অঞ্জন বসু চৌধুরী
এ লেখা সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত কিছু চিঠির সংকলন। যা আমার কাকু অঞ্জন বসু চৌধুরী এই ব্লগ খোলার সময় আমায় উৎসাহ জানিয়ে লিখেছিলেন। এই লেখায় বর্ণিত চরিত্রগুলি সবাই আমার প্রিয়জন। ঘটনাগুলি এক একটা নস্টালজিয়া। তাই ওনার অনুমতি নিয়ে লেখাগুলো অপরিবর্তিত রেখে আপনাদের সামনে তুলে ধরলাম। ~ সুদেষ্ণা মিত্র
তমলুক আগে তাম্রলিপ্ত নামে পরিচিত ছিলো। তাম্রলিপ্ত হলো প্রথম বন্দর যা থেকে তৎকালীন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি তাদের ব্যবসায়িক কার্যক্রমের সূচনা করেছিল। বন্দরটির খুব কাছেই মা বর্গভীমার মন্দির। আজও পৌষ সংক্রান্তিতে মায়ের ভোগ মানুষের মাঝে বিতরণ করা হয়। মন্দির চত্বরের ঠিক সামনে একটি ব্যানার রয়েছে, যেখানে লেখা আছে “কে কাঁদে ক্ষুধায়, জননী শুধায়, আয় তোরা সবে জুটিয়া, ভান্ডার দ্বার খুলেছে জননী, অন্ন যেতেছে লুটিয়া।” ভীমা মায়ের ভোগে আজও শোল মাছে দিতে হয়, মাছের টকের জন্যে। না হলে ভোগ অপুর্ণ থেকে যাবে।
এহেন তাম্রলিপ্ত বন্দর বা অধুনা তমলুকে আমাদের বাড়ি যেখানে ছোটোবেলায় তুই তোর বাবা মানে মন্টেমামা, আর মা আর জয়া মাইমা র সঙ্গে প্রায়ই যেতিস। তমলুক আমাদের রূপনারায়ণ নদের ধারে ছিলো, যেটা একেবারে মন্দির লাগোয়া ছিলো। রূপনারায়নের ধারে তমলুক হলেও আমাদের ছোটোবেলায় দেখেছি নদী পিছিয়ে গেছে। কিন্তু জাহাজ-বন্দরের টিনের টিকিটঘর তখনো ছিল। তোর নিশ্চয়ই মনে আছে তমলুকে আমাদের বাড়িটা ছিল আমাদের রামসাগর পুকুরের একটু দুরে আর তোর বাবার মামারবাড়ি মানে বুড়োদা দের বাড়িটা ছিল একেবারে পুকুরের ধারে। প্রাচীন বন্দর শহর বলে কিনা জানিনা আমাদের আমাদের তমলুক চিরকাল ই মফস্বল হিসেবে বিখ্যাত ছিলো। অনেক বছর আগেই কলকাতা চলে এলেও তমলুক আমাদের কাছে আজ ও নস্টালজিয়া। নিজেদের পরিবারের কথা।
পরিবার একটা বিশাল জায়গা বা পরিবেশ, যেখান থেকে পারিবারিক আচরণ, পরিবেশ, সংস্কৃতি, শিক্ষা এ সব সব তৈরী হয়। আম্রা নিজেদার একটু একটু করে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্যে নিজেদের গড়ে তুলি। সেটাকে কি কোনোও মতে বাদ দেওয়া যায়?? দাদু, দিদা, ঠাকুমা, বাবা, মা, জ্যেঠু, জ্যেঠিমা, কাকা, কাকিমা, ভাই, বোন এদের নিয়েই একটা গোটা পরিবার আর প্রত্যেকের কাছে এই পরিবারের গুরুত্ব হওয়া উচিত অপরিসীম।
আজকাল আমরা মোটামূটি সকলেই নিউক্লিয়ার ফ্যামিলিতে বাস কোরি। ক’জন আছে যারা সত্যিকার পরিবার আর সকলে্র কথা নিয়ে ভাবে? যোগাযোগ রাখে বা একে অন্যের অসুবিধায় তার পাশে এসে দাঁড়ায়? কেউ কি আমরা জানতে চাই?
এই ব্যস্ততার যুগে টাকা রোজগার করাটাই জরুরী। মানছি, ভবিষ্যতের খাওয়া, পরা, বাঁচার জন্যে সেটা অত্যন্ত জরুরী, তাই বলে কি এই অতীতকে আমরা ভুলতে পারি? অতীত ছিলো বলেই আমরা বর্তমানকে পেয়েছি আর একইভাবে বর্তমানের জন্যেই আমরা ভবিষ্যতের দিকে চলতে পারি। এরা যে একে অপরের পরিপূরক। কাউকেই বাদ দেওয়া যায় না।
স্মৃতি স্বততই সুখের। একাকীত্ব যখন আমদের পেয়ে বসে, তখন আমরা স্মৃতি হাতড়াই, কাছের প্রিয়জনের কথা ভাবি, এই নিয়েই পরিবার ও সংসার। তুই যখন বললি তোদের ভাইবোনেদের এই ব্লগে কিছু লেখার জন্যে। মনে ভীড় করে এলো অনেক কথা। অনেক হারিয়ে যাওয়া মানুষের কথা। যারা আজ থাকলে তোদের এই ব্লগ খোলার প্রাক্কালে তোদের আরো অনেক কথা, যা হয়তো আমার মনে নেই তোকে জানাতে পারতো। যা হয়তো তোর লেখার সময় কাজে লাগতো। কেন জানি না খুব নস্টালজিক হয়ে গেলাম তাই কিছু কথা লিখে পাঠালাম।
চিঠি – ১
মন্টে মামা মানে তোর বাবার কথা দিয়েই শুরু করবো। যার (এখন থেকে শুধু মামা লিখবো) ডাক নাম মন্টু ও নীলমনি। তোর দাদু আর ঠাম্মা মানে আমাদের জামাই বাবু (অশোক বোস) ও মেজদি আদর করে ডাকতো মন্টু বলে আর নীলমনি তা ছিলো অন্যদের জন্যে। মন্টু নামটা মন্টে হয়ে গেলো আমাদের আর এক ছোট জামাইবাবু অমিয়দার জন্যে। অমিয়দা ডাকতো অ্যাই মন্টে অ্যাই মন্টে, আর তার থেকে জন্ম নিলো তথাকথিত মন্টে মামা। মামা যে রকম বিনয়ী, নির্ভিক, নম্র; ঠিক ততোটাই কর্তব্যপরায়ণ ছিলো। অফিসে মানে সি.ই.এস.সি.-তে (তখন সি.ই.এস.সি. ছিল ব্রিটিশ যুক্তরাজ্যের একটি সংস্থা) মামার খুব কদর ছিলো। প্রত্যেকে মামাকে ভালোবাসতো সে সাবস্টেশনই এবং হোক আর ভিক্টোরিয়া হাউসই হোক। মামা সি.ই.এস.সি. নিউ কাশীপুর জেনারেটিং পাওয়ার স্টেশনের হেড ছিলো। সহকর্মীরা কাজের ব্যাপারে মামাকে যতোটা ভয় পেতো ঠিক ততোটাই শ্রদ্ধা করতো আর ভালোবাসতো। মামা চিফ ইঞ্জিনিয়ারের পজিশনে থেকে বেরিয়ে সকলের সমস্যা আর কথা শুনতো আর সাধ্য মতো তাদের সাহায্য করতো। এটা অনেকেই জানতো না। গুটি কয়েক লোক যেমন আমার বাবা (ন’দাদু) ও অমিয়দা জানতো। ভালো নাম মিঃ রথীন বোস, চিফ ইঞ্জিনিয়ার সি.ই.এস.সি.-র প্রত্যেকেই পছন্দ করতো। পরবর্তীকালে ১৯৮৬-তে আমি যখন সি.ই.এস.সি.-র সঙ্গে কাজে যুক্ত হলাম, তখন মিঃ এ. কে. রায়, চিফ ইঞ্জিনিয়ার ওয়ান (প্রোজেক্টস্) মামার খুব প্রশংসা করতেন।
এবারে আসি তার বাড়ির দিকের ভুমিকায়। প্রত্যেকে মামাকে ভালোবাসে এবং সেও সবার প্রতি যত্নবান ছিল। তখন তো এখনকার মতো নিউক্লিয়ার ট্রিটমেন্ট ছিলো না। মামা ইঞ্জিনিয়ার মানে সকলের, এমন কি পাড়া প্রতিবেশীদেরও গর্ব ছিলো। তোদের বাড়িতে আমার অবাধ যাতায়াত ছিলো। বাড়ির সকলে আমাকে খুব পছন্দ করতো, এমন কি তোর মা, আমাদের মাইমাও তার ব্যতিক্রম ছিলো না। মামা একদিন বললো যে, অঞ্জন তুই শ্যামল মিত্র্রর গান গা, “কেন তুমি ফিরে এলে, আমি অন্ধকারে খুঁজে পাইনি যারে, আলোয় তুমি পেলে”-টা গাইবি? আমিও মনের আনন্দে সেই গানটা শুনিয়ে ছিলাম। তোর দাদু, আমাদের মেজো জামাইবাবু বলতো, “হ্যাঁ রে, তুই হারমোনিয়াম, তবলা ছাড়া আর কিছু বাজনা জানিস না?” আমি বললাম যে, “একটা পুরনো মাউথ অরগ্যান আছে, সেটা দিয়ে কি হবে?” মামা বললো, “খুব হবে, তুই বাজা।” সেই প্রথম একটা দেশাত্ববোধক গান (ওঠো গো ভারত লক্ষ্মী) আর একটা হিন্দি সিনেমার (শোর) গান ‘এক প্যার কা নাগমা হ্যায়, মোজো কি আওয়াজ হ্যায়, জিন্দেগী আউর কুছ ভি নেহি, তেরি মেরি কাহানী হ্যায়’ বাজালাম। মামা দারুন খুশী হয়েছিলো।
আজ এ পর্যন্তই, পরে আবার লিখবো ও গান পাঠাবো। পছন্দ হলে, ব্লগে প্রকাশ করিস। ভালো থাকিস।
দারুণ কাকু দারুণ !! অনেক অজানা কথা জানতে পারলাম।