রাখা থাকত। মাইকে মুহুর্মুহু ঘোষণা। আগে থাকতেই নাম দিতে হবে। সেইমতো ধুনুচি, ছোবড়া, ধুনো এসবের আয়োজন। মাটির ধুনুচি আর নারকেলের ছোবড়া। ছোবড়াগুলিকে সুন্দর করে সাজাতে হত ধুনুচির মধ্যে। নিচের আর ওপরের লেয়ারে এমনভাবে ছোবড়া গুলিকে পরপর রাখতে হত যাতে ধুনুচি যেকোনো দিকে ঘোরালেও জ্বলন্ত ছোবড়া এদিক ওদিক ছিটকে না পড়ে। ধুনুচি সবাই সাজাতে পারে না।এই কাজের এক্সপার্ট লোকজন সব পাড়াতেই কমবেশি থাকত আর তারাই এগিয়ে এসে ওই কাজের দায়িত্ব নিত।
প্রথমে ধুনুচিগুলোকে ছোবড়া দিয়ে ভরে পরপর সাজিয়ে রাখা হত। পরে প্রয়োজন অনুযায়ী ধুনুচির ছোবড়াতে আগুন দেওয়া হত আর সঙ্গে খানিকটা ধুনো ছড়িয়ে দেওয়া হত ওই জ্বলন্ত ছোবড়াতে। গলগল করে ধোঁয়া বেরতে থাকত তখন ধুনুচি থেকে।
ধুনুচি নাচ প্রতিযোগিতায় নাচতে হত ঢাকের বাজনার সাথে। ঢাকীর ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। নাচতে হবে তালে তালে। যেমন তাল তেমন নাচ। মাঝেমাঝে ঢাকের তাল পাল্টে যেত আর নাচের ছন্দেরও পরিবর্তন ঘটত সেই অনুযায়ী। অনেকটা ঢাক আর নাচের যুগলবন্দি।
নাচের শুরুতে একটা টিপিক্যাল ঢাকের কুরকুরি দেওয়া হত। প্রতিযোগী তখন হাঁটু গেড়ে বসে ধুনুচি ছাড়াই শুধুমাত্র তার শরীর আর হাতদুটোকে ওই ঢাকের কুরকুরির সাথে একই ফ্রিকোয়েন্সি তে কাঁপাতে থাকত নানা ভঙ্গিমায়। কখনো সামনে ঝুঁকে পড়ছে আবার পরক্ষনেই পেছনে হেলে পড়ছে। কখনো বাঁদিকে আবার তারপরেই ডানদিকে হস্তযুগল সহ শরীরের কম্পন ওই কুরকুরির তালেতালেই। এইভাবে প্রায় মিনিট খানেক কুরকুরির পর যখন ঢাকে তাল উঠত তখনই প্রতিযোগী দুহাতে দুটো ধুমায়মান ধুনুচি নিয়ে ঢাকের তালে তালে প্রতিমার দিকে মুখ করে নাচ শুরু করত। বিভিন্ন রকম ভাবে শরীরটাকে একিয়ে বেঁকিয়ে হাতের ধুনুচি দুটোকে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে ঢাকের তালে তালে চলত নাচ। কেউ কেউ নাচতে নাচতে আরও ধুনুচি তুলে নিত মুখে। দাঁত দিয়ে একটা ধুনুচি কামড়ে আর দুহাতে দুটো ধুনুচি নিয়ে নাচতে থাকত। ঘেমে নেয়ে একসার। কেউ কেউ দুহাতে দুটো করে মোট চারটে, মুখে একটা আবার ওই অবস্থায় কপালেও একটা বা দুটো ধুনুচি কোনো রকমে ব্যালেন্স করে রেখে ঢাকের ছন্দে হাল্কা হাল্কা কোমর দোলাত। তখন মনে হত, কে কতগুলো ধুনুচি নিয়ে নাচতে পারে এযেন তারই প্রতিযোগিতা। দর্শকরাও খুব টেনশনে পড়ে যেত এরকম সময়ে। যদি পড়ে যায়!! চারিদিকে দর্শকমন্ডলী, একদিকে প্রতিমা আর একপাশে চেয়ার টেবিলে বসে নম্বর দিতেন বিচারকেরা। নাচ শুরু হত ঘন্টা বাজিয়ে। শেষ হওয়ার এক মিনিট আগে একবার ওয়ার্নিং আর সময় একেবারে শেষ হলে ফাইনাল বেল। তখন প্রতিযোগী সবগুলো ধুনুচি ধীরে ধীরে নামিয়ে রেখে সবাইকে নমস্কার করে প্রস্থান করত। আবার আসত পরের প্রতিযোগী। সর্বশেষ প্রতিযোগী পর্যন্ত চলতে থাকত এভাবেই। বেশিরভাগ প্রতিযোগী অত্যন্ত সাধারণ পোষাক পড়েই ধুনুচি নাচত। কিন্তু দু-একজন ছিল এই লাইনে এক্সপার্ট মানে প্রফেশনাল ধুনুচি নাচিয়ে। তারা রীতিমতো সাদা ধুতি আর সাদা গেঞ্জি পরে কোমরে লাল গামছা জাতীয় কাপড় বেঁধে নাচত। দেখেই বোঝা যেত ওরা খুবই অভিজ্ঞ ধুনুচি নাচিয়ে। নতুন নতুন স্টাইল দেখা যেত ওদের নাচের সময়। তবে সকলেই শালীনতা বজায় রেখে নাচত। কেউ নাচতে নাচতে কোনোরকম বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করলে তাকে তৎক্ষণাৎ ডিসকোয়ালিফাই করে দেওয়া হত। একটা অলিখিত নিয়ম, শাসনের মধ্যে দিয়ে প্রতিযোগিতাগুলো চলত আর সকলেই তা ভীষণভাবে উপভোগ করত।
বাবাকে প্রায় সব জায়গাতেই এই বিচারক মন্ডলীর অন্যতম আসন অলংকৃত করতে হত। সাথে অন্য আরও দুজন বিচারকও থাকতেন। তিনজন বিচারক প্রতিযোগিতার শুরুতেই ঠিক করে নিতেন কোন কোন বিষয়ের ওপরে নম্বর দেওয়া হবে। সেইমতো চলত নম্বর দেওয়ার কাজ। প্রতিযোগিতার শেষে তিনজন বিচারকের দেওয়া নম্বরগুলির গড় করে প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় স্থানাধিকারী ঠিক করা হত।
বাবার যাওয়া মানে আমারও যাওয়া। চলে যেতাম বাবার সঙ্গে মন্ডপে ধুনুচি নাচ দেখতে। কখনো কখনো নামও দিয়ে দিতাম প্রতিযোগিতায়। পুরস্কারও জুটেছিল বেশ কয়েকবার।
কিন্তু পুরস্কার নেবার সময় একটা মিশ্র অনুভুতি হত মনে মনে। তা ছিল লজ্জা মিশ্রিত আনন্দ। বাবার হাত থাকে পুরস্কার নিতে লজ্জা আর ভেতরে ভেতরে পুরস্কৃত হবার আনন্দ। এই দুইয়ে মিলে তখন আমার মুখের অভিব্যক্তিটা যে কেমন হত তা যদি এখন একবার দেখতে পারতাম তাহলে কি ভালই না হত!!
একটা স্ক্রীনশট নিয়ে রাখতাম নিশ্চয়ই।
শ্রী দেবাশিস পোদ্দার
এম.এস্.সি. পদার্থ বিদ্যা, বি.এড.
প্রধান শিক্ষক, বনমালিপুর প্রিয়নাথ ইনস্টিটিউশন
বারাসাত, কলকাতা – ৭০০১২৪।
যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের এক্স ব্লু ( ১৯৮৫-১৯৮৭) ফুটবলার।
হৈ হৈ করে বাঁচতে পছন্দ করি।
খেলাধূলা, সিনেমা দেখা, গান শোনা, আড্ডা দেওয়া প্রভৃতিতে আগ্রহী।
Facebook আর WhatsApp-এ প্রবল আসক্তি।